আমার হুমায়ূন আহমেদ, পর্ব-২
রুহুল মাহফুজ জয়
আগে কয়েকটা বই পড়লেও আমি মূলত হুমায়ূন পাঠক হয়ে উঠি ২০০৭ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তৃতীয় বর্ষে পড়ি তখন। কবিতা লিখি। বিভিন্ন সাহিত্য আড্ডায় যাই। চেনাজানার দুনিয়াটা বড় হতে শুরু হতে যাচ্ছে কেবল। বড় সাহিত্যিকদের সঙ্গে পরিচয় হচ্ছিলো। বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে মাঝে মাঝে কবিতা ছাপা হয়। শরীরের রক্ত ব্যাপক গরম। চোখে অনেক স্বপ্নের আনাগোনা। একবার মনে হয় কবিতা নিয়েই থাকবো। আবার মনে হয় ফিল্ম-টিম বানাবো। কিন্তু তার আগেই বাংলাদেশে রেডিওর পুনর্জাগরণ ঘটাতে রেডিও টুডেতে যোগ দিয়েছি। কবিতা আর নানা রঙের স্বপ্ন নিয়ে দিন চলে যায়।
তখন সহপাঠী শিউলির সঙ্গে আমার তুমুল প্রেম। এই মেয়েটা হুমায়ূন আহমেদের ভক্ত। শিউলি আমাকে বলতো, ‘কবিতা লিখে নাম করা যায় না। উপন্যাস লিখতে পারো না?” আমি ওকে বলেছিলাম, “নাম করার জন্য আমি লেখালেখি করতে চাই না”। ২০০৫ সালে আমার জন্মদিনে শিউলি হুমায়ূন স্যারের বই ‘জোৎস্না ও জননীর গল্প’ উপহার দেয়। তখন কেন যেন পড়া হয় নি বইটা। ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে শিউলির সঙ্গে সম্পর্কটা কেটে যাবার পর সহসা মন খারাপ হলে ওর দেওয়া বস্তুগত জিনিসগুলো নাড়াচাড়া করতে করতে পড়তে শুরু করি বইটা। একটানে পড়েছি, নাওয়া-খাওয়া ভুলে। এভাবে আমি দুটি বই-ই পড়েছি এখন পর্যন্ত। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘দূরবীন’ ও হুমায়ূন আহমেদের ‘জোৎস্না ও জননীর গল্প’। এই বইটি পড়ে আমার ভেতর এমন এক তৃষ্ণার জন্ম দেয়, যেভাবেই হোক হুমায়ূন স্যারের দেখা পাওয়ার জন্য একটা আকুলতা তৈরি হয়।
ওই সময়েই আমার জীবনের সেরা সময়গুলো আসে। তখন বুবু’র ফ্যালকন টাওয়ারের বাসায় আনাগোনা বাড়তে থাকে। আমরা অনেক আড্ডা দেই। বেশিরভাগই মিডিয়া, নতুন কিছু করার আইডিয়া আর কবিতা নিয়ে। বুবুকে কখনো বলা হয় নি, আমার দেখা সবচে প্রতিভাধর নারী সে-ই। ও যদি লেখালেখিটা নিয়মিত করতো, তাহলে অনেক বড় কেউ হতো। এমনকী ওর অভিনয়, উপস্থাপনা আর পরিচালনার গুণও অসাধারণ। সংসারে মনোযোগ দিতে গিয়ে ওর আসলে তেমন কিছু হয়ে ওঠা হয় নি। বুবু হুমায়ূন স্যারের ভক্ত। ওর বাসায় হুমায়ূন আহমেদের নির্বাচিত গল্প বইটি পাই। ওর বাসাতেই শেষ করেছি পড়ে। স্যারের ছোটগল্প পড়ে মনে হয়েছে, কেউ যদি সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদকে মূল্যায়ন করতে চায়, তাঁর ছোটগল্পকার পরিচয়টা না আনলে অন্যায় হবে।
রেডিও টুডে থেকে ২০০৭ বইমেলা কভারের দায়িত্ব দেয়া হয় আমাকে আর আফরোজা সোমাকে। সোমা আমার কবিবন্ধু ও কলিগ। বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাচমেইটও। বইমেলা গিয়েই অন্যপ্রকাশের স্টলে গিয়ে খোঁজ নিতাম, হুমায়ূন স্যার এসেছেন কীনা। এক শুক্রবারে অন্যপ্রকাশের প্রধান নির্বাহী মাজহারুল ইসলাম আমাকে ফোন দিয়ে জানায়, “জয়, আজ স্যার মেলায় আসবেন। স্যারের ছোট একটা সাক্ষাৎকার নেবার ব্যবস্থা করে দেবো আমি। স্যার অন্যপ্রকাশের স্টলে বসবেন না। অন্যদিনের স্টলে বসবেন”। ২০০৭ বইমেলায় অন্যদিনের স্টল ছিলো আলাদা। বহেরাতলার পেছনের কোনায়, যেখানে গত তিন বছর ধরে মুক্তিযুদ্ধের বইয়ের স্টল হয়। বিকেল চারটায় হুমায়ূন স্যার আসলেন।
ভীড় বাড়ার আগেই আমি রেডিও টুডেতে লাইভ ইন্টারভিউ নেই। মাত্র দুইটা প্রশ্ন ছিলো। প্রথম প্রশ্ন: স্যার, আপনার বই কেনার জন্য হুড়োহুড়ি, আর অটোগ্রাফ নেয়ার জন্য দীর্ঘ সারি কতটা ভালো লাগে? স্যারের উত্তর, “আমি তো দেবতা না। মানুষ। তোমার কেমন লাগতো?” স্যারের এই প্রশ্নের জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। আমি বলি, “অনেক ভালো লাগতো”। স্যার বলেন, “আমারও ভালো লাগে। বেঁচে থাকা আবস্থায় খুব কম লেখকই পাঠকের এমন ভালোবাসা পান। এই বিষয়টি আমাকে বেশি আবেগতাড়িত করে”। দ্বিতীয় প্রশ্ন: স্যার, আপনার সৃষ্ট চরিত্রের মধ্যে প্রিয় কোনটি? স্যারের উত্তর, “পুরনো কথাই বলি। বাবার কাছে যদি প্রশ্ন করো, আপনার সন্তানদের মধ্যে প্রিয় কে? তার কোনো উত্তর হয়? হয় না। তারপরও বলি, মিসির আলীর প্রতি আমার আলাদা দুর্বলতা আছে”।
হুমায়ূন আহমেদ স্যারের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা। সেবার ওইটুকুই আলাপ হয়েছিলো। বইমেলায় আরও দু’বার দেখা হয়েছে। অল্প সময়ের জন্য। ব্যক্তি ও লেখক হুমায়ূনের ভক্ত হই তাঁর বাসায় ভূত, ভূতের অস্তিত্ব, ভূতের সাহিত্য ও স্যারের ভূত ভাবনা নিয়ে আড্ডা দেবার পর। তৃতীয় পর্বে থাকবে সেই আড্ডার বিস্তারিত।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



