
শহীদুল ইসলাম প্রামানিক
(চতুর্থ পর্ব)
আজাদ ভাই উকিল হতে রাজী হওয়ায় আমাদের মাঝে একটা স্বস্তি ফিরে এলো। আমি এবং মোহাম্মদ আলী খান অপু স্বেচ্ছায় স্বাক্ষী হতে রাজী হলাম। বিয়ের কাবিন কত ধার্য্য করা হয়েছিল এই মুহুর্তে মনে পড়ছে না তবে সম্ভাবত দুই লক্ষ এক টাকা হবে। মোহরানাটাও আমরা নির্ধারণ করি নাই বর কনে বিয়ের আগেই এটা নির্ধারণ করে রেখেছিল।
কনেকে তিন তলায় বাড়িওয়ালীর ড্রইং রুমে বিয়ের পোষাক পড়িয়ে কয়েকজন আইয়োসহ বসানো হয়েছে। এদিকে অশিত বাবুকে আমার ড্রইং রুমে প্রদীপ বাবুসহ আরো দুই একজনকে তার পাশে বাসিয়ে রাখা হয়েছে। অর্থাৎ একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে বাঙালি মুসলমানদের নিয়ম অনুযায়ী যাকে যেভাবে যেখানে বসানো দরকার সেভাবেই বসানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে।
বিয়ের পুরো পরিবেশ অনুকুলে আসার পর হুজুর আমাদের তিনজনকে নিয়ে অর্থাৎ ইসলামী নিয়ম অনুযায়ী একজন উকিল ও দুইজন স্বাক্ষীসহ তিন তলায় কনের সম্মুকে উপস্থিত হলেন। আশেপাশের মহিলারা এসে ঘরসহ বারান্দা ভরে গেছে। বিয়ের আয়োরা কনেকে ঘিরে বসে আছে। কনেকে বান্ধবীরা যতটা পেরেছে বিয়ের সাজে পুরোই সাজিয়েছে। কনে সাজানোর ক্ষেত্রে তারা কোন কিছুই কমতি রাখে নাই। কনেকে দেখে মনে হলো কোন বাবা তার মেয়েকে কোটি টাকা খরচ করে যে ধরনের বিয়ের সাজে সাজিয়ে থাকে তার চেয়ে কোন অংশেই কম হয় নাই। কারণ কনে সাজানোর জন্য বর কনে নিজেরা নিউ মার্কেট থেকে সাধ্যমত অনেক কিছু কিনে এনেছে কিন্তু অবাক করার বিষয় হলো ইউনিভার্সিটির বান্ধবীরাও খালি হাতে আসে নাই তারাও যার যার সাধ্যমত অনেক কিছু কিনে এনেছে। যে কারণে কনের সাজ সজ¦া নিয়ে রিতিমত অবাকই হলাম। যেখানে কোনরকমে বর কনের বিয়ে পড়িয়ে দায় সারার কথা সেখানে বিয়ের কনেকে এমন নিখুঁতভাবে সাজানো হবে এটা আমার কল্পনার বাইরে ছিল।
কনে জরি লাগানো ওরনা দিয়ে মুখটা আধো ঢাকা ঘোমটা অবস্থায় মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে আছে। কনের সাথে যারা বসে আছে তারা সবাই তার কলেজ ইউনিভার্সিটির বান্ধবী। কনে বা বরের বাবা-মা, আত্মীয় স্বজন উপস্থিত না থাকলেও মনে হচ্ছে না ঘনিষ্ঠ জনের অভাব আছে। এই বিয়েতে বর কনের প্রতি সবার গভীর আন্তরিকতাপূর্ণ আচারণে আমি বেশ আনন্দিতই হলাম।
বর কনের ইচ্ছাতেই এই বিয়ের আয়োজন তারপরেও বিয়ের পূর্ব মুহুর্তে কনেকে বেশ লজ্জিত মনে হলো। লজ্জায় মাথা তুলে তাকাতে পারছে না। তার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী পারভীন এবং ইউনিভার্সিটির আরেক জন বান্ধবী পাশে বসে তাকে জড়িয়ে আছে। অন্য বান্ধবীরা পিছনে বসা। হুজুর উপস্থিত সবার অনুমতি নিয়ে দুই লক্ষ এক টাকা মোহরানা উল্ল্যেখ করে সিরাজগঞ্জ নিবাসী শ্রী বংশীবদন পালের পুত্র জনাব অমিত রায়হানের (অশিত) সাথে বিয়েতে রাজী আছে কিনা উত্তরের আশায় প্রশ্ন করতেই কনে হুঁ হুঁ করে কেঁদে দিল। তার কান্না দেখে ঘর ভর্তি মানুষের গমগমা পরিবেশ মুহুর্তেই নিস্তব্ধ হয়ে গেল। মনে মনে ভাবলাম আবেগের বশে ছেলে মেয়ে নিজেরা বিয়ের সিদ্ধান্ত নিলেও বিয়ের পিড়িতে বসে সেই আবেগ আর আবেগ থাকে না সেটা অশ্রুতে পরিণত হয়। আগামী জীবন চলার ক্ষেত্রে এই বিয়ের পিড়িতে বসেই সুখ-দুখ, হাসি-কান্না, জীবন-মরণের চরম সিদ্ধান্ত নিতে হয়। কাজেই যে যেভাবেই বিয়ের পিড়িতে বসুক না কেন অতীত বর্তমানের সকল প্রিয়জনের মায়া ত্যাগ করে আরেক জনের হাত ধরে সুখের আশায় আগামীর সিদ্ধান্ত নিয়ে দাম্পত্য জীবন শুরু করা প্রত্যেক মেয়ের জন্যই খুব কঠিন একটি সিদ্ধান্ত। পিড়িতে বসে কবুল বলার পর জীবনটা একটা ছঁকে বাধা পড়ে যায়, তখন যদি সুখের বদলে কপালে দুঃখ নেমে আসে তখন করার কিছুই থাকে না, এই দুঃখকেই আজীবন সাথী করে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে নামতে হয়। কাজেই একজন সুস্থ্য মানুষ শত চেষ্টা করেও কবুল শব্দটি উচ্চারণ করার সময় নিজের কান্নাকে কোনভাবেই চেপে রাখতে পারে না। সেই কথা ভেবেই মনে হলো বাবা মা ছাড়া বিয়ের পিড়িতে বসা কনে সুইটিও এই পরিস্থিতির বাইরে নয়। কাজেই কবুল বলার পূর্বে তার কান্না করাটাই স্বাভাবিক।
প্রায় পাঁচ মিনিট আমরা তার কবুল বলার অপেক্ষায় হুজুরের সাথে দাঁড়িয়ে আছি। পারভীন তাকে কবুল বলার জন্য ফিস ফিস করে বার বার তাগাদা দিচ্ছে কিন্তু তারপরেও সে শুধু কেঁদেই যাচ্ছে। একটা পর্যায়ে আস্তে করে কবুল উচ্চারণ করায় আমদের মাঝে স্বস্তির ভাব ফিরে এলো। নিরব নিস্তব্দ ঘরে আনন্দের বন্যা বইতে লাগল। খুশির জোয়ার যেন সবার মাঝেই। অনেকেই কবুল শব্দটি শোনার সাথেই সাথেই আলহামদুলিল্লাহ বলে আল্লার দরবারে শুকুরানা আদায় করলেন।
(চলবে---)
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে অক্টোবর, ২০২২ সন্ধ্যা ৬:১১

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



