চারিদিকে নিস্তব্ধ অন্ধকার। কাচের জানালায় কুয়াশা পড়ে বিন্দু বিন্দু জল জমছে। ঠান্ডা স্যাঁতসেঁতে কুয়াশা। জানালার পাশেই একটা টেবিল। টেবিলের উপর পুরনো আমলের একটা এলার্ম ঘড়ি। ঘড়ির কাঁটায় রেডিয়াম দেয়া আছে। অন্ধকার ঘরে রেডিয়াম বিড়ালের চোঁখের মত জ্বলছে।
বারটা বাজতে এক মিনিট বাকি। টিকটিক করে ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে চলছে। আর দশ সেকেন্ড। ৯, ৮ , ৭ ...
মনে মনে গুনছে জাভেদ। টিটিট টিটিট শব্দে বারটার এলার্ম বাজতেই ছোঁ মেরে ঘড়িটা টেবিলের উপর থেকে নামিয়ে নেয় জাভেদ। এলার্ম টা বন্ধ করে পুরো একমিনিট নিথর হয়ে বিছানায় বসে থাকে।
দশ মিনিট পেরিয়ে যায়।
পনের মিনিট।
টেবিলের উপর থেক মোবাইল ফোনটা তুলে নেয় জাভেদ। একনাগারে ফোনের ওয়ালপেপারের দিকে তাকিয়ে থাকে । চোখ দুটো হঠাৎই জ্বালা করে উঠে। চোখ বন্ধ করতেই দু ফোটা জল গাল বেয়ে ফোনের ডিসপ্লেতে পড়ে।
জাভেদ আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। অনিষার নাম্বার ডায়াল করে। একটার পর একটা নাম্বার সাজিয়ে। বিগত এক বছর ধরে এই নাম্বারেই ফোন করে এসেছে জাভেদ। এত তাড়াতাড়ি কিভাবে ভুলবে।
ওপার থেকে জানিয়ে দেয়, 'দুঃখিত এই মুহুর্তে মোবাইল সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না, অনুগ্রহ করে একটু পরে আবার চেষ্টা করুন।' কেউ যেন করুন গলায় জাভেদের অসহায়ত্ব নিয়ে টিটকারি মারে। জানালার পাশ দিয়ে রাত জাগা পাখি উড়ে যায়। যেতে যেতে বলে যায় তুমি একা। এই পৃথিবীতে কেউ নেই তোমার কেউ নেই।
একটার পর একটা নাম্বার ডায়াল করে যায় জাভেদ। একটা মেয়ের কেন এত গুলো নাম্বার থাকবে মাথায় ঢোকে না জাভেদের। তার পরও আশা হয়। হয়ত কোন একটা নাম্বার খোলা পাওয়া যাবে। প্রত্যেক বার করুন গলায় শুনতে হয় দুঃখিত। উফফ অসহ্য। চিৎকার করতে ইচ্ছে করে। সব কিছু ভেংগে চুরে চুরমার করে ফেলতে ইচ্ছে করে। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করে।
অনিষার কাছে রাতের ঘুম খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেন আজ রাতটাও তাকে ঘুমাতে হবে। একটা রাত। এই টুকু আশাও কি করতে পারে না জাভেদ?
নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে হয় জাভেদের। বাহিরে ঠান্ডায় জমে যেতে ইচ্ছে হয়। চিৎকার করে কাওকে বলতে ইচ্ছে হয় 'তোমরা কেউ আমার সাথে একটু কথা বল।'
নিজেকে খুব অসহায় মনে হয়।
জাভেদ চোখ বুজে ডায়াল প্যাডে কিছু নাম্বার টাইপ করতে থাকে।
হ্যালো?
-কেমন আছেন?
জ্বি ভাল আছি। আপনি কে বলছেন?
- ঘুমুচ্ছিলেন?
হ্যা ঘুমুচ্ছিলাম। কিন্তু আপনি কে বলছেন?
- আচ্ছা ঠিক আছে ঘুমুন। আমি কেউ না , আই এ্যম নো বডি।
বলেই ফোন রেখে দেয় জাভেদ। আপন মনে হাসতে হাসতে আরেকটা আজগুবি নাম্বার টাইপ করতে থাকে। মানুষ কষ্টে থাকলে অন্যে সুখে আছে তা সহ্য হয় না। অন্য কাওকে কষ্টে ফেলতে ইচ্ছে করে।
হ্যালো?
গলার আওয়াজ শুনে চ্যাংড়া টাইপ ছেলে মনে হয় জাভেদের।
- ভাই আপনার গার্লফ্রেন্ড কোথায়?
কে বলছেন?
আমি কে সেটা জেনে লাভ নাই। আপনার গার্লফ্রেন্ড কোথায় সেটা আগে খোজ নিন।
মানে কি? কি বলছেন?
এত মানে কি, মানে কি করবেন না। আপনার গার্লফ্রেন্ড কে নিয়ে আমি পালিয়ে এসেছি।
বলেই একটা ভিলেনি হাসি দেয় জাভেদ। তারপর ফোনটা রেখে দিয়ে একা একাই হো হো করে হাসতে থাকে।
কিছুক্ষন পর সেই নাম্বার থেকে ফোন আসতে থাকে। বেচারা বোধহয় এই রাতে তার গার্লফ্রেন্ডকে ফোনে পায় নি। জাভেদ ফোনটা সাইলেন্ট করে দিয়ে কি যেন গুন গুন করে গাইতে থাকে।
জানালার পাশ দিয়ে আরেকটা রাত জাগা পাখি উড়ে যায়। বলে যায় কেউ নেই তোমার কেউ নেই। এবার জাভেদের গুন গুন স্পষ্ট শোনা যায়
"হ্যাপি বার্থডে টু মি,
হ্যাপি বার্থডে টু মি।
হ্যাপি বার্থডে ডিয়ার জাভেদ,
হ্যাপি বার্থডে টু মি। ।"
না জাভেদ আর কাঁদে না। ছেলেদের কাঁদতে নেই।