খেলতে না গেলে আমার বিকেল কাটতো বাবার বইয়ের দোকানে। দুনিয়ার সব ভুলে রহস্য গল্পে ডুব দিতাম। কখনো কখনো দস্যু বনহুর আর তিন গোয়েন্দাও টানতো। তাই স্বাধীনতার পরে জন্মানো আর দশটা বাঙালি কিশোরের মতো হুমায়ূন আহমেদের বই পড়ে আমি পাঠক হইনি। এজন্য কিছু দু:খবোধ আছে আমার। এখন মনে হয়, হুমায়ূন আহমেদ পড়ে পাঠক হয়ে উঠলে মন আরও জোছনাভেজা হতো। বৃষ্টির মতো তরল হতো গভীর দু:খগুলো। কেন? সে কথায় একটু পর আসছি।
পাঠ্য বইয়ের বাইরে বেশি বিক্রি হতো হুমায়ূন আহমেদের বই। মেয়ে ক্রেতাই থাকতো বেশি। তাঁর লেখা পড়ার আগেই পরিচয় হয় বাকের ভাইয়ের সঙ্গে। আমার তখনো নাটক বোঝার বয়স হয় নি। আমাদের বাড়িতে সতের ইঞ্চি সাদাকালো একটা টেলিভিশন এসেছে তখন। সারা গ্রামের মানুষ ছুটে আসতো বাকের ভাইয়ের নাটক দেখার জন্য। বাকের ভাইয়ের ফাঁসি হবে কীনা, এ নিয়ে কী তুমুল উত্তেজনা! আমাদের বইয়ের দোকানের আড্ডায় চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে বাবার বন্ধুদের আলোচনার ঝড়। বাকের ভাইয়ের ফাঁসি হলে বিচারকের বিরুদ্ধে মিছিল হতেও দেখেছি। তাই বাকের ভাই ছিলেন আমার শৈশবের নায়ক। সেই বাকের ভাই যে কোনো রক্ত-মাংসের মানুষ নয়, তা এখনো বিশ্বাস হয় না আমার!
বছর দুই পরে আম্মা আমাকে নিয়ে ময়মনসিংহের ছায়াবাণী হলে ’শঙ্ক্ষনীল কারাগার’ ছবি দেখতে গিয়েছিলেন। হলে গিয়ে আম্মার সঙ্গে ওটাই ছিলো আমার প্রথম ছবি দেখা। সেই ছবিতে কারা অভিনয় করেছিলো, কী গল্প ছিলো তেমন মনে নেই। কিন্তু চোখ মুছতে মুছতে আম্মার সিনেমা হল থেকে বের হওয়ার মহাকাব্যিক দৃশ্যটা এখনো ভুলতে পারি নি। আম্মা কেঁদেছিলেন, তাই কেঁদেছিলাম আমিও। তখনও জানতাম না 'শঙ্ক্ষনীল কারাগার' হুমায়ূন স্যারের উপন্যাস।
একটু বড় হয়ে দেখেছি স্যারের নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র ’আগুনের পরশমনি।’ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে জানার আগ্রহ এই ছবি দেখেই তৈরি হয়েছে আমার। তারপর যেখানেই মুক্তিযুদ্ধের বই দেখেছি, পড়েছি। পাকিস্তানি হানাদার আর রাজাকারদের প্রতি তীব্র ঘৃণা জন্মে তখনই। আমার ভেতর দেশপ্রেম জাগিয়েছেন হুমায়ূন আহমেদ। আজ রবিবার নাটকটি দেখার জন্য সারা সপ্তাহ অপেক্ষা করতাম পরিবারের সবাই। তারপর সবুজ ছায়া নাটকটি যে আনন্দ দিয়েছে, তার তুল্য কিছু নেই।
এরপরও হুমায়ূন আহমেদ পড়ায় ভাটা পড়ে। তখন আমি ক্লাস নাইনে। জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহের জেলা পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় সুন্দর হাতের লেখা ও উপস্থিত বক্তৃতায় দ্বিতীয় হয়ে বেশ ক’টি বই পেয়েছিলাম। এর ভেতর ছিল হুমায়ূন স্যারের ’তোমাদের এই নগরে’ ও ’অপেক্ষা’ বই দুটিও। তোমাদের এই নগরে পড়ে খুব ভালো লাগে নি। এর মধ্যে এক বড় ভাই একদিন বললেন, ”কী পড়ো মিয়া! আখতারুজ্জামান ইলিয়াস পড়েছো? সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ?” আমি ওনার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকায় যা বোঝার বুঝে নিয়ে আবার বলেন, ”তাও পড়ো নাই? এই দুজনকে পড়ো। আর মজা পাইতে চাইলে সৈয়দ মুজতবা আলী পড়বা।” এই বলে হুমায়ূন আহমেদের বই দুটি সঙ্গে নিয়ে যান তিনি।!
ওনার কথামত হুমায়ূন আহমেদ পড়া বাদ দেই। এর মাঝে তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের কবি, সপ্তপদী আর বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের অরণ্যের দিনরাত্রি পড়ে এতোটাই মুগ্ধ হয়েছিলাম যে, পশ্চিম বাঙলার কথাসাহিত্যের প্রতি বিশেষ দুর্বলতা তৈরি হয়। এর আগেই পড়ে ফেলেছিলাম সমরেশ মজুমদারের 'মনের মতো মন।' ওই ঘোর কাটার আগেই হুমায়ূন স্যার শাওনকে বিয়ে করেন। স্যারের সাহিত্যের সঙ্গে দূরত্ব আরও বেড়ে যায় আমার।
আমি হুমায়ূন আহমেদ পড়া শুরু করি ২০০৭ সালে, হুমায়ূন স্যারের সঙ্গে দেখা হবার পর। তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। স্যারের সঙ্গে চারবার দেখা হয়েছে আমার। তাঁর বাসা দখিন হাওয়ায় প্রায় দুই ঘণ্টার আড্ডা হয়েছে একবার। সেসব রোমাঞ্চকর গল্প থাকবে দ্বিতীয় পর্বে।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



