
শহীদুল ইসলাম প্রামানিক
আমার পাশে বসা ভদ্রলোকের নাম হযরত। প্রায় আটচল্লিশ বছর পর দেখা হলো। একাত্তর সালে যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পাক সেনাদের ভয়ে আমাদের বাডিতে আশ্রয় নিয়ে ছিলেন।
উনার বাড়ি বৃহত্তর পাবনা জেলার বেলকুচি থানা এলাকায় (বর্তমান সিরাজগঞ্জ জেলা)। সেই সময় গাইবান্ধা মহকুমার (বর্তমানে গাইবান্ধা জেলা) ফুলছড়ি থানা বাজারে বর্তমান বিচারপতি খুরশীদ আলমের বাবার কাপড়ের দোকানে চাকরি করতেন (বিচারপতি খুরশীদ আলম ডেপুটি স্পীকার এ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বী মিয়ার জামাতা)। নভেম্বর মাসের শেষ দিকে মুক্তিযোদ্ধারা ফুলছড়ি থানা আক্রমণ করলে পাকসেনাদের সাথে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। গোলাগুলির মধ্যেই প্রাণ বাঁচাতে মালিক কর্মচারীসহ ৯জন এসে আমাদের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। আমাদের বাড়িতে একটি কাচারি ঘর ছিল। এই কাচারি ঘরটিতে যুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধসহ অনেক বিপদগ্রস্ত লোক আশ্রয় নিয়েছিল। সেই সময় লোকজনকে আশ্রয় দেয়াও বিপজ্জনক ছিল। লোকজন আশ্রয় দেয়ার খবর যদি খান সেনাদের কাছে চলে যেত তাহলে আমাদের আর রক্ষা ছিল না। খান সেনাদের হাতে জ্যান্ত গুলি খেয়ে মরতো হতো। এতো বিপদ জেনেও বাবা পুরো ঘরটিই তাদেরকে থাকার জন্য দিয়ে দিয়েছিলেন।
আশ্রয় নেয়া ৯ জনের মধ্যে যারা ছিলেন তারা হলেন, ফুলছড়ি বাজারের কাপড় ব্যাবসায়ী লতিফ সরকার, জিল্লু সরকার, মাহমুদ সরকার, ছোলেমান সরকার ও হযরত আলী, বাকিদের নাম এই মুহুর্তে মনে করতে পারছি না। আশ্রয় নেয়া সবাই পাবনা জেলার লোক। তখন আমি হাইস্কুলে পড়ি। সবাই আমার চেয়ে বয়সে অনেক বড় শুধু এই ভাইটি ছিল আমার সমবয়সী। সমবয়সী হওয়ায় তার সাথে আমার বন্ধুত্বভাব গড়ে উঠে। যতদিন আমাদের বাড়িতে ছিল ততদিন সবসময় আমার সাথেই থাকত এবং আমার সাথেই মাঠে ময়দানে খেলাধুলা করতো। দেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েক দিন পরে দেশ স্বাভাবিক হলে উনারা আবার ফুলছড়ি বাজারে ফিরে যান।
দেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েক বছর পরে ফুলছড়ি বাজারসহ পুরো এলাকা যমুনা নদীতে বিলীন হয়ে গেলে অনেকেই এলাকা ছাড়া হয়ে পড়েন। এই ভাইটিও পাবনা চলে যান। যে কারণে তার সাথে ইচ্ছা থাকা সত্বেও দীর্ঘ দিন যোগাযোগ করা সম্ভব হয় নাই। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে অফিস চালাকলীন সময় হঠাৎ একটি অজ্ঞাত নাম্বার থেকে ফোন আসে। আমার কুশলাদি জিজ্ঞেস করলেও আমি তাকে চিনতে পারি না। তার নামও ভুলে গিয়েছি। পরে একাত্তর সালের কথা বলতেই সেই সময়ের স্মৃতিগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠে, তখন চিনতে আর অসুবিধা হয় নাই।
আমি যখন তাকে জিজ্ঞেস করলাম আপনি আমার ফোন নাম্বার পেলেন কোথায়? উত্তরে বলল, তিন বছর হলো তিনি আমাকে খুঁজতেছেন। আমাদের বাড়ি নদীতে ভেঙে যাওয়ায় আমাকে খুঁজে পাচ্ছিল না। তাছাড়া আমার নামও তিনি ভুলে গিয়েছিলেন। আমার এক ভগিনার কাছে আমাদের যুদ্ধের সময় বাড়ির বর্ননা দেয়ায় আমার ভাগিনা অনুমান করেই আমার নাম্বার দিয়েছিলেন। এভাবেই তিনি আমাকে খুঁজে পান। ২০১৯ সালের ১লা নভেম্বর সরাসরি তার সাথে দেখা করি। তাকে দেখেই যুদ্ধের অনেকগুলো স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে উঠে।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই আগস্ট, ২০২৫ বিকাল ৫:৪৭

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


