সূর্যটা উঠতে দেখছে আরজু। প্রতিদিনই উঠে সূর্য। পুরনো একটা জিনিস। তারপরও প্রতিবারই নতুন লাগে তার কাছে। ওকে প্রকৃতিপ্রেমিক বললে ভুল হবেনা। কফির কাপে শেষ চুমুক দিয়ে রেখে দিল। কম্পিউটারে হাতের কাজটা শেষ করে উঠে দাঁড়াল। তৈরি হতে হবে। আজ পৃথার সাথে দেখা করতে যাবে আরজু।
পৃথা আরজুর আদরের ছোট বোন। অনেক বড় হয়ে গেছে এখন পৃথা। সেই ছোট্ট আধোবোলের মেয়েটি নেই সে। পৃথা এখন মহানগরীর সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। থাকেও সেখানেই। ওকে এভাবে এত দূরে থাকতে দিতে অনেক কষ্ট হচ্ছিল আরজুর। কিন্তু পাখি বড় হয়েছে। তাকে তো তার ইচ্ছেতে উড়তে দিতে হয়। শাওয়ার সেরে কাপড় পাল্টে বের হয়ে পড়ল। ফ্লাইট ধরতে হবে।
এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে মহানগরীর অপ্রিয় জ্যাম পার হয়ে একটা রেস্টুরেন্টে এসে ঢুকল আরজু। পৃথার সাথে প্রথমে সেও চলে এসেছিল ঢাকায়। কিন্তু পুরনো সব স্মৃতি ওকে ঠিক স্বস্তিতে থাকতে দেয়নি। পৃথা নিজে ভালমতো চলতে পারছে বুঝার পরে ও ফিরে যায় চট্টগ্রামে।
ঘড়ির কাটায় ১২টা প্রায় বাজছে। পৃথার আসতে আরও আধ ঘণ্টা বাকি। বসে বসে রেস্টুরেন্টের মিউজিক এ হারাতে চাইল আরজু। আশেপাশের টেবিলে বেশ কিছু কাপল দেখা যাচ্ছে। ওদের দুষ্টুমিষ্টি প্রেম না চাইলেও দেখতে হচ্ছে আরজুকে। খারাপ লাগেনা এদের দুনিয়ার সব বাজে ব্যাপার থেকে দূরে থাকা ছোট একটু শান্তির রেশ দেখতে। নিজের বয়স ও তো বাড়ছে।
পৃথা প্রথম প্রথম বেশ জোর করত ওকে বিয়ে করার জন্য, কারও সাথে মেশার জন্য। কিন্তু কেউই ঠিক আরজুর সাথে মানিয়ে নিতে পারত না। আরজুও আর চেষ্টা করেনি। তারপরও স্মৃতির পাতায় কলেজের গেটে দারিয়ে থাকা সেই তরুণী অথবা বারান্দায় খোলা চুল নিয়ে কফির মগ হাতে দাঁড়িয়ে থাকা নারীমূর্তি যে উঁকি দেয়না তা না। তবে এসব স্মৃতি নিয়ে বাঁচতে শিখে গেছে আরজু। সময়ের খেল।
সময়ের কথা মনে আসতে ঘড়ির দিকে তাকাল আরজু। ভ্রু কুঁচকানর আগেই রেস্টুরেন্টের দরজা দিয়ে ঢুকল পৃথা। স্মিত হেসে দাঁড়াল আরজু। ভ্রু সামান্য কুঁচকে গেল পৃথার পেছন পেছন একটা ছেলেকে ঢুকতে দেখে। কাছে এসে ওকে জড়িয়ে ধরল পৃথা। আর পৃথার মাথার ওপর দিয়ে ছেলেটার উপর কড়া নজর বুলাল আরজু। আলিঙ্গনমুক্ত হয়ে পরিচয় করিয়ে দিল পৃথা,
-ভাইয়া ও আয়ান।
-হুম।
আয়ান নামক ছোকরা ওর দিকে হাত বাড়িয়ে দিল,
-হ্যালো ভাইয়া, কেমন আছেন? আসতে সমস্যা হয়নি তো?
হাতটা ধরে কিছুটা জোর দিল আরজু। ছেলে পুতুল নাকি চেক করে নিল বোধহয়। ব্যাথা পেলেও হাসিটা ধরে রাখল ছোকরা। কুঁচকানো ভ্রু কিছুটা ঠিক করে হাসিটা ফিরিয়ে দিল আরজু। বসতে ইঙ্গিত করল ওদের। বসতে বসতে বলল,
-না সমস্যা হয়নি। তুমি কি পৃথার সাথে পড়ো?
-না ভাইয়া, আমি ওর দুই ইয়ার এর সিনিয়র। এবার ফাইনাল দেব।
-ভাল, পড়াশোনা কেমন?
হেসে ফেলে বলল পৃথা,
-ও পড়াশোনায় তেমন ভাল না ভাইয়া। পরিক্ষাগুলো কোনরকমে টপকে যায়। তবে ভীষণ ভাল গান গায়। এজন্য টিচাররা ওকে কখনও ফেইল করায় না।
-তাই নাকি? ভাল। তা লাঞ্চ হয়ে যাক?
-ওকে ভাইয়া।
মাথা ঝাঁকাল আয়ানও। ওয়েটারকে ডেকে যার যার পছন্দমত অর্ডার দিল ওরা। আয়ানের পছন্দের দিকে কড়া নজর রাখল আরজু। তবে রুচি ভালই দেখতে পেল। খাওয়া শেষ করে পৃথা ওয়াশরুমের দিকে গেল। আরজু হাসিটা ঝেড়ে ফেলে আয়ানের দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকাল,
-মেন্যুর পাশাপাশি আর কি বলেছে পৃথা আমার ব্যাপারে?
ঢোঁক গিলল আয়ান। আস্তে করে বলল,
-আপনি বেশি কথা পছন্দ করেন না। আর আমাকে আপনার খারাপ মনে হলে আমাকে শুধু পৃথা থেকে না, দুনিয়া থেকেই গায়েব করে দেবেন।
-ঠিকই বলেছে। এখন খোলস ঝেড়ে ফেল। আমি বাস্তবতার প্রয়োজনে অভিনয় করলেও অন্য কাউকে করতে দেখতে পছন্দ করিনা।
-জি ভাইয়া।
-খেতে তো পারনি ঠিকমত, আসলে কি পছন্দ তোমার? এখানে পাওয়া যাবে?
একগাল হাসি নিয়ে বলল আয়ান,
-না ভাইয়া, আরেক জায়গায় যেতে হবে।
পৃথা আসতেই বের হল ওরা। গাড়িতে বসে ওদের মধ্যে টুকটাক কথা হল। আয়ান ধরা পরে গেছে অভিনয়ে শুনে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ল পৃথা। গাড়িটা জেলখানার একটু আগে মোড়ে রাখল ড্রাইভার। আয়ান নেমে পথ দেখাল। ছোট একটা বিরিয়ানির দোকানে নিয়ে আসল ওদের। দোকানীর নাম রানামামা। কিছুক্ষণ আগে লাঞ্চ করে এলেও বিরিয়ানির লোভ সামলাতে পারল না কেউই। রাজকীয় এক ভোজ হয়ে গেল। বিল দিয়ে বের হওয়ার সময় মুচকি হাসল আরজু। এক সময় প্রচুর আসত পুরান ঢাকায় এই রানামামার তেহেরি খেতে। আজ অনেককাল পর আয়ানের সুবাদে আবার সেই পুরনো স্বাদ পেল। মানুষগুলো এতো বদলে যায় কিন্তু বিরিয়ানির স্বাদ বদলায় না, অনেকটা ওর মতই। ফ্লাইওভার না থাকায় রাস্তা পার হবার সময় কিছুটা রিস্ক নিয়েই পার হতে হল। শক্ত করে পৃথার হাত ধরে রাখল আরজু। অবাক হয়ে খেয়াল করল পৃথার আরেক হাত ধরে রেখেছে আয়ান।
গাড়িতে উঠে ওরা কোথায় যাবে জানতে চাইল আরজু। শাহবাগে নামিয়ে দিতে বলল পৃথা। রাস্তার পাশে নিজের পুরনো শহরটাকে দেখতে দেখতে এগুলো। ওর কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে পৃথা। এক হাতে ধরে রাখল ওকে আরজু, যাতে রাস্তার ঝাঁকুনিতে পরে না যায়। শাহবাগের মোড় দেখা যেতে আয়ানকে বলল আরজু,
-আয়ান।
-জি ভাইয়া।
-আমার বোনটা যেন কোন কষ্ট না পায়, এ দাবী করব না। মানুষ যেহেতু হয়েছে কষ্ট পেতেই হবে। তবে কষ্টটা ভুলে ওকে হাসানোর জন্য তোমাকে পাশে থাকতেই হবে। ওকে এমন যত্নে আগলে রাখতে হবে। পারবে?
লাজুক হেসে বলল আয়ান,
-পারব ভাইয়া।
গাড়ি টিএসসি এর সামনে এসে থেমে গেল। পৃথার কপালে আরজু একটা চুমু একে দিতেই ঘুম ভাঙল ওর। আদুরে ভঙ্গিতে আড়মোড়া ভাঙল ও। গাড়ি থেকে নেমে আরজুর গালে আদর দিয়ে বিদেয় জানাল পৃথা। গাড়িতে উঠে এয়ারপোর্টে যেতে বলল ড্রাইভারকে আরজু। ওর পৃথিবীটার হাত শক্ত করে ধরে ব্যস্ত ট্র্যাফিকের মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে আয়ান। রিয়ারভিউ মিররে ওদের হারিয়ে যেতে দেখল মানুষের ভিড়ে। চোখের কোন থেকে পানিটা মুছে ফেলল আরজু। এগিয়ে চলল গাড়ি মহানগরীর শত গাড়ির ভিড়েও একা পথে।