শহরে ইদানিং কুয়াশা পড়ে। বিকেলের রোদ মরে আসতে শুরু করলে দিগন্তের অনেক আগেই দৃষ্টিসীমা ফ্যাকাসে হয়ে যায়। যদিও এই শহুরে ঝলমলে জীবনে তার ছাঁপ পড়েনা তবু 'স্বপ্নবাজ সৌরভ'র মত আমিও স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ি। কাজের টেবিলে বসেই অনুভব করি হাফপ্যান্ট পড়ে গুলতি হাতে হলুদ পাখির পেছনে ছোটা আমার কৈশোরকে।
আমাদের কৈশোরবেলা একেবারেই ডিজিটাল ছিলো না, এমনকি অ্যানালগও নয়। আমাদের কৈশোর ছিলো একেবারে কাদামাটিতে মাখা, আম-সর্ষে-ধানের সোদা গন্ধে ভরপুর, দুর্বাঘাসের শিশিরে ভেজা। সে কৈশোরে আমরা অবাক চোখে দেখতাম রেললাইন ধরে সবুজ সোনালী রঙের লম্বা লম্বা ট্রেনের চলে যাওয়া। এক অদ্ভুত মাদকতা ছড়ানো সে ছবির রেশ থেকে যেতো বহু বহুক্ষণ। সম্ভবত ছিয়াশির দিকে সবুজ সোনালী রঙের ইন্টারসিটি ট্রেনগুলো এদেশে এসেছিলো। প্রেসিডেন্ট এরশাদের হাত ধরে। এর আগের ট্রেনগুলো ছিলো মরচেপড়া লাল রঙের মেটাল বডির। এখন যেগুলো ওয়াগন হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
আমার খুব ছোটবেলার একটা স্মৃতি মনে পড়ে, কোনো এক রোজার বিকেলে নাটোর স্টেশনে আমরা পরিবারশুদ্ধ বসে আছি। যশোর আসবো। অপেক্ষা করছি, ট্রেন আগে আসবে না সূর্য আগে ডুববে... সূর্য ডুবলেই নাটোর সুগার মিলের সেই বাতাস কাপানো সাইরেন আর সাইরেন মানেই ইফতার।
এ রকম এক শীতের বিকেলবেলা ট্রেনে করে নাটোর থেকে একেবারে চলে এসেছিলাম। ফেলে এসেছিলাম আমার প্রিয় শহর, মায়ার শহর নাটোরকে।
এরপর নরসিংদীতে থাকার সময়ে কৈশোরের সাথে কৌতুহলও যোগ হচ্ছিল পাল্লা দিয়ে। তখন চট্টগ্রাম বা সিলেট থেকে বিকেলের ঢাকামুখী ট্রেন আসার সময়ে পাঁচ পয়সা, দশ পয়সার কয়েন নিয়ে আমরা ছুটতাম রেললাইনে। ট্রেন আসার আগমুহূর্তে লাইনের উপর পেতে দিতাম ওগুলো। কেউ আমাদেরকে জ্ঞান দিয়েছিলো যে ট্রেনের চাকায় পিষ্ঠ হলে চুম্বকে পরিণত হয় পয়সাগুলো! কোনোদিনই হয়নি। তবুও উৎসাহে খামতি হতোনা আমাদের।
সে সময় ট্রেন ছিল বৈচিত্র্যময়। বিশ্ববিখ্যাত সব ম্যাজিশিয়ানের ম্যাজিক আর নানারকম মালিশের তেল থেকে শুরু করে হেন জিনিস ছিলোনা যা ট্রেনে পাওয়া যেতো না। ঠাস বুননের ভীড়ের মধ্যে ঘামের গন্ধ পেরিয়ে হকাররা সে সবের বিকিকিনি করতো বিরতিহীন। অদ্ভুত সব গল্পও জমতো সে ট্রেনে। স্টেশনে থেকে যাওয়া প্রিয়জনের বারবার চোখ মোছা আর চলে যাওয়া স্বজনের জানালা দিয়ে ফিরে ফিরে তাকানো অথবা পাশে বসা অপরিচিত যুবক বা যুবতির টুকটাক আলাপে জমে যাওয়া ভবিষ্যৎ স্বপ্নগুলো কদাচিৎ বাস্তবেও রুপ নিতো।
আবার ঝিকরগাছায় রেললাইন থাকলেও চলতোনা কোনো ট্রেন। সেই পোড়ো ট্রেনলাইন ধরে আমরা ক্লাসে যেতাম লাই ধরে। প্রতিযোগিতা করতাম লাইনের উপর কে কত বেশি সময় থাকতে পারে। কপোতাক্ষের উপর দিয়ে যাওয়া রেলসেতুর উপর থেকে দুরন্ত ছেলেরা নদিতে লাফ দিতো। গত শতকের শেষ দিকে সেই পোড়োলাইন আবার জেগে ওঠে খুলনা-যশোর-বেনাপোল কমিউটার ট্রেন চালুর মধ্য দিয়ে। প্রায়ই আমরা দলবেঁধে ওই ট্রেনে চড়ে যেতাম বেনাপোল পর্যন্ত। আগের ট্রেনটার পাশাপাশি ইদানিং ওই লাইনে ঢাকা-বেনাপোলের 'বেনাপোল এক্সপ্রেস' এবং আন্তদেশীয় ট্রেন 'বন্ধন এক্সপ্রেস' চলছে।
ক্লোজআপ ওয়ানের একটা গান শুনলাম, শীতের বিকেলবেলা, ঢাকামুখী ট্রেন..... শুনতে শুনতে কত কথা মনে পড়ে গেলো, যদিও বিস্তর ট্রেনযাত্রায় আমার পাশে কখনও কোনো অচেনা যুবতি এসে বসেনি। এমনকি যেবার চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের শাটল ট্রেনে চড়েছিলাম, সেবারও না.. সিটই পেলাম না তখন!
তবুও ট্রেনগুলো দিনের পর দিন নতুন নতুন গল্প রেখে যায় আর সে গল্পগুলোই শীবপ্রসাদ মুখার্জী আর নন্দিতা রায়ের হাত ধরে আবার জীবনের অংশ হয়ে ওঠে প্রাক্তন মুভিতে।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে ডিসেম্বর, ২০১৯ বিকাল ৩:১৯