গত ৫ তারিখে মহাজোট সরকারের ২ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশ্যে যে বক্তব্য প্রদান করেন তাতে তিনি জোট সরকারের ব্যাপক সমালোচনা করেন এবং নিজেদের বিভিন্ন ব্যাপারে সাফল্যের কথা তুলে ধরেন। বিভিন্ন সুশিল এবং বিশিষ্টজনরা ‘দিন বদলের সনদ’ এবং ‘ডিজিটাল বাংলাদেশের’ স্বপ্নদ্রষ্টা প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যকে গতানুগতিক বলেই চিহ্নিত করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের জবাব বিরোধী দলীয় নেত্রী দিবেন এমনটি অনেক আগেই ঠিক হয়েছিল আর তাই গত ৫ তারিখে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পরপরি ঠিক করা হয় ৯ তারিখে বিরোধী দলীয় নেত্রী তার জবাব দিবেন। সেই হিসেবে গতকাল তিনি প্রায় ৫০ মিনিট ব্যাপী বক্তব্য তুলে ধরেন। বিভিন্ন সংবাদ পত্র থেকে জানা যায়, শুধু প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের জবাব হলেও বিরোধি দলের নেত্রীর এই বক্তব্যে সমসাম্যিক অনেক ইস্যু ঊঠে আসবে বলে ধরে নেওয়া হয়েছিল। সংবাদপত্রের খবর থেকে এটাও জানা যায় যে বিভিন্ন টিভি বেসরকারী টিভি চ্যানেল বিরোধী দলের নেত্রীর এই বক্তব্য সরাসরি প্রচার করবে। আজকের কয়েকটি পত্রিকার (আমার দেশ, শীর্ষনিউজ) খবর থেকে জানা যায় যে টিভি চ্যানেলগুলোর পূর্ন প্রস্তুতি থাকার পরও অজ্ঞাত কারনে এই বক্তব্য সরাসরি দেখানো হয়নি। এমনকি যখন এই বক্তব্য চলছিল তখন উপস্থিত দলীয় নেতা-কর্মীদের ধারনা ছিল যে বক্তব্যটি সরাসরি দেখানো হচ্ছে। কি কারনে শেষ মূহুর্তে সরাসরি দেখানো হলো না বিরোধী দলের নেত্রীর বক্তব্য তা হয়তো আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক হানিফ সাহেবের কথায় বোঝা যায় -“বিরোধী দলের নেত্রী জাতির উদ্দেশ্যে বক্তব্য দিতে পারেন না”।
যাইহোক, মাননীয় বিরোধী দলীয় নেত্রী, প্রধানমন্ত্রী মহোদয়ের বক্তব্যের জবাব দেবার আপনার পদক্ষেপ অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার কিন্ত আপনি বক্তব্যে অযথা বাক্য ব্যয় বেশি করেছেন বলে আমার মনে হয়েছে। আপনি প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে যে মিথ্যা অভিযোগগুলো পেয়েছেন সেগুলোর জবাব ভালোভাবেই দিয়েছেন এই ব্যাপারে সন্দেহ নাই। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের মত আপনার বক্তব্যটিও গৎ বাধাই হয়ে গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক ডঃ আসিফ নজরুলও এই কথাই বলেছেন মানবজমিন পত্রিকায়। অতিরিক্ত বিশেষনের ব্যবহার আপনার বক্তব্য অপ্রয়োজনীয়ভাবে লম্বা করেছে। যেমন, একটি উদাহরন দেইঃ আপনার বক্তব্যের দ্বিতীয় পাতায় শেষ থেকে তিন লাইন উপরে একটা বাক্যে আপনি বলেছেন “...তাদের উল্লাস দেখে শোষিত, বঞ্চিত, উৎপীরিত মানুষ হয়েছে আরো আতঙ্কিত”। এই বিশেষন গুলোর ব্যবহার পাঠকদের ভিতরে এক ধরনের বিরক্তির সৃষ্টি করে বলেই আমার ধারনা। আপনি তথ্য দিন, তথ্যের সূত্র দিন, বস্তুনিষ্ট ভাবেই পুরো বক্তব্য দিন। জনগন নিজের মনের মত বিশেষন বসিয়ে নিবে। মাননীয় নেত্রী, আপনার বিরোধী পক্ষ থেকে আলাদা হতে হলে আপনাকে অবশ্যি তার থেকে উন্নত মানের বক্তব্য দিতে হবে। আর বিশ্বাস করুন, সাধারন জনগন আর ‘কামড় দেয়া’ ধরনের আক্রমনাত্মক বক্তব্য পছন্দ করেনা। একটা কথা দয়া করে মনে রাখবেন- যারা আপনার সমর্থক তারা আপনার যে কোন কথাই পছন্দ করবে; যারা আপনার সমর্থক না তাদের আপনি কোন তথ্য দিয়েই আপনার দিকে নিতে পারবেন না; কিন্তু এদের মাঝামাঝি যে শ্রেনী আছে তারা কিন্তু বিচার বিশ্লেষন করেই তাদের রায় দেয়। আর এদেরকেই মূলত আপনার টার্গেট করা উচিত।
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে কোন আত্মসমালোচনা ছিলোনা, আপনারও নাই। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে নিজেদের উন্নয়নের ফিরিস্তি এবং বিরোধি দলের নিন্দা করেছেন, আপনিও কিন্তু তাই করলেন। প্রধানমন্ত্রী এক রাশ নতুন স্বপন দেখিয়ে গেলেন যা সব প্রধানমন্ত্রীই করেন কিন্তু আপনি কিন্তু গঠনমূলক ভাবে এই স্বপ্নগুলোর অসারতা দেখাতে পারলেন না। অপ্রয়োজনীয় বাক্য না ব্যবহার করে আরো কিছু ব্যাপার খোলাশা করে বলতে পারতেন এবং সরকারের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিতে পারতেন, যেমনঃ যুদ্ধাপরাধী ইস্যু নিয়ে আওয়ামী লীগের নোংরা রাজনীতির ধরন, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, রাজনৈতিক বিবেচনায় বিভিন্ন মামলা বাতিলের সুপারিশ ইত্যাদি। তারপরও আমি আপনাকে ধন্যবাদ দিতে চাই- নিজের ব্যক্তিগত যে ক্ষতি এবং কষ্ট গুলো (শহীদ মইনুল রোডের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ) এই সরকারের কারনে আপনি ভোগ করেছেন তা বক্তব্যে নিয়ে আসেন নি। যদিও আপনার বক্তব্য মূলত ছিলো প্রধানমন্ত্রির অভিযোগের জবাব দেওয়া, অনন্য করার জন্যে আমার মতে আপনার বক্তব্যের ৩০% থাকা উচিত ছিলো মিথ্যা অভিযোগগুলোর জবাব, ৪০% থাকা উচিত ছিলো বিভিন্ন ইস্যুতে সরকারের কার্যক্রমের তথ্যবহুল এবং গঠনমূলক সমালোচনা এবং যে বিষয়গুলোতে সরকার উদাসীন, ১৫% আপনাদের কার্যক্রম, পরিকল্পনা এবং বাঁধা, ১০% আত্ম-সমালোচনা, ৫% সরকারের প্রসংসা করা (শুধু এইটুকুই আপনাকে আপনার প্রতিপক্ষ থেকে মহান করার জন্যে যথেষ্ট)। যুদ্ধাপরাধী ইস্যু নিয়ে আপনার অবস্থান পরিস্কার করা এবং আওয়ামী লীগের কু-রাজনীতি তুলে ধরার সুযোগ ছিলো। দূর্নীতি নিয়ে জোট সরকারের বিরুদ্ধে একটি চলমান অভিযোগ রয়েছে সেই ব্যাপারে আপনি কিছু বলতে পারতেন। সাংস্কৃতিক আগ্রাসনটা প্রকট হিসেবে দেখা দিচ্ছে- সেই ব্যাপারেও আপনার কাছে থেকে দিক নির্দেশনামূলক বক্তব্য আশা করেছিলাম। প্রধানমন্ত্রী আপনাদের তুলনা করতে বলেছেন প্রথম ২ বছরের সাথে, আপনি প্রশ্ন ছুড়ে দিতেন প্রধানমন্ত্রীর দিকে-তারা দিন বদলের সনদের কোনটার কতটুকু এখন পর্যন্ত বাস্তবায়ন করেছেন।
মাননীয় নেত্রী, ১৯৯০ সালের দিকে আপোষহীন নেত্রী হিসেবে যে সংখ্যাগরিষ্ট জনগোষ্ঠীর কাছে আপনি একজন আদর্শ হয়ে ঊঠেছিলেন, এই সংখ্যাগরিষ্টতা এখন সময়ের পরিবর্তনে ধারন করে আধুনিক চিন্তা চেতনা এবং অবাধ তথ্য প্রযুক্তির ধারনকারী অপেক্ষাকৃত তরুন জনগোষ্ঠী। আমার বিনীত অনুরোধ থাকবে, আপনি এদের বোঝার চেষ্টা করবেন। ১৯৯১ সালের রাজনীতি এবং কথামালার ধারায় এই জনগোষ্টী বিরক্ত আর তাই রাজনীতিতে বাড়ছে নিরাশক্তি। কিন্তু জাতীয়তাবাদি রাজনীতির অন্যতম ধারক হিসেবে, আওয়ামী পলায়নপর রাজনীতির বিপরীতে আপনাকেই তুলে ধরে ধরতে হবে যে এই দেশের জন্যে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদি রাজনীতি কতটা গুরুত্বপূর্ন। শহীদ জিয়াউর রহমানকে যতই কালিমা দেবার চেষ্টা করুক না কেন, উনি এখনো বাংলাদেশের একজন সফল রাজনীতিবিদ হিসেবে রোলমডেল। উনি কখনো পলায়নপর ছিলেন না। উনি সব কিছু সাহসের সাথে মোকাবেলা করেছেন। বিরোধি মতের সাথে সরাসরি কথা বলেছেন, কথা এবং কাজ করেছেন লজিকালি সবসময়। তাই আপনার প্রতিও অনুরোধ ব্লগ দেখুন, ফেসবুক, অনলাইন পত্রিকার খবরগুলোর নিচে কমেন্টগুলো পড়ুন এবং এদের পালস বোঝার চেষ্টা করুন প্লীজ। আপনি নিজে না পারলেও বিশ্বস্ত কাউকে নিয়োগ করুন যে আপনার হয়ে এই কাজ গুলো করবে। প্রতিক্রিয়াশিল জনগোষ্ঠীদের যৌক্তিক ব্যাপারগুলোকে আপনি ভালোভাবে এড্রেস করুন, আমার বিশ্বাস আপনার জনপ্রিয়তা আরো বৃদ্ধি পাবে।