somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

যুদ্ধে নিহত মনোজ দা’র বাবা

২৫ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৩৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

১৯৭১ সালের এপ্রিলের ছব্বিশ তারিখ। দেশে তখন ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়েছে। উচ্চ শিক্ষিত এবং কলেজ পড়ুয়া ছাত্রদের নিয়েই বেশি সমস্যা। তাদেরকে খুঁজে খুঁজে ধরে নিয়ে হত্যা করছে। এরকম খবরে যাদের ছেলে মেয়ে শিক্ষিত এবং কলেজ পড়ুয়া ছিল তারা বড়ই আতঙ্কে দিন কাটাতে লাগল। কলেজ ছাত্ররাও মৃত্যুভয়ে পালাতে লাগল। মনোজ কুমার সরকার তখন আমাদের গ্রামের একমাত্র বিএ পাশ। সংক্ষেপে আমরা তাকে মনোজ দা’’ নামেই ডাকি। মনোজ দা’র বাবা রুহিনী কান্ত ডাক্তার তাকে নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন। আমাদের গ্রামে আর কোন বিএ পাশ ছিল না তবে বিএ পড়ুয়া ছিল। তাদের একজন হলেন সিংড়িয়া উত্তর গ্রামের দেলোয়ার হোসেন বিকম এবং দক্ষিণ গ্রামের আমার বড় ভাই ইছাহক আলী বিএসসি, তারা দুইজনেই বিএ দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন।

গ্রামে খবর আাসলো কলেজ পড়ুয়া বা শিক্ষিত যুবক ছেলেদের যেখানে পাচ্ছে সেখান থেকেই ধরে নিয়ে গুলি করে মারছে। এইরকম খবর শুনে এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে গেল। মনোজ দা’র বাবা রুহিনী কান্ত ডাক্তার নিজের ছেলের জানের নিরাপত্তার জন্য আমার বাবাকে এসে খুব করে ধরলেন। ভাই আমার ছেলেকে আপনার বাড়িতে কয়দিন লুকিয়ে রাখেন, তা না হলে আমার ছেলেকে যদি খান সেনারা ধরে নিয়ে যায় তাহলে ওর সাথে আমারো মরণ ছাড়া উপায় থাকবে না। তার দুশ্চিন্তা হলো মনোজ দা তার একমাত্র সন্তান। মনোজ দা ছাড়া তার আর কোন ছেলে সন্তান নাই। যে কোন ভাবেই হোক ছেলেকে রক্ষা করতে হবে।

মনোজ দা তখন বিবাহিত ছিলেন। দেড় বছর বয়সী মানিক নামের একটি ছেলে আছে। তখন আমাদেরই নিরাপত্তা নাই আওয়ামীলিগের সক্রিয় সদস্য হওয়ায় বড় ভাইকে নিয়েই বাবা খুব দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন, সেখানে মনোজ দা’কে কি নিরাপত্তা দিবে। কিন্তু ডাক্তার এমনভাবে বাবাকে ধরেলেন বাবা না করতে পারলেন না। ডাক্তারের অনুরোধে বাবা মনোজ দা’কে আমাদের বাড়িতে থাকার জায়গা দিতে রাজি হলেন। মনোজ দা তার স্ত্রী এবং বাচ্চাসহ রাতের আঁধারে আমাদের বাড়িতে চলে আসলেন। বাবা আমাদের দক্ষিণ দুয়ারী ঘরেই তার থাকার ব্যাবস্থা করে দিলেন। তখন এই ঘরকে আমরা বড় ঘর বলতাম, বড় ঘর বলার কারণ হলো এই ঘর সাইজে যেমন বড় ছিল তেমনি আমাদের ধান চাল সব থাকতো এই ঘরেই।

বড় ঘরে থাকতে দেয়ার কারণ হলো অন্যান্য ঘরে এলাকার অনেক মানুষ এসে আড্ডা দিত কিন্তু এই ঘরে নিজেদের লোক ছাড়া বাইরের কেউকে ঢুকতে দেয়া হতো না। নিরাপদ এবং নিরাপত্তার জন্য এই ঘরেই বাবা তার থাকার ব্যাবস্থা করে দেন।

দুই দিন দুই রাত কাটতে না কাটতেই মনোজদার শিশু বাচ্চা মানিককে নিয়ে হলো বিপদ। মানিকের বয়স তখন দেড় দু’বছর। এই ছোট্ট বাচ্চা বাড়ির খোলামেলা উঠানে খেলাধুলা করা অভ্যাস। সেই বাচ্চা কোনভাবেই ঘরে আবদ্ধ থাকতে চাচ্ছে না। তাকে যতোই ঘরে আটকে রাখার চেষ্টা করে ততই সে কান্না করে। সারাদিন কান্না করে মা বাবাকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। সারা দিন ঘ্যান ঘ্যান করে একটাই কথা বলতো, হাট মা বাড়িত যাই হাট মা বাড়িত যাই। মায়ের কাপড় ধরে সারা দিনই টেনে হিঁচড়ে তাদের বাড়ির দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতো। দুই দিন দুই রাত থাকার পরে মনোজ দা তার বাচ্চার জ্বালায় টিকতে পারলেন না। ২৯ তারিখ রাতে বৌদিসহ নিজের বাড়ি চলে গেলেন।

নিজের বাড়িতে রাতটা তাদের ভালোই কেটেছিল। কিন্তু সকাল বেলায় ঘটল দুঃখজনক ঘটনা। বেলা আটটা নয়টার দিকে ফুলছড়ি থানার দারোগা হেদায়েতুল্লাহ (যতটুকু মনে পড়ে দারোগার নাম এটাই ছিল) এসে আমার বাবা ছোলেমান আলী প্রামানিক, নিবারণ কাকা এবং নিবারণ কাকার বড় ভাই রুহিনী কান্ত ডাক্তারকে ডেকে নিয়ে কাতলামারির সামছুল মেম্বারের বাড়ি যায়। দারোগার সাথে যাওয়ার কারণ হলো, এই দারোগা আগে থেকেই এলাকার লোকজনের কাছে পরিচিত ছিল। একেতো বাঙালি তারোপর ফুলছড়ি থানায় অনেক দিন হলো চাকরি করছে। মাঝে মাঝে রাতের টহলে আসলে আমাদের বাড়িসহ অনেকের বাড়িতেই আশ্রয় নিত। নিবারণ কাকার সাথেও তার ভালো সম্পর্ক ছিল। নিবারণ কাকার বাড়ি ডাকাতি হলে এই দারোগা তদন্তের জন্য প্রায়ই আসতো এবং কাকার বাড়িতে খাওয়া দাওয়া করতো। এই কারণে এলাকার লোকজনের বিশ্বাস ছিল তার দ্বারা কারো কোন ক্ষতি হবে না।

আমাদের গ্রাম থেকে আমার বাবা ছোলেমান আলী প্রামানিক, নিবারণ কাকা ও নিবারণ কাকার বড় ভাই রুহিনী কান্ত ডাক্তার এই তিনজন দারোগার সাথে গিয়ে দেখেন সেখানে কাতলামারি গ্রামের আরো লোকজনকে ডেকে জড়ো করা হয়েছে। দারোগা বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে মিটিং করার কথা বলে ডেকে নিয়ে পাকিস্থানের পক্ষে এবং বিপক্ষে কারা আছেন তাদের নাম জানতে চান। বিশেষ করে পাকিস্থানের বিপক্ষে কারা আছে তাদের নাম জানতে চাচ্ছিলেন। ওখানে যারা গিয়েছিলেন তারা সবাই প্রায় মাতাব্বর ধরনের লোক। কেউ এবিষয়ে কোন তথ্য না দিয়ে উল্টো তাকে বোঝাতে থাকে আমাদের এলাকায় এধরনের কেউ নাই। কিন্তু সে মানতে নারাজ। কারো কাছ থেকে কোন তথ্য না পেয়ে উল্টো কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে দারোগা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন। দারোগার সামনে বাবা বসা ছিলেন। প্রথমেই বাবাকে লাথি মারেন এরপরে নিবারণ কাকাকে লাথি মেরে অন্যদের লাথি মারতে গেলে সব দৌড়ে পালিয়ে যায়। বাবা নিবারণ কাকাসহ অন্যরা পালিয়ে আসলেও রুহিনী ডাক্তার আর আসতে পারেন নাই। দারোগা তাকে পাকরোও করে থানায় নিয়ে যায়। কয়েক দিন আগেই পাক সেনারা ফুলছড়ি থানা দখল করে ঘাঁটি গেরেছে। তারা এসেই চারদিকে হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে। সেই ভয়ে কেউ আর ফুলছড়ি থানায় যাওয়ার সাহস পেল না। মনোজ দা’র বাবা রুহিনী কান্ত ডাক্তারকে সেই যে ধরে নিয়ে গেল আর তিনি ফিরতে পারেন নাই।

এই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই ঠিক তার পরদিনই সকাল বেলা গ্রামের পশ্চিম পাশ দিয়ে খান সেনারা দুটি গাড়ি নিয়ে অকস্মাৎ ঢুকে পড়ে। সকাল বেলা কিছু বুঝে উঠার আগেই আর্মিদের গাড়ি দেখে অনেকে দৌড়াদৌড়ি করে পালাতে সক্ষম হলেও ছয়জনের ভাগ্যে পালানো সম্ভব হয় নাই। তারা আর্মিদের হাতে ধরা পরে যায়। হাত বেঁধে গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর আজ পর্যন্ত তাদের আর কোন খোঁজ খবর পাওয়া যায় নাই।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৪:২২
৮টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ওহাবী-সালাফি-মওদুদীবাদ থেকে বাঁচতে আরেকজন নিজাম উদ্দীন আউলিয়া দরকার

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৬ ই জুন, ২০২৪ দুপুর ২:৩৩

১.০
ঐতিহাসিক জিয়া উদ্দীন বারানী তার তারিখ-ই-ফিরোজশাহী বইতে শায়েখ নিজাম উদ্দীনের প্রভাবে এই উপমহাদেশে জনজীবনে যে পরিবর্তন এসেছিল তা বর্ণনা করেছেন। তার আকর্ষণে মানুষ দলে দলে পাপ থেকে পূণ্যের পথে যোগ... ...বাকিটুকু পড়ুন

এই ৩০ জন ব্লগারের ভাবনার জগত ও লেখা নিয়ে মোটামুটি ধারণা হয়ে গেছে?

লিখেছেন সোনাগাজী, ১৬ ই জুন, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৯



গড়ে ৩০ জনের মতো ব্লগার এখন ব্লগে আসেন, এঁদের মাঝে কার পোষ্ট নিয়ে আপনার ধারণা নেই, কার কমেন্টের সুর, নম্রতা, রুক্ষতা, ভাবনা, গঠন ও আকার ইত্যাদি আপনার জন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

আর্তনাদ

লিখেছেন বিষাদ সময়, ১৬ ই জুন, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২১

গতকাল রাত থেকে চোখে ঘুম নাই। মাথার ব্যাথায় মনে হচ্ছে মাথার রগগুলো ছিঁড়ে যাবে। এমনিতেই ভাল ঘুম হয়না। তার উপর গতকাল রাত থেকে শুরু হয়েছে উচ্চস্বরে এক ছাগলের আর্তনাদ।... ...বাকিটুকু পড়ুন

মন তার আকাশের বলাকা || নিজের গলায় পুরোনো গান || সেই সাথে শায়মা আপুর আবদারে এ-আই আপুর কণ্ঠেও গানটি শুনতে পাবেন :)

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ১৬ ই জুন, ২০২৪ রাত ১০:০০

ব্লগার নিবর্হণ নির্ঘোষ একটা অসাধারণ গল্প লিখেছিলেন - সোনাবীজের গান এবং একটি অকেজো ম্যান্ডোলিন - এই শিরোনামে। গল্পে তিনি আমার 'মন তার আকাশের বলাকা' গানটির কথা উল্লেখ করেছেন। এবং এ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×