কোথা থেকে লেখাটা শুরু করবো এবং পরিশেষে এটা কি দাঁড়াবে নিশ্চিত নই। আমি বলতে পারি ডিপ্রেশন কি করতে পারে তার অভিজ্ঞতা। যেহেতু আমি কোন পেশাদার মনরোগ বিশেষজ্ঞ নই। সেক্ষেত্রে আমার কাছে যে যুদ্ধ করার কৌশল গুলো আছে তা বলে দিতে পারি। আবার মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত মানুষ দেখলে আমি কিভাবে বুঝি তাও লেখা যায় এখানে। লেখার সীমাবদ্ধতা নিয়ে কতটুকু পরিস্কার ভাবে বোঝাতে পারবো তা নিয়েও আমি সন্দেহে আছি। আমি অন্তর্জালে বিভিন্ন তথ্য দেখে এবং নিজের অভিজ্ঞতা থেকে কিছু উপায় সংগ্রহ করেছি সামাল দেবার। জানিনা এগুলো কারো কাজে আসবে কিনা? বা কারো সাথে মিলবে কিনা? কিন্তু জেনে রাখুন আমি খুবই সমব্যাথী।
বিশেষজ্ঞদের মতে, রোগীর সাংখ্যিক বিচারে ২০২০ এর পর থেকে বেশি হতে শুরু করবে মানসিক রোগীর সংখ্যা। যেটা হতে শুরু করেছেও তাদের বিশ্লেষণ মোতাবেক। কিছু কিছু ক্ষেত্রে চারপাশের পরিবেশ প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। কিন্তু মানসিক ব্যাধি বংশানুক্রমিক। পরিবারের পুর্বপুরুষদের যেকোন কেউ এই ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে নিজে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা বেশি। মজার ব্যাপার হলো আক্রান্ত হবার পর থেকে আমার এ সমস্যা কেন হচ্ছে, এর উৎস কী জানতে গিয়ে বিভিন্ন মানসিক ব্যাধি সম্পর্কে অন্তর্জালে জানতে পারি। বাইপোলার ডিজিজ, এনক্সাইটি, অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিজর্ডার, প্যারানয়া, SOC.,AD ইত্যাদি। আমি যখন একজন পেশাদার মনরোগের অধ্যাপকের কাছে গিয়ে আমার সমস্যা গুলো বলতে শুরু করেছিলাম তিনি আমাকে বলেছিলেন নেটে খুজে বের করে এসেছি কিনা। আমাকে সাইকোথেরাপি প্রেস্ক্রাইব করা হয়েছিলো। আর সবার মতোই আমিও 'লোকে কি বলবে?' নিয়ে ভীত ছিলাম। তাই যাই নি থেরাপি নিতে। আমার অভিভাবক সবার মতই অভিনয় বলেই উড়িয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু আমি নিজেকে ধন্যবাদ দেই যে আমি বিশেষজ্ঞকে বলতে পেরেছিলাম, আমাকে অন্তত কোন ওষুধ দিন। এজন্য আমি নিজেকে নিয়ে গর্বিত।
আমার কাছে ডিপ্রেশন মানে হলো সকল রোগের মিলিত অবস্থা। কিংবা এদের যেকোন দু একটি মিলে আক্রান্ত হওয়া। একদিন সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে হঠাত খেয়াল করলাম "আমার কী হবে? " প্রশ্নটা খুব জোরালো হয়ে গেছে। চাকরি হচ্ছিলো না। বন্ধুরা অন্য শহরে। তারপর থেকেই এনক্সাইটি, মানসিক দুর্বলতা টের পাচ্ছিলাম। পরবর্তীতে শারীরিক ভাবেও দুর্বল লেগেছে। যেকোন তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ভয়ে পেতে শুরু করলাম। ফোনকলে কথা বলার আগে এবং পরিচিত মানুষের সাথে দেখা হলেই ভয় পাওয়া শুরু হতো। একটি চাকরি হলো খুশী হবার বদলে ভয় পাওয়া শুরু হলো। দশ দিনের মাথায় চাকরি ছেড়ে চলে আসলাম। অভিভাবকরা ভালো ভাবে নিলেন না। মধ্যবিত্তের চাকরি ছাড়ার ফ্যান্টাসি থাকে তবে এতো জোরালো হবে ভাবতে গিয়ে অবাক হলেন। আরেকটি চাকরি হলো। জয়েন না করেই চলে আসলাম। যথারীতি সেই ভীতিজনক চিন্তারা গ্রাস করে ফেলল। যেখানে আমি গ্রাহ্য হবো না ভয়ে ভীত সেখানে পুরো একটি চাকরি কিভাবে করব তা নিয়ে আক্রান্ত বোধ করলাম। ব্যাংকে গিয়ে কোন বিল দেয়া আমার কাছে খুব বড় ব্যাপার। ডিপ্রেশনে যারা থাকেন তারা এমনই সমস্যার সম্মুখীন হন। আবার চারদিকে যাদেরকে স্বয়ংসম্পূর্ণ মানুষ বলা হয়ে থাকে তাদের প্রায় বেশিরভাগই টক্সিক। তাদের সাথে পেরে উঠব না ভেবেই তারা প্রথমে আক্রান্ত হন।"আমি যথেষ্ঠ নই" " অপারগ " ইত্যাদি ইত্যাদি। এ রোগে আক্রান্তদের বাওয়েল মুভমেন্টেও সমস্যা হয়।
আমাকে যদি বলা হয় আপনার জীবনের কোন স্মৃতি আপনি মুছে দিতে চান তাহলে আমি বলব, ২০১৯ এর শেষ ছয় মাস। প্রতিদিন ভোরে যে অসহ্য লক্ষ কু চিন্তারা মাথায় ঢুকতে থাকতো তখন আত্মহত্যার চিন্তাকে সমস্যা সমাধানের সবচেয়ে সহজ চিন্তা মতো মনে হতো। খুবই প্রিয় লাগতো। ওজন বাড়তে আরম্ভ করেছিলো এবং আমি কেবলই খেতে পছন্দ করতাম। সবচেয়ে দুখঃজনক সত্যি কথা হলো আশেপাশের মানুষদের সাহায্য খুবই প্রয়োজন হয়ে যায় কিন্তু পাওয়া যায়না। আপনার নিজেকে নিজেই সাহায্য খুজতে হবে। অন্তত চেস্টা করতেই হবে।
ডিপ্রেশন শুধুমাত্রই হতাশা কিংবা দুঃখবোধ নয়। এটা মস্তিষ্কের ক্যামিক্যাল ইম্ব্যালেন্স। কিভাবে ডিপ্রেসড হবেন?
খুবই সোজা। অন্য ফিজিক্যাল এক্টিভিটি বাদ দিন। তিনমাস শুধু ফেসবুকে স্ক্রল করুন, শুয়ে থাকুন। এর একমাত্র কর্তব্য হলো ফিজিক্যাল ইনএক্টিভিটি। আমাদের চারপাশে এমনিতেই দূষণ বাড়ছে। শব্দদুষণকে সরাসরি একটি অনুঘটক হিসেবে নেয়া যায়। আবার অনেকেই বাস্তবের কষাঘাতে যা করতে পছন্দ করেন না তাই বেচে থাকার জন্যে করে যেতে থাকেন। সেটা শুধু মাত্র চাকরি না,বিয়ে বা অন্য সম্পর্ক, অন্য কোন দায়বদ্ধতাও হতে পারে। আসলে ডিপ্রেশন হবার কোন নির্দিষ্ট কারণ নেই। তবে মা-বাবা বা প্রপিতামহদের কারো থেকে থাকলে ডিপ্রেশন হতে পারে।
আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, রবিন উইলিয়ামসন, জিম ক্যারি, সুশান্ত সিং রাজপুত দের মতো এখনো আমার সুইসাইডাল থট আসে। ঐ সময় টায় নিয়মিত ছিলো এখন অনিয়মিত। আমার হাস্যোজ্বল চেহারা কিংবা হিউমার যেভাবে ভালোভাবে রান করছে তা দেখে কেউ বুঝতেই পারবে না যে আমার ভেতর এনক্সাইটি এমন দাপট দেখিয়ে বেড়াচ্ছে। দু সপ্তাহে একবার জীবন নিয়ে এগিয়ে যেতে আলসেমিতে পায়। আশেপাশের কেউ ভুগছে কিনা তা জানতে আমার সমস্যা হয় না। অনেকে স্বীকার করতে চান না। আমার এক বাইপোলার বন্ধুর সাথে আমার সম্পর্ক শেষ হয়ে গেছে।
ডিপ্রেশনের কার্যত কোন সম্পুর্ণ সমাধান নেই। এটা নিয়ন্ত্রণ করা যায় কিন্তু একেবারে নির্মূল করা সম্ভব নয়। প্রথমে আমি হাটতে শুরু করেছিলাম ভোরে উঠে। কিন্তু সোশ্যাল এনক্সাইটি প্রকট হয়ে যাওয়ায় হলো না। তারপরে বোনের পরামর্শে মেডিটেশন করা শুরু করলাম। দু মাস পরে তাতেও মনযোগী হতে পারলাম না। এরপর ডাম্বলস নিয়ে হোমওয়ার্কআউট শুরু করলাম। এবারে ফল পাওয়া শুরু করলাম। ব্যায়ামের ফলে আমাদের ব্রেইন থেকে হ্যাপি হরমোন নিঃসরণ হয়। মানসিক যন্ত্রণা কিছুটা কমতে শুরু করল। ট্রাভেলিং শুরু হলো আবার। মোবাইল থেকে দূরে রইলাম। সবচেয়ে টনিক হিসেবে কাজ করেছে আমার স্কুলের শিক্ষার্থীদের হাসিমুখগুলো। ওরা আমি ডেংগুজ্বরে আক্রান্ত ছিলাম জেনে আসার পরে বলেছে আমার জন্য তাদের দোয়া করার ব্যাপারটা। কত সহজে ওরা ভালোবেসে ফেলে। আর বাড়িতে কুকুরদের খাওয়ানো আমাকে খুব সাহায্য করেছে। যদি কেউ বলে আমার OCD তাহলে আমি প্রথমেই বলব Hit the gym. বাচ্চাদের সাথে থাকুন, কুকুরদের খাওয়ান। আমার উপলব্ধি হলো, সেলফিশ মানুষদেরই ডিপ্রেশন হয় বেশিরভাগ। আর সুইসাইড করলে আপনি ছাড়া আশেপাশের সব মানুষ জিতে যায়। আপনার যে ফুচকা খাবার কথা, অন্য কেউ খাবে। যে ভালোবাসা আপনি হয়তো পেতেন তা অন্য কেউ পাবে। একটা নোংরা বিষাক্ত লোক বেচে থাকবে আর আপনি অপেক্ষাকৃত কম বিষাক্ত হয়েও ঝুলে পড়বেন? এইডা হইলো??? বিষাক্ত লোক পৃথিবীর এতো ক্ষতি করছে তা যদি দেখতে না পান এখনকার অর্থহীন যুদ্ধ গুলো দেখুন। কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায় আসুন। ওরা ঠিকই ঘুম থেকে উঠে এক হাজার শিশু মেরে ফেলার সিদ্বান্ত নেবে। ধর্মের নামে, আদর্শের নামে, বিপ্লবের নামে। আবার তাতে সায় দেবে আরো কিছু নোংরা বিষাক্ত কুতসিত মানুষ। অথচ দেখুন, আত্মহত্যার সিদ্বান্ত নেবে না। আর আপনি ওদের চেয়ে কম বিষাক্ত হয়ে এমন ছুটি নেবেন? নিজেকে বলুন, ওরা যদি বেচে থাকতে লজ্জা না পায়,,,,,,,ইত্যাদি ইত্যাদি।
কিছু ধরন যেগুলো আমার কাছে যেমন মনে হয়েছে তা লিখছি। দেখুন মিলে কিনা? আপনার হতেই হবে তা নয়। আশেপাশের কারো সাথে মিলে কিনা দেখতে পারেন।
বাইপোলার - হুট করে রেগে যায়। খুব বাজে বিহেভ করে। ফলে ইমোশনাল এনার্জি খরচ হয়ে যায়। পরবর্তীতে কান্নায় ভেংগেও পড়তে পারে। কিন্তু সমস্যা স্বীকারই করবেনা। পাশের কারো এগিয়ে আসতে হবে। একসাথে সকল আবেগ এসে গেলে যেমন ব্যবহার করে মানুষ, তারা তাই।
এনক্সাইটি - "বুক ধড়ফড় করে" এদের কমন বার্তা হতে পারে। কারণ অনেকেরই আমাদের যশস্বী ব্লগারদের মতো শব্দভাণ্ডার সমৃদ্ধ নয়। কল আসলে কিংবা উর্ধতন কেউ ডেকে পাঠালে কিংবা পরীক্ষার আগের মুহুর্তে তাদের ভেতরকার অবস্থা বুঝতে হলে নিজেকে অক্সিজেন কম একটি অন্ধকার কন্টেইনারে কল্পনা করুন।
প্যারানয়া- যত তুচ্ছই হোক না কেন তার ভয়ে ভীত হওয়া এবং ভয়ে বিছানা থেকে নামতে না পারা। সব ভয়ংকরী প্রলয় আমার হতে পারে যেমন: ছিনতাই, রেইপ,মার্ডার, অর্থনৈতিক ক্ষতি ইত্যাদি।
ADHD - এটেনশনের জন্য উচ্চস্বরে অনর্গল কথা বলা। কাউকে বলতে না দেয়া। কেউ কাছে থাকলেই কথা বলা। নিজে নিজে কথা বলা।
OCD - একই কাজ বারবার করা। যেমন : হাত ধোয়া, বারবার গোসল করা, কোন কাজ করতে একই আদেশ বারবার দেয়া ইত্যাদি।
ডিপ্রেশন - যে জিনিসগুলো করতে আনন্দ পেতেন যেমন জীবন যাপন তা করা অর্থহীন মনে করা এবং কোনকিছুতেই
ভালো না লাগা অথবা ক্রমাগত কান্না করে নিজেকে ব্যর্থ ভাবা ইত্যাদি।
এই পুরো লেখার উদ্দেশ্য হলো সান্ত্বনা দেয়া। আপনি যে হোন না কেন একলা নন। স্বীকার করুন, কাউকে বলুন, আশেপাশের মানুষদের খেয়াল করুন। পরিশেষে সাহায্য নিন। এই লেখার কোন তথ্যই বিশেষজ্ঞের মত নয়। আমার ব্যাক্তিগত জগাখিচুড়ি। এড়িয়ে যাবার এবং হেসে উড়িয়ে দেবার সুযোগ আপনার রয়েছে। ব্যায়াম করুন(সপ্তাহে অন্তত চারদিন), টডলারদের লক্ষ্য করুন, কুকুরদের খাওয়ান। আমার সাথে যেটা থাকে তাকেও খাওয়াতে টাকা পাঠাতে পারেন। আমি দরিদ্র স্কুল শিক্ষক। এত টাকা কই পাবো?