গত শুক্রবার প্রথম আলোতে জনাব হাসান ফেরদৌস সাহেবের একটা লেখা পড়লাম মেহেরজান প্রসঙ্গে। লেখাটির জবাবে কলম না ধরে পারলাম না। তিনি গত সপ্তাহে ইন্ডিয়ান আমেরিকান ফিল্ম ফেস্টিভালে মেহেরজান ছবিটি দেখেছেন।তাঁর দৃষ্টিতে মেহেরজান একটি "স্পেলবাউন্ড" ফিল্ম।
জনাব হাসান ফেরদৌসের দৃষ্টিতে, মেহেরজান নিয়ে
"তর্ক-বিতর্ক যা হয়েছে তার সবটাই রাজনৈতিক, ছবি হিসেবে এর গুণাগুণ বিচারের কোনো চেষ্টাই হয়নি। আসলে এমন ছবির জন্য বাংলাদেশ এখনো তৈরি নয়। মুক্তিযুদ্ধ ব্যাপারটা আমাদের কাছে এখনো শুদ্ধ আবেগের ব্যাপার। যুক্তি দিয়ে, বুদ্ধি দিয়ে তাকে বিচারে আমরা এখনো প্রস্তুত নই।"
- জনাব হাসান, একটি দেশের জন্মের ইতিহাস নিয়ে যখন কোনো ছবি নির্মাণ করা হয়, তাতে রাজনীতি আসবেই এবং ঐ ছবির সমালোচনা রাজনৈতিক দৃষ্টিতে হওয়াই স্বাভাবিক। যদি ছবির গুনাগুনের কথা বিচার করার কথা বলেন তবে বলবো, সীমিত ও অল্প পরিসরে হলেও বাংলাদেশে বিশ্বমানের ছবি নির্মাণ হতে শুরু করেছে। গেরিলা, মনপুরা, থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার, স্বপ্নডানায়, নিরন্তর ছবিগুলোর শিল্পমান মেহেরজানের চে অনেক ওপরে। এই ছবিগুলোর শিল্পমানের বিচার করতে গেলেও "স্পেলবাউন্ড" শব্দটি ব্যবহার করা যাবে না। সত্যিই বলেছেন, মেহেরজান ছবির মতো ছবি দেখার জন্য বাংলাদেশ এখনো তৈরি হয়নি। যতদিন তৈরি না হবে, ততদিনই দেশের জন্য মঙ্গলকর। কারণ, মুক্তিযুদ্ধ আমাদের গৌরব করার মতো বিষয়। মুক্তিযুদ্ধ ব্যাপারটা যতদিন শুদ্ধ তরল আবেগের ব্যাপার হয়ে থাকবে, ততদিন আমাদের মাঝে দেশপ্রেম জাগ্রত থাকবে। সেই তরল আবেগ আমাদের আছে বলেই বাংলাদেশি হিসেবে গর্ব করি। যে যুক্তি-বুদ্ধি মহান মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে আমাদেরকে উদাসীন করে দেয়, তা বুঝেশুনেই এড়িয়ে চলা উচিত। মুক্তিযুদ্ধকে তরল আবেগের বিষয় বলে আপনি সকল মুক্তিযোদ্ধাকে অপমান করেছেন।
ফেরদৌস হাসান আরো লিখেছেন, "মনে রাখতে হবে, এই ছবি একটি ফিকশন। শিল্পের কাজ বাস্তবকে অবিকল তুলে আনা নয়। তার কাজ বাস্তবতাকে শিল্পীর বিশ্বাসের ও চৈতন্যের আদল পুনর্নির্মাণ। ব্রেখট বলেছিলেন, শিল্প হচ্ছে সেই হাতুড়ি, যা দিয়ে শিল্পী পরিচিত, চলতি বাস্তবতাকে ভেঙে, দুমড়ে নতুন করে নির্মাণে সক্ষম। রুবাইয়াত হোসেন—এই ছবির পরিচালক—সেই কাজটাই করেছেন।"
- আপনার লেখা উপর্যুক্ত সব কথা মেনে নিতে পারলাম না। মেহেরজান একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের ছবি। শিল্পীর কাজ পুরনোকে দুমরে-মুচড়ে নতুন কিছু সৃষ্টি করা হলেও, ইতিহাসকে উল্টিয়ে দেবার নজির কোথাও নেই। আর একটি দেশের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসকে নিজের ইচ্ছেমতো করে কোনো ফিল্ম মেকার সৃষ্টি করতে পারেন না। বিভিন্ন দেশের মুক্তিসংগ্রাম, বিশ্বযুদ্ধ এবং নানা ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট নিয়ে অজস্র ছবি বিশ্বব্যাপি নির্মিত হয়েছে, কিন্তু কোথাও মেহেরজানের মতো করে ইতিহাসকে পাল্টে দেয়া হয়নি। বাস্তবতা ও নিয়ম ভাঙার জন্য শতশত বিষয় রয়েছে, মুক্তিযুদ্ধ সেই বিষয়ের মধ্যে পড়ে না। মেহেরজান ছবিতে সমকামী প্রেমের মুহুর্ত দেখে আপনি বেশ পুলকিত হয়েছেন। কিন্তু সমকামীতা মেনে নেওয়াকেই কী আধুনিকতা বলে? আমি বিশ্বাস করি না।
"মেহেরজান ছবির প্রধান ‘থিম’ দুটি। প্রথমত, একাত্তরে নারীর ভূমিকার যে পরিচিত ন্যারেটিভ, তাকে ঠোঙার মতো দলে-মুচড়ে ওয়েস্ট বাস্কেটে ছুড়ে ফেলা। দ্বিতীয়ত, ‘শত্রুকে’, যাকে এই ছবিতে বলা হয়েছে ‘দি আদার’, তাকে নতুন করে দেখা ও চেনা। এই দুটি ব্যাপারই আমাদের চিন্তাজগতে নতুন। তৃতীয় ‘থিম’, কিছুটা কৌতুকের সঙ্গে পরিবেশিত হলেও ভীষণ রকম নতুন, তা হলো নারীর ‘সেক্সুয়ালিটি’।"
- ফেরদৌস সাহেব মেহরজান ছবির তিনটি থীমের কথা বলেছেন। চাইলেই কী একাত্তরে নারীর ভূমিকার যে পরিচিত ন্যারেটিভ, তাকে ঠোঙার মতো দলে-মুচড়ে ওয়েস্ট বাস্কেটে ছুড়ে ফেলে দেওয়া যায়? জানি না একাত্তরে ফেরদৌস সাহেবের কোনো পরিচিত নারী ধর্ষিত হয়েছেন কীনা, বা ওনার পরিচিত কোনো পরিবারের কেউ শহীদ হয়েছেন কীনা। একাত্তরের সেইসব বীরমাতা এবং শহীদের পরিবারের লোকজনই জানেন, কতটা যণ্ত্রণা তারা বয়ে বেড়ান। সেই যন্ত্রণা মোটেই ঠোঙার মতো দলে-মুচড়ে ওয়েস্ট বাস্কেটে ছুড়ে ফেলে দেওয়া যায় না। তা করার অধিকার কারোরই নেই। একাত্তরে রাজাকার, আলবদর এবং পাকি শত্রুদের নতুন করে দেখতে ও চিনতে বলে আপনি কী বোঝাতে চেয়েছেন, তা আপনিই ভালো জানেন। ওদেরকে আমরা সব সময় একইরকম করে চিনি। ওরা এখনো বাংলাদেশকে মেনে নেয় নি, ভবিষ্যতেও মেনে নেবে তাও বিশ্বাস করি না। ওরা সর্বদাই বাংলাদেশ এবং এর জনগণের শত্রু। যেসব নতুন চিন্তা আমাদের দেশীয় চেতনার বিপক্ষে, তাকে স্বাগত জানানোর কিছু নেই। নতুন ভাবনা যদি ধংসাত্বক হয়, তাও কী মেনে নিতে হবে?? আর নারীর সেক্সুয়ালিটির প্রকাশও এদেশের ছবিতে নতুন কিছু নয়।
"নীলা, এই ছবির ‘বীরাঙ্গনা’, স্পষ্ট ভাষায় সে বলে দেয়, শত্রুর হাতে সে সম্ভ্রম হারিয়েছে বটে, কিন্তু নিজের নারীত্বের নারী হিসেবে নিজের মর্যাদার কিছুই সে হারায়নি। তারও আছে ভালোবাসার অধিকার, সংসার গড়ার সাধ।"
- এই বিষয়টিতেও নতুন কিছু নেই। একাত্তরের বীর মাতাদের কেউ মনে করেন না তাঁরা আত্মমর্যাদা হারিয়েছেন। যদি কেউ এমন ভেবে থাকেন, তবে তা কল্পনাপ্রসূত। কোনো বীরাঙ্গনা ভালোবাসার অধিকার কখনো হারায়নি, হারাবেও না।
ফেরদৌস সাহেব ঠিকই বলেছেন, "এই ছবি তো নিয়মভাঙার ইচ্ছা পূরণের গল্প"। আমাদের দেশের যে সকল নারী "আফ্রিদি, মেরি মি!" ধরনের মানসিকতা ধারন করেন নিজের ভেতর, তাদের ইচ্ছে পূরণের গল্প। মেহেরজান ছবির পরিচালক রুবায়েত হোসেনও সম্ভবত সেই মানসিকতা লালন করেন।তা তিনি ব্যক্তিগতভাবে পারেনও, কিন্তু একটি ছবির মাধ্যমে সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারেন না।
"উইলিয়াম স্টায়রনের সোফি’স চয়েস বা পল ভেরহভেন পরিচালিত চলচ্চিত্র ব্ল্যাক বুক-এর কথা ভাবুন (দুটোই ইহুদি মেয়ে ও নাৎসি সেনার প্রেমের গল্প)। অথবা ভাবুন লাইলি-মজনু বা রোমিও-জুলিয়েটের কথা।এর প্রতিটি ক্ষেত্রেই জয়ী হয় প্রেম, ঘৃণা নয়। মেহের-ওয়াসিমের প্রেম মোটেই অবাস্তব নয়, এমনকি যে ঘটনাক্রমে তা প্রকাশিত হয়, তা সংহত, বিশ্বাসযোগ্য ও সম্পূর্ণ মানবিক।"
- সোফি'স চয়েস বা ব্ল্যাক বুক ছবি দুটি কোনোটই বাংলাদেশের সংস্কৃতির সাথে উদাহরণ হিসেবে যায় না। লাইলি-মজনু এবং রোমিও-জুলয়েট দুটো উপাখ্যানই সাহিত্যের অমর সৃষ্টি। কিন্তু একাত্তর আমাদের কাছে কোনো কল্পনার গল্প নয়। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের অহংকার এবং দগদগে একটি ঘায়ের নাম। মেহের-ওয়াসিমের প্রেম অবশ্যই অবাস্তব, বিশ্বাসযোগ্য নয়, কিন্তু মানবিক। একাত্তরের প্রক্ষাপটে যতো শিক্ষিতই হোক, শত্রুসেনার দ্বারা ধর্ষিত বড়বোনের মতো জ্বলন্ত ঘা থাকতে সেই শত্রুদের কারো প্রেমে পড়ে লীলাখেলা করবে এতোটা স্বার্থপর ও জঘন্য নির্লজ্জ মানসিকতা বাংলাদেশের কোনো মেয়ের হতেই পারে না।
ফেরদৌস সাহেব, আপনার লেখা আর্টিকেলের বাকি অংশগুলো ভালো লেগেছে। তবে আপনার মতো একজন ব্যক্তির কাছ থেকে আমরা দায়িত্বপূর্ণ লেখা পড়তে চাই, নগ্ন পক্ষপাতমূলক কিছু নয়।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই মে, ২০১১ বিকাল ৫:০২

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



