আজকের বাংলাদেশে আমরা যা দেখছি, তা শুধু রাজনৈতিক সহিংসতা নয় এ এক জাতিগত আত্মাহত্যা। হাজার হাজার শিক্ষক, ডাক্তার, সরকারি কর্মকর্তা, সাহিত্যিক, সংস্কৃতিজন, এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের যেভাবে উলঙ্গ করে, রাস্তায় ফেলে লাঠিপেটা করে থানায় নেওয়া হচ্ছে, তা দেখে কেবল চোখে জল আসে না বুকের ভেতর পাজর যেন হাহাকার করে উঠে। আমরা যারা স্বাধীনতা যুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করি, একটি সুন্দর, শিক্ষিত, মানবিক ও আত্মনির্ভর বাংলাদেশ চেয়েছিলাম আজ তাদের হৃদয়ের টুকরো টুকরো রক্ত ছড়িয়ে আছে প্রতিটি সড়কে, প্রতিটি স্কুল-কলেজে, প্রতিটি জেলখানায়।
৩০ লক্ষ শহীদের আত্মদান এভাবে অপমানিত হবে?
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল একটি গণতান্ত্রিক, বৈষম্যহীন রাষ্ট্রব্যবস্থার স্বপ্ন নিয়ে। যেখানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার অধিকার থাকবে। সেই স্বাধীনতার জন্য ৩০ লক্ষ মানুষ প্রাণ দিয়েছিলেন। ২ লক্ষ মা-বোন তাদের সম্ভ্রম হারিয়েছিলেন। প্রশ্ন হলো এই কী সেই স্বাধীনতা?
যখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে আজ শিক্ষকরা পেটানো হয়, নারীদের শ্লীলতাহানি করা হয়, ছাত্রদের গুম করে ফেলা হয় তখন মনে হয়, আমরা নিজেরাই আমাদের ইতিহাসকে ধ্বংস করছি। আমরা আমাদের শহীদের রক্তকে বিক্রি করে দিচ্ছি ক্ষমতার লোভে।
একটি রাষ্ট্রীয় নির্মমতা
সাম্প্রতিক সময়ের চিত্র ভীষণ উদ্বেগজনক। সংবাদমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়া থেকে আমরা দেখেছি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ডাক্তার, কলেজের অধ্যক্ষ, স্কুলছাত্র থেকে শুরু করে টিভি অভিনেতা, সাংবাদিক পর্যন্ত কাউকে রেহাই দেওয়া হচ্ছে না।
অনেককে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে অফিস থেকে, বাসা থেকে, এমনকি হাসপাতাল থেকেও। বিবেকবান মানুষদের অপমানিত করা হচ্ছে জনসম্মুখে। একজন মানুষের জামা ছিঁড়ে ফেলা মানে কেবল তার শরীর নয়, রাষ্ট্রব্যবস্থাকেই নগ্ন করে দেওয়া।
অতীত সরকারের সময়ে এমন কী ঘটেছে?
রাজনীতির ময়দান সব সময় উত্তপ্ত ছিল, থাকবে। কিন্তু ২০০৯-২০২৩ সময়কালে আওয়ামী লীগ সরকার যেসব রাজনৈতিক উত্তেজনার মধ্যে দিয়েও রাষ্ট্র পরিচালনা করেছে, সেখানে এতটা প্রকাশ্য রাষ্ট্রীয় পীড়ন কখনো ঘটেনি।
সাংবাদিক, শিক্ষক, ডাক্তারদের হয়তো মতপার্থক্য ছিল, কিন্তু এইভাবে রাস্তায় পেটানোর মতো ঘটনা সাধারণ হয়নি। সেই তুলনায় আজ যা হচ্ছে তা অবর্ণনীয়, অমানবিক এবং রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের নামান্তর।
রাষ্ট্রীয় বাহিনীর নির্লিপ্ততা ও দায়
সবচেয়ে ভয়ংকর দিক হলো এই দমন-পীড়ন ঘটছে পুলিশের, র্যাবের, এমনকি সেনাবাহিনীর সামনে। তারা দাঁড়িয়ে থেকে নিরব দর্শক। অথচ তাদের কাঁধে দেশের সংবিধান রক্ষার দায়িত্ব। যখন একটি রাষ্ট্রের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাই জনতার বিরুদ্ধে অস্ত্র হয়ে ওঠে, তখন সেই রাষ্ট্র আর গণতান্ত্রিক থাকে না তা হয়ে ওঠে ফ্যাসিবাদী।
যাদের স্বপ্ন ছিল একটুকু শান্তি
যারা বিদেশ থেকে ফিরে এসেছিল দেশ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে, যারা গ্রামের স্কুলে শিক্ষকতা করেছিল শুধুমাত্র আলোকিত প্রজন্ম তৈরির আশায়, যারা রাজনীতি করেছিল জনগণের পাশে দাঁড়ানোর শপথ নিয়ে আজ তারা পালিয়ে বেড়াচ্ছে, লুকিয়ে আছে, জেল খাটছে, নাকি নিখোঁজ!
আমরা যারা দেশের মাটি, মানুষের ঘ্রাণ, এবং ৩০ লক্ষ শহীদের ত্যাগকে হৃদয়ে ধারণ করি তাদের কাছে আজকের বাংলাদেশ এক বিভীষিকা।
আমরা এমন রাষ্ট্র চাইনি। আমরা স্বাধীনতার নামে দাসত্ব চাইনি। আমরা উন্নয়নের নামে মানবাধিকার হরণ চাইনি।
তাই বলি পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেলে শুধু ঘুষি নয়, ইতিহাসও জবাব দেয়।
এই জবাব দেবে সেই শিক্ষক, সেই ছাত্র, সেই মা-বোন যারা এখন চুপ, কিন্তু চিরকাল নয়। এ এক জাতিগত আত্মাহত্যা।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই মে, ২০২৫ সকাল ৮:১১

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




