তুই তো শালা ভুলে গেছিস, অনেক মৌজে আছিস মনে হয়। আজ কত্দিন হল একবার-ও এলিনা। সামনেও দেখিনা সে অনেকদিন। নিজেকে নিয়ে খুব ব্যাস্ত, তাই না ? হোবিই বা না কেনো ! তোকে কখনো এমন ভাবতেও পারিনি, অথচ তুই এমনই ছিলি, কাউকে বুঝতেও দিসনি। বড্ড স্বার্থপর-রে তুই। বন্ধু বলে চিৎকার করতিস, অথচ .. থাক তোকে আর আজ দোষ দেবনা।
দোস, তোকে কখনও বন্ধু বলে ডেকেছি কিনা সন্দেহ ! বন্ধু তো শুধু সম্পর্কের নাম বা তার চেয়েও বেশীকিছু। 'শালা' ডাকটা খুব কমন ছিল, তাই না ? তুই আসলেই একটা শালা ছিলি।
তোর যা মন, মনে আছে কিনা ! প্রথম পরিচয়, স্কুলের এসেম্বীলেতে “আমার সোনার ময়না, আমি তোমায় ভালবাসি” এই তোর জাতীয় সঙ্গীত! টিচারের কাছে নালিশ করতেই, কান ধরে এক পায়ে স্কুলের মাঠে আধ ঘন্টা ! পরে জেনেছিলাম ‘নীলা’র জন্য তোর এ গান !
বদলা নিতে চেয়েছিলি, পারিসনি, সারা রাত ভাইরাস জ্বর শরীরে কতবার বলেছি “তোকেও ভাইরাস ধরবে, তুই যা” “- ধরলে ধরুক;” ধরেওছিল তোকে, তখন পাশে থাকতে দেয়নি, অথচ আমরা কিন্তু পাশাপাশিই থাকতাম।
-নাম্বার ওয়ান ফাকিঁবাজ- তোর নাম পিছিয়ে দেবে, সাধ্য কি কারো ছিল? পড়া পারতিনা, কান ধরে বেঞ্চের উপর, সেদিন পড়া শিখেও পারিনি, শুরুটা তো সেখানেই। কি পেলাম, আর কি দিলাম আর তুই কি নিলি, কখনো তো বলিসনি, আর বলবিও-নে জানি !
প্রজাপতির দুটো রঙিন ডানা এনে দিলি, “কোথায় পেয়েছিস এগুলো ? ” “ -- বাগান থেকে ধরেছি” .. দশ কি বারো দিন তোর সাথেই কথাই বলিনি, দেখা তো দূরে থাক। সকালে বারান্দায়, একটা খাঁচায় দুটো হলুদ পাখি। তুই পেছনে দাড়িয়ে, খেয়াল করিনি। খাঁচাটা খুলে “ -- জানিস, পাখিরদুটোর একটা তুই আর একটা আমি”, দোস সেদিন তোর বুকের প্রশস্ততা টের পেয়েছিলাম, আজও ভুলতে পারিনি। হলুদ যে আমার প্রিয় রং সেটাও তুই জানতি।
দেখতে দেখতে বড় হলাম, তোর আগে গোফ উঠল, ছোট-ছোট কুচ-কুচে কাল। মহল্লার মোড়ে যে নাপিত বাবুর দোকান, চুরি করে গোফটা একবার ছেটেও এলি। ‘বুড়ো’ ‘বুড়ো’ বলে খেপালাম, ফলাফল; শুধু আমাকে রেহাই দিলি, বাকীদের অবস্থা ! সাত দিন কাসে অ্যাবসেন্ট।
‘প্রাইমারী’ - প্রায় মারামারি হত, তারপর ‘হাইস্কুল’ - হ্ইাটে তুই আমার চেয়ে এগিয়ে। নিতান্তই তোর কাধের নীচে মুন্ডুখানি রগরগে ঘাড়ে সোজা হয়ে উচ্চতা বাড়াতে চাইতাম। এরপর তো মিনিট তিরিশ ঝুলে থাকা নিয়মিত অভ্যেস হচ্ছিল, তখনই তোর পরামর্শে ‘গরু মোটা তাজাকরণ ট্যবলেট’ যোগাড়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম, ভাগ্যিস ... সেদিন বাবার মার খেলাম, নইলে এ জীবনের বাকীটা, গরু-ই হয়ে থাকতে হত !
‘অনুপা' - আমাকেই শুধু বলতিস, সাহস ছিলনা ওকে বলবার। কতবার যে বুকে ফু দিয়ে পাঠিয়েছি, এখন তো আর সেই সংখ্যাটা মনে নেই। তবুও পারতিনা। একবার .. “শালা ! ছাগল কোথাকার, প্রেম করবি অথচ বলবিনা, বুঝলি আর যাই হোকম তোকে দিয়ে আর এ প্রেম-ট্রেম কিচ্ছু হবেনা” কিছু বলতিনা, মাথা গুজে শুধু হাতে ঝুলে থাকা ক্যাসিও ঘড়িটার সময় দেখতি।
‘প্রদীপ স্যার’-এর কাথা মনে আছে তোর। স্যারের এমন একটা নাম দিলি, অভদ্র সমাজেও উচ্চারণ করা যাবেনা! স্যারের বাসার জানলার কাঁচ ভাঙ্গা, চেয়ারে চকের গুড়োতে কালো প্যান্টের পশ্চাতদেশে যে শিল্প অংকন, সবই তো তোর হাতের। স্যার সেবার যখন স্কুল থেকে বিদায় নিলেন, একটা গিফট্ কিনব বলে টাকা যোগাড় হচ্ছিল, টিফিনের জমানো টাকাগুলোর সবটাই দিলি। জানতাম, তুই-ই সবচেয়ে বেশী ভালবাসতি স্যারকে।
সেদিনের চুরি করে সিনেমা দেখে বাড়ী ফেরা, বাবার দেড় হাত শক্ত বেতের মার, ঘর পালানো - ভুলে গেছিস তুই? এইটা তোর মনে থাকবে, শেষ যেবার ঘর ছাড়লি, হন্তদন্ত হয়ে সবাই খুজছে, আমি নিশ্চিত তোর শেষ দৌড় কোথায়। রাতে তো সিঙ্গেল খাটে দুজনের সে কি গুতোগুতি, ঠেলাঠেলি ! জানিস, খাটের পায়াটা আজও নড়বড়ে।
স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে তখন কলেজে, সেবার কষ্টটা ছিল খুব বেশী। এই প্রথম তোকে ছেড়ে থাকতে হবে। তোর বাবার ট্রান্সফার। অবশ্য দুজনেই ঢাকাতেই। এলাকা তফাত দূর। তুই ভর্তি হলি এক কলেজে আমি অন্যটাতে। যোগাযোগ আগের মতনই ছিল, শুধু পাশাপাশি থাকা হলনা।
‘অনুপা'কে’ তখনও ভুলিসনি। মেয়েটা'কে বড় রহস্যময়ী লাগত, তোকে বলেছিলামও কতবার, তোর সরলতায় কখনো বারন করা হয়নি। শুধু বলেছিলাম, “কষ্ট পাবিনা? যদি চলে যায় ও” “ - - কষ্ট না হয় একবারই পাব, বেশী তো নয়”
তুই বলতি তোর হার্ট একটা আর হৃদয় আরেকটা। আমার ভেতর সেরকমটা কখনো অনুভব হলনা। “ --- হার্ট ফেল করলে তাতে কি? হৃদয়টাতো থাকবে !” কথা ছিল হৃদয়ের ভালবাসা, স্নেহ, মায়া, মমতাগুলো রেখে যাবি। সত্যি বলেছিলি সেদিন, হৃদয়টা এখনও আছে, নিতে পারিসনি তুই !
এই তো সেদিনের কথা, ছাদের কোনায় রেখে দেয়া তোর গীটারে টুং টাং সুর তোলা। তুই ভাল গাইতি তখন, পরে তো গানটাও ছাড়লি। মোড়ের চায়ের দোকানে তোর বাকী টাকা শোধে আমার পকেট প্রায় শূন্য, শুধু বলতি “ - - আগে চাকরী-টা পাই, সব শোধ করে দেব”, তুই কথা রাখিসনি, দোস, এখনও অনেক বাকী।
২০০৬ সন
ফয়সল তখন বি.কম শেষ করেছে মাত্র। ততদিনে পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী। নীলেেতর হুবহু কপি করবার দোকানের ক্যাশ বক্সের কড়কড়ে নোটের কচকচে শব্দে প্রায় গুন গুন করে কি গাইত। আমায় শুধু বলত “ - - বুঝলি, টাকাই সব, টাকা না হইলে জীবনটা ..” থামিয়ে দিতাম “আগে বলতো! টাকা আগে? না, জীবন ? ” কিচ্ছু বলতনা !
রাত তখন দুটোর’ও কিছু বেশী, আমার মাষ্টার্স চলছিল, মাত্র শুয়েছিলাম, সেলফোনটা বাজতেই, দেখি ফয়সলের ফোন ..
“ কিরে শালা, কি খবর.. এত রাতে ..”
.........................
“ ওই, কথা বলছিসনে ক্যান”
--- দোস্ত !!!
.......................
“কি হইছে ? ”
“তাড়াতাড়ি বল, কাল পরীক্ষা একটু ঘুমাইতে হইবো”
--- দোস্ত, আমি পয়জন খাইছি !
“কিরে শালা, ফাইজলামী মারার আর টাইম পাওনাই !”
“ওই শালা, আজ কয় গ্লাস টানছস ? ”
--- না রে, দোস্ত সত্যি
“শোন, পাগলামী করিসনে, যা খাইছিস . খাইছিস”
“এইবার একটু ঘুমা, সব ঠিক হয়ে যাইবো”
“আর শোন, কাল নীলতে যামু, কিছু নোট কপি করতে হইবো”
হাইস্কুলে থাকতেই সিগারেটটা ধরেছিল, অনেক চেষ্টা করেছিলাম, ছাড়েনি আর ছাড়াতেও পারিনি। উন্নতি হল। এবার ড্রিংকস্। মাঝে মাঝেই খেত। এটা জানি, তাও প্রায় বছর খানিক হল। তাই ওর মাতলামী স্বভাবটার সাথে প্রায় অভ্যস্ত। আজও তাই মনে হল। হয়ত একটু বেশীই টেনে ফেলেছে, আর এখন মাতলামী করছে।
আকাশে মেঘ ছিল, সাথে বৃষ্টি। পরদিন পরীক্ষা শেষে, নীলেক্ষেতে ওকে দোকানেই পেলাম ...
“কিরে, কুইচ্চা মুরগীর মত ডিমে তা দিচ্ছিস কেন?”
--- না দোস্ত, কিচ্ছুনা, এই তো ...
“চল, আগে চা খেয়ে আসি, মাথাটা ধইরা গেছে”
.........................................................
“আর এভাবে কতদিন, ওইসব ছাইপাশ এবার ছাড়”
“বললাম, একটা বিয়ে করে ফেল, না সেই অনুপা আর অনুপা”
“বলেছিলাম না? একটু ভাব, ভাবলি না তো !”
“হলো এখন, মেয়েটা তো সুখেই আছে”
“নতুন জামাই, নতুন ঘর”
“আর তুই, সারা রাত মদ টেনে, সকালে কুইচ্চা মুরগীর মত ঝিমানি”
“আর কি সব আলতু-ফালতু, --পয়জন খাইছি---”
“কিরে, কিছু বলছিসনে ক্যান”
........................
“চল, কাজটা সেরে নিই, আজ তাড়াতাড়ি বাসায় যাব”
রাত সোয়া এক’টা। এত তাড়াতাড়ি কোনদিন শোয়া হয়না। সেদিন কান্ত ছিলাম বেশ। মা নিজেই ফোনটা ধরলেন।
‘ফয়সলের বাসা থেকে ফোন এসেছে, তোমাকে খুজছে’
মায়ের কথায় আমার ভেতরটা তখন তোলপাড়, ফয়সলের বাসা কেন হবে? ফয়সল কোথায় ...
---- ---- ---- ---- ---- ---- ---- ---- ---- ---- ---- ---- ---- ----
রাত সাড়ে বারোটারও পর, বুকের জ্বালাপোড়ায় ছটফট করেছিল, দম বন্ধ হয়ে আসছিল। হাসপাতালে নিতে পারেনি, ততনে সব শেষ হয়ে যায়।
চারিদিকে কান্না, আমি নির্বাক তখন, নিথর ওর দেহটার পাশে।
---- ----
ফয়সল চলে গেছে আর বছর তিন হল। দোস্ত বোলে, মাতলামী, যত সব পাগলামী করার এখনটি আর কেউ নেই। ওদের নীলেেতর দোকানটা এখনও আছে। মাঝে মাঝেই যায়, কিছুটা সময় কাটিয়ে আসি।
মায়াগুলো আজ মলীন, আবেগ-টা হিসেবের কারসাজিতে শূন্যের কোঠায়, আর চোখের জল-ড্রামা মুভী’তে কেঁদে ফেলি ঠিকই, অথচ তোর জন্য না, কতটা হিসেবি হয়েছি, দেখছিস।
তোর জন্য যা রেখেছিলাম, আজও কাউকে দিতে পারিনি, গলে-পচে-শুকিয়ে নষ্ট হয়েছে, ভাবছি মমি করে রাখব, যা পারিনি তোকে করে রাখতে।
আজ এ বন্ধু দিবসে সবাইকে বা কাউকে কাউকে শুভেচ্ছা জানাতে ভুল করি
সেলফোনের ইনবক্সে আনরিড উইশ ম্যাসেজগুলো না পড়েই যখন ডিলিট করি, তখন, খুব মনে পড়ে-রে দোস তোকে !
প্রথম মেসেজটা তোর থাকবেই, তুই বরাবরই জিততিস, আমি হারতাম
অথচ জীবনের কাছে আজ তুই হারলি, আর আমি মাঝামাঝি !
জানিস দোস, সেদিনের পর থেকে আমি কত সিরিয়াস, বাবার ওষুধের কথা আর ভুলিনা, মায়ের ডাক্তারী চেকাপ-ডায়েরীতে নোট করে রাখি, টেস্টিমোনিয়াল লেটারে --হাইলি সিনসিয়ার--, চাকরীর এসিআর ফরমে-সিনসিয়ারিটি--তে ‘গ্রেড এ-প্লাস’, কায়েন্ট সাপোর্টে বেষ্ট টিম মেম্বার, এবার ডাবল প্রমোশন হল। সব তুই শিখিয়ে দিয়ে গিলি। সবটাই তোর !
আজও একটা অপরাধবোধে নিজেকে ক্ষমা করতে পারিনি, ও কি পেরেছিল ? জানা হয়নি। সেদিন যদি আমি সিরিয়াস হতাম, হয়ত ওর মৃত্যুটা ঠেকাতে পারতাম। ওর কাধে হাত রেখে এখনও বলতে পারতাম
“কিরে, শালা, কাপুরুষ কোথাকার, মরে বীর হতে গিছিলি, মরলে বুঝতিস!”
..............................................
“দোস, তুই একটা কথা দে, কোনদিন ক্ষমা করিস না-রে, আমাকে শাস্তি পেতে দে, কোনদিনও ক্ষমা করবিনা কিন্তু ! ওই জীবনেও না !”
“ভাল থাকিস তুই !”
উৎসর্গ : আমার বন্ধু, কলিগ, বড় ভাই, উপদেশদাতা, পরামর্শদাতা - সাইফুর
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা আগস্ট, ২০০৯ দুপুর ২:২৯