somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ভিয়েতনামের মেয়ে (গল্প)

০৯ ই জুলাই, ২০১৮ রাত ৯:২৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


শামচুল হক

নাইমুল যে ফ্লোরে কাজ করে সেই ফ্লোরেই পাশের স্যুইং মেশিনে কাজ করে ভিয়েত নামের একটি মেয়ে। মেয়েটির নাম মিস থিয়েন। ধর্মে খ্রীষ্টান। অবিবাহিতা। ভালো ইংরাজি বলতে পারে। বেতন নাইমুলের চেয়ে অনেক বেশি। খ্রীষ্টান ধর্মের মেয়ে হলেও বেশ শান্ত শিষ্ট। পাশাপাশি বসলেও নাইমুল খুব একটা কথা বলে না। অন্য ছেলেরা তার সাথে আড্ডা দিলেও নাইমুল ইসলামী ভাবাপন্ন হওয়ায় কিছুটা দূরুত্ব বজায় রেখে চলে।

মিস থিয়েন বিনা কারণে অফিস মিস করে না। কিন্তু হঠাৎ করেই কযেকদিন হলো ডিউটিতে অনুপস্থিত। পরপর সাতদিন না দেখে নাইমুল পাশের মেয়েকে জিজ্ঞেস করল, মিস থিয়েন আসে না কেন?
পাশের মেয়েটি বলল, থিয়েন অসুস্থ্য, গত সাতদিন হলো হাসপাতালে আছে।
হাসপাতালের কথা শুনে নাইমুল কিছুটা আশ্চার্য হয়ে গেল। বিস্ময় প্রকাশ করে বলল, হাসপাতালে! ওর কি খুব অসুখ? সাথে কে আছে?
থিয়েনের অসুস্থ্য হওয়ার কথা নাইমুল আগ্রহভরে জানতে চাওয়ায় মেয়েটি বলল, কেউ নেই, হাসপাতালে সে একা।

হাসপাতালে থিয়েন একা আছে শুনে নাইমুল মনে মনে ভাবলো-- অসুস্থ্য থিয়েনের সাথে দেখা করা উচিৎ। বিদেশে চাকরী করতে আসা বেশিরভাগ লোকেরই আত্মীয় স্বজন নেই। স্বজনহীন অবস্থায় থাকতে হয়। মেয়েটিও হয়তো একা একা অসহায় বোধ করছে। দেখা করে আর্থিক সহযোগীতা করতে না পারলেও মানসিক শান্তনা তো দিতে পারবো। মানসিক শান্তনা দিলেও অনেক সময় রুগীরা স্বস্তিবোধ করে।

নাইমুল মাদ্রাসায় লেখাপড়া করেছে। আলেম পাস করার পর আর্থিক অনটনের জন্য আর লেখাপড়া করতে পারে নাই। সংসারের অভাব দূর করার জন্য মালায়শিয়া এসেছে। মাদ্রাসায় পড়া নাইমুল মালায়শিয়ায় এসে অবাধ স্বাধীনতা ভোগ করলেও চরিত্রের দিক থেকে খুবই কঠোর। এখানে এসে অনেকেই অনেক কিছু করলেও নাইমুল চরিত্রহানী করার মত কোন কাজ এখন পর্যন্ত করে নাই। তবে ইসলামী মনোভাবাপন্ন নাইমুল পরোপকারে বেশ অগ্রনী ভূমিকা পালন করে থাকে। নিজের বিবেক থেকেই মেয়েটির সাথে দেখা করা উচিৎ বলে মনে করল। দেরি না করে সেই দিনই হাসপাতালের ওয়ার্ড নাম্বার, বেড নাম্বার জেনে নিয়ে দেখা করতে গেল।

নাইমুল যখন হাসপাতালে পৌঁছল তখনও সূর্য ডোবে নাই। সারিবদ্ধভাবে হাসপাতালের বেড সাজানো। অনেক বেডে রুগীর পাশে রুগীর আত্মীয় স্বজন বসে আছে। থিয়েনের পাশে কেউ নেই। ধবধবে সাদা বিছানায় থিয়েন চোখ বন্ধ করে আছে। খুবই অসুস্থ্য। বেডের কাছে গিয়ে “থিয়েন” নাম ধরে ডাক দিতেই চোখ মেলে তাকালো। নাইমুলকে দেখে থিয়েন আশ্চার্যই হলো। যাদেরকে সে আশা করেছিল তারা কেউ আসে নাই, যে এসেছে তাকে সে কখনই কল্পনা করে নাই।

নাইমুল থিয়েনের জন্য কিছু ফল নিয়ে এসেছে। ফল হাতে নাইমুলকে দাঁড়ানো দেখে থিয়েন আরো আশ্চার্য হয়ে যায়। এই সাত দিনে কেউ তাকে দেখতে আসে নাই। হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকতে থাকতে অস্থির হয়ে উঠেছে। আত্মীয়-স্বজনহীন বিদেশের মাটিতে খুব অসহায়বোধ করছে। এ অবস্থায় নাইমুলকে ফল হাতে দেখে অসুস্থ্য অবস্থায়ও বিস্মৃত হয়ে যায়। দাড়ি, টুপি পড়া নাইমুলকে এতদিন সে মুসলিম মৌলবাদী হিসাবে জানতো। তার ধারণা মুসলিম মৌলবাদীরা কট্টোরপন্থী লোক। এরা নিজের ধর্ম ছাড়া অন্য ধর্মের লোকদের ভালো চোখে দেখে না, এমন ধারনাই সে ছোটকাল থেকে পেয়ে এসেছে। তার দেশে খ্রীষ্টান ধর্মের লোক বেশি, মুসলিমের সংখ্য খুবই কম, তারপরেও স্কুল, কলেজ জীবনে যে দুইচার জন মুসলিম ছেলে মেয়ে ছিল তাদের সাথে তার তেমন একটা সখ্যতা ছিল না। যে কারণে মুসলিম সম্পর্কে তার জানাশোনাও কম।

খ্রীষ্টান ছেলে-মেয়েরাও তার সাথে কাজ করে, তারা কেউ আসে নাই, অথচ নাইমুল মুসলিম হয়েও তাকে দেখতে এসেছে। তার এই মানবতাবোধ দেখে থিয়েন অভিভুত হয়ে যায়।এ কয়দিন অসুস্থ্য অবস্থায় একা একা শুধু ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেছে, হে প্রভু-- আমার চরম বিপদে আমাকে সাহায্যের জন্য কাউকে পাঠিয়ে দাও। তার প্রার্থনা যেন ঈশ্বর শুনেছে, নাইমুল অন্য ধর্মের লোক হলেও এ যেন তারই প্রমাণ।

থিয়েন ভিয়েতনামী ভাষার পাশাপাশি ইংরাজি ভালো বলতে পারলেও মালায় ভাষায় তেমন একটা দক্ষ নয়। নাইমুল ইংরাজি জানে না তবে কিছুটা মালায় ভাষা শিখেছে। মালায় ভাষাতেই নাইমুল কুশলাদি জিজ্ঞেস করছে, থিয়েন যতটা পারে কাতর কন্ঠে ভাঙা ভাঙা মালয় ভাষায় জবাব দেয়ার চেষ্টা করছে। মালায় ভাষায় দক্ষ না হলেও দুইজনের মধ্যে কথোপোকথনে খুব একটা সমস্যা হচ্ছে না। যতটাই পারে উভয়েই উভয়ের মনের কথা প্রকাশ করতে পারতেছে।

কাথোপোকথনের একপর্যায়ে থিয়েন শোয়া থেকে উঠার চেষ্টা করে কিন্তু উঠতে পারে না। শরীর এমনই দুর্বল যে মাথা সোজা করে বসতে গিয়ে টলকে পরে যায়। নাইমুল তার এই অবস্থা দেখে মাথা ধরে উঠিয়ে বসানোর জন্য হাত বাড়িয়েও হাত গুটিয়ে নেয়। মনে মনে ভাবে বিবাহযোগ্য একজন বেগানা নারীর গায়ে হাত দেয়া ইসলামী বিধান অনুযায়ী বোধ হয় ঠিক হবে না, হোক না অসুস্থ্য, তারপরেও পর নারী তো? হাত এগিয়ে নিয়ে আবার গুটিয়ে নেয়ায় থিয়েন তার দিকে অসহায়ভাবে তাকিয়ে থাকে, তার এই অসহায়ভাবে তাকানো দেখে নাইমুল লজ্জায় পড়ে যায় । মনে মনে চিন্তা করে অসুস্থ্য থিয়েনের দিকে হাত বাড়িয়ে আবার হাত গুটিয়ে নেয়াটা বোধ হয় উচিৎ হলো না। এই মুহুর্তে অসুস্থ্য থিয়েনকে ধরে উঠানো তার উচিৎ ছিল। থিয়েন আবার উঠার চেষ্টা করতেই নাইমুল হাত বাড়িয়ে দেয় । মাথার পিছনে হাত দিয়ে টেনে উঠিয়ে বসিয়ে দেয়। কিন্তু থিয়েন বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারে না। মাথা ঘোরায় অল্প কিছুক্ষণ বসে থেকেই আবার শুয়ে পড়ে।

নাইমুল প্রায় এক ঘন্টার মত থিয়েনের পাশে বসে রইল। ঘনিষ্ট না হওয়া সত্বেও টুকটাক কিছু কথা হলো। কথার মধ্যে অন্য কিছু নয়, তার অসুস্থ্য হওয়ার পরে কিভাবে হাসপাতালে এলো এবং কেমন চিকিৎসা চলছে এসব বিষয়ে। একসময় নাইমুল চলে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালে থিয়েন নাইমুলের মুখের দিকে আবার অসহায়ের মত তাকিয়ে থাকে। বিদায় চাইতেই কেঁদে দেয়। তার কান্না দেখে নাইমুল মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। কান্নারত অসুস্থ্য থিয়েনকে সে কিভাবে শান্তনা দিয়ে বিদায় নিবে সেটা সে এই মুহুর্তে বুছতে পারছে না। তারপরেও মাথায় হাত রেখে শান্তনা দিয়ে বলল, ভয় পেয়ো না থিয়েন, তোমার অসুস্থ্য অবস্থায় আর কেউ পাশে না থাকলেও আমিই তোমার পাশে আছি, সাধ্যমত সহযোগীতা করে যাবো, আগামী কাল আবার আসবো।

সাধ্যমত সহযোগীতা করে যাবো, আগামী কাল আবার আসবো -- নাইমুলের এমন কথায় থিয়েন যত না খুশি হলো তার চেয়ে বেশি খুশি হলো-- আগামী কাল আবার আসবো-- এমন প্রতিশ্রুতি দেয়ায়।

পরদিন বিকেল থেকেই থিয়েন নাইমুলের আসার অপেক্ষায় বসে আছে। নাইমুল তার কথার বরখেলাপ করে নাই। অফিস শেষে ঠিক ছয়টায় এসেই হাজির হলো। নাইমুলকে দেখেই থিয়েনের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। যেন মরা দেহে প্রাণ ফিরে পেয়েছে। বিদেশের মাটিতে অসুস্থ্য অবস্থায় নাইমুলের উপস্থিতি যেন তার বেঁচে থাকার ভরসা। থিয়েন টাইফয়েড জ্বরে ভুগছে। নিজের কেউ না হওয়া সত্বেও অসুস্থ্য অবস্থায় নাইমুলের উপস্থিতিটা তার কাছে বিধাতার আশীর্বাদ মনে হচ্ছে। বিপদগ্রস্থ মানুষ যেমন বিপদের সময় সাহয্যকারীকে আপন মনে করে, তেমনি এই মুহুর্তে নাইমুলকেই তার খুব আপন মনে হচ্ছে, স্বজনের অভাবটা যেন নাইমুলই পূরণ করছে।

নাইমুল কাছে আসলে তার মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। মনে মনে ভাবে এ যেন ঈশ্বরেরই সহযোগীতা। যদিও সে খ্রীষ্টান ধর্মের আর নাইমুল মুসলিম, তারপরও ধর্মের দেয়াল ঈশ্বর নিজেই তুলে দিয়ে দেয়াল বিহীন সৃষ্টির সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। ঈশ্বরের এমন রহস্যময় সহযোগীতার জন্য চোখ দু’টো জলে ভিজে যায়। চোখের কোনে জল জমতেই নাইমুল বলে উঠে, থিয়েন তুমি কাঁদছো কেন? এখন তুমি তো একা নও, আমি তোমার পাশে আছি।

এতক্ষণ থিয়েন অন্য জগতে চলে গিয়েছিল, নাইমুলের কথা শুনে সম্বিৎ ফিরে পায়। টাওয়েল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে উঠে বসার চেষ্টা করে কিন্তু উঠতে পারল না। নাইমুল গতকালের মত থিয়েনের মাথার পিছনে হাত দিয়ে আজকেও উঠিয়ে বসিয়ে দিল। গতকাল নাইমুল সঙ্কোচবোধ করলেও আজ আর কোন সঙ্কোচবোধ করল না। থিয়নও নাইমুলের প্রতি অনেকটা সহজ হয়ে এসেছে। নাইমুলকে বেডে বসতে বলে তার কাঁধে মাথা রেখে অনেকক্ষণ বসে রইল। নার্সরা নাইমুলের সহযোগীতা দেখে এগিয়ে আসল। তার সাথে কোন সম্পর্ক আছে কিনা জিজ্ঞেস করল। নার্সদের কথা শুনে নাইমুল মৃদু হাসি দিয়ে বলল, কোন সম্পর্ক নেই, শুধু অফিস কলিগ হিসাবে তাকে দেখতে এসেছি।
শুধু অফিস কলিগ হিসাবে দেখতে এসেছে শুনে নার্সরা কিছুটা আশ্চার্যই হয়ে গেল। তার মানবতাবোধের জন্য অনেকেই ধন্যবাদ দিল।

নাইমুল দুইদিন হাসপাতালে এসে থিয়েনকে উঠিয়ে বসিয়ে কথা বলাতে থিয়েন মানসিকভাবে কিছুটা চাঙা হয়ে উঠল। তার এই মানসিক পরিবর্তনের সাথে সাথে অসুখও কমতে লাগল। থিয়েনের সুস্থ্য হওয়ার পরিবর্তন দেখে ডাক্তার, নার্সরাও নাইমুলকে প্রতিদিন আসতে অনুরোধ করল, বিশেষ করে শ্রীলঙ্কার নার্সটিই নাইমুলকে আসার জন্য বেশি উৎসাহ দেখালো। নার্সদের অনুরোধে নাইমুল প্রত্যেক দিনই একবার করে আসে। হাসপাতালের উন্নত চিকিৎসা আর নাইমুলের যাতায়াতে কয়েক দিনেই থিয়েন পুরো সুস্থ্য হয়ে উঠে।

প্রায় তেরোদিন হাসপাতালে থাকার পর ডাক্তার থিয়েনকে রিলিজ দেয়। রিলিজ হওয়ার সময় থিয়েন নাইমুলকে আসার জন্য অনুরোধ করল। থিয়েনের অনুরোধ নাইমুল উপেক্ষ করে নাই। অফিস থেকে ছুটি নিয়ে রিলিজ হওয়ার ঠিক পূর্ব মুহুর্তেই এসে হাজির হলো। নিজেই দৌড়াদৌড়ি করে হাসপাতালের ফর্মালিটিজের সমস্ত কাগজপত্র পুরণ করে বেলা বারোটার সময় বের হলো। একটি মাইক্রোবাস ভাড়া করে থিয়েনকে সাথে নিয়ে হোষ্টেলে পৌছে দিলো। নাইমুলের এমন সহযোগীতায় থিয়েন মুগ্ধ। মনে মনে চিন্তা করে, বিদেশের মাটিতে আত্মীয়-স্বজন না হয়েও নাইমুল তাকে অসুস্থ্য অবস্থায় যে সহযোগীতা করেছে, তার তুলনা হয় না, নিজের ভাইয়ের কাছেও এমন সহয়োগীতা পেত কিনা সন্দেহ। তার এ অবদান কোনদিনই অস্বীকার করা যাবে না, যদি জীবনে কোন সুযোগ আসে তাহলে যে কোন মূ্ল্যেই হোক নাইমুলের এ প্রতিদান দেয়ার চেষ্টা করবো।

থিয়েনকে বাসায় পৌছে দেয়ার পর থেকে প্রায় তিন দিন নাইমুল আর তার সাথে দেখা করতে আসে নাই। না আসার কারণও আছে, থিয়েন মেয়েদের হোষ্টেলে থাকে, হাসপাতালে তার সাথে দেখা করার সুযোগ থাকলেও হোষ্টেলে অনেক কড়াকড়ি থাকায় দেখা করার সুযোগ কম।

নাইমুল দেখা না করলেও তিনদিনের দিন থিয়েন নিজেই হেঁটে হেঁটে অফিসে এলো। হোষ্টেল থেকে অফিস খুব দূরে নয়। হোষ্টেল থেকে অফিসে হেঁটে আসলেও শারীরিকভাবে তখনও সে দুর্বল। দুর্বল শরীরে থিয়েনকে দেখে নাইমুল কিছুটা রেগেই গেল, এই অবস্থায় তার অফিসে আসা উচিৎ হয় নাই বলে তিরষ্কার করল। কিন্তু নাইমুল তিরস্কার করলেও থিয়েন কিছু মনে করল না। সে নাইমুলের রেগে যাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তার তাকানো দেখে নাইমুল জিজ্ঞেস করল, এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?

উত্তরে থিয়েন বলল, আমার একা একা বাসায় ভালো লাগে না, তাই তোমাকে দেখার জন্য এসেছি।
-- আমাকে দেখার কি আছে?
-- জানি না, তোমাকে দেখার জন্য মনটা ছটফট করছিল, তাই এসেছি।
-- মন চাইলেই সব কিছু করা ঠিক নয়। তোমার আসা উচিৎ হয় নাই। বাসায় আরো রেষ্ট নেয়া উচিৎ।
-- কত রেষ্ট নিব? এ কয়দিন বদ্ধঘরে থেকে থেকে হাঁপিয়ে উঠেছি। তুমি যদি অফিস শেষে সময় দাও আমি তোমার সাথে একটু ঘুরে বেড়াবো।

থিয়েন নাইমুলের সাথে ঘুরে বেড়াতে চাইলেও নাইমুল কিছু বলল না। মনে মনে চিন্তা করল, হাসপাতালে তার সাথে দেখা করেছে তখন অসুস্থ্য রুগীর সাথে দেখা করার একটা অজুহাত ছিল, কিন্তু সুস্থ্য হওয়ার পর তাকে সাথে নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ানোটা মোটেই উচিৎ হবে না। নামায, কোরান পড়া নামাজি লোক হয়ে যদি অন্য ধর্মের অবিবাহিতা মেয়ে নিয়ে ঘুরে বেড়াই তখন যারা ভালো জানে তারাও চরিত্রহীন ভাববে। নিজের চরিত্রের কথা  চিন্তা করেই নাইমুল চুপ করে রইল।

থিয়েন আর নাইমুল যখন কথা বলছিল তখন বাঙালি রফিক অল্প দূরেই দাঁড়ানো ছিল। তাদের সব কথাই তার কানে এলো। থিয়েন চলে যাওয়ার পর রফিক নাইমুলকে কিছুটা খোঁচা মেরেই বলল, কিরে নাইমুল, তোকে আমরা খুব ভালো মনে করেছিলাম, মুখে দাড়ি, মাথায় টুপি, কোরান পড়িস, পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়িস সেই মানুষ যদি খ্রীষ্টান মেয়ের সাথে টাংকি মারিস তাহলে আর ঈমানদার বলবো কাকে রে? একদিকে মোল্লাগীরিও করিস আবার মেয়েদের সাথে ফষ্টিনষ্টিও করিস, এটা কেমন মোল্লাগীরি রে? বিদেশের মাটিতে চরিত্র খারাপ হলে এত খারাপ হতে হয়?

ইসলামী লেবাসের খোটা দিয়ে কথা বলায় নাইমুল খুবই লজ্জা পেল। মনে মনে যা ভেবেছিল তাই হলো। ঘুরে বেড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে তাতেই অপমানিত হচ্ছে আর যদি ওকে নিয়ে ঘুরে বেড়ায় তাহলে ঢিঁ ঢিঁ পড়ে যাবে। নিজের মান সম্মানের কথা ভেবেই মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল, থিয়েনের সাথে আর কোনো যোগাযোগই রাখবে না। যার সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক নাই, ধর্মের মিল নাই তার সাথে বন্ধুত্ব করে কি লাভ? বিনা কারণে চরিত্র নিয়ে বদনাম রটে যাবে। অতএব দূরে থাকাই ভালো।

থিয়েন অফিস ছুটি পর্যন্ত বাইরে অপেক্ষা করলেও নাইমুল লোক লজ্জার ভয়েই আর দেখা করল না।
অনেক অপেক্ষার পর থিয়েন মনের কষ্ট নিয়ে বাসায় ফিরে গেল। তিনদিন পরে থিয়েন কাজে যোগ দিল। তখনও সে পুরোপুরি সুস্থ্য নয়। একা একা হোষ্টেলে সময় কাটতে চায় না, কাজে থাকলে আর কিছু না হোক সবার সাথে কথা বলতে পারবে, তাতে একাকিত্ব ভাবটা থাকবে না। এমন চিন্তাভাবনা থেকেই সে কাজে জয়েন করেছে।

কাজে জয়েন করে থিয়েন মনে করেছিল নাইমুলের সাথে তার ঘনিষ্টতা আরো বাড়বে। যে লোকটি হাসপাতালে এত সহযোগীতা করেছে সেই লোক অফিসে নিশ্চয় আরো বেশি সহযোগীতা করবে। সেই মানসিকতায় থিয়েন ঘনিষ্ট হওয়ার চেষ্টা করলেও নাইমুল ঘনিষ্ঠ না হয়ে আগের মতই দূরুত্ব বজায় রেখে চলতে লাগল। থিয়েন প্রত্যেক দিনই কিছু না কিছু দুপুরের বাড়তি খাবার নিয়ে আসে কিন্তু নাইমুলকে দিলেও খায় না। এতে থিয়েন মানসিকভাবে খুব কষ্টবোধ করতে থাকে, কিন্তু ইসলামী নিয়ম নীতি পালনকারী নাইমুলকে জোর করে কিছু বলতেও পারে না।

এক সপ্তাহ পরে নাইমুল বাড়ি যাওয়ার জন্য ছুটি নেয়। ছুটি অনুযায়ী আগামী সপ্তাহেই বাড়ি যাবে। প্রায় দুই বছর হলো বাড়ি থেকে এসেছে। এই দুই বছরে একবারও বাড়ি যেতে পারে নাই। জীবনের প্রথম বিদেশে আসা, বাড়ি যাওয়ার জন্য মনটা ছটফট করছে। বাড়ি যাওয়ার কথাটি নাইমুল না বললেও থিয়েন অন্যের কাছ থেকে শুনতে পায়। নাইমুলের বাড়ি যাওয়ার কথা শুনেই থিয়েন মনমরা হয়ে যায়। নাইমুলের সাথে কথা বলতে চাইলেও নাইমুল কথা বলার সুযোগ দেয় না। অনেক চেষ্টার পর একদিন সুযোগ পেয়ে থিয়েন নাইমুলকে জিজ্ঞেস করল, নাইমুল, তুমি কি দেশের বাড়ি যাবে?
নাইমুল ঘাড় কাতা করে শুধু সায় দেয়, হুঁ।
(চলবে)
ছবি ঃ গুগল

দ্বিতীয় পর্ব পড়ার জন্য নিচে ক্লিক করুন
ভিয়েতনামের মেয়ে (শেষ পর্ব)
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে ডিসেম্বর, ২০১৮ রাত ১২:৩২
৮টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:২৮




আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না। আমাদের দেশে মানুষ জন্ম নেয়ার সাথেই একটি গাছ লাগানো উচিৎ । আর... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানবতার কাজে বিশ্বাসে বড় ধাক্কা মিল্টন সমাদ্দার

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:১৭


মানুষ মানুষের জন্যে, যুগে যুগে মানুষ মাজুর হয়েছে, মানুষই পাশে দাঁড়িয়েছে। অনেকে কাজের ব্যস্ততায় এবং নিজের সময়ের সীমাবদ্ধতায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারে না। তখন তারা সাহায্যের হাত বাড়ান আর্থিক ভাবে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। আমের খাট্টা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৪



তাতানো গরমে কাল দুপুরে কাচা আমের খাট্টা দেখে ব্যাপারটা স্বর্গীয় মনে হল । আহা কি স্বাদ তার । অন্যান্য জিনিসের মত কাচা আমের দাম বাড়াতে ভুল করেনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডাক্তার ডেথঃ হ্যারল্ড শিপম্যান

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০৪



উপরওয়ালার পরে আমরা আমাদের জীবনের ডাক্তারদের উপর ভরশা করি । যারা অবিশ্বাসী তারা তো এক নম্বরেই ডাক্তারের ভরশা করে । এটা ছাড়া অবশ্য আমাদের আর কোন উপায়ই থাকে না... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ইতং বিতং কিচ্ছার একটা দিন!!!

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:০৩



এলার্ম এর যন্ত্রণায় প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গে আমার। পুরাপুরি সজাগ হওয়ার আগেই আমার প্রথম কাজ হয় মোবাইলের এলার্ম বন্ধ করা, আর স্ক্রীণে এক ঝলক ব্লগের চেহারা দেখা। পরে কিছু মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×