পশ্চাৎদেশে সার্বক্ষণিক একটা ব্যথা নিয়ে সৃজনশীল চিন্তা করাটা সম্ভব না; অথচ বিভিন্নমুখী সৃজনশীল চিন্তাগুলো দৃশ্যমান করাটা মাহফুজের পেশাগত দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে।
সমস্যাটা শুরু হয়েছে সপ্তাহখানেক আগে ‘ভেরিকোসেলেকটমি’ নামের আপাত নিরীহ এক ল্যাপারস্কোপিক সার্জারির পর ডাক্তার যখন বারো ঘন্টার ব্যবধানে দিনে দুটি করে ইনজেকশনের দাওয়া দিলো।
যেহেতু ইনজেকশনগুলো দিতে হবে মাংশপেশিতে, সেহেতু পশ্চাতদেশ ছাড়া গতি কি! অগত্যা সকাল-সন্ধ্যা দু’বেলা সূঁচের আঘাতে প্রাণপাত করতে হচ্ছে। চোখের সামনেই মেল নার্স যখন কাচের জার থেকে স্বচ্ছ ঔষধটুকু সিরিঞ্জে টেনে নিতে থাকে, তখন খুব গাইতে ইচ্ছে হয়- কাঁটার আঘাত দাওগো যার তার, সূঁচের (ফুলের) আঘাত সয়না- তোমার দিল কি দয়া হয় না...
এরও আগে স্ট্রেচারে শুইয়ে অপারেশন থিয়েটারের দিকে নিয়ে যাওয়ার সময় একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিলো মাহফুজের। দৃষ্টিসীমায় থাকা দু’জন অ্যাটেনডেন্টের মুখের পেছনে ছাদগুলো সড়সড় করে উল্টো দিকে চলে যাচ্ছে।
হাসপাতালে আসার আগে লুবনা বলে দিয়েছিলো যে ‘একদম ভয় পাবা না, ল্যাপারস্কোপি কোনো ব্যাপারই না, আরিবা হওয়ার সময় য্যামনে আমার পেট কাটছিলো.....’। কথা এখানেই থামিয়ে হাতের ইশারায় বাকিটুকু বোঝাতে চাইলো লুবনা।
তবুও মাহফুজ ভয় পাচ্ছিলো। ওর পিঠের নিচের দিকে মেরুদণ্ড বরাবর যায়গাটা শিরশির করছিলো। প্রায় বারো বছর আগে একটা সার্জারি করার সময়ে বিশাল এক সিরিঞ্জ দিয়ে ডাক্তার ওই যায়গাটাতে লোকাল অ্যানেস্থেশিয়া পুশ করেছিলো।
এবার ওরকম কিছু হলো না। ওটি’তে ঢোকানোর পরপরই জাহেদের বাঁ হাতে ক্যানোলা বসিয়ে স্যালাইন জাতীয় তরল জুড়ে দেওয়া হলো। ডাক্তার ওই তরলে সিরিঞ্জ দিয়ে কিছু একটা মিশিয়ে দেওয়ার সাথে সাথেই মাহফুজের চোখে রাজ্যের ঘুম এসে সব কিছু ঝাঁপসা করে দিলো। এরপর আর কিছুই মনে নেই মাহফুজের।
তার ঠিক কতক্ষণ পর ওর জ্ঞান ফিরেছিলো কোনো আন্দাজ নেই, তবে মাহফুজের মনে পড়ে যে খুব সামান্য চেতনার মধ্যে ও প্রথম দেখেছিলো ইসহাকের মুখ, কিছু একটা বলছে। লুবনা প্রেগন্যান্সির আর্লি স্টেজে থাকায় হাসপাতালে আসতে পারেনি, ডাক্তার মুভমেন্টে রেস্ট্রিকশান দিয়ে দিয়েছে। কিন্তু অফিস থেকে ছুটি নিয়ে পুরো দুইদিনই হাসপাতালে ছিলো ইসহাক আর ওবায়েদ; মাহফুজের ক্যাম্পাসের দুই বন্ধু।
এরপর আবারও ঘুম-জাগরণ, ঘুম-জাগরণ করতে করতে যখন পূর্ণমাত্রায় জ্ঞান ফিরে আসলো, মাহফুজ তখন পোস্ট অপারেটিভ রিকভারি ইউনিটে একটা বেডে শুয়ে আছে। প্রচণ্ড পানি পিপাসা লাগায় একজন নার্সকে পানির কথা বলতে গিয়ে মাহফুজ খেয়াল করলো যে ওর মুখে ব্রিদিং মাস্ক আটকানো এবং গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বের হচ্ছে না। অসহায় চোখে মাহফুজ দ্রুত পায়ে এদিক ওদিক যাওয়া নার্সদের দিকে তাকিয়ে থাকলো।
মাহফুজের বা হাতে তখনও স্যালাইনের মত তরল ঔষধ চলমান। অন্য হাত দিয়ে পেট স্পর্শ করে ওর সার্জারির ধরনটা বুঝতে চেষ্টা করলো। না, লুবনা ঠিকই বলেছিলো, ল্যাপারস্কোপিক সার্জারি খুব কঠিন কিছু না। নিজের পেটে বড় ধরনের কোন কাটাকাটির চিহ্ন পেলো না, কেবল তিন পাশে ব্যান্ড এইডের চেয়ে একটু বড় ব্যান্ডেজের মত কিছু একটা লাগানো।
কিন্তু মাহফুজের এই সুখভাবনা খুব বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। গায়ের ওপর দেওয়া কাপড়টা পায়ের কাছে একটু সরে গিয়েছিলো, আরেক পা দিয়ে ওটা ঠিক করার জন্য যেই না পা উঁচু করেছে, অমনি মনে হলো পেটের ডান দিকের ব্যান্ডেজটার নিচে কেউ যেনো একটা ধারালো ছুরি ঢুকিয়ে গেঁথে দিলো! শুধু গাঁথাই নয়, মনে হয় একটা মোচড়ও দিলো!!
প্রচণ্ড যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠতেই একজন নার্স দৌড়ে এসে বললো, ‘নড়বেন না’।
পরের এক সপ্তাহ মাহফুজ খুব ভালো করে বুঝতে পেরেছিলো নার্সের ওই সাবধানবাণী ‘নড়বেন না’র গুরুত্ব কত বেশি। দু’দিন হাসপাতালে থেকে বাসায় ফিরে এসেও ওকে বিশ্রামে থাকতে হয়েছে আরো সপ্তাহ খানেকের মত। এই সময়ে নড়তে চড়তে গিয়ে, বিশেষ করে শোয়া থেকে উঠতে গেলেই ওই ক্ষতগুলোতে এমন টান লাগতো যে মনে হতো কেউ বুঝি প্রাণটা ধরেই টান দিলো! অথচ ছোট ছোট মাত্র তিনটা ক্ষত!
এই সময়ে মাহফুজ শুয়ে শুয়ে লুবনার কথা ভাবতো। আরো ভাবতো ওর বোনেদের কথা, পরিচিত মেয়েদের কথা, বাংলাদেশের তাবৎ মা হওয়া নারীদের কথা। নিজের পেটের তিনদিকে তিনটা ছোট্ট ক্ষত নিয়ে যে যন্ত্রণা পোহাতে হচ্ছে, সেখানে বাচ্চা প্রসবের সময় মেয়েদের সিজারটা কত বেশিই না যন্ত্রণাদায়ক হয়! অথচ এত বড় একটা ক্ষতের ওই যন্ত্রণা সহ্য করেই দিনের পর দিন কোনো ত্রুটি না রেখেই নবজাতকের পরিচর্যা করে যায় ওরা, কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংসারের যাবতীয় কাজও!
মাহফুজ মনে মনে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। আরিবা হওয়ার সময় লুবনাও একই কষ্ট করেছে, কিন্তু মাহফুজ একদিনও বুঝতে পারেনি, লুবনা বুঝতে দেয়নি। সামনে আবার আরেকজন আসছে... কষ্টে মাহফুজের চোখে পানি এসে গেলো।
---------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমাদের মহামহিম ডাক্তারবৃন্দ এবং চিকিৎসাব্যবস্থা সম্পর্কে সাধারণের মধ্যে ধারণাটা মোটের উপর ইতিবাচক নয়। আমি নিজে এই ব্লগেই চার পাঁচটা পোস্ট দিয়েছি ডাক্তারদের নিয়ে; যেগুলোতেও নানারকম অভিযোগের ফিরিস্তি ছিলো। এই অভিযোগগুলো অস্বীকার করারও খুব একটা সুযোগ নেই। অবিশ্বাস্য ব্যাপার হলো, এই নেতিবাচক ধারণা সম্পর্কে ডাক্তার সম্প্রদায় ভালোভাবেই অবগত থাকার পরও এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়ার গরজ বোধ করেন না। উপরন্তু তাঁরা এতে রোগীদেরই দোষ দেখেন শতভাগ।
ডাক্তারদের যে সংগঠনগুলো বাংলাদেশে ক্রিয়াশীল রয়েছে, তার একটার একজন নেতৃস্থানীয় ভদ্রলোকের সাথে আমার বেশ খাতির আছে। খুব ঠাণ্ডা মেজাজের মিশুক একজন মানুষ, নামাজ কালাম পড়েন নিয়মিত। একদিন আড্ডায় আমি এই প্রসঙ্গটা উঠালাম। উনি সেই ঠাণ্ডা মেজাজ ধরে রেখেই এমন কঠিনভাবে রোগীদের দোষারোপ করতে লাগলেন যে আমি মানে মানে করে থেমে যেতে বাধ্য হলাম।
আমার মেজ বোনের মেয়েটা রাজশাহী মেডিকেলে পড়ছে। ডেভিলস ঔথ-এ উজ্জীবিত। কিছুদিন আগে বাড়িতে দেখা হওয়ার পর একটু অভিমান নিয়েই বললো- মামা, আপনি খালি ডাক্তারদের দোষ দেন... আমি আর কি বলবো, গুণী ব্লগার কাউসার চৌধুরীর ধনন্তরী লেখাটা প্রিন্ট করে ধরিয়ে দিলাম ওর হাতে। তারপর কি হলো তা জানা গেলো না। কারণ ওইদিনই আমি ঢাকা ফিরে আসলাম।
সম্প্রতি আমাকে একটা সার্জারির ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। হ্যাঁ ওপরের গল্পটা আমারই। এই সামান্য একটা সার্জারির কষ্ট আমাকে বেশ ভুগিয়েছে। ইনফ্যাক্ট এখনও ভুগছি। পেট কেটে ফেলার এই কষ্ট আমার চেয়ে ডাক্তাররা ভালো বোঝেন নিশ্চয়। তবুও কোনো এক অদ্ভূত কারণে তাঁরা নর্মাল ডেলিভারি পছন্দ করেন না। প্রসূতী মায়েদেরকে সবসময় অস্ত্রপচার করানোর জন্য বিভিন্নভাবে চাপ প্রয়োগ করেন, ইমোশনালি ব্ল্যাকমেইল করেন, ভয়ভীতিও প্রদর্শন করেন। অথচ এ ধরনের একটা সিজার একজন মেয়ের সারা জীবনের জন্য একটা সেটব্যাক হয়ে যেতে পারে।
ব্লগের যারা বাইরের দেশে থাকেন, তারা নিশ্চয় জানেন যে বাইরের দেশগুলোতে হাসপাতালের ডাক্তাররা একেবারে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত স্বাভাবিক প্রসবের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যান, এমন কি অনেক সময় রোগিনী বা তাঁর আত্মীয় স্বজনের চাপ উপেক্ষা করেও। অন্যদিকে আমাদের ডাক্তাররা কেবল কিছু বেশি টাকার জন্য একেকটা মেয়েকে এ রকম একটা বিপদে ফেলতে দ্বিধা করেন না। অথচ ডেভিলস ঔথ অনুযায়ী ডাক্তারদের হওয়ার কথা ছিলো অনেকটা ঈশ্বরের মত গুণান্বিত।
আমরা পুরোনোকালের অনেক ডাক্তারদেরকে মনে করতে পারি, যাঁদের মধ্যে এই ধরণের সদগুণাবলী বিদ্যমান ছিলো। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য এই যে নতুন প্রজন্মের ডাক্তারদের মধ্যে সেই সেবার মনোভাব ভয়াবহভাবে ক্রমহ্রাসমান। সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রের অবক্ষয়ের মতই।
উৎসগ: দ্বিতীয়বারের মত মা হতে চলা শুভভাবী
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে অক্টোবর, ২০১৮ বিকাল ৫:০৮