যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ
শামছুদ্দীন আহমেদ: অতীতের রাজনৈতিক সরকারগুলোর সঙ্গে বর্তমান বিশেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের তাৎপর্যপূর্ণ বা মৌলিক পার্থক্য কী? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বিচার-বিশ্লেষণ করে বিশ্লেষকরা বলছেন, গুণগত বা মৌলিক তেমন কোনো তফাৎ নেই। বর্তমান সরকারও পুরনো ধাঁচের আচরণই চর্চা করছে। রাজনৈতিক সরকারগুলোর বিরুদ্ধে মোটা দাগে ক্ষমতার অপব্যবহারের যেসব অভিযোগ করা হতো, তুলনামূলক বিচারে এই সরকারও সেসব অভিযোগমুক্ত নয়। প্রশাসনিক ক্ষমতার অপব্যবহার ও রাষ্ট্রীয় অর্থ অপচয়ের যোগ-বিয়োগের ফলাফলে দেখা যায়, অভিযোগের পাল্লার ব্যবধান খুব বেশি এদিক-ওদিক নয়। বরং কোনো কোনো অনিয়মের ক্ষেত্রে এই সরকার অতীতের রাজনৈতিক সরকারগুলোকেও হার মানিয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, বিশেষ করে বিগত চারদলীয় জোট সরকারের সময় একটি প্রতিষ্ঠিত অভিযোগ ছিলÑ ক্ষমতার কেন্দ্র একাধিক। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের প্রায় সমান্তরালে সরকার ও প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করতো ‘হাওয়া ভবন’। ড. ফখরুদ্দীন আহমদের সরকারেরও শুরু থেকেই ক্ষমতার একাধিক কেন্দ্র বা উৎস পরিলক্ষিত ও অনুভূত হয়েছে। এর ফলে গত ২২ মাসে অসংখ্য ইসুতে প্রশ্ন উঠেছেÑ আসলে সরকার চালাচ্ছে কে?
অতীতের সরকারগুলোর বিরুদ্ধে একটি সাধারণ অভিযোগ ছিল, তারা মন্ত্রিসভায় ও প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো আত্মীয় বা দলীয়করণ করতো। বর্তমান উপদেষ্টা পরিষদেও স্পষ্ট দেখা যায়, বেশ ক’জন একে অপরের নিকটাত্মীয়। তাদের কারোই ব্যক্তিগত যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন না থাকলেও কথা উঠেছেÑ তাদেরকেই নিতে হলো কেন। দেশে আর কাউকেই খুঁজে পাওয়া যায়নি?
সরকারের অযাচিত ও বেআইনি হস্তক্ষেপের কারণেই রাজনৈতিক সরকারগুলোর আমলে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে পৃথক করার দাবি উঠেছিল। দাবি অনুযায়ী এই সরকারের আমলে বিচার বিভাগ পৃথককরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়। কিন্তু এখনকার বাস্তবতার দিকে তাকালে সহজেই অনুমান করা যায়Ñ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ সরকারের পক্ষে, নিু আদালত আগের চেয়েও সরকারের বেশি নিয়ন্ত্রণে। কেবলমাত্র হাইকোর্ট বিভাগ অনেকটাই সরকারের নিয়ন্ত্রণমুক্ত। শীর্ষ দুই নেত্রীসহ অনেক রাজনীতিক, ব্যবসায়ী ও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী অন্যদের তুলনায় এবার তা স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করার সুযোগ পেয়েছেন। তারা বুঝেছেন, বিচার এবং আইন ও নিয়ম-নীতি নিজস্ব স্বাভাবিক গতিতে চলেনি। এই পরিস্থিতি স্বাধীন বিচার বিভাগের সংজ্ঞাকেই হাস্যকর করে তুলেছে।
ওয়ান ইলেভেনের আগেরদিন পর্যন্ত রাজনৈতিক সরকারগুলোর বিরুদ্ধে আরেকটি বড় অভিযোগ ছিল, তারা নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) নিয়ন্ত্রণ করতো, নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে কমিশনকে যেমন খুশি ব্যবহার করতো। এ কারণে ইসিকেও নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা করার দাবি দীর্ঘদিনের। জনগণের দাবি আমলে নিয়ে এই সরকারের আমলে পুনর্গঠিত হয় ইসি। কিন্তু কয়েকদিন যেতে না যেতেই প্রতীয়মান হয়, এই ইসিও সরকার বা বিশেষ কোনো মহলের এজেন্ডা বাস্তবায়নে সহযোগী হিসেবে কাজ করছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপিকে প্রথমে সংলাপের আমন্ত্রণ না জানানো এবং পরে খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনকে চিঠি দেয়া প্রসঙ্গে খোদ সিইসি ড. এটিএম শামসুল হুদা বলেছিলেন ‘আগে আমাদের অন্য একটি উদ্দেশ্য ছিল। এ কারণেই প্রথমে হাফিজ সাহেবকে চিঠি দেয়া হয়েছিল’।
প্রেস ফ্রিডমের ক্ষেত্রে এই সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ আরো গুরুতর। প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য নির্দেশে মিডিয়া নিয়ন্ত্রণের প্রতিযোগিতায় এই সরকার রাজনৈতিক সরকারগুলোকেও ছাড়িয়ে গেছে। বিভিন্ন টিভি টক-শো বন্ধ করা, টক-শো’র অতিথি নির্ধারণ করে দেয়া, প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার বিভিন্ন সংবাদ প্রচার-প্রকাশে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করার ক্ষেত্রে এই সরকারের জুড়ি ছিল না। রাজনৈতিক সরকারের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের মতো বর্তমান উপদেষ্টাদেরও অনেকের মিডিয়া প্রচারপ্রীতি দৃশ্যমান। বিটিভিসহ বিভিন্ন চ্যানেলের খবরের বেশিরভাগ সময়ই থাকে উপদেষ্টাদের দখলে।
ক্ষমতার বলয়ে থাকা দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান হাসান মশহুদ চৌধূরীর বিরুদ্ধে থানা মামলা না নেয়ায়ও প্রশ্ন উঠেছে। রাজনৈতিক সরকারগুলোর আমলে যেমন ক্ষমতাসীনদের বা তাদের দলীয় নেতাকর্মী ও আত্মীয়-স্বজনের বিরুদ্ধে পুলিশ মামলা নেয়ার সাহস করতো না, সেই একই আচরণ এবার দেখা গেল দুদক চেয়ারম্যানের ক্ষেত্রে। কথা উঠেছেÑ তাহলে কি পুলিশ এখনো স্বাধীন নয়?
বিগত চারদলীয় জোট সরকারসহ অতীতের সবগুলো সরকারের প্রধানমন্ত্রী কিংবা মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় অর্থ অপচয় করে ঘন ঘন বিদেশ সফরের অভিযোগ উঠতো হরহামেশা। বর্তমান সরকারের প্রধান উপদেষ্টাসহ কয়েক উপদেষ্টাও বিদেশ সফরের ক্ষেত্রে ইতোমধ্যে রেকর্ড করেছেন। রাজনৈতিক সরকারের অনেক মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা মন্ত্রণালয়ের নির্দিষ্ট গাড়ি ছাড়াও মন্ত্রণালয়াধীন বিভিন্ন প্রকল্পের একাধিক বিলাসবহুল গাড়ি ব্যবহার করতেন। বর্তমান সরকারেরও কোনো কোনো উপদেষ্টা নিয়ম বহির্ভূতভাবে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়াধীন প্রকল্পের একাধিক গাড়ি ব্যবহার করেছেন।
প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ে পদোন্নতির ক্ষেত্রে এই সরকারের আমলেও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ উঠেছে। পদোন্নতি ও পদায়নের ক্ষেত্রে আগে যেভাবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় বা ক্ষমতার বিকল্প কেন্দ্র থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হতো, এখনো একইভাবে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়সহ ক্ষমতার বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে বিশেষ নির্দেশনা দেয়ার অভিযোগ শোনা যায়। কিন্তু প্রশাসনে স্বচ্ছতা বজায় থাকলে, এই পদোন্নতি ও পদায়নের কাজটি সংস্থাপন মন্ত্রণালয়েরই করার কথা।
এই সরকারের দুর্নীতি বিরোধী অভিযান পরিচালনার ক্ষেত্রেও নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। সন্দেহভাজন দুর্নীতিবাজ হিসেবে তালিকায় নাম থাকার পরও বড় মাপের অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কোনো আইনি ব্যবস্থা না নেয়ার বিষয়টি জনগণের চোখ এড়ায়নি। দুদক চেয়ারম্যান একবার বলেছিলেন, ‘মনের জোর থাকলে এবং নিজেদের সৎ দাবি করতে চাইলে উপদেষ্টাদেরও স্বেচ্ছায় সম্পদের হিসাব দেয়া উচিৎ। দুদক নিজ থেকে সম্পদের হিসাব চেয়ে কোনো উপদেষ্টাকে বিব্রত করতে চায় না’। কিন্তু কোনো উপদেষ্টাই সততার জোরে বিবেকের সাহস ও স্বচ্ছতা দেখাতে পারেননি। অথচ এই হিসাব দিয়ে বা না দেয়ার কারণে অনেক প্রভাবশালী ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে আইনের মুখোমুখি হতে হয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, রাজনৈতিক সরকারগুলোর আমলের মতো বর্তমানেও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে দেশে-বিদেশে কাউকে কাউকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নিয়োগটি যৌক্তিক হলেও রাষ্ট্রদূত হিসেবে মালদ্বীপে সেলিনা মোহসীন ও পাকিস্তানে য়াসমীন মুর্শেদকে কী এমন জাতীয় স্বার্থে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়েছে তা স্পষ্ট নয়।
এছাড়া বিশেষ বিশেষ বা ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিকে ছাড় দেয়ার ক্ষেত্রেও বর্তমান সরকারের আচরণ রাজনৈতিক সরকারগুলোর মতোই। যেমন, এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সহ-সভাপতি মোহাম্মদ আলীর ব্যাংক ঋণের মোটা অংকের সুদ মওকুফ করে দেয়া হলেও অন্য অনেককেই আরো অনেক কম ঋণের স্বল্প সুদ পরিশোধ না করার কারণে বিচারের মুখোমুখি হতে হয়েছে। ডিওএইচএস ও সাধারণ জনগণের জন্য দুই ধরনের বিধানের বিষয়টিও মানুষের চোখে সম্প্রতি ধরা পড়েছে। ডিওএইচএস’র প্লটপ্রাপ্তরা কিছু টাকা জরিমানা দিয়ে বড় অন্যায় থেকে রেহাই পেয়ে যাচ্ছেন। অথচ একই অপরাধে সাধারণ নাগরিকদের বড় শাস্তি মাথা পেতে নিতে হচ্ছে। অভিযোগ উঠেছে, এই ডিওএইচএস’র প্লট দেয়া-নেয়া এবং ইমারত নির্মাণকে কেন্দ্র করেও একটি দুর্নীতি চক্র দাঁড়িয়ে গেছে। বিশ্লেষকদের দাবি, এভাবে একে একে খতিয়ে দেখলে বর্তমান সরকারের আরো অনেক অনিয়ম বের হয়ে আসতে পারে। সম্পাদনা: হুমায়ুন কবির খোকন
Click This Link