অনেকদিন পর বাসায় যাবো, সাথে পুরোনো ফ্রেন্ড। তাকে ফোনে বললাম তুই মহাখালী বাসস্ট্যান্ডের দিকে রওনা দে, আমি বের হচ্ছি। কিন্তু বের হয়েই পরলাম শাহ্বাগের মহা জ্যামে। ঐদিকে ফ্রেন্ড মহাখালী পৌছে গিয়েছে। আমি জ্যামে আটকে আছি, আর বেচারার কথা ভাবছি। বেচারা নিশ্চয়ই আমার গুষ্টি উদ্ধার করছে। অবশেষে এক ঘণ্টা পর মহাখালী পৌছলাম। কপাল ভালো, গিয়েই দেখি বাস দাঁড়িয়ে আছে। টিকেট কেটে উঠে বসলাম। একটু পরেই বাস ছেড়ে দিলো। বাস অনেকটাই খালি। ভাবলাম আরামে যাওয়া যাবে। কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারলাম আমার ধারণা কতোটা ভুল। বাস গাজিপুর হয়ে কিশোরগঞ্জ যাবে। স্টপেজের কোনো অভাব নেই, একটু পর পর স্টপেজ। বাস দাঁড়ায় আর ঠেলেঠুলে মানুষ উঠতে থাকে। একটা স্টপেজে এক হিজড়া উঠে টাকা আদায় করতে থাকলো। আমিতো ভয়ে চিমসে গেলাম। ওদের সাথে পাঙ্গা নেয় এমন সাহস কারো নেই। দেখলাম সবাই নিঃশব্দে টাকা দিয়ে দিচ্ছে। আমি এক সুযোগ বুঝে নিচে নেমে পড়লাম। ফ্রেন্ডের পকেট থেকে ১০ টাকা গেলো। ফ্রেন্ডকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য চিপসের প্যাকেট নিয়ে বাসে উঠলাম। ২/৩ স্টপেজ পরেই বাস পুরো ভরে গেলো। ধীরে ধীরে জ্যাম ঠেলে বাস এগিয়ে যেতে থাকলো।আমার পাশে বসা ব্যাক্তির বয়স প্রায় আমার মতই। পোশাক খুব ফিটফাট। দেখে মনে হয় কোনো প্রাইভেট ফার্মে ভালো বেতনে চাকরী করেন। চলার পথে অপরিচিত ব্যাক্তির সাথে কথা বলার আগ্রহ আমার কখনো ছিলো না। কিন্তু একটু পর ঐ ব্যাটা একটি লরির উপর রাখা যন্ত্রপাতি দেখিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলো বলেনতো ভাই ঐগুলো কিসের? আমি বিরক্ত হয়ে বললাম জানি না। তিনি জ্ঞান দেওয়ার ভঙ্গিতে বললেন ঐগুলো হচ্ছে ক্রেনের পার্টস। আমি চুপ মেরে থাকলাম। ঐগুলো ক্রেনের পার্টস হোক আর আইফেল টাওয়ারের পার্টস হোক আমার তাতে কিছু যায় আসে না। কিছু মানুষই থাকে এরকম যারা বাস বা ট্রেনে বসে আজাইড়া কথা বলতে খুব পছন্দ করেন। এটা খেয়াল করেন না, পাশের মানুষগুলো কথা শুনতে চাচ্ছেন কী না। কথা বলতে পারাতেই যেন খুব আনন্দ। বাস চলতে থাকলো। ইতিমধ্যে গাজিপুরের কাছাকাছি চলে এসেছে। পাশের যাত্রীটি আমার সাথে কথা বলার সুযোগ না পেয়ে পাশে দাঁড়ানো এক ব্যাক্তির সাথে কথা বলা শুরু করেছে। তাদের কথোপকথনের মধ্যে শুনতে পারলাম পাশের যাত্রীটি নিজের পেশা সম্পর্কে বলছেন, “আমি এখন জাহাজ চালাই, আগে লঞ্চের সারেং ছিলাম।” এই কথা শুনে আমার আগ্রহ গেলো বেড়ে। জাহাজ চালক কোনো ব্যাক্তির সাথে আগে আমার কখনো পরিচয় হয়নি। জানতে চাইলাম কী ধরণের জাহাজ চালান? বললেন কার্গো জাহাজ। মোবাইলে জাহাজের কয়েকটি ছবি ছিলো, সেটা দেখালেন। যথেষ্ট বড় জাহাজ। বেশিরভাগ চিটাগাং থেকে ঢাকা রুটেই চালাতে হয়। জানতে চাইলাম চিটাগাং থেকে ঢাকা আসতে কতক্ষণ লাগে। বললেন, ১৬ থেকে ১৭ ঘন্টা। সারা বছরই নাকি এই পথে নাব্যতা থাকে। শেষবার কী বহন করেছিলেন জানতে চাইলে বললেন, কোনো এক গ্যাস ফিল্ডের পাইপ। পরিবহন ভাড়াই ছিলো ৬/৭ লাখ টাকা। আরো বললেন উনার জাহাজটির মূল্য ৭কোটি টাকার মতো। উপকূল থেকে অনেক দূরে বড় হয়েছি বলে সমুদ্র ও জাহাজের গল্প, ঢেউয়ের গল্প অনেক বেশি আকর্ষণ করে। যে আমি অপরিচিত কোনো ব্যাক্তির সাথে সহজে মিশতে পারিনা, সে আমিও গল্পে মশগুল হয়ে পড়লাম। আমার ফ্রেন্ড পাশে ঘুমের চেষ্টাতেই ব্যস্ত। তারপর তিনি নিজের জীবনের গল্প শোনালেন। উনার জন্ম সন্দ্বীপে। সারা জীবন দ্বীপেই বড় হয়েছেন। বাবাও জাহাজ চালান। ওই দ্বীপের বেশিরভাগ মানুষের কাজ হয় মাছ ধরা নয়তো জাহাজে কাজ করা। ক্লাস সেভেন পর্যন্ত পড়াশোনার পর উনিও লঞ্চে কাজ শুরু করেন। তখন অনেক ছোট কাজ দিয়ে জীবন সংগ্রামে নামতে হয়েছিলো। সারেংদের কথামতো চলতে হতো। সারেংদের কাপড় ধোয়া ও শরীর ম্যাসেজ করে দিতে হতো। কালের পরিক্রমায় একসময় তিনি লঞ্চের সারেং হলেন। সারা জীবনের কাজের অভিজ্ঞতা জাহাজে। আর এখন তিনি বড় জাহাজের চালক, যাকে মাস্টার বলা হয়। মোট বেতন পান ৩০হাজার টাকা। ছোট ভাইকে চিটাগাং ভার্সিটিতে পড়াচ্ছেন। আমার সম্পর্কেও অনেক কিছু জানতে চাইলেন। শোনার পর বললেন, ভাই আমি যদি আপনার নামটা ইংরেজিতে লিখতে পারতাম তবেই দেশে/বিদেশের অনেক ভালো শিপিং কোম্পানিতে খুব ভালো বেতনে জয়েন করতে পারতাম। শুনে বললাম, আমি ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে অনার্স ও মাস্টার্স পাশ করেছি, ডিগ্রির ঝোলা নিয়ে ঘুড়ে বেরাচ্ছি কিন্তু চাকরী পাচ্ছি না। কারন আমার অভিজ্ঞতা নেই। আর আপনার অনেকদিনের অভিজ্ঞতা রয়েছে কিন্তু ডিগ্রি নেই। আরো অনেক কথায় কথায় যাত্রার সময় পেরিয়ে গেলো। উনার জীবনের গল্প, সন্দ্বীপের গল্প, দ্বীপের ভাঙ্গনের গল্প আরোও অনেক গল্প। বলেলন মাত্র কিছুদিন হলো বিয়ে করেছেন। হাতে তখনো মেহেদির রঙ রয়ে গিয়েছে। বউ এবার এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে। মোবাইল বের করে বউয়ের ছবিও দেখালেন। সাথে এটাও বলতে ভুললেন না যে, বউ পড়াশোনায় যথেষ্ট ভালো এবং অনেক দুষ্টু। আমারতো আফসোস হওয়া শুরু হল, কবে আমি চাকরী পাবো আর কবে আমার একটা বউ হবে। আর কবেইবা পাশের সহযাত্রীকে বউয়ের ছবি দেখাতে পারবো। তারপর শুরু করলাম ঝড়ের গল্প। জানতে চাইলাম সর্বোচ্চ কত নম্বর সিগন্যালে আপনি পড়েছিলেন। বললেন সাত নম্বর। এরকম সময়ে জাহাজ যদি সাগর তীরের জেটিতে থাকে তবে নাকি জাহাজ নিয়ে উনারা গভীর সাগরে চলে যান। যেনো জাহাজে জাহজে ধাক্কা না লাগে অথবা জাহাজ যেনো তীরে উঠে না পড়ে। হয়তো এ কারনেই বলা হয় জাহাজ ডুবলেও জাহাজের ক্যাপ্টেন কখনো পালায় না। ঝড় তুফান যাই হোক না কেনো ক্যাপ্টেনকে জাহাজেই থাকতে হয়। জাহাজেই চলে থাকা, খাওয়া, রান্না। এই জাহাজই তাদের বাড়িঘর, তাদের আশ্রয়, অন্নের যোগানদাতা। আমরা কখনো তীরে দাঁড়িয়ে, কখনোবা চলার পথে সেতুর উপর থেকে দূরের জাহাজ দেখি আর নিজের অজান্তেই নিজেকে প্রশ্ন করি জাহাজটা কোথায় যাচ্ছে, কোথা থেকে এসেছে, কী নিয়ে যাচ্ছে; সেই জাহাজই এই মানুষগুলোর ঠিকানা। শেষমেষ ভৈরব স্টপেজ চলে আসলো। জাহাজের চালককে এখানেই নামতে হবে। তিনি এখন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তার জাহাজে গিয়ে উঠবেন। নামার আগমুহূর্তে উনার নাম জানলাম, আব্দুল হালিম। এখন নদীতে ছুটে চলা কোনো জাহাজ দেখলেই আমার মনে হয় এটিই বুঝি সেই জাহাজ যার চালক আমার সেই এক বিকেলের সহযাত্রী।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই অক্টোবর, ২০১৩ রাত ১২:০৮