বিশ্বদরবারে জাতি হিসেবে খুব বেশী গর্ব করার মতো তেমন কিছু আমরা আজও করতে পেরেছি বলে আমার মনে হয় না। এখনো অনেক দেশের মানুষ বাংলাদেশী বা বাংলাদেশকে ভালোভাবে চেনেননা। যারাও চেনেন, তাদের কাছে আমাদের ইমেজ ততটা আশানুরূপ নয়। তার সবচেয়ে বড় কারণ বিভিন্ন আর্ন্তজাতিক পর্যায়ে আমাদের অর্জন খুবই কম, হোক সেটা একাডেমিক বা প্রফেশনালি। দেশের বাইরে এসে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন মানুষের সাথে কথা বলার পর আমার বারবারই মনে হয়েছে ১৬/১৭ কোটি মানুষের বাংলাদেশে আরো অনেক বেশী আর্ন্তজাতিক যোগ্যতা সম্পন্ন লোক থাকা উচিত ছিলো। আরো অনেক বেশী সফল, শিক্ষিত প্রবাসী বাংলাদেশী থাকা উচিত ছিলো। যারা দেশকে প্রবাসের মাটিতে আরো অনেক বেশী উচ্চতায় নিজে যেতে পারেন।
আমেরিকায় বিগত ১০/১২ বছরেও আমি হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া তেমন কোন উচ্চ শিক্ষিত, প্রফেশনাল প্রবাসী বাংলাদেশী দেখিনি। পুরো আমেরিকায় খুব সম্ভবত নিউ ইয়র্কেই সবচেয়ে বেশী বাংলাদেশী বংশোদ্ভুত লোকজন বসবাস করেন, সেখানেই যদি এমন অবস্থা হয়, তাহলে আমেরিকার অন্যান্যা রাজ্যের অবস্থা যে আরো নাজুক, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অথচ আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ, ভারত তথা ভারতীয়দের অবস্থান আমেরিকায় বেশ রমরমা। আমার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে কর্মক্ষেত্রে সব জায়গায় তাদের সফল পদচারণা বিশেষভাবে লক্ষণীয়।
আনুপাতিক হারে বলতে গেলেও ভারতীয়রা আমাদের চেয়ে অনেক অনেক বেশী শিক্ষিত জনগোষ্ঠী হিসেবে নিজেদেরকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রতিষ্ঠিত করেছে বা করতে পেরেছে। খোদ আমেরিকায়, মাইক্রোসফট এবং গুগল এর মতো শক্তিধর কোম্পানীর সিইও হয়ে বসে আছে এরা। ইমিগ্র্যান্টদের মধ্যে ভারতীয়দের পারিবারিক আয় সবচেয়ে বেশী আর শিক্ষার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি।
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার ভঙ্গুর দশা, ধর্মীয়-সামাজিক রাীতি নীতি, আচরণ সবদিক থেকেই আমরা বিশ্বের অনেক দেশ থেকেই পিছিয়ে আছি। ঠিক কতটা পিছিয়ে আছি তা হয়তো প্রবাসে দীর্ঘদিন অবস্থান করলেই টের পাওয়া যাবে। আর এসব কারণেই মূলত, প্রবাসে সমাজের উচুঁ কাতারে খুব বেশী বাংলাদেশীদের দেখা পাওয়া যায় না।
ছোট্ট একটা গল্প বলি, গতবছর বাবার হঠাৎ অসুস্থতার কথা শুনে যখন বাংলাদেশে যাচ্ছি তখন আমার ট্রানজিট ছিলো ফ্রান্কফুর্ট আর সিংগাপুর। হঠাৎ টিকিট কেনার কারনে খুব বেশী অপশন হাতে ছিলোনা, অগত্যা সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের টিকিট কাটতে হলো। যাইহোক, নিই-ইয়র্ক থেকে ফ্রান্কফুর্ট হয়ে সিঙ্গাপুর পর্যন্ত যাত্রাটা বেশ ভালোই ছিলো কিন্তু ঢাকার ফ্লাইটে কর্মরত এ্যাটেন্ড্যান্টদের আচরণ আমার কাছে বেশ খারাপ মনে হয়েছে। চেঙ্গি থেকে ঢাকা আসার পথের বিমানে বেশীর ভাগ যাত্রীই ছিলো সিঙ্গাপুরে কর্মরত বাংলাদেশী শ্রমিক ভাইয়েরা। যিনি আমার পাশের সিটে বসেছিলেন, তিনিও তেমনি একজন। পুরোটা পথে তার জীবনের গল্প শুনে চোখের পানি ধরে রাখা কঠিন ছিলো। ঢাকায় এসে বিমান থেকে নামার আগে এ্যাটেন্ড্যান্টদের বিদায় জানানোর তেমন একটা গরজ বা উৎসাহ দেখা গেলোনা। তারা শুধু গেটের কাছে দাঁড়িয়ে ছিলো, না কোন বিদায়ী সম্ভাষণ না আবার তাদের সাথে ফ্লাই করার অনুরোধ। ব্যাপারটা আমার কাছে রীতিমত অভদ্রতা বলেই মনে হলো।
ফিরে আসার সময়ও প্রায় একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। আগের বাজে অভিজ্ঞতার কারণে আমি টিকিট কেটেছিলাম টার্কিশ এয়ারে। ঠিক আগের মতোই বেশীর ভাগ যাত্রী বাংলাদেশী। ইস্টাম্বুলে নামার আগে যখন খাবার দেয়া হলো, তখন এ্যাটেন্ড্যান্টকে ধন্যবাদ জানিয়ে খেতে শুরু করবো, ঠিক তখনই এ্যাটেন্ড্যান্ট আমাকে বললেন,"পুরো বিমানে শুধু আপনিই আমাকে যতবার খাবার পরিবেশন করেছি, ততবারই ধন্যবাদ জানিয়েছেন, আর কেউ জানায় নি"। সত্য-মিথ্যা জানিনা তবে আমার কাছে ব্যাপারটা বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি। তবে আমার পাশের সিটের বাংলাদেশী লোকটা যখন এই কথা শোনার পরেও এ্যাটেন্ড্যান্টকে ধন্যবাদ বলেনি, তখন আর বিশ্বাস না করে উপায় ছিলোনা। ব্যাপারগুলো ভেবে দেখার মতো।
আমার সমসাময়িক আমেরিকায় ইমিগ্র্যান্ট হওয়া ১২-১৫ জনের মধ্যে একজনও নেই, যে পরবর্তী সময়ে এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করতে পেরেছে। ২-১ জন অনেক চেষ্টা করে ভর্তি হতে পারলেও মূল কোর্সে ঢুকতে পারেন নি শুধু ইংরেজীতে দুর্বল হওয়ার কারনে, ২-৩ জন আছেন যারা পড়াশোনা শুরু করেও মাঝপথে ছেড়ে দিয়েছিলেন, শুধুমাত্র দেশে গিয়ে বিয়ে করার তাগিদে। হাতে কাচা টাকা আসলে চ্যাংড়া পোলাপাইনদের যা হয় আর কি। কেউই শেষ পর্যন্ত আর পড়াশোনার পথ মাড়াননি। সবাইকে এক কাতারে দাঁড় করানো যায় না জানি, তবে এই রকম ব্যর্থতার কাহিনী অনেক জেনেছি।
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার, আচার-আচরণ, মন-মানসিকতার আমূল পরিবর্তন না হলে এই অন্ধকার অচিরেই কাটছেনা।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা ফেব্রুয়ারি, ২০২০ দুপুর ২:১৬