আকাশে মেঘ করেছে। মুখ তুলে মেঘের উপর এক নজর বুলিয়ে আবার কাজে মন দিল জসিমউদ্দিন। জসিমউদ্দিন আজ কাজ করছে হাবিব মোল্লার জমিতে। জসিমের নিজের কোন জমি নেই। মানুষের জমিতে কাজ করে খায়। সবসময় যে কাজ পায় এমনও না। তখন যে কাজ পায় তাই করে। কাজ না করে বসে থাকলে ভাত জুটবে না। ভাতের কষ্ট সে বুঝে। সে অনেক ছোট থাকতে ভাতের কষ্টে তার মা মারা গিয়েছিল। কেউ এসে কবর দেয়নি মাকে। কে দেবে! চারিদিকেই যে একই অবস্থা। শিশু জসিম মায়ের মৃত শরীরের পাশে একটা রাত কাটানোর পর পরেরদিন ভোরের আলো ফোঁটার আগেই শৈশব থেকে বেরিয়ে এসেছিল। ভাতের কষ্ট অনেক বড় কষ্ট।
জসিমের ধ্যান ভাঙল মফিজ বুড়ার ডাকে। খাওয়ার সময় হয়েছে। খেতে ডাকছে ওকে। নিড়ানিটা রেখে কোমর থেকে গামছাটা খুলে মুখের ঘাম মুছল ও। বুড়ার কাছে গিয়ে দেখল ভাত নিয়ে এসেছে বুড়ার বড় মেয়ে রানু। কলমির শাক, ডাল আর ভাত। পেট ভরে খেয়ে নিল দুজন। রানু বাতাস করল পাশে বসে বসে। বাতাসের তোড় যেন জসিমের দিকেই একটু বেশি আসছে। ওর দিকে ইদানিং কেমন যেন এক অদ্ভুত চোখে তাকায় মেয়েটা। এ দৃষ্টির ভাষা বুঝে জসিম। বড় লোভ হয় ঐ দৃষ্টির মায়ায় হারাতে। তবে যে ভয়ে সে এতটা জীবন একা পার করে এসেছে, সেই ভয়ই তাকে আঁটকে রাখে। জীবন নামের মায়ায় জড়িয়ে পড়ার ভয়।
পাতিল, প্লেট গুছিয়ে নিয়ে চলে গেল রানু। মফিজ বুড়ো একটা বিড়ি ধরিয়ে আরেকটা দিল জসিমকে। জসিম নিয়ে আগুন ধরাল। মফিজ বুড়ো বিড়িতে লম্বা টান দিয়ে বলল,
-খাওন ভালা হইছেনি জসিম?
-জে, ভালই। আমনের মাইয়া খাসা রান্দে।
-আল্লার কুদরত। মাইয়াডা আমার বড় কপাল নিয়া আইয়েনাই। কত গুনি মাইয়া, লক্ষ্মী মাইয়া, বড় ঘরে বিয়া দিলাম... মাস না ঘুরতে জামাইডা মইরা গেল।
-আহা!
-বুঝলা জসিম, মাইয়াডা সুখের দেখা পাইল না, বড় আদরের মাইয়াডা আমার।
-সুখের লাইগা বইয়া থাকলে সুখ আইব না বুড়া, সময়ে সুখ খুইজা নিতে হয়।
-কি কও? বুঝিনাই।
-বাদ দেন বুড়া, চলেন কামে লাগি। মেঘ নামলো বইলা।
বিড়ি ছুঁড়ে ফেলে স্বগতোক্তি করে কাজে নেমে পড়ল মফিজ বুড়া। অনেক দূরে খেতের আইল দিয়ে রানুর চলে যাওয়া অবয়বের দিকে একবার তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল জসিম। সেও কাজে নেমে পড়ল।
দুদিন ধরে বৃষ্টি পরছে তো, পরছেই। থামার নাম নেই। বন্যা হয় নাকি সেই ভয়ে আছে সবাই। গঞ্জের একটু দূরে একটা চায়ের দোকানে বসে আছে জসিম। ও ছাড়াও আরও কয়েকজন আছে। বৃষ্টির ছিটে থেকে বাঁচতে তারা বসেছে দোকানের মাচায়। তাদের মধ্যে গায়েন মধুও আছে। গান ধরেছে সে,
“আষাঢ় মাসের আসমান, বড় দুঃখ তার
সে দুঃখের পানিত ভাসায় দিল গেরাম আজ...
তার দুঃখে দুখি হইল পাষাণ মেঘনা,
অকুল নদীত লইয়া গেল পাড়ের ঘর, সুখ-ভাবনা”
গানটা বেশ আবেগ দিয়ে গাইছে গায়েন। একদম বুকে এসে লাগে। কত মানুষ যে এই গ্রামে ঘর হারিয়েছে, সংসার হারিয়েছে নদীর ভাঙ্গনে ওরা জানে। তারপরও গ্রাম ছেড়ে যায়না মানুষগুলো। গ্রামের মায়ায় আঁটকা পরে গেছে। বৃষ্টির শব্দে হারিয়ে যায় জসিমউদ্দিন।
রাত বেশ হয়ে এসেছে দেখে উঠল জসিম। পুকুর পাড় হয়ে মফিজ বুড়োর বাড়ির কাছাকাছি আসতে দূর থেকে ছুটে আসতে দেখল রানুকে। অবাক হল জসিম, এতো রাতে বৃষ্টির মধ্যে মেয়েটাকে এভাবে বাহিরে ছুটতে দেখে। কাছে এসে থামল ও।
-জসিম ভাই, আব্বার শরীর ভালা না। কেমন জানি করতেসে।
এক মুহূর্ত ভাবল জসিম,
-তুমি ঘরে গিয়া বুড়ার কাছে থাক। আমি ডাক্তার আনতে যাইতাসি।
রানু ফিরতি পথে রওনা হতেই দৌড় দিল জসিম। গঞ্জের ডাক্তারের বাড়ি যেতে হবে। যত তাড়াতাড়ি যাওয়া যায়। ভেজা পথে আছাড় খেতে খেতে ছুটল সে। ঝড়ো কাকের মতো ভিজছে ওর সারা শরীর।
গঞ্জের ডাক্তারকে নিয়ে ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ফিরল জসিম। ডাক্তার বুড়োকে কিছুক্ষণ খুঁটিয়ে দেখে জানাল হাঁপানির টান উঠেছে। ওষুধ দিয়ে এক সপ্তাহ বিছানায় থাকতে বলে চলে গেল। তাকে এগিয়ে দিয়ে এল জসিম।
বেশ জ্বরে পরেছে জসিম। সেদিন রাতে ডাক্তারকে দিয়ে এসে ঘরে ফিরেই অসুস্থ হয়ে পড়েছে। একলা মানুষ ও। এ গ্রামে এসেছেও নতুন। খোঁজখবর নেওয়ার, দেখভাল করার কেউই নেই। মফিজ বুড়োর ঘরের একটু দূরে ওর একটা ছাউনি ভাড়া নিয়ে থাকে জসিম। এটা আগে গোয়াল ঘর ছিল, যখন মফিজ বুড়োর বাপ গরু পালত। বেশ সামর্থ্যবান কৃষক ছিল সে। ঘর পেরিয়ে ছিল ফসলি জমির মাঠ। একবার নদীর ভাঙ্গনে ফসলি জমি হারায় সে, ঘরটাই কেবল টিকে গেছে। তারপর আর সেই সুখের দিন খুঁজে পায়নি। এখন বুড়োর গোয়াল ঘর ঠিকঠাক করে নিয়ে সেখানেই থাকে জসিম।
জ্বরের ঘোরে আবল-তাবোল দেখে জসিম। ওর মনে হয় ওর মা যেন এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, কাঁথা গায় জড়িয়ে দেয়, মাথায় জলপট্টি দিয়ে দেয়। মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। বড় শান্তি লাগে জসিমের সেই স্পর্শে। মনে হয় ওর ছুটে বেরাবার সময় বোধহয় শেষ হয়েছে। আর এ গঞ্জ থেকে সে গঞ্জ, এই গ্রাম থেকে সেই গ্রাম ছুটতে হবেনা। যেন ঘরের খোঁজ পেয়ে গেছে সে। ভোরের আলোয় মার কবর খোঁড়ার দুঃস্বপ্ন দেখে আর জেগে উঠতে হবেনা। জ্বর থেকে উঠতে ইচ্ছে হচ্ছে না জসিমের। ভয় যদি উঠলেই সেই স্পর্শ হারিয়ে যায়! এরকমভাবে জ্বরে মরে যেতেও রাজি জসিম তার বিনিময়ে।
তিনদিনের দিন জ্বর মোটামুটি ভাল হয়ে উঠল ওর। কাঁথা জড়িয়ে ঘরের বাইরে এসে বসল। ঘরের দাওয়ায় বসেছিল রানু। ওকে দেখে ফুরুত করে নিজেদের ঘরে ঢুকে পড়ল। একটু পরেই বুড়োর ছোট মেয়ে ঝুনু একটা পাতিল নিয়ে জসিমের ঘরের দিকে আসল। ওকে দেখে হাসল জসিম। কাছে এসে ওর কপালে হাত রেখে জ্বর আছে নাকি দেখল ঝুনু। হেসে বলল,
-প্রায় ভালা হইয়া গেছে। একদম অল্প।
মৃদু হেসে বলল জসিম,
-হাতে কিরে তোর?
-মুড়ি বানানি।
-আমারে দিবি একটু?
-এইডা আমনের লাইগা, বুবু বানায় পাডাইসে। নেন খান। এই কয়দিন বুবুরে যা পেরেশানিতে ফালাইছিলেন, আম্নের দেখভাল আর বাপের খোঁজ করতে করতেই ওর ঘুম গেল।
কিছু না বলে চুপচাপ বলটা নিয়ে মুড়ি চাবাতে লাগল জসিম। জ্বর জ্বর মুখে মুড়ি খেতে ভাল লাগছে না। ঘরে হয়ত আর কিছু নেই। থাকবে কিভাবে বাপ এক সপ্তাহ ধরে বিছানায় পরে। তাই রানু মুড়িই বানিয়ে পাঠিয়েছে। বিস্বাদ লাগলেও তাই চিবিয়ে যেতে লাগল জসিম। বিকেলের দিকে উঠে বাজারে গিয়ে সদাই এনে দিল রানুকে। ব্যাগটা রানুর হাতে ধরিয়ে নিজের ঘরে চলে এল ও। এক সপ্তাহ চলার মতো সদাই আছে ওতে।
অনেক হয়েছে। মায়ায় পরে যাচ্ছে জসিম। ভালভাবেই পড়ছে বুঝতে পারল ও। মায়ায় আটকাতে চায়না সে। মায়া বড় ভয়ের জিনিস। নিজের জিনিসপত্র অল্পসল্প যা আছে সব গুছিয়ে নিতে বসল জসিম। কখন ওর ঘরের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে রানু, জানেও না।
-কই যান জসিম ভাই?
চমকে ফিরে তাকাল জসিম। রানুকে দেখে চোখ নামিয়ে বলল,
-জানি না রানু।
-আইবেন কবে?
-জানি না।
আর কিছু বলল না রানু। জসিম নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে দরজায় রানুর সামনে এসে দাঁড়াল। বুকপকেট থেকে কিছু টাকা বের করে দিল।
-বুড়ারে দিও, ঘর ভাড়ার টেকা।
কিছু বলল না রানু। টাকাটা ওর হাতে গুঁজে দিয়ে পা বাড়ালো জসিম। পেছন থেকে ডাকল রানু,
-জসিম ভাই...
ফিরে তাকাল জসিম রানুর দিকে,
-আমি কি এতই খারাপ?
মেয়েটার চোখ এ বর্ষণ নেমেছে। আকাশে আবার মেঘ করে এসেছে। ঝড় হবে, বেশ বড়সড় ঝড়।
উত্তর না দিয়ে পা বাড়াল জসিম।
রাতটা কাটিয়ে দিতে জনু গাজির চা দোকানে আশ্রয় নিল জসিম। মনটা কেমন যেন করতে লাগল ওর। মাত্র মাস কয়েক হয়েছে এখানে এসেছিল ও। তারপরও মনে হচ্ছে যেন নিজের ঘর ছেড়ে চলে যাচ্ছে। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। মফিজ বুড়ো যে বলে ‘গেরামের মায়া রে জসিম মিয়া, নদী এক পা খাইয়া ফালাইলেও আরেক পা দিয়া খারায় থাকুম আমরা, বুঝবানা তুমি। একবার এই মায়া ধরলে আর ছাড়বো না।’, ঠিকই বলে।
জসিম মায়া চেনে না। মায়া, শৈশব সেই রাতেই হারিয়েছে যে রাতে তার মৃত মায়ের লাশ রাস্তার পাশে ফেলে ভাতের খোঁজে গিয়েছিল। আর সেই পথ খুঁজে পায়নি সে ফেরার। কেউ আসেনি তার মায়ের লাশটা কবর দিতে। শিশু জসীমও আর পায়নি মায়ের কাছে ফিরতে। পারেনি মায়ের মৃত দেহটা কবরে নামিয়ে দিতে। সেই যে ছোটা শুরু জসিমউদ্দিনের, আর থামেনি। রাতের পর রাত মায়ের কবর খোঁড়ার দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে উঠে সে এখনও।
শেষ রাতে ধড়মড় করে উঠে পড়ল জসিমউদ্দিন মানুষের চিৎকার শুনে। দোকানের ঝাপি খুলে সে আর জনু গাজি বের হয়ে এল কি ব্যাপার দেখতে। ভয়ংকর ঝড় হচ্ছে। তার মাঝেই সবাই দলে দলে ছুটছে। একজনকে থামিয়ে জিগ্যেস করল গাজি,
-কি মিয়া, কি হইছে?
-ভাঙ্গন লাগসে গাজী, পাষাণ মেঘলা আবার টান দিসে।
-হায় হায়! কোন পাড়, কোন কোন বাড়ি?
-পশ্চিম পাড়। দর্জি, আবুলের বাড়ি, মফিজ বুড়ার বাড়ি...
আর কিছু শুনতে পারল না জসিম। চোখের সামনে ভেসে উঠল রানুর কান্না ভেজা মুখটা। রানুর কথা,‘আমি কি এতই খারাপ...’ নিজের অজান্তেই ছুটতে শুরু করেছে সে... তাকে যে ফিরতে হবে, মায়ায় পড়েছে সে। গ্রামের মায়ায় না, একটা ছোট সংসারের স্বপ্নের মায়ায়, এক মমতাময়ি নারীর মায়ায়। ছুটল জসিম বাড়ির পথে।