somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

স্ফুলিঙ্গ (পাকিস্তানীদের চোখে একাত্তর)

১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ বিকাল ৩:৪২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

একাত্তরে বাংলাদেশের মাটিতে পশ্চিম পাকিস্তানের পরাজয়ের পর কিছু পাকিস্তানী অফিসার দেশে ফিরে গিয়ে যুদ্ধের স্মৃতিকথা লেখেন। কেউ কেউ নির্মোহ ভাবে সত্যটিকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন আবার কেউ গা-বাঁচিয়ে লিখেছেন। দোষ অন্যের ঘাড়ে চাপানোর প্রবণতাও লক্ষ্যণীয়। এসবকিছুর মাঝেই একাত্তর নিয়ে অনেক অজানা কাহিনী উঠে এসেছে। পাকিস্তানি জেনারেল/অফিসারদের লেখা বইগুলো থেকে সেই ইতিহাসের চুম্বক অংশগুলো আমি এ লেখায় তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।
একটি কথা না বললেই নয় যে, আমাদের দেশে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে গুটি কয়েক মানুষ বিকৃত করার চেষ্টা করে আসছে। নানা রকম শেখানো বুলি ও ছলচাতুরী ব্যবহার করে তৎকালীন দেশদ্রোহীদের কাপুরুষতাকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। এবং দুঃখজনকভাবেই তা করা হয় ইসলামের নামে। ধর্মকে ব্যক্তিস্বার্থে বা গোষ্ঠীস্বার্থে ব্যবহারের জন্য করা হয় জঘন্য মিথ্যাচার। যে মিথ্যার মুখোমুখি আমাকেও হতে হয়েছিল। কিন্তু মিথ্যার বিরুদ্ধে সত্যই হচ্ছে একমাত্র অস্ত্র। যা পাকিস্তানি জেনারেলদের লেখায় উঠে এসেছে। এখানে আমি সেই সত্যই তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।


১৯৭১সালে বাংলাদেশ ও ভারতের নিকট পশ্চিম পাকিস্তানের করুণ পরাজয়ের পর এর কারন নির্ণয়ের জন্য প্রেসিডেন্ট ভুট্টো ১৯৭১ সালের ২৬ডিসেম্বর তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিশন গঠন করেন যার প্রধান ছিলেন বিচারপতি হামুদুর রহমান। এই কমিশনের রিপোর্টকে হামুদুর রহমান কমিশনের রিপোর্ট নামে অভিহিত করা হয় যেখানে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে দায়িত্বপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তাদের জবানবন্দি রয়েছে। রিপোর্টটি পারভেজ মোশাররফ সরকার ৩০ডিসেম্বর ২০০০সালে স্পর্শকাতর অংশগুলো বাদ দিয়ে প্রকাশ করে। যা দিব্য প্রকাশ ২০০১ সালে “একাত্তরের গণহত্যা হামুদুর রহমান কমিশনের রিপোর্ট” নামে প্রকাশ করে। বইটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন বশীর আলহেলাল। আমি এখানে রেফারেন্স হিসেবে ‘২য় মুদ্রন মে ২০০৯’ ব্যবহার করেছি।



১৯৭০ এর প্রথম দিকে রাজনৈতিক তৎপরতার উপর থেকে বাঁধা তুলে নেওয়া হল। রাজনৈতিক প্লাবনের ধারা যা দীর্ঘ্যকাল অবরুদ্ধ ছিল, দ্রুত ছাপিয়ে উঠলো। এই জোয়ারের শুরুতেই শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি জনসমর্থন প্রমাণ হয়ে গেল এবং সময় পার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্পষ্ট হতে লাগলো যে, আওয়ামী লীগের জাদুকরী শক্তির অধিকারী ওই নেতা ও ৬-দফা কর্মসূচি সম্পর্কে জনমনে বিরাট সমর্থন রয়েছে।
এডমিরাল আহসান –এগ-হারকরি-পৃষ্ঠা-১৯ (এগ-হারকরি- একাত্তরের গণহত্যা-হামুদুর রহমান কমিশনের রিপোর্ট)


কিছু লোক চাইছিল ক্রমবর্ধমান বাঙ্গালী জাতি-পূজাকে পশ্চিম পাকিস্তান শক্ত হাতে ঠেকাক। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষকে তারা উপনিবেশের লোক বলে মনে করতো।
এডমিরাল আহসান –এগ-হারকরি-পৃষ্ঠা-২১


(৭০এর ঘূর্ণিঝড়ের পর)
ইয়াহিয়া ঢাকায় অল্প সময় থাকেন এবং ঘূর্ণিঝড়ে দুর্গত এলাকাগুলোর পরিমাপ নেওয়ার পর নিজে নিজেই সিদ্ধান্ত করেন, শেখ মুজিব ও অন্য নেতারা যতো বলেন ততো ক্ষতি হয়নি। তিনি তাড়াহুড়ো করে ইসলামাবাদ চলে যান। তারপর হেলিকপ্টার পাঠাতে অনাবশ্যক দেরি করা হয়। সাহায্যের কাজের জন্য ওগুলোর জলদি দরকার ছিল।
কিন্তু তার মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে কেন্দ্রের বৈষম্যমূলক ব্যবহার তিনি স্পষ্ট করে দেখিয়েছেন। যখন পূর্ব কমান্ডের কমান্ডার জেনারেল ইয়াকুবের কাছে আমি ত্রাণকার্যের জন্য সেনাবাহিনীর সেবা প্রদানের কথা বললাম, তিনি জবাব দিলেন, তার কাছে ফালতু খরচ নেই।
এডমিরাল আহসান –এগ-হারকরি-পৃষ্ঠা-২১

১৯৭১এর ২২ফেব্রুয়ারির দিকে আমাকে গভর্নর আর সামরিক আইন প্রশাসকদের সম্মেলনে অংশগ্রহনের জন্য ডাকা হল। রাওয়ালপিন্ডিতে পৌছালে আমি ভারি দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। সামরিক তৎপরতা শুরু হয়েছে দেখা গেল। মন্ত্রিপরিষদ বাতিল হয়েছে। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সরাসরি বিমান সার্ভিস বন্ধ হয়েছে, জলপথে সরঞ্জাম যাচ্ছে। পিন্ডিতে ‘পরিকল্পনা মোতাবেক সামরিক সমাধানের’ খোলাখুলি কথাবার্তা হচ্ছে।
এডমিরাল আহসান –এগ-হারকরি-পৃষ্ঠা-২৬

বস্তুত, চক্ষুষ্মান যে কোনো ব্যক্তিই সহজে দেখতে পাচ্ছিলেন, শেখ মুজিবুর রহমানই এই ব্যাপারের শেষ বাঙ্গালী যাঁর সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তান কথা বলতে পারতো ও কোনো একটা সমঝোতায় পৌঁছাতে পারতো। বাংলার নৌজোয়ান যারা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কালে বয়সে খুব ছোট ছিল তারা বড়ই হয়ে উঠেছিল ঘৃণা আর অপমানের মধ্যে। অবশিষ্ট দেশের প্রতি তাদের কোনো ভালবাসা ও সৌহার্দ্য ছিল না।
এডমিরাল আহসান –এগ-হারকরি-পৃষ্ঠা-২৬

(১৯৭১, ২৫ফেব্রুয়ারি থেকে ২৬ফেব্রুয়ারির ভেতর শেখ মুজিবকে এডমিরাল আহসান)
আমি তাঁকে স্মরণ করিয়ে দিলাম যে, কেবল তিনিই রয়েছেন যিনি এখোনো পাকিস্তানকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে পারেন। শেখ মুজিব বিচলিত, হতবুদ্ধি হয়ে থাকলেন কিন্তু অল্পক্ষণের মধ্যে নিজেকে সামলে নিলেন। তিনি আমাকে বললেন, তিনি ধমককে ডরান না, আর বাংলার জনগনকে তিনি ধোঁকা দেবেন না।
এডমিরাল আহসান –এগ-হারকরি-পৃষ্ঠা-২৭

(এডমিরাল আহসান – ১সেপ্টেম্বর ১৯৬৯সালে পুর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিযুক্ত হন এবং ১মার্চ ১৯৭১পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন)


বিচারপতি হামুদুর রহমানকে জেনারেল নিয়াজি একটি চিঠি লিখেছিলেন তাতে নিয়াজি জেনারেল টিক্কা খানকে বেলুচিস্তানের কসাই এবং পূর্ব পাকিস্তানের কসাই বলে উল্লেখ করেন। (উল্লেখ্য যে, ১৯৭১সালের ২৫মার্চের কালরাত্রের অপারেশনের সময় জেনারেল টিক্কা খান ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের কমান্ডার ও গভর্নর)
এগ-হারকরি-পৃষ্ঠা-৩০


(জেনারেল টিক্কা খান হামুদুর রহমান কমিশনের রিপোর্ট প্রসঙ্গে)
আমি এই রিপোর্ট প্রকাশের দাবি করবো না, কিন্তু রাজনীতিবিদদের এ দাবি করা উচিত, যাতে জাতি জানতে পারে আসলে হয়েছিল কী? চিফ অব আর্মি স্টাফের ক্ষমতা বলে আমি রিপোর্ট প্রকাশের অনুমতি দিয়েছিলাম। কিন্তু পরে জেনারেল জিয়াউল হক সেনাবাহিনীকে খুশি রাখার নীতি অনুযায়ী রিপোর্ট হিমাগারে নিক্ষেপ করেন।
এগ-হারকরি-পৃষ্ঠা-২৬

১০ডিসেম্বর সূর্যাস্তের সময় আমাকে ঢাকার কমান্ডার মেজর জেনারেল জমশেদ ধানমন্ডির পিলখানায় তার সদর দপ্তরে আসতে বললেন। তার কমান্ড পোস্টের কাছে পৌছে আমি দেখি সেখানে অনেক গাড়ি। তিনি তার মোর্চা থেকে বেরোচ্ছিলেন। তিনি আমাকে তার কারে যেতে বললেন। কয়েক মিনিট পরে জানতে চাইলাম, এতো গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে কেনো? বললেন, ‘এই ব্যাপারে কথা বলতেই আমরা নিয়াজির কাছে যাচ্ছি’। তখনো কোর হেড কোয়ার্টার্সের রাস্তায়ই আমরা আছি, উনি আমাকে বললেন, তিনি বহুসংখ্যক বুদ্ধিজীবী ও অন্য বিশিষ্ট ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করার আদেশ পেয়েছেন। বললাম, ‘কেনো, কিসের জন্য? এখন ওই কাজ করার সময় নয়’। আমরা যখন নিয়াজির দপ্তরে গিয়ে পৌছলাম, জমশেদ ওই কথা ওঠালেন। নিয়াজি আমার মত জানতে চাইলে বললাম, ‘এখন সময় নয়। আপনি আগে যাদের গ্রেপ্তার করেছিলেন আপনাকে তাদের হিসাব দিতে হবে। দয়া করে এর বেশি গ্রেপ্তার করবেন না’।
উনি মেনে নিলেন। আমার সন্দেহ, প্রথম আদেশ বাতিল করার আদেশ জারি করা হয়নি, তাই কিছু লোক গ্রেপ্তার করা হয়। আমি আজ পর্যন্ত জানি না তাদের কোথায় রাখা হয়েছিল। সম্ভবত তাদের এমন এলাকায় রাখা হয়েছিল যার হেফাজত মুজাহিদরা করছিল। (এখানে মুজাহিদ বলতে রাজাকারদের বোঝানো হয়েছে)
মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী-এগ-হারকরি-পৃষ্ঠা-৪২

(ভারতে বন্দী থাকা অবস্থায়)
ভারতীয় বাহিনীর ব্রিগেডিয়ার লাজলি জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আমার কাছে এলেন। তার প্রথম প্রশ্নঃ আপনার বিরুদ্ধে ১৬-১৭ ডিসেম্বরের মধ্যরাতে দুশ বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করার অভিযোগ রয়েছে, এ ব্যাপারে আপনার বক্তব্য কী? বললাম, জেনারেল নিয়াজি সিঁড়ির উপর বসে রয়েছেন, গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করুন ১০ডিসেম্বর আমি ওইসব ব্যক্তির গ্রেপ্তারির বিরোধিতা করেছিলাম কিনা। যদি আমি তাদের গ্রেপ্তারিরই বিরোধিতা করে থাকি তাহলে তাদের হত্যা করার আদেশ কেনো দেব?
মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী-এগ-হারকরি-পৃষ্ঠা-৪৩
(উল্লেখ্য যে, এই সেই মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী যাকে ১৯৭১ সালের ১৪ডিসেম্বরের বুদ্ধিজীবী হত্যার রূপকার বলে ধরা হয় এবং তিনি ছিলেন ২৫মার্চের অপারেশন সার্চলাইটের অন্যতম প্ল্যানমেকার)

যদি পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতার কারনসমূহের অনুসন্ধান করতে হয় তাহলে লাহোর প্রস্তাব থেকে তা করতে হবে। বিস্তৃত বিবরণ দিতে গেলে, বারবার বলতে হবে, ইয়াহিয়া যখন ক্ষমতা পেলেন তখন বাঙ্গালীর জাতীয়তার চেতনা ফুলে-ফলে পূর্ণ বিকশিত হয়ে গেছে। তাদের রাজনৈতিক অধিকার ও আশা-আকাঙ্ক্ষা অগ্রাহ্য হওয়ার পরিণামে তাদের হতাশার বোধ বেড়ে গিয়ে তা প্রাদেশিক স্বশাসন ও শেষ পর্যন্ত ৬দফার রূপ লাভ করে। বাঙ্গালীরা পুরাদস্তুর আলাদা হয়ে গিয়েছিলেন। অতএব, ঘটনাস্থলে আমার পৌঁছানোর আগেই বিচ্ছিন্নতার তৎপরতা শুরু হয়ে গিয়েছিল এবং নিছক এক স্টাফ অফিসাররূপে আমার হাতে কোনো ক্ষমতা ছিল না।
মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী-এগ-হারকরি-পৃষ্ঠা-৪৫

আমাদের মুজিবকে ক্ষমতা হস্তান্তর করা উচিত ছিল। কেননা তিনি পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিলেন।
মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী-এগ-হারকরি-পৃষ্ঠা-৪৬

আমাদের পরাজয় ও পরিণামস্বরূপ অস্ত্রসমর্পণের একটি বড় কারন পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে প্রায় সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ ও সামরিক ব্যক্তিদের ক্রমান্বয়ী শত্রুতা।
বছরের পর বছর আমাদের অসামরিক ও সামরিক প্রশাসনের দিক থেকে পূর্ব পাকিস্তানের যে করূণ অবস্থার সৃষ্টি করে রাখা হয়েছিল, প্রাথমিকভাবে এ শত্রুতা ছিল তারই পরিণাম।
লে. জেনারেল(অবঃ) এরশাদ আহমদ খান-এগ-হারকরি-পৃষ্ঠা-৬৩

কমিশনের মতে পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা ২৫মার্চ খারাপ হয়ে যায়, যখন ইয়াহিয়া খান সেখানে মানুষের বিরুদ্ধে সামরিক তৎপরতা শুরু করেন। এক ব্রিটিশ সাংবাদিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছাত্রী হলে দেখা ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে লিখেছেনঃ ৩টা সোয়া ৩টার দিকে ৩৫০থেকে ৪০০ পাকিস্তানি মিলিটারি ওখানে হামলা করে। তারা এক এক করে তাদের কাপড় খুলে নেয়। আতঙ্কে তাদের মুখ থেকে চিৎকার বের হচ্ছিল। শাড়ি, সালোয়ার আর ব্রা টেনে টেনে এক দিকে ফেলে দেওয়া হল। মেয়েদেরকে তাদের স্তন ধরে দাঁড় করানো হল এবং ছড়ি দিয়ে পেটানো হল। বৃহৎ সংখ্যক সামরিক ও অসামরিক অফিসার যারা কমিশনের সামনে হাজির হয়েছিলেন তারা সেই ভয়াবহ দিনগুলোর বিবরণ দিয়েছেন। ওই সময়ের ঢাকার অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনার মোহাম্মদ আশরফ বলেন, ‘সামরিক তৎপরতার পর বাঙ্গালীদেরকে নিজ বাসভূমে পরবাসী করে দেওয়া হয়েছিল’।

ব্রিগেডিয়ার ইকবালুর রহমান শরিফ কমিশনকে বলেন, সামরিক ইউনিট গুলোর পরিক্রমাকালে তিনি দেখেছেন, জেনারেল গুল হাসান সৈন্যদের বলতেনঃ
‘তোমরা কতজন বাঙ্গালী কতল করেছ?’

আর এক সাক্ষ্য অনুযায়ী, যেদিন লে.জেনারেল এ.এ.কে.নিয়াজি পূর্ব পাকিস্তানে বাহিনীগুলোর কমান্ড লাভ করেন, তিনি তার লোকদের বলেনঃ
‘এ শত্রুর এলাকা। যা কিছু হাতের কাছে পাও নিয়ে নাও। আমরা বার্মায় তাই করতাম’।

বাঙ্গালী, তা সৈন্য হোক বা সাধারণ নাগরিক, হিন্দু হোক বা মুসলমান, তাকে শত্রু মনে করা হত। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসার ও জওয়ানদের বৃহৎ সংখ্যায় মেরে ফেলা হয়। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের গণহত্যার বিবরণ দিতে গিয়ে এক সাক্ষী, ৯ডিভিশনের জিএসও লে.কর্নেল মনসুরুল হক বলেনঃ সিও লে.কর্নেল ইয়াকুব মালিকের হুকুমে এক অফিসারের মাত্র আঙ্গুলের ইশারায় ১৭জন অফিসার ও ৯১৫জন জওয়ান খতম করে দেওয়া হয়।

১৬ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল নজর হোসেন শাহ, ৯ডিভিশনের জিওসি মে. জেনারেল এ.এইচ আনসারী এবং ইস্টার্ন কমান্ডের চিফ অব স্টাফ ব্রিগেডিয়ার বাকের সিদ্দিকী প্রকাশ করেন যে, সাতজন সিনিয়র অফিসার ও তাদের ইউনিটগুলো ব্যাপকভাবে লুটপাট করে। তার মধ্যে ন্যাশনাল ব্যাংকের সিরাজগঞ্জ ট্রেজারি থেকে এক কোটি পয়ত্রিশ লাখ টাকার চুরিও রয়েছে। ওই অফিসারদের মধ্যে ছিলেন ব্রি.জাহানজেব আরবাব, লে.কর্নেল মোজাফফর আলী খান জাহেদ, লে. কর্নেল বশারত আহমদ, লে. কর্নেল মোহাম্মদ তাজ, লে.কর্নেল মোহাম্মদ তোফায়েল ও মেজর মোহাম্মদ হোসেন শাহ্‌।
কমিশনের রিপোর্ট-এগ-হারকরি-পৃষ্ঠা-৬৫-৬৬


কমিশনের সিদ্ধান্তে লেখা হয়েছিলঃ ‘সামরিক কমান্ডারগণ মিলিটারি নেতৃবৃন্দ পাকিস্তানের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করলেন। সামরিক আইনের অধীন নিছক প্রথাগতভাবে চলে আসা প্রশাসনের দরুন এই কমান্ডাররা প্রকৃতিগতভাবেই দুর্নীতিগ্রস্ত অ পেশাগতভাবে অযগ্য হয়ে পড়েছিলেন। তাদের ইচ্ছার অভাব ছিল আর সংকল্পের ত্রুটি ছিল। তারা যুদ্ধ করার যোগ্য ছিলেন না’।
কমিশনের রিপোর্ট-এগ-হারকরি-পৃষ্ঠা-৬৬


পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি বাহিনী যে জুলুম ও অত্যাচার চালিয়েছে তার তদন্ত করার জন্য একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন আদালত বা তদন্ত কমিশন গঠন করা দরকার এবং যেসব ব্যক্তি পাশবিক অত্যাচার ও নির্যাতন এবং নৈতিক অপরাধে অপরাধী প্রমানিত হবেন তাদের যথাবিধি শাস্তি দেওয়া যায়।
কমিশন রিপোর্টের সুপারিশ-এগ-হারকরি-পৃষ্ঠা-৬৮

‘উইটনেস্ টু সারেন্ডার’ সিদ্দিক সালিকের লেখা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক একটি অনন্য গ্রন্থ। মেজর সিদ্দিক সালিক ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানে নিয়োগ প্রাপ্ত কমান্ডারদের জনসংযোগ অফিসার। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগদান করার পূর্বে তিনি ছিলেন লাহোর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী সাহিত্যের প্রভাষক। পরবর্তিতে তিনি ব্রিগেডিয়ার পদে উন্নীত হন এবং সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউল হকের প্রেস সেক্রেটারি নিযুক্ত হন। ১৯৮৮সালের ১৭আগস্ট প্রেসিডেন্টকে বহনকারী বিমান মধ্য আকাশে ধ্বংস হলে প্রেসিডেন্ট ও তার সফরসঙ্গীদের সাথে তিনিও প্রাণ হারান। উইটনেস্ টু সারেন্ডার বাংলায় অনুবাদ করেছেন মাসুদুল হক ‘নিয়াজির আত্মসমর্পনের দলিল’ নামে যা প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮৮সালে। আমি এখানে জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ কতৃক মুদ্রিত ফেব্রুয়ারি ২০০৭ এর সংস্করণটি ব্যবহার করেছি।

(পাকিস্তান থেকে তেজগাও বিমানবন্দরে নামার পর)
অবশেষে সামরিক বাহিনীর একটি গাড়ি আমাকে পৌছে দিতে চাইলো। গাড়ির পাশ দিয়ে এক বাঙ্গালী কিশোর হেঁটে যাচ্ছিল। তাকে ড্রাইভার আদেশ করলো আমার সুটকেস জিপে তুলে দিতে।ছিন্নবস্ত্র পরিহিত কিশোরটি ড্রাইভারের আদেশ হৃষ্টচিত্তে নিল না, বরং ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তার প্রভুর দিকে তাকালো এবং আদেশ পালন করলো। তার সাদা চোখের মণি আমার দিকে ঘুরলো। শরীরের কালো রঙের ভেতর সাদা মণির দৃষ্টিকে দারুণ মর্মভেদি মনে হল। আমি তাকে পয়সা দিতে গেলে ড্রাইভার আর্তচিৎকার করে উঠল, ‘করছেন কী? এই হারামজাদাদের আর নষ্ট করবেন না’।
উইটনেস্ টু সারেন্ডার-পৃষ্ঠা-১৪

(ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাকিস্তান সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিতে যাওয়ার পথে)
যাওয়ার পথে বাস্তবতার নতুন যাত্রা আমার মানসপটে প্রতিভাত হয়ে উঠল। এমন ধরনের দারিদ্র্যের দৃশ্য নজরে এলো-যা কাজের খোঁজে আসা আয়াদের ভিড় জমানোর কারনটা আমার কাছে সহজবোধ্য করে তুললো। মেয়েরা তালি দেওয়া ময়লা এক চিলতে কাপড় জড়িয়ে আব্রু ঢাকার চেষ্টা করছে। পুরুষ হ্রস্ব শরীরের এবং ক্ষুধার্ত। চলন্ত গাড়িতে বসেও তাদের বুকের কালো চামড়ার পাতলা স্তরে ঢাকা হাড় গোনা যায়।

আমি সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম যে, বাংলার দরিদ্ররা পশ্চিম পাকিস্তানের দরিদ্রদের থেকেও দরিদ্রতর। পূর্ব পাকিস্তানের ওপর অর্থনৈতিক শোষণ সম্পর্কিত অভিযোগের অর্থ আমার কাছে পরিষ্কার হতে শুরু করল। নিজেকে অপরাধী মনে হল।
উইটনেস্ টু সারেন্ডার-পৃষ্ঠা-১৫


বাঙ্গালীদের সঙ্গে প্রাথমিক যোগাযোগের পর আমার ধারণা হল, পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে মানসিক ক্ষেত্রে পুরোপুরি বিচ্ছেদ ঘটে গেছে। জোড়া কী আর লাগবে? অথবা দু অংশের বন্ধন কী পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে?
উইটনেস্ টু সারেন্ডার-পৃষ্ঠা-২০


(লে. জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব সামরিক আইনের দন্তহীনতা সম্পর্কে)
পাকিস্তানের জনগণের কাছে সামরিক আইন একটি ভীতির প্রতিমূর্তি। কিন্তু তারা এও ভুলে গেছে যে, এই সামরিক সরকার দেশকে গণতন্ত্রের পথে নিয়ে যাচ্ছে। মূলত সামরিক আইন এবং গণতন্ত্রের সম্পর্ক বৈরিতামূলক। সামরিক আইনের ঐতিহ্যগত ধারা গণতন্ত্রের অঙ্কুরোদগমন করতে দেয় না।
লে. জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব - উইটনেস্ টু সারেন্ডার-পৃষ্ঠা-৩৩


(৭০এর নির্বাচনের পর)
বস্তুত নির্বাচনের আগের দিনই আওয়ামী লীগ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে গেল। ৭ডিসেম্বর মুজিবুর রহমানের প্রকৃ্ত বিজয়কে শুধু আনুষ্ঠানিকতার মালা পরানো হলো। আওয়ামী লীগ নির্বাচনে বিজয়ী হবে – অনেকেই নভেম্বরের শেষাশেষি থেকে তাদের এই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে থাকে।
উইটনেস্ টু সারেন্ডার-পৃষ্ঠা-৩৪


(নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতা গ্রহণ করলে নিজের ভাগ্যে কী ঘটবে তা নিয়ে অনেক সরকারি কর্মকর্তার মাঝে ভীতির সঞ্চার হয়েছিল বিশেষ করে পাকিস্তানপন্থীদের মাঝে)
সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের একজন সিনিয়র অফিসারের কথা মনে পরলো। তিনি বলেছিলেন, ‘ক্ষমতায় যাওয়ার পর শেখ সাহেব যদি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সমস্ত কাগজপত্র চেয়ে পাঠান তাহলে নিশ্চয়ই বেশ কয়েক জায়গায় আমার নাম দেখতে পাবেন। এবং ভুলে যাওয়া ও ক্ষমা করার মত উদার মুজিব নন’। সামরিক বাহিনীর যেসব অফিসার তাদের চাকরি জীবনে কখনোই মুজিবকে অসন্তুষ্ট করেননি, তারা ছয় দফার পক্ষে উচ্চকণ্ঠে প্রচারাভিযানে নেমে পড়লেন। আওয়ামী লীগের কর্মসূচির গুণাগুণ নির্ণয়ের ব্যাপারে বক্তব্য রাখাকালে তারা একে অপরকে ছাড়িয়ে যাবার চেষ্টা করলেন।
উইটনেস্ টু সারেন্ডার-পৃষ্ঠা-৩৪


(৭০এর নির্বাচনের পর ডিসেম্বরের শেষ দিকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার আস্থাভাজন এক জেনারেল ঢাকায় আসেন এবং গভর্নমেন্ট হাউজে নিচের মন্তব্যটি করেন)
গভর্নমেন্ট হাউজে সুস্বাদু ভোজ পর্ব সমাধার পর ঘরোয়া পর্যায়ে আলাপচারিতাকালে তিনি ঘোষণা করলেন, ‘চিন্তা করো না.... আমাদের ওপর শাসন চালাতে এই কালো জারজদের সুযোগ দেব না’।
উইটনেস্ টু সারেন্ডার-পৃষ্ঠা-৩৮


নির্বাচনোত্তর পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের এই মোকাবেলা ঢাকায় আমাদের কাছে নতুন ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়ালো। যে সমস্ত জুনিয়র অফিসার রাজনৈতিক জটিল সমস্যাবলি নিয়ে কদাচিৎ মাথা ঘামায়, তাদের ওপর এর কী প্রভাব পরবে, তা বুঝতে পারি। যারা ভুট্টোকে তাদের আশা-আকাংক্ষার পক্ষে সর্বজয়ী বীর মনে করলো তারা বললো, কিভাবে একটি প্রদেশ সারা দেশ শাসন করতে পারে? অন্যরা যাদের মনে স্থানীয় অবস্থার প্রতি খাঁটি দরদ রয়েছে – তারা বললো, ‘তেইশ বছর ধরে আমরা তাদের(বাঙ্গালীদের) ওপর আধিপত্য করেছি। এখন তাদের সময়। সব সময় তাদের ঠকানো উচিৎ নয়’।
উইটনেস্ টু সারেন্ডার-পৃষ্ঠা-৩৮


ঢাকা সমাবেশের পর দিনই ছিল পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের তেইশতম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী দিবস। মনে হলো লক্ষ্য অর্জনে মুজিব থেকে ছাত্ররাই অধিকতর অধৈর্য হয়ে উঠেছে। তারা তার উপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করলো তাদের ইচ্ছার কাছে তাকে আত্মসমর্পন করতে। কিন্তু তিনি ধৈর্য ধারণের পরামর্শ দিয়ে বলেন, ‘যদি প্রয়োজন পরে তাহলে আমি বিপ্লবের ডাক দেব। ততক্ষণ পর্যন্ত তোমাদের অপেক্ষা করতে হবে’।
উইটনেস্ টু সারেন্ডার-পৃষ্ঠা-৪১


(২মার্চ রাতে সেনাবাহিনীর গুলিতে ৬জন নিহত হয়)
পরদিন তারা(আওয়ামী লীগ) মৃতদেহগুলো নিয়ে শহরের প্রধান প্রধান রাস্তায় মিছিল করলো। এরপর মুজিব মৃতদেহগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে একজন বাগ্মী হিসেবে নিজের শ্রেষ্ঠতম প্রতিভার পরিচয় দিলেন। তার আগুনঝরা বক্তৃতা মিছিলে এমন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করলো যে, তারা তার জন্য জীবন বাজি রেখে যে কোন ধরণের ভয়াবহ কাজে তাৎক্ষনিক ভাবে নেমে যেতে পারে।
উইটনেস্ টু সারেন্ডার-পৃষ্ঠা-৫৪


(৬মার্চ ইয়াহিয়া শেখ মুজিবের জন্য একটি বার্তা পাঠান যাতে ইয়াহিয়া শেখ মুজিবকে অনুরোধ করেন দ্রুত কোন সিদ্ধান্ত না নেওয়ার জন্য। বার্তাটি একজন ব্রিগেডিয়ার ধনামন্ডিতে গিয়ে পৌঁছে দিয়ে আসেন)
একজন ব্রিগেডিয়ার নিজে ধানমন্ডির বাসভবনে গিয়ে মুজিবের হাতে বার্তাটি পৌঁছে দিয়ে এলেন। ফিরে এসে তিনি মুজিবের আতিথেয়তা ভদ্র আচরণ, বাসভবনের সামনে দাঁড়ানো ডজন ডজন গাড়ি, শত শত মানুষ ইত্যাদি সম্পর্কে অনর্গল বলে যেতে থাকেন। বলেন, ‘বাড়ির চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মানুষগুলো যেন কোন উৎসবের রৌদ্রে অবগাহন কড়ছে’।
উইটনেস্ টু সারেন্ডার-পৃষ্ঠা-৫৯



(৭মার্চ)
সেই চরম সন্ধিক্ষণ এসে গেল। মুজিবের ভাষণ দেবার কথা ছিল ২টা ৩০মিনিটে(স্থানীয় সময়)। রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্র মুজিবের ভাষণ নিজ উদ্যোগে সরাসরি প্রচারের ব্যবস্থা সম্পন্ন করে। রেডিওর ঘোষকরা আগে থেকেই রেসকোর্স থেকে ইস্পাত দৃঢ় লক্ষ দর্শকের নজিরবিহীন উদ্দীপনার কথা প্রচার করতে শুরু করে।

এ ব্যপারে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দফতর হস্তক্ষেপ করল এবং এই বাজে ব্যপারটি বন্ধ করার নির্দেশ দিল। আমি বেতার কেন্দ্রে আদেশটি জানিয়ে দিলাম। আদেশটি শোনার সঙ্গে সঙ্গে টেলিফোনের অপর প্রান্তের বাঙ্গালী বন্ধুটি তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন। বললেন, ‘আমরা যদি সাড়ে সাত কোটি জনগণের কন্ঠকে প্রচার করতে না পারি তাহলে আমরা কাজই করবো না’। এই কথার সাথে সাথে বেতার কেন্দ্র নীরব হয়ে গেল।
(এরপর সারাদিন বেতার নীরব ছিল, পরদিন সকাল ৮টায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ প্রচারের মধ্যদিয়ে বেতার কেন্দ্র আবার চালু হয়)
উইটনেস্ টু সারেন্ডার-পৃষ্ঠা-৬০


(লে. জেনারেল টিক্কা খান ৭মার্চ ঢাকায় আসেন এবং তিনি একাধারে গভর্নর, সামরিক আইন প্রশাসক ও পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন)
মুজিবুর রহমান তখনও প্রদেশ চালিয়ে যাচ্ছেন। আর জেনারেল টিক্কা খান পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হিসেবে শপথ নেবার জন্য কোনো বিচারপতি খুঁজে পেলেন না। ‘অসুস্থ শরীরের কারণে’ পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি মি. জাস্টিস সিদ্দিকী শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনায় অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করলেন। মূলত তিনি প্রদেশের ডি ফ্যাক্টো শাসক আওয়ামী লীগকে ক্ষুদ্ধ করতে চাইলেন না।
উইটনেস্ টু সারেন্ডার-পৃষ্ঠা-৬২


ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগ তার শাসনকে সংহত করার জন্য একের পর এক নির্দেশ (মোট সংখ্যা ৩১) জারি করে চললো। এইসব নির্দেশাবলি সমাজের সর্বস্তরে তথা সরকারের সব বিভাগ, কলকারখানা, রাষ্ট্রীয় ও বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ বাঁকি সব প্রতিষ্ঠানই মেনে চললো। এমনকি সরকারি নিয়ন্ত্রণাধীন রেডিও এবং টিভিও মুজিবের আদেশ অনুসারে চলতে থাকে।
উইটনেস্ টু সারেন্ডার-পৃষ্ঠা-৬২


তিনি(শেখ মুজিব) সেনাবাহিনীকে রেল ও সড়কে প্রবেশ করতে না দিতে জনগণের প্রতি আহবান জানালেন। স্থানীয় ঠিকাদাররা সরবরাহ বন্ধ করে দিল। ফলে খাদ্যের জন্য অফিসার ও জোয়ানরা মজুদ শুকনো রেশনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পরে। তবু তারা আদেশ মেনে চললো।
উইটনেস্ টু সারেন্ডার-পৃষ্ঠা-৬২


(১৫মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া আলোচনার উদ্দেশ্যে ঢাকায় আসেন)
ব্রিফিং শেষে প্রেসিডেন্ট বললেন, ‘ভাবনার কিছুই নেই। মুজিবের ব্যবস্থা কালকেই করছি আমি। তাকে আমার মনের ইচ্ছা একটুখানি জাণীয়ে দেব। শীতল চেহারা দেখাবো এবং তাকে দ্বিপ্রাহরিক ভোজেও আমন্ত্রণ জানাবো না।
এরপর পরদিন আমি তার সাথে দেখা করবো এবং এতে তার মধ্যে কী প্রতিক্রিয়া হয়, সেটা দেখবো। যদি তিনি ভদ্র আচরণ না করেন, তাহলে আমি জবাবটা জানিয়ে দেব’। একটি নিস্তব্ধতা নেমে এলো। একটি অস্বস্তিকর মুহূর্ত। এই সময় দীর্ঘকায় ঋজু দেহের পেশীবহুল এক ব্যক্তি গর্বোন্নত স্কন্ধদেশ সোজা করে দাঁড়ালেন। এবং কিছু বলার জন্য অনুমতি চাইলেন। মাথা নেড়ে তাকে অনুমতি দেয়া হল। তিনি মুখ খুললেন, ‘স্যার অবস্থা খুবই নাজুক। অপরিহার্যভাবে এটা একটি রাজনৈতিক ব্যাপার এবং রাজনৈতিকভাবেই এর সমাধান হওয়া বাঞ্ছনীয়। নইলে হাজার হাজার নিরপরাধ নারী, পুরুষ ও শিশু নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে’। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া গভীর মনোযোগের সঙ্গে শুনছিলেন এবং অন্যরা শুনছিলেন দুরু দুরু বক্ষে। প্রেসিডেন্ট মাথা নাড়লেন। যেন চাবুক দিয়ে আঘাত করলেন, এমনি স্বরে বললেন, ‘মিঠঠি, আমি জানি সেটা ...আমি জানি’। মিঠঠি বসে পরলেন। (কয়েকদিন পর তার দায়িত্ব থেকে তাকে নীরবে অব্যাহতি দেওয়া হল। পরবর্তী সময়ে তিনি শুধু নিজের মনোবলের উপরই টিকে ছিলেন।)
উইটনেস্ টু সারেন্ডার-পৃষ্ঠা-৬৬-৬৭
(মিঠঠি-তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কোয়ার্টার মাস্টার জেনারেল মেজর জেনারেল এ ও মিঠঠি)


মূলত পূর্ববর্তী মাসের প্রথম পনের দিনেই সমঝোতামূলক সমাধানের সাধারণ ভিত্তি বিলুপ্ত হয়ে যায়। এই সময়টিতে মুজিব শক্ত হাতে প্রদেশটি শাসন করলেন। বেসামরিক প্রশাসন ও জনগণের ওপর তার নিরঙ্কুশ আধিপত্য ছিল। তার এই ডি ফ্যাকটো নিয়ন্ত্রণের পেছনে সমর্থন জুগিয়েছিল গত নির্বাচনে জনগণের দেয়া শক্তিশালী ম্যান্ডেট। কেন তা হলে মুজিব স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ভাগাভাগি করবেন? তিনি পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত একজন অতিথির জন্য কিছুটা জায়গা ছেড়ে দিতে পারেন –যদি ওই অতিথিটি তার খসড়া শাসনতন্ত্র অনুমোদনে পালটা সাড়া দেন।
উইটনেস্ টু সারেন্ডার-পৃষ্ঠা-৬৭


ওই বৈঠকেই জেনারেল ফরমান হালকা নীল কাগজের অফিসিয়াল প্যাডের ওপর একটি সাধারণ কাঠ পেন্সিল দিয়ে নতুন পরিকল্পনাটি লিপিবদ্ধ করেন। আমি জেনারেল ফরমানের নির্দোষ হাতের মূল পরিকল্পনাটি দেখেছিলাম। পরিকল্পনার দ্বিতীয় অংশটি লেখেন জেনারেল খাদিম। তাতে প্রাপ্য সমর সম্ভারের বণ্টন ও বিভিন্ন ব্রিগেড ও ইউনিটের কাজ ভাগ করে দেয়া হয়েছিল।

১৬টি প্যারা সম্বলিত পাঁচ পৃষ্ঠাব্যাপি এই পরিকল্পনার নামকরণ করা হল অপারেশন সার্চ লাইট।
উইটনেস্ টু সারেন্ডার-পৃষ্ঠা-৬৯


এইভাবে ২৩মার্চের সূর্য উদিত হল। তারিখটি ঐতিহাসিক পাকিস্তান দিবসের স্মৃতিবার্ষিকীর দিন। এই দিনে, ১৯৪০সালে পাকিস্তান প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল। আওয়ামী লীগ এই দিনটিকে ‘প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করলো। তারা পাকিস্তানের পতাকা পোড়ালো, কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ছবি টুকরো টুকরো করে ছিঁড়লো এবং তার কুশপুত্তলিকা দাহ করলো। অন্যদিকে তারা স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা ওড়ালো এবং শেখ মুজিব নিজেই এর অংশী ছিলেন। সকালে তিনি তার বাড়িতে একটি ছাত্র প্রতিনিধি দলকে অভ্যর্থনা জানান এবং তার বাড়ির ছাদে (ডি ফ্যাকটো প্রেসিডেন্ট ভবন) বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের অনুমতি দেন। বাড়ির সামনে দিয়ে মার্চপাস্ট করে এগিয়ে যাওয়া ছাত্রদের সালাম গ্রহণ করেন।

সারা শহর ছেয়ে যায় গাঢ় মেরুন ও সোনালী রঙের পতাকায়। পাকিস্তানের পতাকা তখন মাত্র দুইটি স্থানে দেখা গেল। একটি গভর্নমেন্ট হাউসে ও অন্যটি সামরিক আইন সদর দফতরে। কিছু চতুর ছেলে গভর্নমেন্ট হাউসের পশ্চিম প্রবেশ দ্বারে বাংলাদেশের একটি ছোট্ট পতাকা সেঁটে দিয়েছিল। কিন্তু সংযুক্ত পাকিস্তানের প্রতীক হয়ে তখনো প্রধান ভবনের শীর্ষে পাকিস্তানের পতাকা উড়ছিল। অবশ্য সেটাকে অত্যন্ত নিঃসঙ্গ দেখাচ্ছিল।
বাঙ্গালী যুবকরা ‘জয়বাংলা’ শ্লোগানে নগরীর রাজপথ প্রকম্পিত করে তুললো।
উইটনেস্ টু সারেন্ডার-পৃষ্ঠা-৭৩


(একাত্তরের ২৫মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া অত্যন্ত গোপনে ঢাকা ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন, যদিও তা গোপন থাকেনি)
লে.কর্নেল এ আর চৌধুরী ছিলেন ইয়াহিয়ার স্টাফদের একজন। তিনি দেখলেন প্রেসিডেন্টের মালামাল ডজ গাড়িতে করে বিমান বন্দরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি মুজিবুর রহমানকে জানিয়ে দিলেন। সন্ধ্যে সাতটায় জেনারেল ইয়াহিয়া খান পিএএফ গেট দিয়ে বিমান বন্দরে ঢুকলেন বিমানে চড়ার জন্য। উইং কমান্ডার খন্দকার তার অফিসে বসে এ দৃশ্যটি দেখলেন। সাথে সাথে মুজিবকে জানিয়ে দিলেন। পনের মিনিট পর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল থেকে একজন বিদেশী সাংবাদিক টেলিফোন করলেন আমাকে। জিজ্ঞেস করলেন, ‘মেজর, প্রেসিডেন্ট চলে গেছেন, খবরটি কি সত্য?’

ইতিমধ্যে রাত্রি পা পা করে এগিয়ে এলো। কিন্তু কেউই তখনো জানতো না যে, এ রাত্রির শেষটা একটি অনাময় সকাল হয়ে আর আসবে না।
উইটনেস্ টু সারেন্ডার-পৃষ্ঠা-৭৫


(২৫মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইট শুরুর আগমুহূর্তে)
আকাশে তারার মেলা, শহর গভীর ঘুমে নিমগ্ন। বসন্তের ঢাকার রাত যেমন মনোরম হয়, তেমনই ছিল রাতটি। একমাত্র রক্তক্ষয়ী হত্যাযজ্ঞ ছাড়া অন্য সবকিছুর জন্যই পরিবেশটি ছিল মোহনীয়।
উইটনেস্ টু সারেন্ডার-পৃষ্ঠা-৭৭


নির্দিষ্ট সময়ের আগেই সামরিক কার্যক্রম শুরু হয়ে যায়। এখন আঘাত হানার নির্ধারিত মুহূর্তে (এইচ আওয়ার) প্রর্যন্ত স্থির থাকার চিহ্ন বিলুপ্ত হয়ে গেল। নরকের দরজা উন্মুক্ত হয়ে গেল। যখন প্রথম গুলিটি বর্ষিত হল, ঠিক সেই মুহূর্তে পাকিস্তান রেডিওর সরকারি তরঙ্গের কাছাকাছি একটি তরঙ্গ থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষীণ কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। ওই কণ্ঠের বাণী মনে হল আগেই রেকর্ড করে রাখা হয়েছিল। তাতে শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ হিসেবে ঘোষণা করলেন। ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ ডকুমেন্টস’ এ ওই ঘোষণার পূর্ণ বিবরণ প্রকাশিত হয়েছিল। ঘোষণায় বলা হয়, ‘এই-ই হয়তো আপনাদের জন্য আমার শেষ বাণী হতে পারে। আজকে থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের জনগণের প্রতি আহবান জানাচ্ছি – যে যেখানেই থাকুন, এবং হাতে যার যা আছে তা-ই নিয়ে দখলদার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলুন। ততদিন পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যেতে হবে যতদিন না দখলদার পাকিস্তান বাহিনীর শেষ সৈন্যটি বাংলাদেশের মাটি থেকে বিতাড়িত হচ্ছে এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হচ্ছে’।

আমি রেডিওর ওই ঘোষণাটি শুনিনি। শুধু শুনলাম, রকেট ল্যান্সারের গোলার প্রচণ্ড শব্দ। মুজিবের বাসভবন অভিমুখী রাস্তার প্রতিবন্ধক অপসারণ করছে কমান্ডোরা রকেট গোলা বর্ষণ করে। হামলাকারী প্লাটুনের সঙ্গে ছিলেন কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল জেড এ খান ও কোম্পানি কমান্ডার মেজর বিল্লাল।

কমান্ডোরা মুজিবের বাড়ির কাছাকাছি হলে গেটে অবস্থানরত সশস্ত্র পাহারাদারদের গুলির মুখে পড়লো তারা। পাহারাদারদের দ্রুত অকেজো করে ফেলা হল এবং মুহূর্তে পঞ্চাশজন শক্তিশালী সৈন্য দৌড়ে চার ফুট উঁচু বাড়ির দেয়াল লাফিয়ে উঠোনে নামলো। স্টেনগানের ব্রাস্ট ফায়ার করে তারা তাদের উপস্থিতি জানান দিল এবং চিৎকার করে শেখ মুজিবকে বেরিয়ে আসার আহবান জানালো। কিন্তু কোনো সাড়া এলো না। তারপর দুপদাপ শব্দ তুলে হড়হুড়ি করে বারান্দায় উঠলো তারা। এরপর দোতলায়। অবশেষে মুজিবের শোবার ঘর খুঁজে বের করলো। দরজা বাইরে থেকে তালা মারা ছিল। একটি বুলেট ঝুলন্ত ইস্পাত খণ্ডকে বিদীর্ণ করে। সঙ্গে সঙ্গে সেটা খুলে নীচে পড়ে গেল এবং মুজিব তৎক্ষণাৎ রুম থেকে বেরিয়ে এলেন। গ্রেফতারের জন্য নিজেকে সোপর্দ করলেন। মনে হল, তিনি এর জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। হামলাকারী দল বাড়ির সবাইকে গ্রেফতার করলো। সেনাবাহিনীর একটি জিপে করে তাদেরকে দ্বিতীয় রাজধানীতে নিয়ে আসা হলো। কয়েক মিনিট পর ৫৭ব্রিগেডের ব্রিগেড মেজর জাফরের কণ্ঠ বেতার যন্ত্রে ভেসে উঠলো। আমি তার কাঁপা কাঁপা কণ্ঠ স্পষ্ট শুনতে পেলাম। তিনি বলছেন, ‘বড় পাখিটা খাঁচার ভেতর... অন্যগুলো নীড়ে নেই...ওভার’।
উইটনেস টু সারেন্ডার-পৃষ্ঠা-৭৯


সে সময় আমার বন্ধু মেজর বিল্লালের কাছে জানতে চাইলাম কেন সে উত্তেজনার মুহূর্তে মুজিবকে শেষ করে দিল না। সে বললো, ‘মুজিবকে জীবন্ত গ্রেপ্তারের জন্য জেনারেল মিঠঠি আমাকে ব্যক্তিগতভাবে নির্দেশ দিয়েছিলেন’।

যখন মুজিব আদমজী স্কুলে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন(গ্রেপ্তারের পর) সে সময় ঢাকা নগরী গৃহযুদ্ধের তাণ্ডব যন্ত্রণায় দগ্ধ হচ্ছিল। চারঘণ্টা ধরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমি সেই হৃদয়-বিদারক দৃশ্য দেখলাম। সেই রক্তাক্ত রাতের প্রধান বৈশিষ্ট হল – অগ্নিশিখা আকাশকে বিদ্ধ করছে। একসময় অগ্নিবর্ণের শোকার্ত ধূম্রকুণ্ডলী ছড়িয়ে পড়লো কিন্তু পড় মুহূর্তেই সেটাকে ছাপিয়ে উঠলো লকলকে অগ্নিশিখা। তারকাপুঞ্জকে স্পর্শ করতে চাইছে। মনুষ্যসৃষ্ট এই অগ্নিকুণ্ডের পাশে চাঁদের উজ্জ্বল আলো আর তারকাপুঞ্জের রক্তিমাভা ম্লান হয়ে গেল। বিশালদেহী ধুম্রকুণ্ডলী ও অগ্নিশিখা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর ছাড়িয়ে আকাশে মাথা তুললো। অবশ্য শহরের অন্যান্য অংশ যেমন ‘দৈনিক পিপল’ এর চত্বরও এই ভয়ংকর আতশবাজি খেলার শিকারে কোন অংশে কম নিপতিতি হল না।

প্রায় রাত দু’টোর দিকে জিপের ওপর বসানো বেতার যন্ত্রটি আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করলো। আমাকে বার্তাটি গ্রহণের আদেশ দেয়া হলো। বেতার যন্ত্রের অপর প্রান্তে ছিল একজন ক্যাপ্টেন। সে জানালো, ইকবাল হল ও জগন্নাথ হলে তাকে প্রচণ্ড রকমের প্রতিরোধের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। সে মুহূর্তে একজন সিনিয়র অফিসার আমার হাত থেকে যন্ত্রটি কেড়ে নিলেন এবং মাউথ পিসটি মুখের সামনে এনে চিৎকার করে বললেন, ‘লক্ষ্যকে ধ্বংস করতে তোমার কতক্ষণ লাগতে পারে?’
‘.....চারঘণ্টা’। ....... ‘....ননসেন্স কী কী অস্ত্র আছে তোমার কাছে? রকেট লাঞ্চার, রিকয়েললেস রাইফেলস, মর্টার এবং ঠিক আছে, সবগুলোই ব্যবহার কর। পুরো এলাকা দু’ঘণ্টার মধ্যে দখলের ব্যবস্থা কর’।

বিশ্ববিদ্যালয় ভবন ভোর চারটায় দখলে এলো। বছরের বেশিরভাগ সময়ধরে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের প্রচার হয়েছে যেখানে, সেটাকে দমন করতে প্রচুর সময় নেবে। সম্ভবত আদর্শ অজেয়।
উইটনেস্ টু সারেন্ডার-পৃষ্ঠা-৮০


ভুট্টো প্লেনে উঠার আগে গত রাতে সেনাবাহিনীর কাজের প্রশংসা করে একটি সাধারণ মন্তিব্য করলেন। সশস্ত্র প্রহরীদের প্রধান ব্রিগেডিয়ার আরবাবকে বললেন, ‘আল্লাহকে অশেষ ধন্যবাদ, পাকিস্তানকে রক্ষা করা গেছে’। করাচি পৌঁছে তিনি এই উক্তির পুনরাবৃত্তি করেন।

যখন ভুট্টো এই আশাব্যঞ্জক মন্তব্য করেন তখন আমি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার গণকবরগুলো দেকছিলাম। পাঁচ থেকে পনের মিটার ব্যাসার্ধের তিনটি গর্ত দেখতে পেলাম। সেগুলো সদ্য তোলা মাটি দিয়ে ভরাট করা হয়েছে। কোন অফিসারই মৃতের সংখ্যা প্রকাশ করতে চাইল না। ইকবাল হল ও জগন্নাথ হলের চারপাশ দিয়ে আমি হাঁটতে শুরু করলাম। দূর থেকে মনে হয়েছিল, হামলার সময় দুটি ভবনই মাটির সাথে মিশে গেছে।
উইটনেস্ টু সারেন্ডার-পৃষ্ঠা-৮১


দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য আমি তাড়াতাড়ি ক্যান্টনমেন্টে ফিরে এলাম। এখানকার পরিবেশ সম্পূর্ণ ভিন্নতর দেখলাম। শহরের হৃদয়-বিদারক ঘটনা সামরিক বাহিনীর লোকজন এবং তাদের ওপর নির্ভরশীলদের স্নায়বিক অবস্থাকে স্বাভাবিক করে তুলেছে। তাদের অনুভূতি এই রকম- দীর্ঘদিন পড় ঝড় শান্ত এবং অবশেষে বয়ে গেছে দিগন্তকে নির্মল করে। স্বস্তির সাথে গা এলিয়ে দিয়ে অফিসার্স মেসে অফিসাররা বসে গল্প করছে। কমলালেবুর খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে ক্যাপ্টেন চৌধুরী বললেন, ‘বাঙ্গালীদের ভালো করে এবং ঠিকমতো নিবীর্য করা হয়েছে অন্তত একটি বংশধরের জন্য তো বটেই’।
উইটনেস্ টু সারেন্ডার-পৃষ্ঠা-৮২


অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল –এর দ্বিতীয় ব্যক্তি মেজর জিয়াউর রহমান ব্রিগেডিয়ার মজুমদারের অনুপস্থিতিতে চট্টগ্রামের বিদ্রোহীদের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। রেডিও স্টেশন প্রহরারত সরকারি সৈন্যরা সেখানে শক্তভাবেই অবস্থান করছিল। কাপ্তাই রোডে ছিল আলাদা একটা ট্রান্সমিটার। মেজর জিয়া সেটার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন এবং বাংলাদেশের ‘স্বাধীনতা ঘোষণা’ প্রচারের জন্যে যাবতীয় যন্ত্রপাতির ব্যবহার করলেন।
উইটনেস্ টু সারেন্ডার-পৃষ্ঠা-৮৩


(জেনারেল টিক্কার উপর চাপের ভার লাঘবের জন্য নতুন একজন জেনারেল পাঠানো হয় যার নাম জেনারেল নিয়াজি)
১১ এপ্রিল ফ্লাগ স্টাফ হাউসের ফুলবাগানে তার সাথে আমি দেখা করি। একই দিন সকালে তিনি পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। নতুন নিয়োগ তার পদোন্নতি ঘটায়। তিনি লে. জেনারেল হলেন। যাবতীয় রিবন ও যুদ্ধে প্রাপ্ত খেতাবের মেডেলে সজ্জিত হয়ে তিনি পদোন্নতির আমেজ উপভোগ করছিলেন। নতুন চাকরির বিষয়ে তাকে পুরোপুরি আস্থাবান মনে হল। জিওসি জেনারেল খাদিম রাজা পরে আমাকে বলেন, যে সময়ে তিনি কমান্ডের দায়িত্ব হস্তান্তর করছিলেন সে সময় জেনারেল নিয়াজি তাকে প্রশ্ন করেন, ‘কখন তুমি তোমার রক্ষিতাদের আমার হাতে তুলে দিচ্ছ?’
উইটনেস্ টু সারেন্ডার-পৃষ্ঠা-৯৬


এই সৈন্যদের নিয়ে বাঙ্গালী প্রতিরোধের মেরুদণ্ড ভাঙ্গতে জেনারেল নিয়াজির বেশি সময় লাগলো না। এপ্রিলের শেষাশেষি তিনি প্রধান প্রধান শহরের দখল নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ছোট-খাট অপারেশন পরিচালনায় মনোনিবেশ করলেন। কিন্তু তুলনামূলকভাবে শান্ত এবং নিরংকুশভাবে নিয়ন্ত্রিত এ সময়কে বাঙ্গালীদের মন জয় করার জন্য তেমন কোন গঠনমূলক প্রচারাভিযানে ব্যবহার করা হল না। তাদের ক্ষত আরো দগদগে করে তোলা হলো সাধারণ মানুষের বাড়ি বাড়ি হামলা চালিয়ে। ‘উচ্ছেদকরণ অপারেশন’ নামে তাকে অভিহিত করা হয়।

এ অপারেশন আংশিকভাবে সফল হয়। কেননা, পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যরা সন্দেহজনক লোকদের চেহারা যেমন চিনতো না তেমনি অলগলির নম্বরও (বাংলাতে লেখা) পড়তে পারতো না।...............এসময় একমাত্র দক্ষিণপন্থীরা এগিয়ে এলেন। যেমন, কাউন্সিল মুসলিম লীগের খাজা খয়ের উদ্দীন, কনভেনশন মুসলিম লীগের ফজলুল কাদের চৌধুরী, কাইয়ুম মুসলিম লীগের খান এ সবুর খান, জামায়াতে ইসলামীর অধ্যাপক গোলাম আযম ও নেজামে ইসলাম পার্টির মৌলভী ফরিদ আহমদ।

এদের সবাইকে আওয়ামী লীগ ১৯৭০সালের নির্বাচনে পরাজিত করে। বাঙ্গালীদের ওপর এদের প্রভাবও ছিল অত্যন্ত সামান্য। সাধারণ মানুষের অনুভূতি ছিল, এরা সবাই অচল মুদ্রা। সেনাবাহিনী আরেকবার এদের চালু মুদ্রায় পরিণত করেছে। সেনাবাহিনী নিজস্ব প্রয়োজনেই তাদের উপস্থিতির গুরুত্ব দিল এবং তাদের পরামর্শ অনুসরণ করে চললো।
উইটনেস্ টু সারেন্ডার -পৃষ্ঠা-৯৭



রেডিও এবং টেলিভিশনে, হামলা সংঘটিত হবার পরপরই ‘স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজমান’ এ ধারণা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে নতুন নতুন সামরিক আইন আদেশ প্রচারের জন্য আমাকে বেতার কেন্দ্র ‘পুনঃসক্রিয়করণ’ এর কাজে নিয়োগ করা হয়। শুরুতে আমি ভাবলাম সামরিক আইন আদেশ ঘোষণার বিরতির মাঝে তাদেরকে যন্ত্র সঙ্গীত বাজানোর সুযোগ দেয়া নিরাপদ। সুযোগ পেয়ে তারা অন্ত্যেষ্টিকালীন শোক সঙ্গীত বাজাতে শুরু করে। সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে সৃষ্ট ধ্বংস ও মৃত্যুর জন্যে বিলাপমূলক সঙ্গীত বাজিয়ে চললো। বদলে দেশের দু’অংশের মধ্যকার ইসলামী ভ্রাতৃ বন্ধন পুনঃজাগরণে নাত ও হামদ বাজানোর নির্দেশ দিলাম। তারা অত্যন্ত চতুরতার সাথে এ আধ্যাত্মিক সঙ্গীতটি ট্রান্সমিট করলোঃ

‘আয়ে মওলা-এ- আলী, আয়ে শের-এ খোদা,
মেরে কিস্তি পার লাগা দে না।‘
(হে প্রভু!হে আলী! আমার নৌকা নিরাপদে তীরে নিয়ে যাও।)
ঘটনাক্রমে নৌকা ছিল আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতীক।

একইভাবে হিন্দু ও বৃটিশ আধিপত্য থেকে স্বাধীনতা লাভের বিষয়টি ঊর্ধে তুলে ধরার প্রয়োজনে পাকিস্তান আন্দোলনের বীরদের নিয়ে স্বল্পদৈর্ঘ্য নাটক তৈরির জন্যে টেলিভিশন কতৃপক্ষকে নির্দেশ দিলাম। তারা মওলানা মুহম্মদ আলী জওহরের মত বিখ্যাত ব্যক্তিত্যকে বেছে নেয় এবং স্বাধীনতার পবিত্রতম বৈশিষ্ট্যসমূহ প্রচারের জন্যে একটি শক্তিশালী নাটক প্রচার করে। নাটকের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার যোদ্ধাদের(মুক্তিবাহিনী) প্রতি আহবান জানানো হয় যে, যে কোন মহান ত্যাগের জন্য তারা যেন কুণ্ঠিত না হয়।

স্বাধীনতার এই বীজ উৎপাটনের বদলে কতৃপক্ষ ‘তাসের জুয়ার কোর্ট নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য’ ত্রাসের রাজত্ব অব্যাহত রাখা বিজ্ঞোচিত মনে করলো। ‘দেশপ্রেমিক’ পাকিস্তানিদের খবরের উপর ভিত্তি করে তারা প্রায়শই ‘সন্ধান ও উচ্ছেদকরণ অপারেশন’ চালাতে লাগলো।
উইটনেস্ টু সারেন্ডার- পৃষ্ঠা-৯৮



দৃষ্টান্তস্বরূপ, একদিন একজন দক্ষিণপন্থী রাজনীতিক একটি তরুণকে সঙ্গে নিয়ে সামরিক আইন সদর দফতরে আসে। বারান্দাতে হঠাৎ করেই তার সাথে আমার দেখা। আস্থাভরে ফিসফিসিয়ে সে বললো, ‘বিদ্রোহীদের সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কিছু খবর তার কাছে আছে’। আমি তাকে যথাযথ কতৃপক্ষের কাছে নিয়ে গেলাম। সেখানে গিয়ে সে বললো, ‘বালকটি তার ভাইয়ের ছেলে। সে বুড়ীগঙ্গা নদীর অপর পার কেরানীগঞ্জের বিদ্রোহীদের বন্দীশিবির থেকে পালিয়ে এসেছে’। বালকটি আরো বললো, ‘বিদ্রোহীরা শুধু স্থানীয় লোকজনদের হয়রানিই করছে না –রাতে ঢাকা শহর আক্রমণের পরিকল্পনা নিয়েছে’। তৎক্ষণাৎ ‘উচ্ছেদকরণ অপারেশন’ –এর আদেশ দেয়া হয়।
................যে অফিসার হামলা পরিচালনা করে, সন্ধ্যায় তার সাথে দেখা করলাম। সে যা বললো, তাতে আমার রক্ত হিম হয়ে গেল। দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে সে বললো, ‘ওখানে কোন বিদ্রোহী ছিল না। ছিল না অস্ত্রও। শুধু গ্রামের গরিব লোকেরা –অধিকাংশ নারী এবং বৃদ্ধ। গোলার আগুনের মাঝে পুড়ে দগ্ধ হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক এই যে, গোয়েন্দা মারফত সঠিক সংবাদ সংগ্রহ না করেই এই হামলা পরিচালিত হয়েছে। আমার বিবেকের ওপর এ ভার আমি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বয়ে বেড়াবো’।

যখন এই সন্ধান উচ্ছেদ অপারেশন এগিয়ে চলছিল সে সময় রেডিও পাকিস্তান, সংবাদপত্র ও টেলিভিশন ‘স্বাভাবিক’ নিয়ে একঘেয়ে সুরে বাঁশি বাজাতে শুরু করে যে, প্রদেশে স্বাভাবিক অবস্থা দ্রুত ফিরে আসছে। এটা এমন সময় ঘটলো যখন কোন বাড়ির লোকজন রেডিও পাকিস্তান প্রচারিত ‘স্বাভাবিক অবস্থার’ কথা শুনছে তখনই অনুসন্ধান দলের সামনে যা পড়ছে তাই-ই তারা উচ্ছেদ করে চলেছে। ফলে সরকার নিয়ন্ত্রিত অন্যান্য প্রচার মাধ্যমের মতই রেডিও পাকিস্তান বাঙ্গালী শ্রোতার কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়ে ফেলে।
উইটনেস্ টু সারেন্ডার -পৃষ্ঠা-৯৮-৯৯



জুলাই এবং আগস্টের শেষের দিকে বিপুল মানুষের দেশত্যাগ ঘটলো। অন্যদিকে বিদ্রোহ পুরোমাত্রায় রূপ নিল। অনিশ্চিত অবস্থা সত্ত্বেও যারা ঘরে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, তারা সেনাবাহিনীর কোন না কোন অফিসার কিংবা ইউনিফরম পরিহিত কোন না কোন ব্যক্তির সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলাটাকে বিজ্ঞোচিত মনে করলো। একটি খাকি পোশাক এবং একটি পাঞ্জাবি কংবা পশতু সংলাপকে বলি হওয়া থেকে কিংবা হয়রানি হওয়া থেকে বাঁচার একটি ঢাল বলে ধরে নেইয়া হয়। আমাদের অনেকেই দয়াপরবশ হয়ে একেকটি বাঙ্গালী পরিবারের ‘পৃষ্ঠপোষক’ হয়ে গেল। একটি সুন্দরী মেয়ে উপহার দিয়ে একটি পরিবার একই সঙ্গে কয়েকজন অফিসারের পৃষ্টপোষকতা লাভ করলো।
উইটনেস্ টু সারেন্ডার -পৃষ্ঠা-৯৯



তাদের(মুক্তিবাহিনী) তেজস্বিতার একটি উদাহরণ তুলে ধরছি। নাশকতামূলক প্রচেষ্টা নেয়ার অভিযোগে ১৯৭১ সালের জুন মাসে রোহনপুর এলাকায় (রাজশাহী জেলা) একটি বালককে গ্রেফতার করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে তাকে কোম্পানি সদর দফতরে নিয়ে আসা হলো। কিন্তু কোন তথ্যই সে প্রকাশ করতে স্বীকৃত হল না। মুখ খোলানোর জন্য যখন সব পদ্ধতিই ব্যর্থ হল তখন মেজর আর তার স্টেনগান বালকটির বুকের ওপর চেপে ধরে বললো, ‘এই-ই তোমার জন্য শেষ সুযোগ। যদি মুখ না খোল, তাহলে বুলেট তোমার বুক চিরে বেরিয়ে যাবে’। সে সঙ্গে সঙ্গে হাঁটু গেড়ে মাথা নুইয়ে মাটি চুম্বন করলো। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললো, ‘আমি এখন মরতে প্রস্তুত। আমার রক্ত নিশ্চয়ই আমার পবিত্র ভূমির মুক্তিকে ত্বরান্বিত করবে’।
উইটনেস্ টু সারেন্ডার -পৃষ্ঠা-১০৮



অপারেশন চলার সময় কিছু সৈন্য লুট, হত্যা ও ধর্ষণের মত লজ্জাজনক কাজে লিপ্ত হয়। ধর্ষণের নয়টি মামলা সরকারিভাবে লিপিবদ্ধ হয় এবং অপরাধীদের কঠোর শাস্তিবিধান করা হয় কিন্তু ক্ষতি যা হবার তা হয়েই যায়। এ ধরনের ঘটনা ঠিক কতগুলো ঘটেছিল, তা আমি বলতে পারবো না। কিন্তু আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, যদি একটি ধর্ষণের মতো অপকর্ম করে, তবে তা সমগ্র সেনাবাহিনীর ভাল কাজ ধ্বংস করতে যথেষ্ট।
এই ধরনের নৃশংস কাহিনী স্বাভাবিকভাবেই আমাদেরকে বাঙ্গালী জনগণ থেকে আরো দূরে সরিয়ে দেয়। আগেই তারা আমাদের পছন্দ করতো না। এখন তারা দারুণভাবে ঘৃণা করতে লাগলো।
উইটনেস্ টু সারেন্ডার -পৃষ্ঠা-১০৮

তথাপি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট তার ১২অক্টোবরের রেডিও ভাষণে জাতির প্রতি এই অঙ্গীকার করলেন, ‘আপনাদের বীর সশস্ত্র বাহিনী পাকিস্তানের পবিত্র মাটির প্রতি ইঞ্চি রক্ষায় এবং সংরক্ষণে পুরোপুরি প্রস্তুত’। ইতিমধ্যে সীমান্ত এলাকায় প্রায় ৩০০০বর্গমাইল জায়গা ভারতীয় নিয়ন্ত্রণে চলে যায়।

জেনারেল নিয়াজি প্রেসিডেন্টের ঘোষণার সাথে অতিরঞ্জিত বিজয়ের দাবি জুড়ে দেওয়া কর্তব্য বলে মনে করলেন। তিনি কয়েকবারই ঘোষণা করেন, যদি যুদ্ধ বেধে যায় তাহলে লড়াই তিনি ভারতীয় রাষ্ট্রসীমার মধ্যে নিয়ে যাবেন। তার চিৎকৃত উদ্ভট কাল্পনিক আক্রমণ একবার ধাবিত হয় কলকাতার দিকে, আরেকবার আসামে। তার জনসংযোগ অফিসার হিসেবে তাকে আমি অনুরোধ জানাই দুর্লভ আশার কথা না তুলতে। এতে তিনি বলেন, ‘তুমি কি জান না, ধাপ্পা আর চাতুরি হচ্ছে যুদ্ধের দেবদূত?’

আদতে শত্রুকে ধাপ্পা দেয়ার ব্যাপার ছিল না। তিনি কেবল নিজেই নিজেকে ধাপ্পা দিচ্ছিলেন।
উইটনেস্ টু সারেন্ডার -পৃষ্ঠা-১১৯


নিয়মিত সৈন্য ছাড়াও শক্তি বর্ধনের জন্যে প্রত্যেকটি ডিভিশনের সঙ্গে অতিরিক্ত হিসেবে ইপিসিএএফ, মুজাহিদ ও রাজাকার বাহিনীর সদস্যদের দেয়া হল। সেনাবাহিনীর সাথে তাদের নিয়োজিত করা হয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ঘন করার জন্য। কিন্তু যুদ্ধের সময় তারা নিজেদেরকে সবচেয়ে দুর্বলতম সংযোগ হিসেবে প্রতিপন্ন করে।
উইটনেস্ টু সারেন্ডার -পৃষ্ঠা-১২৮


৪ ডিসেম্বর শত্রু আমাদের প্লাটুন অবস্থান দখল করলো এবং হিলির এগার কিলোমিটার উত্তরে চিরাইর কাছাকাছি একটি ফাঁককে ফলোৎপাদক সোজা পথ হিসেবে দেখতে পেল। চিরাই একটি প্লাটুনের অধীন ছিল। কিন্তু নভেম্বরের শেষ দিকে কাসিম চৌকির ঘটনার পড় অবস্থানকে হালকা করে আনা হয়েছিল অন্যান্য স্থানের ঘাটতি পূরণের জন্য। এ এলাকাটির দিক থেকে কোন রকমের হুমকি আসার কথা ধারণা করা যায়নি। কেননা এলাকাটি বিল এবং সংকীর্ণ ও গভীর খানাখন্দে ভরা। ট্যাংক পরিচালনার জন্য এক রকম অসম্ভব মনে করা হল। তাছাড়া সেখানে কোন বড় রাস্তাও ছিল না, যা দিয়ে শত্রু আক্রমণের লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে আসতে পারে। তথাপি এ অসম্ভাব্য রাস্তাটিকেই ব্যবহার করলো শত্রু। মুক্তিবাহিনীর পরিচালনা ও সাহায্যে শত্রু ট্যাংক এবং একটি পদাতিক সেনাদল চিরাই চৌকি দখল সম্পন্ন করে পূর্ব দিকে এগোতে শুরু করলো।

এ বার্তাটি ঊর্ধ্বতন সদর দফতরে প্রেরিত হলে ক্রুদ্ধ স্টাফ অফিসার প্লাটুন কমান্ডার বললেন, ‘কল্পনার ফানুস উড়িও না। যেখানে বিল, খাল আর মাইন ঠাসা সেখানে ট্যাংক আসে কী করে? নিশ্চয়ই তুমি মোষ দেখেছ’। তরুণ ক্যাপ্টেন জবাব দিল, ‘ আপনি হয়তো ঠিক বললেন সার। কিন্তু আমি শপথ করে বলতে পারি, মোষগুলোর কাঁধে ১০০ মিলিমিটার কামান বসানো এবং সেগুলো আমাদের বাংকারগুলোকে একটার পড় একটা গুঁড়িয়ে দিচ্ছে’।
উইটনেস্ টু সারেন্ডার -পৃষ্ঠা-১৫১


বলা হয়, এ সব সীমান্ত চৌকির রক্ষা ব্যবস্থায় সবচেয়ে দুর্বলতম অংশ ছিল ইপিসিএএফ এবং রাজাকাররা। এরাই সর্বপ্রথম তাদের চৌকি পরিত্যাগ করে। বলা হয়, কাপুরুষতা সর্বদাই ছোঁয়াচে। এ সংক্রামক রোগ দ্রুত নিয়মিত সৈন্যদের মধ্যেও ছড়িয়ে পরে। যুদ্ধ বিষয়ক নৈতিকতা হচ্ছে এইঃ কদাপিও অগ্রবর্তী রক্ষাব্যুহে আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্যদের সাথে নিয়মিত সৈনিকদের মিশ্রণ ঘটিও না।
উইটনেস্ টু সারেন্ডার -পৃষ্ঠা-১৬১

যখন ব্রিগেডিয়ার কাদির এবং তার দলটি পূর্বোক্ত মাইন বিস্ফোরিত স্থানে হাজির হন, কিছু রাইফেলের গুলির শব্দ তারাও শুনতে পেলেন। ফলে সড়ক ছেড়ে ফসল ক্ষেতের ভেতর দিয়ে একশ পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরের পথ কালিয়াকৈর-এ হেঁটে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।.............কালিয়াকৈর-এ পৌঁছতে ব্রিগেডিয়ার কাদির ও তার আঠার জনের লাগলো তিনদিন ও তিনরাত। সন্ত্রাসীদের(মুক্তিবাহিনী) তরফের বিপদ ও বিস্তৃত ভূখণ্ডের বিপদ এড়ানোর জন্য তারা কাঁদামাটির মধ্যদিয়ে হেঁটেছেন। রাতে শীতে কাঁপন ধরেছে। দিনে না খেয়ে থেকেছেন। তাদের কাছে অর্থ ছিল কিন্তু কেউই তাদের কাছে কিছু বিক্রি করবে না।
উইটনেস্ টু সারেন্ডার -পৃষ্ঠা-১৮৩


৭ডিসেম্বর সন্ধ্যায় গভর্নর মালিকের সঙ্গে জেনারেল নিয়াজির বৈঠকটি ছিল তার জন্য একটি অস্বস্তিকর অভিজ্ঞতা। সরকারিভাবে এবং প্রকাশ্যে জেনারেল নিয়াজি এমন ভাবভঙ্গি ধরে রাখতেন যার পেছনে কোন বাস্তব ভিত্তি ছিল না। সর্বাত্মক যুদ্ধের চতুর্থ দিনেই তিনি কী তার বিপর্যয়ের খবর একজন বেসামরিক গভর্নরের কাছে স্বীকার করবেন? অথবা তিনি কী প্রতিরোধের তুচ্ছতা এবং বীরত্মব্যঞ্জক সহিষ্ণুতার একটা বাহ্যিক চেহারা দেখাবেন? যদি তিনি দ্বিতীয় ধারাটি বেছে নেন তাহলে কতদিন পর্যন্ত তিনি গভর্নর, সরকার এবং জনগণকে বোকা বানাতে পারবেন?

গভর্নর মালিক, জেনারেল নিয়াজি এবং দু’জন সিনিয়র অফিসার গভর্নমেন্ট হাউসের একটি বিলাসবহুল কক্ষে বসেছিলেন। তারা কথা বেশি বলছিলেন না। কয়েকমিনিট অন্তর অন্তর নীরবতা আলাপচারিতাকে গ্রাস করছিল। গভর্নরই বললেন বেশি এবং বললেন সাধারণ ধারাতেই। তার বক্তব্যের মূল বিষয় ছিলঃ কোন বিষয়ই কখনো একই রকম থাকে না। ভাল পরিস্থিতি মন্দের জন্য পথ করে দেয় এবং উল্টোটাও হয়। একইভাবে একজন জেনারেলের জীবনে উঠানামা আছে। যশ একসময় তাকে আচ্ছাদিত করে, আরেক সময় পরাজয় তার মর্যাদাকে ধূলিসাৎ করে। যে মুহূর্তে ডাক্তার মালিক তার বক্তব্যের শেষাংশ উচ্চারণ করেন সেই মুহূর্তে জেনারেল নিয়াজির স্থূলকায় শরীর কেঁপে উঠে। তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। তিনি দু’হাত দিয়ে মুখ ঢাকলেন এবং শিশুর মতো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন।
উইটনেস্ টু সারেন্ডার -পৃষ্ঠা-১৮৫-১৮৬


জেনারেল নিয়াজি নিজের সদর দফতরে ফিরে এলেন এবং নিজেকে নিজের কক্ষে আবদ্ধ করে রাখলেন। মূলত পরবর্তী তিনটি রাত তিনি নিষ্ক্রিয় থাকেন। এ সময়ে ৮/৯ ডিসেম্বর রাতে আমি তার কক্ষে প্রবেশ করি। ততক্ষণ পর্যন্ত আমি গভর্নমেন্ট হাউসের বৈঠকের কথা জানতে পারিনি। আমি দেখলাম দু’হাতের কনুই বিস্তৃত করে তার ওপর মাথা ঠেকিয়ে তিনি বিশ্রাম নিচ্ছেন। প্রবেশকারীর দিকে তার মুখ পুরোপুরি ঢাকা ছিল। আমি বলতে পারবো না তিনি কাঁদছিলেন কি-না। সংক্ষিপ্ত আলাপের সময় তার একটি মাত্র মন্তব্য আমার স্মরণে আছে। তিনি বলেন, ‘সালিক, তোমার ভাগ্যকে ধন্যবাদ যে, তুমি আজকে একজন জেনারেল নও’। এ কথাতেই তার যন্ত্রণা আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠলো। আমি তার ঘর ছেড়ে চলে এলেম বটে; কিন্তু সারা রাত ধরে আমার কানে তার কথাটি বাজতে থাকলো। তার জন্য আমার করুণা হলো।
উইটনেস্ টু সারেন্ডার -পৃষ্ঠা-১৮৬


অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি শুধুমাত্র পলায়ন্রত বিদেশী কিংবা অবরুদ্ধ বেসামরিক জনগণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, সেনাবাহিনীর কিছু অফিসারের মনের মধ্যে এই অনুভূতির প্রবেশ ঘটে। এসব অফিসারের মধ্যে দু’জন কাঁধে প্রচুর পরিমাণ তকমা ঝুলিয়ে আমার কাছে এলেন এবং বলেন, ‘জেনারেল নিয়াজির কাছে যাতায়াত আছে তোমার। কেন তাকে বলছো না বাস্তববাদী হতে? নইলে কুকুরের মতো মৃত্যু ঘটবে আমাদের’।
উইটনেস্ টু সারেন্ডার -পৃষ্ঠা-১৮৭


একমাত্র ৯ ডিসেম্বর সকালে ইস্টার্ন কমান্ডের সদর দফতর প্রথমবারের মত স্বীকার করলো যে, পরিস্থিতি ‘দারুণ সংকটপূর্ণ’। এ বিষয়ে একটি সংকেত বাণী পাঠানো হলঃ

একঃ আকাশে শত্রুর প্রভুত্বের কারনে পুনঃসংবদ্ধকরণ এবং পুনঃবিন্যাসকরণ সম্ভব নয়। জনসাধারণ আরো বেশি শত্রুভাবাপন্ন হয়ে উঠেছে। শত্রুকে সবরকমের সাহায্য করছে। বিদ্রোহীদের তীব্র অতর্কিত হামলার কারনে রাতে সৈন্য পরিচালনা সম্ভব নয়।
উইটনেস্ টু সারেন্ডার -পৃষ্ঠা-১৮৮
অল ইন্ডিয়া রেডিও আসন্ন আত্মসমর্পণের সংবাদ ১৪ ডিসেম্বরের সকাল থেকেই প্রচার করতে থাকে। এই প্রচার ঢাকাসহ অন্যান্য স্থানের অবাঙ্গালীদের আতংকগ্রস্ত করে তোলে। তাদের অধিকাংশই নিজেদের বাড়িঘর ছেড়ে ক্যান্টনমেন্টের দিকে ছুটতে শুরু করে পাকিস্তানি সৈন্যদের ভাগ্যের সাথে নিজেদের ভাগ্যকে এক সূত্রে গ্রথিত করার জন্য। পথে তারা মুক্তিবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে এবং হত্যা করা হয়। সে নৃশংসতার কাহিনী লোমকূপকে শিহরিত করে। রক্ত শীতল করে দেয়। আর সে কাহিনীর সংখ্যা এত বেশি যে, তার তালিকা প্রণয়নও অসম্ভব।
এই নিরপরাধ মানুষদের জীবনরক্ষার সময় ছিল না ভারতীয়দের। বিজয় অর্জিত লুণ্ঠিত দ্রব্য তারা ভারতে সরিয়ে নিয়ে যাবার জন্য ছিল ব্যস্ত। সামরিক উপকরণ, খাদ্যবস্তু, শিল্প উৎপাদন, বাড়িঘরের মালমাত্তাসহ রেফ্রিজারেটর, কার্পেট এমনকি টেলিভিশন সেটও পাচার করা হয় রেল ও ট্রাকের বহরে করে।
উইটনেস্ টু সারেন্ডার -পৃষ্ঠা-২০২-২০৩
(এইখানটায় নিজের কিছু কথা যুক্ত না করে পারছিনা। অবাঙ্গালী যাদেরকে বিহারী হিসেবে অভিহিত করা হয় তারাও একাত্তরে বাঙ্গালী জাতির বিপক্ষে অস্ত্র ধরেছিল। পাকিস্তানী সৈন্যদের সাথে হাত মিলিয়ে চালিয়েছে লুঠতরাজ ও অত্যাচার। স্বাধীনতার পর পরই এদেশের প্রথিতযশা কথা সাহিত্যিক ও চলচ্চিত্র পরিচালক জহির রায়হান বড় ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারের খোঁজে বের হয়ে প্রাণ হারান, কিন্তু তার লাশ খুঁজে পাওয়া যায়নি। সে সময় জহির রায়হানের পাশে থাকা একজন পুলিশ কন্সটেবল ঘটনাক্রমে বেঁচে যান এবং সেই কন্সটেবলের বর্ণনা অনুসারে জহির রায়হান অস্ত্রধারী বিহারীদের হাতেই নিহত হন।
মেজর সিদ্দিক সালিকের বর্ণনা অনুযায়ী ভারতীয়রা খাদ্যবস্তু, শিল্পপণ্য, ফ্রিজ, টিভি, কার্পেট লুঠ করে নিয়ে যায়। কিন্তু তৎকালীন বাংলাদেশে লুঠ করার মতো ফ্রিজ, টিভি, কার্পেট সত্যিই কি ছিল? নাকি এর মাধ্যমে তিনি পরাজিত হৃদয়ের জন্য কিছুটা স্বান্তনা খুজেছেন? –ব্লগ লেখক)


(আত্মসমর্পণ)
১০১ কমিউনিকেশন জোন-এর মেজর জেনারেল নাগরা (ভারিতীয় জেনারেল) অগ্রবর্তী কমান্ডো সৈন্যদের অনুসরণ করে এগিয়ে আসছিলেন। সেতু থেকে বেশ দূরে তিনি অবস্থান নিলেন। এবং লে.জেনারেল আমীর আবদুল্লাহ খান নিয়াজির জন্য একটি চিরকুট পাঠালেন। চিরকুটে তিনি লেখেনঃ ‘প্রিয় আবদুল্লাহ, আমি এখন মিরপুর সেতুর কাছে। আপনার প্রতিনিধি পাঠান’।
জেনারেল নিয়াজি সকাল ন’টায় চিরকুটটি পেলেন। সে সময় তার পাশে ছিলেন মেজর জেনারেল জামশেদ, মেজর জেনারেল ফরমান ও রিয়ার অ্যাডমিরাল শরীফ। ফরমান, -যিনি তখনো ‘যুদ্ধ বিরতি আলোচনার’ বার্তাটির সাথে সেঁটে আছেন, বললেন, ‘তিনি কী(নাগরা) আলচক দল?’ জেনারেল নিয়াজি কোন মন্তব্য করলেন না। স্পষ্ট প্রশ্ন এখন এটাই –তাকে অভ্যর্থনা জানানো হবে, না মোকাবেলা করা হবে। ইতিমধ্যে ঢাকার দোরগোড়ায় এসে গেছেন।

মেজর জেনারেল ফরমান জেনারেল নিয়াজিকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনার কোন রিজার্ভ বাহিনী আছে?’ জেনারেল নিয়াজি এবারও কিছু বললেন না। রিয়ার আডমিরাল শরীফ পাঞ্জাবিতে কথাটি অনুবাদ করে বললেন, ‘কুজ পাল্লে হ্যায়?’ (থলেতে কিছু কি আছে?) নিয়াজি ঢাকার রক্ষক জামশেদের দিকে তাকালেন। জামশেদ এদিক ওদিক মাথা নাড়লেন, -যার অর্থ হল, ‘কিছুই নেই, শূন্য’ ‘যদি এই-ই হয় তাহলে যান- যা সে(নাগরা) বলে, করেন গিয়ে’। প্রায় একই সাথে ফরমান ও শরীফ বলে ওঠেন।

জেনারেল নিয়াজি নাগরাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য মেজর জেনারেল জামশেদকে পাঠালেন। তিনি মিরপুর সেতুতে অবস্থানরত আমাদের সৈন্যদের যুদ্ধ বিরতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং নাগরার নির্বিঘ্ন আগমনের সুযোগ প্রদানের আদেশ দিলেন। ভারতীয় জেনারেল কয়েকজন সৈন্য নিয়ে ঢাকায় প্রবেশ করলেন। কিন্তু ঢুকলেন গৌরবের শিরোপা ধারণ করে। এবং বস্তুত সেটাই ছিল ঢাকার পতন। পতন ঘটলো নীরবে, -একজন হৃদরোগীর মত।
কোন অঙ্গচ্ছেদন হলো না। কিংবা দেহ দ্বিখণ্ডিতও হলো না। একটি স্বাধীন নগরীর সত্তা বিলুপ্ত হল মাত্র। সিঙ্গাপুর, প্যারিস অথবা বার্লিনের পতন কাহিনীর পুনরাবৃত্তি হলো না এখানে।

ইতিমধ্যে পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের কৌশলগত সদর দফতরকে নিশ্চিহ্ন করা হয়। সমস্ত অপারেশনাল মানচিত্র সরিয়ে ফেলা হলো। প্রধান সদর দফতরটিকে ধূলি-ধূসরিত করা হলো ভারতীয়দের অভ্যর্থনা জানানোর জন্য কেননা, ব্রিগেডিয়ার বকর বললেন, ‘এটা বেশি রকমের সুসজ্জিত’। লাগোয়া অফিসার্স মেসকে পূর্বাহ্নেই জানিয়ে দেয়া হয়েছিল অতিথিদের জন্য অতিরিক্ত খাবার তৈরি করতে। প্রশাসনে বকরের দারুণ দক্ষতা।

মধ্যাহ্নের একটু পরেই বকর বিমান বন্দরে গেলেন তার ভারতীয় প্রতিপক্ষ মেজর জেনারেল জ্যাকবকে অভ্যর্থনা জানাতে। ইতিমধ্যে নিয়াজি নাগরাকে তার কৌতুক পরিবেশন করে আমোদিত করতে শুরু করলেন। সেগুলো তুলে ধরতে পারলাম না বলে আমি ক্ষমা প্রার্থী। কেননা তা ছাপাবার যোগ্য নয়।

মেজর জেনারেল জ্যাকব আত্মসমর্পণের দলিল নিয়ে এলেন। জেনারেল নিয়াজি এবুং চিফ অব স্টাফ সেটাকে যুদ্ধ বিরতি চুক্তির খসড়া বলতেই অধিকতর পছন্দ করলেন। জ্যাকব কাগজপত্র বকরের হাতে তুলে দিলেন। তিনি সেটা মেজর জেনারেল ফরমানের সামনে পেশ করলেন। জেনারেল ফরমান ‘ভারত-বাংলাদেশ যৌথ কমান্ড’ সম্বলিত ধারাটির ব্যাপারে আপত্তি জানালেন। জ্যাকব জানালেন, ‘কিন্তু এভাবেই বিষয়টি দিল্লী থেকে এসেছে’। ভারতীয় সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের কর্নেল খেরা এক পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। বললেন, ‘ওফ, এটা তো ভারত আর বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। আপনারা তো শুধুমাত্র ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছেই আত্মসমর্পণ করছেন’। দলিলটি নিয়াজির সামনে দেয়া হল। তিনি নজর বোলালেন কিন্তু মন্তব্য করলেন না। তিনি আবার সেটা টেবিলের অপর পাশে ফরমানের দিকে ঠেলে দিলেন। ফরমান বললেন, ‘এটা অধিনায়কেরই বিষয় –তিনি গ্রহণ অথবা বাতিল করতে পারেন। নিয়াজি কিছুই বললেন না। এই নীরবতাকে তার সম্মতি হিসেবেই গ্রহণ করা হল।

বিকেলের শুরু হতেই জেনারেল নিয়াজি গাড়ি করে ঢাকা বিমান বন্দরে গেলেন ভারতীয় পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরাকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্য। তিনি পত্নীকে সঙ্গে নিয়ে হেলিকপ্টারে করে এলেন। এক বিপুল সংখ্যক বাঙ্গালী ছুটে গেল তাদের মুক্তিদাতা ও তার পত্নীকে মাল্যভূষিত করতে। নিয়াজি তাকে সামরিক কায়দায় স্যালুট দিলেন এবং করমর্দন করলেন। সে ছিল একটি হৃদয়স্পর্শী দৃশ্য। বিজয়ী এবং বিজিত দাঁড়িয়ে আছে প্রকাশ্যে বাঙ্গালীর সামনে। আর বাঙ্গালীরা অরোরার জন্য তাদের গভীর ভালোবাসা এবং নিয়াজির জন্য তীব্র ঘৃণা প্রকাশে কোনরূপ গোপনীয়তার আশ্রয় নিচ্ছে না।

উচ্চকণ্ঠে চিৎকার ও শ্লোগানের মধ্যদিয়ে তাদের গাড়ি রমনা রেসকোর্স-এ এলো। সেখানে আত্মসমর্পণের জন্য মঞ্চ তৈরি করা হয়। বিশাল ময়দানটি বাঙ্গালী জনতার উদ্বেগ আবেগে ভাসছিল। তারা প্রকাশ্যে একজন পশ্চিম পাকিস্তানি জেনারেলের অবমাননার দৃশ্য দেখবার জন্য উদগ্রীব হয়র উঠেছিল। এই ঘটনা বাংলাদেশের জন্মের বিন্যাস ঘটালো।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি সুসজ্জিত দলকে হাজির করা হল বিজয়ীকে গার্ড অব অনার দেয়ার জন্য। অন্যদিকে একটি ভারতীয় সেনাদল বিজিতের প্রহরায় নিযুক্ত হল। প্রায় দশ লাখ বাঙ্গালী এবং কয়েক কুড়ি বিদেশী সংবাদপত্র ও সংবাদ মাধ্যমের প্রতিনিধিদের সামনে লে. জেনারেল অরোরা ও লে.জেনারেল নিয়াজি আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করলেন। ঢাকা দখলের নিদর্শনস্বরূপ জেনারেল নিয়াজি তার রিভলবার বের করে অরোরার হাতে তুলে দিলেন। রিভলবারের সাথে তিনি পূর্ব পাকিস্তানও তুলে দিলেন।
উইটনেস্ টু সারেন্ডার -পৃষ্ঠা-২০০-২০২
৬টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

লালনের বাংলাদেশ থেকে শফি হুজুরের বাংলাদেশ : কোথায় যাচ্ছি আমরা?

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৪



মেটাল গান আমার নিত্যসঙ্গী। সস্তা, ভ্যাপিড পপ মিউজিক কখনোই আমার কাপ অফ টি না। ক্রিয়েটর, ক্যানিবল কর্পস, ব্লাডবাথ, ডাইং ফিটাস, ভাইটাল রিমেইনস, ইনফ্যান্ট এনাইহিলেটর এর গানে তারা মৃত্যু, রাজনীতি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি! চুরি! সুপারি চুরি। স্মৃতি থেকে(১০)

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৪


সে অনেকদিন আগের কথা, আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। স্কুলে যাওয়ার সময় আব্বা ৩ টাকা দিতো। আসলে দিতো ৫ টাকা, আমরা ভাই বোন দুইজনে মিলে স্কুলে যেতাম। আপা আব্বার... ...বাকিটুকু পড়ুন

যেকোন বাংগালীর ইন্টারভিউর সময়, 'লাই-ডিটেক্টটর' যোগ করে ইন্টারভিউ নেয়ার দরকার।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৫ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০৭



আপনার এনলাকার এমপি, প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী কামাল সাহেব, যেকোন সেক্রেটারী, যেকোন মেয়র, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান, বিএনপি'র রিজভী, আওয়ামী লীগের ওয়ায়দুল কাদের, আপনার থানার ওসি, সীমান্তের একজন বিজিবি সদস্য, ঢাকার... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×