
সেই ছোটবেলায় আমার বাড়ির কাছেই একটা বুনো ঝোপঝাড়ে ঠাসা জায়গা ছিলো। একটি দুটি পুরনো কবর থাকায় জঙ্গলে ছাওয়া এলাকাটায় দিনে দুপুরে যেতেই গা ছমছম করতো। সেখানে বাস করতো এলাকার শেষ কয়েকটি বেঁচে থাকা শেয়াল আর বেজী। সেই ঝোপঝাড়ের মাঝে ছিলো দুটি সোনালু গাছ। আমরা তাকে বলতাম "বান্দর লাঠি" গাছ। যখন বছরের একটা সময় গাছ গুলিতে হলদে ফুলে ছেয়ে যেতো তখন দূর থেকে দেখতাম, ঝোপঝাড় পেরিয়ে গাছের কাছে গিয়ে ফুল আনার সাহস হতো না কখনো। এখন আর সেই দিন নেই, সেই ঝোপঝাড় নেই, গাছ নেই, ফুল নেই। গাছের জায়গা দখল করে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বহুতল ভবন। সেই সোনালুর মুগ্ধতায় বিভোর হয়ে আমার বারান্দার একটি টবে সোনালুর একটি চাড়া করেছিলাম। বছরের পর বছর সেটিকে লালন করলেও ফুল ফোটাতে পারি নাই।

সোনালু
অন্যান্য ও আঞ্চলিক নাম : বাঁদর লাঠি, বান্দর লাঠি, বানরনড়ী, রাখালনড়ী, কানাইনড়ি, সোদাল, সোনাইল, সোনারু।
সংস্কৃত নাম : আরগ্বধ, অমলতাস, আরোগ্যশিম্বী, কুণ্ডল, কৃতমালক, কর্ণিকার, কর্ণী, কলিঘাত, চতুরঙ্গুল, দীর্ঘফল, নৃপদ্রুম, প্রগ্রহ, ব্যাধিঘাত, রাজবৃক্ষ, শম্পাক, স্বর্ণাঙ্গ, হেমপুষ্প।
Common Name : Golden shower, purging cassia, Indian laburnum, purging cassia.
Scientific Name : Cassia fistula
আয়ুর্বেদে সোনালু গাছটিকে "আরগ্বধ" বলা হয়, যার অর্থ "রোগ নাশক"।

শুনতে পাই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই ফুলের নাম দিয়েছিলেন "অমলতাস"। আমার চোখে এখনো তাঁর কোনো কবিতায় বা গানে সোনালুর উল্লেখ পাইনি। আছে হয়তো, আমার পড়ার দৌড় কম বলে চোখ এড়িয়ে গেছে। তবে কাজী নজরুল ইসলাম তার অনেকগুলি কবিতায় সোনালু ফুলকে "সোনাল" নামে উল্লেখ করেছেন।
আমি ময়নামতীর শাড়ি দেবো, চলো আমার বাড়ি
ওগো ভিনগেরামের নারী
তোরে সোনাল ফুলের বাজু দেবো চুড়ি বেলোয়ারি।।
তোরে বৈঁচী ফুলের পৈঁচী দেবো কলমিলতার বালা,
রক্ত-শালুক দিবো পায়ে, পরবে আলতা তা'রি।।
হলুদ-চাঁপার বরণ কন্যা এসো আমার নায়
সরষে ফুলের সোনার রেণু মাখাবো ওই গায়!
ঠোঁটে দিবো রাঙা পলাশ মহুয়া ফুলের মউ,
বকুল-ডালে ডাকবে পাখি, 'বউ গো কথা কও!'
আমি সব দিবো গো, যা পারি আর যা দিতে না পারি।।
----- কাজী নজরুল ইসলাম -----
দোল ফাগুনের দোল লেগেছে, আমের বোলে দোলন-চাঁপায়।
মৌমাছিরা পলাশ-ফুলের গেলাশ ভরে মউ পিয়ে যায়।।
শ্যামল পাতার কোলে কোলে
আবির-রাঙা কুসুম দোলে,
দোয়েল শ্যামা লহর তোলে কৃষ্ণচূড়ার ফুলেল শাখায়।।
বন-গোপিনী ফুল ছুঁড়ে ঐ খেলে হোরী দখিন-বায়ে,
হলদে পাখি দোদুল দুলে সোনাল শাখায় আদুল গায়ে।
ভাঁট-ফুলের ঐ নাট-দেউলে
রঙিন প্রজাপতি দুলে,
মন ছুটে যায় দূর গোকুলে, বৃন্দাবনে প্রেম যমুনায়।।
----- কাজী নজরুল ইসলাম -----

সোনালু ভারতীয় উপমহাদেশ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি স্থানীয় শোভাময় বৃক্ষ। হাজার বছর আগেও সোনালু গাছ আমাদের উপমহাদেশে ছিল। এর আদি নিবাস হলো ভারত, মিয়ানমার ও বাংলাদেশ। এটি তার অসাধারণ উজ্জ্বল হলুদ ফুলের জন্য সকলের নজর কাড়ে। আগে গ্রামের বনে, পথের ধারে প্রাকৃতিক ভাবেই জন্মাতো এই ফুলগাছটি। তবে এখন গ্রামের প্রকৃতিতে এর উপস্থিতি অনেকটাই কমে গেলেও মহাসড়কের ধারে, সৌখিন বাগানে, পার্কে পরিকল্পিত ভাবে রোপন করা হচ্ছে এই সোনালু গাছ। সোনালু বা বাঁদর লাঠি গাছ সাধারণত ১৫ থেকে ২০মিটার উঁচু হয়ে থাকে।
সোনালু গাছের পাতা হালকা সবুজ। এরা পত্র ঝরা বৃক্ষ, শীতে গাছের সমস্ত পাতা ঝরে গিয়ে গাছটি হয়ে যায় পত্র শূন্য। বসন্তের শেষে গাছের ডালে ডালে ফুলের কলি আসার আগে আগে গাছে নতুন পাতা গজায়। গ্রীষ্মে গাছের শাখা-প্রশাখা জুড়ে ঝুলন্ত পুষ্পমঞ্জুরিতে সোনালী হলুদ রঙের ফুল ফুটে এবং এর ব্যাপ্তি থাকে গ্রীষ্ম কালের পুরোটা সময় জুড়ে।
সোনাল ফুলের পাঁপড়ি পাঁচটি, ফুলের ঠিক মাঝখানে পরাগদন্ড থাকে। এই পাঁচ পাপড়ি বিশিষ্ট ফুল তার পুষ্পমঞ্জুরি সহ একটি উজ্জ্বল হলুদ ঝারবাতির মতো ঝুলে থাকে গাছের ডালে। মৌমাছি, প্রজাপতি এবং ছোট ছোট পাখিরা ছুটে আছে ফুলের মধুর টানে। আর প্রকৃতি প্রেমি মানুষের দৃষ্টি আটকে থাকে সোনালুর স্বর্ণালী আভায়।

নতুন পাতার নূপুর বাজে দখিনা বায়ে
কে এলে গো, কে এলে গো চপল পায়ে।।
ছায়া-ঢাকা আমের ডালে চপল আঁখি
উঠল ডাকি' বনের পাখি — উঠল ডাকি'।
নতুন চাঁদের জোছনা মাখি সোনাল শাখায় দোল দুলায়ে
কে এলে গো, কে এলে গো চপল পায়ে।।
----- কাজী নজরুল ইসলাম -----
দূরে পাহাড়ের গায়ে
সোনালু ফুলের ছায়ায়
সন্ধের লাল আকাশকে সাক্ষী করে
ছেলেটি মেয়েটির
যাবতীয় দু:খ-কষ্ট, অনাচার আর শোককে
প্রেমের চাদরে মুড়িয়ে দেবে বলে
প্রতিশ্রুত হচ্ছে, তারা কি জানত
----- মীর মোশাররফ হোসেন -----
সোনালুর ফুল থেকে ফল হয়, ফলের আকার দেখতে লাঠির মতো প্রায় এক-দেড় ফুট লম্বা, মসৃণ। ফলের রং প্রথমে কাঁচা অবস্থায় সবুজ এবং পরে পরিপক্ব হলে কালচে খয়েরি রঙ ধারণ করে। ফলের ভিতরে বীজ হয়। সাধারণত এই বীজ হতেই গাছটির বংশ বিস্তার ঘটে। ফলের ভিতর একধরনের কালচে আঠালো অংশ থাকে, যেটির স্বাদ মিষ্টি। গ্রামের বাচ্চারা তাই এই ফল খেয়ে থাকে। আর এই ফলের লোভে বানরের দল সোনালো গাছ খুব পছন্দ করে। হয়তো এই কারণেই সোনালুর আরেক নাম হয়েছে "বাঁদর লাঠি"। শুধু ফল না বরং সোনালুর ফুল, ফল ও পাতা বানরের খুব প্রিয়।

শিরিষ পাতায় ঝিরিঝিরি, বাজে নূপুর তারি
সোনাল ডালে দোলে তাহার কামরাঙা রঙ শাড়ি।
হয়েছি মন-ভিখারি কোন্ শিকারি আমি
উঠি পাহাড় চূড়ায়, ঝর্না জলে নামি
----- কাজী নজরুল ইসলাম -----
জোছনা-হসিত মাধবী নিশি আজ।
পর পর প্রিয়া বাসন্তি-রাঙা সাজ।।
রাঙা কমল-কলি দিও কর্ণ-মূলে
পর সোনালি চেলি নব সোনাল ফুলে,
স্বর্ণলতার প’র সাতনরী-হার আজি উৎসব-রাত,
রাখ রাখ গৃহ-কাজ।।
পর কবরী-মূলে নব আমের মুকুল
হাতে কাঁকন পর গেঁথে অতসীর ফুল,
দূরে গাহুক ডাহুক পাখি সখি, মুখর নিলাজ।।
----- কাজী নজরুল ইসলাম -----
সোনালু গাছের পাতা জীবাণুনাশকের জন্য খুবই প্রসিদ্ধ।
বিভিন্ন চর্মরোগ, ক্ষত শুকাতে, শরীরের ইনফেকশন রোধে, কীটপতঙ্গের কামড় ও চামড়ায় জ্বালা-পোড়া বন্ধ করতে, গ্যাস্ট্রিক, এজমা ও ডায়রিয়া রোধে এর পাতার রস সেবন, পাতা রান্না করে ও বাহ্যিকভাবে পাতার রস ব্যাবহার করা হয়।
টনসিলের সমস্যায় ফুলা কমাতে এই উদ্ভিদের পাতা গরম করে ছেক দেওয়া হয়।
কেউ কেউ বলেন সোনালু ফুল শাকের মতো রান্না করে খাওয়া যায়।
ফুলের এন্টি-ফাংগাল ও এন্টি-ব্যাকটেরিয়াল গুনাগুণ রয়েছে।
সোনালুর বীজ এন্টি-ক্যান্সার ও এন্টি-টিউমারের জন্য খুবই জনপ্রিয়। কসমেটিকস ইন্ড্রাস্টিতে এর বীজ ব্যাবহার করা হয়।
এর বীজ থেকে প্রাপ্ত ঘাম খাবারের গুনাগুণ ও খাবার প্রিজারভেশনের জন্য ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
বিভিন্ন ফ্লু জনিত জ্বর ও ঠাণ্ডার জন্য এর শেকড় খাওয়া হয়।
সতর্কতা : অভিজ্ঞ আয়ুর্বেদিক চিকিৎকের পরামর্শ ছাড়া এর কোনোটাই ব্যবহার করা স্বাস্থের জন্য হানিকর হতে পারে।

সোনালু ফুল আর তার ঝকমকে ডানা
ছিল মানুষের আবেগ
এখন ঝরে যাওয়া ফুলগুলো মাটিরাঙ্গা
আকাশের কাছে মৃত মাছের চোখ
নিয়ে অভিযোগ জানায়
প্রেমহীন এ শতকে সোনালু ফুলের
অভিমান কি তীব্র
গাছে গাছে সোনালু ফুল এখন রূপকথার
ঝুলিতে
অতঃপর বিপ্লব মহিমান্বিত হোক।
----- মীর মোশাররফ হোসেন -----
সোনালু গাছ থাইল্যান্ডের জাতীয় গাছ আর সোনালু ফুল থাইল্যান্ডের জাতীয় ফুল।
ভারতের কেরালা রাজ্যের রাজ্যফুলও এই সোনালু।
থাইল্যান্ড, ভারত, কানাডা সহ বিভিন্ন দেশের ডাকটিকেটে এই সোনালু ফুল স্থান পেয়েছে।

বলা হয় সোনালু ফুলের হলুদ রঙ বৌদ্ধধর্মের এবং রাজপরিবারের রঙের সাথে সম্পর্কিত ছিল।
থাইল্যান্ডের রাজপরিবারেও সোনালু ফুল প্রতিক হিসেবে ব্যবহার হয় কখনো কখনো।
মালয়ালি লোককাহিনীতে বলা আছে এই সোনালু ফুল ভগবান শ্রী কৃষ্ণকে খুশি করে।
ভারতের কেরালা, তামিলনাড়ুর সংলগ্ন অঞ্চলে মালয়ালি হিন্দু সম্পদায়ের লোকেরা ১৪ বা ১৫ এপ্রিল "বিষু কান্নি" উৎসব নামের তাদের নতুন বছরের প্রথম দিনকে স্বাগত জানায়। বিষু কান্নিতে যে ডালা সাজানো হয় সেটিতে থাকে এই সোনালু ফুল। তাই সোনালু হচ্ছে বিষু উৎসবের ফুল।


তথ্য সূত্র : উইকিপিডিয়া, অন্তর্জাল।
ছবি ও বর্ণনা : মরুভূমির জলদস্যু
ছবি তোলার তারিখ : ২৯/০৪/২০১৮ ইং
ছবি তোলার স্থান : কার্জনহল, ঢাকা, বাংলাদেশ।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে মে, ২০২৫ সকাল ১১:৩০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


