রাগ ভৈরবীর কথা :এই আনন্দের দিনে আমাদের শহীদ মহাপ্রাণদের জন্য বেদনা ফিরে ফিরে আসে । শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা । বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা সবাইকে । এই বিজয়ের দিনেও শফিক রেহমানের লেখাটি গুরুত্বপূর্ণ মনে হওয়াই ব্লগে তুলে দিলাম । যারা শফিক রেহমানকে পছন্দ করেন এবং যারা অপছন্দ করেন, সবার প্রতি অনুরোধ, ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ থেকে না, বরং লেখাটি পড়ে আপনার মূল্যবান মতামত দিন ।
বাংলাদেশে বিপন্ন মানব অধিকার
গত পরশু অর্থাৎ ১০ ডিসেম্বর ছিল জাতি সংঘ ঘোষিত বিশ্ব মানব অধিকার দিবস। আপনারা হয়তো সমালোচনা করতে পারেন, দুই দিন পরে কেন এই লেখা? এই ধরনের সমালোচনা যথার্থই হবে। আসলে বাংলাদেশের মানব অধিকার পরিস্থিতি যে অবনতির দিকে গড়িয়েছে এবং এখনো গড়াচ্ছে, তাতে, অদূর ভবিষ্যতে এই দেশে প্রতিদিনই মানব অধিকার রক্ষার জন্য সবাইকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। তখন দুই দিন দেরি একটি অমার্জনীয় ত্রুটি হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
গোড়াতেই বলে রাখি মানব অধিকার মানে কি? মানব অধিকার লংঘন মানে শুধু কেউ কাউকে পেটানো অথবা অপমানজনক গালি দেয়াই নয়, মানব অধিকারের পরিধি অনেক বেশি বিস্তৃত। শিশুর দুধের অধিকার, আপনার ভাতের অধিকার, বেকার যুবকের চাকরির অধিকার, সবার শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান এবং কথা বলার ও লেখার অধিকারও মৌলিক মানব অধিকার।
মানব সভ্যতার ইতিহাসের একটি বড় দিক হচ্ছে এসব মানব অধিকার রক্ষার ইতিহাস। শ্রী গৌতম বুদ্ধ থেকে শুরু করে বিশ্বের বিভিন্ন ধর্মপ্রচারকরা নির্যাতিত মানুষের পক্ষে বলে গিয়েছেন। তারা মানব অধিকার রক্ষায় ধর্ম প্রচার করেছেন। তাদের সেই মহৎ কাজের ধারাবাহিকতায় আধুনিক সময়ে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে মানব অধিকার রক্ষা বিষয়ে আলোচনা হয়েছে, আইন পাস হয়েছে।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে ১৯৪৫-এ জাতি সংঘের জন্ম এবং তার পর বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার জন্ম, যেমন, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং পাশাপাশি বিভিন্ন দেশে মানব অধিকার বিষয়ক সংস্থার জন্ম যেমন, বাংলাদেশে অধিকার, ব্লাস্ট, আইন ও সালিশী কেন্দ্র প্রভৃতির কর্ম তৎপরতার ফলে মানব অধিকার বিষয়ে বিশ্ব জুড়ে মানুষ এখন সচেতন হচ্ছে।
অতীতে বাংলাদেশে মানব অধিকার লংঘনের ঘটনাগুলো ব্যক্তি, পরিবার, জাতি ও ধর্মের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ ছিল। যেমন, স্বামীর হাতে স্ত্রীর নির্যাতন, শ্বাশুড়ির হাতে পুত্রবধূ নির্যাতন, যৌতুক না দিতে পারায় পরিবার কর্তৃক বধূ নির্যাতন, সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় কর্তৃক সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নির্যাতন এবং ধর্মীয় অনুশাসনের নামে অসহায় ব্যক্তি নির্যাতন, যেমন দোররা মারা ইত্যাদি। এই সময়ে রাষ্ট্র কর্তৃক সাধারণ নাগরিক নির্যাতনের ঘটনা কমই শোনা যেত।
কিন্তু ১৯৫২ থেকে বাংলাদেশের মানুষ তাদের ন্যায্য অধিকার আদায় করতে গিয়ে পাকিস্তানি শাসকদের হাতে নির্যাতিত হতে থাকে। বাংলাদেশের মানুষ সেই নির্যাতনে দমে যায়নি। সেই মানব অধিকার হরণের ঘটনাগুলো মেনে নেয়নি। তারা সংঘবদ্ধ হয়। প্রতিবাদী হয়। এবং সবশেষে ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ হয়। যার চূড়ান্ত ফল আমরা পাই ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১-এ স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমে। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসও এই ভূখণ্ডে মানব অধিকার প্রতিষ্ঠার ইতিহাস।
কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, পাকিস্তানি শাসকরা বিদায় নিলে, স্বদেশী শাসকরা তাদের শূন্য স্থান পূরণে এগিয়ে আসেন। এর ফলে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫-এ বহু বামপন্থী নেতাকর্মী গ্রেফতার নির্যাতিত ও নিহত হয়। ১৯৭৪-এ হাজার হাজার মানুষ দুর্ভিক্ষে মারা যায়। এখানে জানিয়ে দেয়া উচিত যে, মানব অধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্রের ধারা-৩-এ বলা হয়েছে, প্রত্যেকেরই জীবন ধারণ, স্বাধীনতা ও ব্যক্তিগত নিরাপত্তার অধিকার রয়েছে। ১৯৭৪-এ বহু মানুষ তাদের জীবন ধারণের অধিকার হারিয়েছিল বলেই তাদের মৃত্যু ঘটেছিল। অর্থাৎ, ওই সময়ের শাসক গোষ্ঠির ব্যর্থতার ফলে বহু মানুষ তাদের বেচে থাকার মৌলিক অধিকারটি হারিয়েছিল।
এর অনিবার্য পরিণতির ফলে সেই ব্যর্থ শাসকগোষ্ঠির পতন ঘটে ১৯৭৫-এ। তবে সেই ভীতিকর ঘটনাটি পরবর্তী শাসকগোষ্ঠিদের একটি শিক্ষা দিয়ে যায় এবং সেটি হলো বেচে থাকার এই মৌলিক অধিকারটি রক্ষা না করলে তাদেরও সমূহ বিপদ হতে পারে। এর ফলে পরবর্তী প্রতিটি শাসকগোষ্ঠি সচেতন ও তৎপর থেকেছে বাংলাদেশে আর সেই রকমের দুর্ভিক্ষ না ঘটে।
বাংলাদেশে মানব অধিকারের এই দিকটি গত প্রায় ৩৪ বৎসর যাবৎ মোটামুটিভাবে রক্ষিত হলেও, মাঝে মধ্যে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে খাদ্যাভাবের কথা শোনা গিয়েছে।
বাংলাদেশের ভোটাররা এখন আশ্বস্ত হতে চায় যে রাষ্ট্র তাদের বেচে থাকার অধিকার রক্ষা করবে। তাই আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনী অভিযানে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল নির্বাচনে জয়ী হলে তারা দশ টাকা কেজি দরে মানুষকে চাল খাওয়াবে। কিন্তু আওয়ামী লীগ বিজয়ী হওয়ার পরে সেই প্রতিশ্রুতি পালনে ব্যর্থ হয়েছে। বরং অন্যান্য খাদ্যদ্রব্যের দাম বেড়ে গিয়েছে। বিষয়টি এখানে তুললাম আবারও সরকারকে মনে করিয়ে দিতে যে, মানুষকে অভুক্ত রাখাও মানব অধিকার লংঘন।
১৯৭৪ এবং ১৯৭৫-এর ভয়াবহতার কথা স্মরণে রেখে পরবর্তী কালের সরকারগুলো মানুষকে ক্ষিধে মুক্ত রাখার দিকে সচেষ্ট হলেও, উদ্বেগের বিষয় এই যে, সরকার কর্তৃক, সাম্প্রতিক কালে, বিশেষত গত তিন বছরে অন্যান্য ধরনের মানব অধিকার লংঘনের বহু ঘটনা ঘটেছে এবং এখনো ঘটে চলেছে।
এই প্রসঙ্গে আমি মানব অধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্রের আরও কয়েকটি ধারার উল্লেখ করতে চাই।
ধারা ৫-এ বলা হয়েছে, কারো প্রতি নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা অবমাননাকর আচরণ করা, কিংবা কাউকে নির্যাতন করা বা শাস্তি ভোগ করতে বাধ্য করা চলবে না।
ধারা-৬-এ বলা হয়েছে, আইনের কাছে প্রত্যেকেরই সর্বত্র মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি লাভের অধিকার রয়েছে।
ধারা ৭-এ কথা হয়েছে আইনে কাছে সকলেই সমানএবং কোনো রকম বৈষম্য ছাড়া সকলেরই আইনের আশ্রায় সমানভাবে রক্ষা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। এই ঘোষণাপত্র লংঘনকারী কোনো রকম বৈষম্য বা বৈষম্যের উস্কানির বিরুদ্ধে রক্ষা পাওয়ার সম অধিকার সকলেরই আছে।
ধারা ৮-এ বলা হয়েছে যে সব কাজের ফলে সংবিধান অথবা আইন প্রদত্ত মৌলিক অধিকারগুলো সংঘন করা হয় তার জন্য উপযুক্ত জাতীয় বিচার লাভ বা আদালতের মারফৎ কার্যকর প্রতিকার লাভের অধিকার প্রত্যেকেরই আছে।
ধারা ৯-এ বলা হয়েছে, কাউকে খেয়ালখুশি মতো গ্রেফতার বা আটক করা অথবা নির্বাসন দেয়া যাবে না।
ধারা ১০-এ বলা হয়েছে প্রত্যেকেরই তার নিজের বিরুদ্ধে আনা যে কোন ফৌজদারী অভিযোগের সত্যতা প্রমাণের জন্য সমান অধিকার নিয়ে একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার-আদালতে ন্যায্যভাবে ও প্রকাশ্যে শুনানী লাভের অধিকার রয়েছে। এভাবে প্রত্যেকেই তার অধিকার ও দায়িত্বগুলো ও প্রয়োজনে একটি স্বাধীন, নিরপেক্ষ আদালতের মাধ্যমে যাচাই করে নিতে পারে।
ধারা ১১-তে বলা হয়েছে কেউ কোন দণ্ডযোগ্য অপরাধে অভিযুক্ত হলে সে এমন কোন গণ আদালতের আশ্রয় নিতে পারে যেখানে সে আত্মপক্ষ সমর্থনের নিশ্চয়তা পাবে। এই গণ-আদালত যতক্ষণ তাকে আইন অনুযায়ী দোষী সাব্যস্ত না করে ততক্ষণ পর্যন্ত তার নির্দোষ বলে বিবেচিত হবার অধিকার রয়েছে।
ধারা ১২-তে বলা হয়েছে কারো ব্যক্তিগত গোপনীয়তা, পরিবার, বসতবাড়ি বা চিঠিপত্রের ব্যাপারে খেয়াল-খুশিমতো হস্তক্ষেপ করা চলবে না। কারো সম্মান ও সুনামের উপরও ইচ্ছামতো আক্রমণ করা চলবে না।
ধারা ১৩ তে বলা হয়েছে প্রত্যেকেরই নিজের দেশ বা যেকোন দেশ ছেড়ে যাবার এবং স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করার অধিকার রয়েছে।
ধারা ১৪-তে বলা হয়েছে নির্যাতন এড়ানোর জন্য প্রত্যেকেরই অপর দেশসমূহে আশ্রয় প্রার্থনা করবার এবং আশ্রয় লাভ করবার অধিকার রয়েছে।
ধারা ২০-এ বলা হয়েছে, প্রত্যেকেরই শান্তিপূর্ণভাবে সম্মিলিত হবার অধিকার আছে।
জাতি সংঘ ঘোষিত সর্বজনীন মানব অধিকারের এসব ধারা জাতি সংঘের সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের মেনে চলা উচিত। কিন্তু এগারো জানুয়ারি ২০০৭ থেকে ডিসেম্বর ২০০৮ পর্যন্ত, এই দুই বছরে এসব ধারা লংঘনকারী ঘটনার সংখ্যা সীমাহীন হয়ে পড়েছিল।
শুধু তাই নয়, মিডিয়ার একাংশ মানব অধিকারের সংঘনের ঘটনায় উল্লসিত হয়েছিল এবং একটি বিশেষ গোয়েন্দা বাহিনীর সাপ্লাই করা, তাদের নির্যাতনের মাধ্যমে আদায় করা, স্বীকারোক্তি যেমন আওয়ামী লীগের তদানীন্তন সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল জলিলের সিডি খুব আনন্দের সঙ্গে ছাপছিল। সম্পত্তি, ব্যাংক ব্যালান্স, সঞ্চয়পত্র এবং যাবতীয় পুজি ও সঞ্চয়ের সব খতিয়ান তারা মনের সুখে ছাপছিল। কোনো আইনজীবী, এমনকি তথাকথিত আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী কতো আয় করেছেন, কতো ট্যাক্স দিয়েছেন এসব তথ্যও সেই গোয়েন্দা বিভাগ দিচ্ছিল এবং মিডিয়ার সেই দায়িত্বজ্ঞানহীন অংশটি ছাপছিল। পরিহাসের বিষয় এই যে এই আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবীর নিয়ন্ত্রণে একটি এবং তার পারিবারিক নিয়ন্ত্রণে আরেকটি মানব অধিকার সংস্থা থাকলেও ওই দুই বছরে সংস্থা দুটি প্রায় নিষ্ত্র্নিয় ছিল। কেন নিষ্ত্র্নিয় ছিল, তার কারণ নিশ্চয়ই আপনারা বুঝতে পারছেন।
শুধু আইনজীবীদের সম্পর্কেই তথ্য নয়, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, অন্যান্য পেশাজীবী, পলিটিশিয়ান ও বিজনেসম্যানদের বিষয়ে বহু রকমের সত্যমিথ্যা তথ্য গোয়েন্দা বাহিনীর সহায়তায় মিডিয়ার ওই অংশটি ছাপছিল। তাদের ওই অপতৎপরতা কমা শুরু হয় যখন তারা বুঝতে পারে প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টার প্রণীত ও প্রচারিত মাইনাস টু ফর্মুলা ব্যর্থ হতে চলেছে। কিন্তু ততক্ষণে অনেক মানব অধিকার লংঘিত হয়ে গিয়েছিল। ব্যক্তি ও দেশের যা ক্ষতি হবার, তা হয়ে গিয়েছিল। যার ফলে গ্রামের হাটবাজার ও শহরের ফুটপাথ থেকে শুরু করে টাওয়ার ব্লক থেকে পরিচালিত সব ব্যবসা বাণিজ্য শিল্প প্রায় স্থবির হয়ে যায় এবং কর্ম সংস্থান কমে যায়, যার দাম এখনো দেশকে দিতে হচ্ছে।
সেই সময়ে মিডিয়ার ওই অংশটির নিশ্চয়ই জানা ছিল, সেনা সমর্থিত সরকার তাদের এসব অন্যায়, কুৎসিত ও জঘন্য কর্মকাণ্ডে মানব অধিকার ঘোষণাপত্রের, অন্ততপক্ষে, তিনটি ধারা তারা লংঘন করছে। ধারাগুলো হলো, ৫ অর্থাৎ কাউকে নিষ্ঠুরভাবে নির্যাতন করা যাবে না। ধারা ৯, কাউকে খেয়ালখুশি মতো গ্রেফতার বা আটক করা যাবে না। এবং ধারা ১২, কারো ব্যক্তিগত পোপনীয়তা, পরিবার, বসতবাড়ি বা চিঠিপত্রের বিষয়ে খেয়ালখুশি মতো হস্তক্ষেপ করা চলবে না। কারো সম্মান ও সুনামের উপরেও ইচ্ছা মতো আক্রমণ করা চলবে না।
মিডিয়ার ওই অংশটি জেনেশুনেই মানব অধিকার লংঘনের ঘটনায় সহযোগি হলেও তাদের কেউ কেউ তাদের মালিকের মানব অধিকার রক্ষায় খুবই সচেতন, বা এক্ষেত্রে বলা উচিত, খুবই ট্যাটন ছিল। যেমন, ব্যবসায়ী মি. লতিফুর রহমানের নাম দুর্নীতিবাজদের লিস্টে থাকলেও তারা, মি. লতিফুর রহমানের সম্মান ও সুনাম অক্ষুন্ন রেখেছিল। মি. লতিফুর রহমানরে বিষয়ে কোনো অনুসন্ধানী রিপোর্ট প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টারে প্রকাশিত হয়নি।
এই একটি ঘটনা থেকে একটি সিদ্ধান্তে আসা যেতে পারে যে ওই সময়ে উল্লিখিত পত্রিকা দুটি বিচারকের ভূমিকাও নিয়েছিল। কোনো পলিটিশয়ান ও বিজনেসম্যানের বাড়িতে কটা রিলিফের শাড়ি, কটা ঢেউ টিন, কটা হরিণ, ময়ুর অথবা কয় ক্যান হাইনিকেন বিয়ার, রেড ওয়াইন, ব্ল্যাক লেবেল হুইস্কি আছে, কার ব্যাংকে কতো সঞ্চয়পত্র ও ডিপজিট আছে, এসব তথ্য বিস্তারিতভাবে ছাপালেও নিজেদের মালিকের বিষয়ে কোনো তথ্য প্রকাশ করেনি। তারা বৈষম্যমূলক আচরণ করেছে� যার ফলে তারা সর্বজনীন মানব অধিকার ঘোষণাপত্রের ৭ নাম্বার ধারাটি লংঘন করেছে, যেখানে বলা আছে, আইনের কাছে সকলেরই সমান এবং কোনো রকম বৈষম্য ছাড়া সকলেরই আইনের আশ্রয় সমানভাবে রক্ষা পাওয়ার অধিকার আছে।
এই প্রসঙ্গে আমিও এটাও সুস্পষ্টভাবে বলতে চাই, ১১ জানুয়ারি ২০০৭-এর পর যাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছিল, তাদের কেউ কেউ হয়তো কম বেশি দোষী। তাদের বিচার হওয়া উচিত ছিল প্রচলিত আইনের যথার্থ প্রয়োগের মাধ্যমে। কোনো উচ্চাভিলাষী সেনা অফিসারদের যাদের কেউ কেউ পরবর্তীকালে নিজেরাই দুর্নীতিপ্রবণ রূপে পরিচিত হয়েছেন, তাদের তৈরি ক্যাঙ্গারু কোর্টের বিচারে নয় এবং এক শ্রেণীর বৈষম্যপরায়ণ সম্পাদকের মিডিয়া ট্রায়ালে তো নয়ই।
এখানে মিডিয়া কর্মীদের প্রতি আমি বিনীতভাবে মনে করিয়ে দিতে চাই মানব অধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্রের ২৯ নাম্বার ধারাটি, যেখানে বলা আছে-
এক. সমাজের প্রতি প্রত্যেকেরই কর্তব্য আছে এবং এই কর্তব্যগুলো পালনের মাধ্যমেই একজন মানুষের ব্যক্তিত্বের অবধি ও পূর্ণ বিকাশ সম্ভব এবং
দুই. নিজের অধিকার ও স্বাধীনতা ভোগ করবার সময়ে এ কথা প্রত্যেকেরই মনে রাখতে হবে যে, তাতে যেন অপরের অধিকার ও স্বাধীনতার প্রতি কোনো রকম অস্বীকৃতি বা অশ্রদ্ধা প্রকাশ না পায়।
সুতরাং, প্রিয় তরুন মিডিয়া কর্মীরা আপনারা ভয় পাবেন না। মানব অধিকারের এই ধারাটি পালনের চেষ্টা করুন। আপনারা বিবেকের নির্দেশে কাজ করুন। প্রয়োজনে বৈষম্যপরায়ণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করুন। এ জন্য যদি আপনার চাকরি চলেও যায়, তাহলে আপনার বিবেক পরিষ্কার থাকবে। এবং আপনি পরে অবশ্যই বিবেকবান সম্পাদকের নজরে আসবেন, চাকরি পাবেন। মনে রাখবেন, রাইটস বা অধিকার থাকলেই তার পাশাপাশি রেসপন্সিবিলিটি বা দায়িত্বজ্ঞানও থাকতে হবে।
কেউ কেউ হয়তো প্রশ্ন তুলতে পারেন, ভবিষ্যতে যদি প্রমাণিত হয়, সরকার পরিচালনায় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং প্রধান বিরোধী দল পরিচালনায় খালেদা জিয়া ব্যর্থ হয়েছেন, তাহলে কি তখন মাইনাস টু ফর্মুলার যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠিত হবে? আবার মাইনাস টু ফর্মুলা কি ফিরে আসতে পারে? আবার সেনা সহযোগিতায় প্লাস টু সম্পাদক হয়ে যাবে?
এর উত্তর হচ্ছে ভবিষ্যতে দুই নেত্রী ব্যর্থ হতেও পারেন। কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়েছেন কিনা সেটা বিচার করবে দেশের ভোটাররা শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। সেনা সহযোগি, অনৈতিক ও অতিবিপ্লবী সম্পাদকদের বিচারে নয়। দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ধ্বংস করে নয়। দেশের অশান্তি ও অস্থিরতা সৃষ্টি করে নয়। সংবিধান মাড়িয়ে নয়।
এই প্রসঙ্গে আমি আরেকটি তথ্য আপনাদের জানাতে চাই। গত অক্টোবরে আমেরিকায় হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে একটি সমাবেশে বাংলাদেশে নিযুক্ত আমেরিকার রাষ্ট্রদূত মি. জেমস মরিয়ার্টি বলেছেন, তার সরকার বাংলাদেশের মিডিয়াকে সাহায্য করছে। মি. মরিয়ার্টির পাশেই বসা ছিলেন ডেইলি স্টারের সম্পাদক মি. মাহফুজ আনাম। মি. মরিয়ার্টির প্রতি আমার অনুরোধ, বৈষম্যমূলক সাংবাদিকতাকে প্রশ্রয় আশ্রয় দেবেন না। আপনি ওদের কাছে জানতে চান এবং প্রকাশ করতে বলুন, মি. লতিফুর রহমান কি দুর্নীতি করেছিলেন, বা আদৌ কিছু করেছিলেন কিনা। আর আপনি যদি ট্রান্সপারেন্সি বা স্বচ্ছতায় বিশ্বাস করেন, তাহলে জানিয়ে দিন বাংলাদেশের কোন মিডিয়াকে কিভাবে এবং কতো সাহায্য আমেরিকান সরকার করেছে।
এখন প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টারের দুই সম্পাদকদের একটি অনুসন্ধানী রিপোর্ট প্রকাশ করা উচিত মি. লতিফুর রহমানের বিষয়ে। তিনি যে নির্দোষ ছিলেন সেই বিষয়টি প্রতিষ্ঠা করা উচিত। তাতে তার মানব অধিকার রক্ষা হবে। তিনি উপকৃত হবেন।
মিডিয়া প্রসঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে আমিও যে ওই অবৈধ সরকারের, সময়ে মানব অধিকার লংঘনের ঘটনার শিকার হয়েছিলাম তা আজ আপনাদের জানাতে চাই। ওই সময়ে আমার পচিশ বছরের কষ্টে গড়া যায়যায়দিন পত্রিকার সম্পাদক আমি ছিলাম। আমি রাজি হইনি গোয়েন্দা সংস্থার সাপ্লাই করা সিডির বিবরণ বা দুর্নীতিবাজদের লিস্ট ছাপতে। বরং আমি ছেপেছিলাম বিএনপি কর্মীদের হাতে বিএনপির জনৈক সংস্কারপন্থী নেতার জুতাপেটা হবার ফটো। আমি ছেপেছিলাম তদানীন্তন সেনা প্রধানের আলু প্রেম এবং চূড়ান্ত ক্ষমতা দখলের অভিলাষ সম্পর্কে। আমি লিখেছিলাম দুই নেত্রী মাইনাস থেকে প্লাস হয়ে যাবেন, তিন উদ্দীনই মাইনাস হয়ে যাবেন। এর ফলে আমি বিশেষ মহলের রোষানলে পড়েছিলাম।
আমি খুশি যে আমার সেদিনের সেই ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হয়েছে। তবে আমি দুঃখিত যে আমার ওই সময়ের ভূমিকার কারণে যায়যায়দিন পত্রিকাটি হাতছাড়া হয়ে গিয়েছে। পত্রিকাটি আমি বিক্রি করিনি। পত্রিকার সম্পাদক পদ থেকে আমি পদত্যাগও করিনি। লক্ষ্য করবেন, এখনো যায়যায়দিন পত্রিকার পেছনের পাতায় সম্পাদক রূপে কারো নাম নেই। তদানীন্তন সেনাপ্রধানের অসন্তোষ এবং অভিপ্রায় উল্লেখ করে এপ্রিল ২০০৮-এ নির্দেশ দেয়া হয়েছিল মাত্র তিন দিনের মধ্যে আমাকে সম্পাদকের পদ ছেড়ে দিতে হবে। প্রচণ্ড চাপের মুখে আমি বাধ্য হয়েছিলাম পাচ দিন পরে সেটাই করতে।
আমি তখন কোনো আপোষ করতে রাজি হইনি। কম্প্রোমাইজ করিনি। সেনা অফিসারদের সঙ্গে বিপ্লবী সম্পাদকদের মতো পিলখানায় লাঞ্চ খাইনি, গলফ ক্লাবে দহরম মহরম করিনি।
বিষয়টি এখন আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে। তাই এ সম্পর্কে আর কিছু বলবো না। তবে আমি আশা করবো ভবিষ্যতে সম্মানিত আদালত আমার মানব অধিকার হরনের বিষয়টি গভীরভাবে বিবেচনা করবেন।
ফিরে আসি দেশ ও বিদেশে মানব অধিকার বিষয়ে।
১০ ডিসেম্বর ১৯৪৮-এ ঘোষিত সর্বজনীন মানব অধিকারকে সম্মানিত করার জন্য ১০ ডিসেম্বরকে মানব অধিকার দিবস হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। মানব অধিকার দিবস হিসেবে এই দিনটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় ৪ ডিসেম্বর ১৯৫০-এ জাতি সংঘের সাধারণ অধিবেশনে। সেই সময় জাতি সংঘ সদস্য রাষ্ট্রদের এবং বিভিন্ন সংস্থার প্রতি অনুরোধ করা হয় তারা যেন দিনটিকে তাদের প্ল্যান অনুযায়ী পালন করে।
এই দিনটি নিউ ইয়র্কে অবস্থিত জাতি সংঘ হেড কোয়ার্টার্সের একটি বিশেষ দিন। মানব অধিকার বিষয়ে জাতি সংঘ প্রতি পাচ বছর অন্তর যে পুরস্কার ঘোষণা করে সেটি এই দিনেই দেয়া হয়। নোবেল শান্তি পুরস্কারও এই দিনেই দেয়া হয়। লক্ষ্য করুন, পরশু দিন, ১০ ডিসেম্বরে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এই দিনেই নোবেল শান্তি পুরস্কার গ্রহণ করেছেন।
প্রেসিডেন্ট ওবামাকে এই শান্তি পুরস্কার দেয়াটা এখন খুবই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। কারণ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবার আগে জোরালোভাবে শান্তির কথা বললেও এখন দেখা যাচ্ছে ইসরেলকে নিয়ন্ত্রণে আনার বিষয়ে তিনি প্রতিশ্রুত ভূমিকা রাখতে পারছেন না। ইরাকে আমেরিকান সৈন্যরা চেপে বসে আছে এবং আফগানিস্তানে আরও বেশি আমেরিকান সৈন্য পাঠানোর সিদ্ধান্ত তিনি নিয়েছেন।
বাংলাদেশের যে সুশীল সমাজ মানব অধিকার রক্ষার বিষয়ে, এক সময়ে, সোচ্চার ছিলেন, তারাও প্রায় একইভাবে, এখন নিশ্চুপ হয়ে আছেন।
শুধু মানব অধিকার বিষয়েই বাংলাদেশে প্রায় দেড়শটি বেসরকারি সংস্থা বা এনজিও আছে। কিন্তু এগারো জানুয়ারি ২০০৭-এর পর সেনাদের একাংশ এবং মিডিয়ার একাংশ সমর্থিত একটি অবৈধ, অসাংবিধানিক সরকার ক্ষমতায় এসে যখন স্বেচ্ছাচারীভাবে মানব অধিকার লংঘন শুরু করলো তখন তাদের কেউ কোনো কথা বলেনি। একটি উচ্চবাচ্যও করেনি। এই তো তাদের সাহসের নমুনা।
আমি তাদের মানব অধিকার বিষয়ে সবচাইতে বেশি প্রচলিত কথাটি মনে করিয়ে দিতে চাই, অধিকার কেউ দেয় না, অধিকার কেড়ে নিতে হয়।
সুতরাং আমার সনির্বন্ধ অনুরোধ, আপনারা, যারা মানব অধিকার বিষয়ে কাজ করছেন, তারা, সংঘবদ্ধ হোন, সাহসী হোন, সোচ্চার হোন।
সব সময়েই, সব দিনেই।
সংঘবদ্ধ হলেই �অধিকার� নামে যে মানব অধিকার সংস্থাটি আছে, তাদের মতো যে গুটিকয়েক মানব অধিকার সংস্থা সাহসী ভূমিকা রাখছে, তারা সবাই শক্তিমান হতে পারবে।
এগারোই জানুয়ারি ২০০৭-এর অবৈধ এবং স্বেচ্ছাচারী সরকার বিদায় নিলেও এবং একটি সাধারণ নির্বাচনের পর একটি রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এলেও গত এগারো মাসে মানব অধিকার লংঘনের বহু ঘটনা ঘটেই চলেছে। ১০ ডিসেম্বর অধিকার সংস্থার একটি গোল টেবিল বৈঠকে জানানো হয়েছে গত এগারো মাসে র্যাব, পুলিশ ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী অন্যান্য বাহিনীর সসদ্যদের হাতে বিনা বিচারে ১৪১ জন নিহত হয়েছে। বলা বাহুল্য, অধিকার সংস্থার প্রতি বর্তমান সরকার প্রীত নয়। গত ১৭ আগস্টে অধিকারের প্রজেক্ট অপারেশন পারমিশন সরকার কোনো কারণ না দর্শিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে বাতিল করে দেয়। অধিকার তখন হাইকার্টের শরণাপন্ন হয়। রিট পিটিশন দাখিল করে এবং একটি স্থগিতাদেশ আদায়ে সক্ষম হয়। জানিয়ে রাখা উচিত, বিএনপি জোট সরকারের আমলেও কিছুটা হলেও, অধিকার সংস্থাটি অসুবিধায় পড়েছিল এবং ওয়ান-ইলেভেন সরকারের আমলে তাদের একজন ডিরেক্টরকে আটক ও টর্চার করা হয়েছিল। কিন্তু লজ্জার বিষয় অধিকার সংস্থাটির অধিকার রক্ষার জন্য তথাকথিত সুশীল সমাজ এবং ওয়ান-ইলেভেনের কুশীলব সম্পাদকবৃন্দকে এগিয়ে আসতে দেখা যায়নি। এদের নিষ্ত্র্নিয়তা এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতার ফলে মানব অধিকারের ঘটনাগুলো ঘটেই চলেছে। বিশেষত কয়েকটি ঘটনার কথা আপনাদের মনে করিয়ে দিতে চাই।
এক. ডুমুরিয়ায় মুক্তিযোদ্ধা নিরাপদ বিরাগী পুলিশের কথিত ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন।
দুই. নিউ এজ পত্রিকার সাংবাদিক মাসুম নির্যাতিত হয়েছেন।
তিন. ভুল পরিচয়ের ফলে নিরপরাধ মডেল বাপ্পী নিহত হয়েছেন।
চার. খবরে প্রকাশ সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর এবং সাবেক প্রতিমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু রিমান্ডে নির্যাতিত হচ্ছেন। তাদের কাছ থেকে জোর করে স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা চলছে।
বস্তুত, রিমান্ডের নামে যে বহু রকমের টর্চারের কাহিনী সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে তার ফলে অবস্থাটা এমনই দাড়িয়েছে যে, ২৪ নভেম্বরে রিমান্ডে নেয়ার আদেশ শুনেই মাহমুদুল নামে এক জওয়ান আদালতেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস, শুধু সাধারণ জওয়ান অথবা সিপাহীই নয়, সেনাপ্রধান, সেনা অফিসার, ম্যাজিস্ট্রেট, সম্পাদক, নিজেরা অনেকেই এখন রিমান্ডে যেতে চাইবেন না।
প্রশ্ন করতে পারেন, নির্যাতনমূলক রিমান্ডে না নিয়ে কিভাবে আটক ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা যেতে পারে? এর উত্তর পাবেন ২০০৩-এ ব্লাস্ট বনাম বাংলাদেশ সরকার মামলার সুপ্রিম কোর্টের রায়ে। আটক ব্যক্তিকে জেল গেইটের সামনে জিজ্ঞাসাবাদ করা যেতে পারে।
দুর্নীতির দমনের নামে দুই বছরের একটি উদ্ভট ও ব্যর্থ বিপ্লব করে, দেশের সমস্যার সমাধান হয়নি। বরং তাতে মানব অধিকার যে চরমভাবে লঙ্ঘিত হয়, সেটাই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শুধু তাই নয় এখন দেখা যাচ্ছে, তারই ধারাবাহিকতায় মানব অধিকার লংঘনের ঘটনা, ঘটে চলতে পারে, একটি বৈধ অসামরিক সরকার ক্ষমতায় এলেও।
এসব কথা মনে রেখে, আমি অনুরোধ করবো ভবিষ্যতে বিপথগামী সেনা সদস্যদের সঙ্গে বিপথগামী সাংবাদিকরা যেন যোগ না দেন। পিলখানায় অথবা গলফ ক্লাবে আতাত করবেন না। সবাই সংবিধান এবং আইনের আওতায় কাজ করুন। তাতে যদি ইপ্সিত ফল না হয়, তাহলে, প্রচলিত আইনসমূহের প্রয়োজনীয় সংস্কারের দিকে মনোযোগী হোন।
আরেকটি কথা।
গত পরশু দিন মানব অধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি আমিরুল কবির জানিয়েছেন, জনবল সংকটের কারণে মানব অধিকার কমিশন সঠিকভাবে কাজ করতে পারছে না। বর্তমানে মানব অধিকার কমিশনে মাত্র চারজন সরকারি কর্মচারি এবং ইউএনডিপির পাচজন সদস্য কাজ করছেন। অর্থাৎ, চেয়ারম্যানসহ মোট দশ জন এই সংস্থায় কাজ করছেন। এই অবস্থার পরিবর্তন না হলে এই সংস্থাটি অকার্যকরই থেকে যাবে, যার একমাত্র কাজ হবে প্রতি বছরে ১০ ডিসেম্বরে এই ধরনের বক্তৃতা সর্বস্ব মানব অধিকার দিবস পালন করা।
বাংলাদেশে ইউএনডিপির আবাসিক প্রতিনিধি মিজ রেনাটা ডেসালিয়েনও একই দিনে মানব অধিকার রক্ষা বিষয়ে কিছু বক্তব্য রেখেছেন। অবৈধ সরকারের দুই বছরে মানব অধিকার রক্ষা বিষয়ে ইউএনডিপির তেমন কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি। তবে, দেরিতে হলেও যে ইউএনডিপি, তাদেরই মাতৃসংস্থা ইউএন-এর ঘোষিত মানব অধিকার রক্ষায় এগিয়ে এসেছে সেজন্য মিজ ডেসালিয়নকে ধন্যবাদ জানাই।
রিমান্ড এবং মানব অধিকার লংঘন এখন সমার্থক হয়েছে। রিমান্ড মানেই টর্চার এই ধারণা জনমনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এটা অভিযুক্ত ও নির্যাতিত ব্যক্তির জন্য চরম যন্ত্রণাদায়ক। আর অভিযোগকারী ও নির্যাতনকারী আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর জন্য চরম ক্ষতিকর। কারণ, এর ফলে আইনের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা কমে যাচ্ছে। এমনকি হাই কোর্টের বিচারপতিও বলতে বাধ্য হচ্ছেন, আমাদের আর দরকার কি? হাইকোর্ট তুলে দিন।
আপনারা জানেন, আমার নিজের জীবনে আরেকটি মানব অধিকার লংঘনের ঘটনায় বিষয়ে ছয় বছর নির্বাসিত থাকার পর, স্বদেশে ফিরে এসে আমি, বাংলাদেশে ১৪ ফেব্রুয়ারিতে ভালোবাসা দিন চালু করেছিলাম ১৯৯৩-এ। সেই সময় থেকে ভালোবাসা বিষয়ে পাঠকদের লেখা দিয়ে এখনো আমি প্রতি বছর ১৪ ফেব্রুয়ারিতে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে চলেছি। আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি ভালোবাসা দিন উপলক্ষে আমি ইতিমধ্যে বহু লেখা পেয়েছি। তার মধ্যে একটি লেখা এসেছে বর্তমানে আটক এক ব্যক্তির কাছ থেকে। তিনি তার ভালোবাসার মেয়েটিকে যে চিঠি লিখেছেন তার কিছু অংশ আমি আপনাদের পড়ে শোনাতে চাই।
�আমি কিংবা আমরা এখন যে সময়টা পার করছি তার ব্যাখ্যা কিভাবে দেব ঠিক বুঝতে পারছি না। ভবিষ্যতহীন একদল মানুষ! কি করুণ চাহনি এক একটা মানুষের!
প্রথম পর্যায়ে দু'বেলা সামান্য দু'চামচ পাতলা খিচুড়ি খেয়ে সারাটা দিন পার করেছি। একটানা প্রায় তের দিন ভাত না খেয়ে থাকার কষ্ট এখনও মনে দাগ কাটে। আজ বুঝতে পারছি অনাহারী মানুষ কেন পেটের আগুন নেভাতে দোজখের আগুনে ঝাপ দিতেও ভয় পায় না।
সারাক্ষণ নির্দিষ্ট একটা গণ্ডিতে থাকতে হয়েছে। কখনও শুয়ে, কখনও বসে। আবার কখনও পায়চারি করে সময় পার করছি। কখনও নিজের অস্তিত্বটাকেই ভুলে যাই। এ জীবন অসহ্য মনে হয়। তবে তোমাকে ভাবলে ভালো লাগে।
এখনও রাতে বারান্দায় দাড়িয়ে রাতের আকাশ দেখি। তারাগুলো যখন লজ্জা অবনত মুখে আকাশের কোলে বের হয়, তখন সেদিকে তাকিয়ে আমি যেন আমার স্বপ্নকন্যার মাঝে হারিয়ে গিয়েছি। ভাবতে থাকি তোমার মুখের ছবি। যতবারই তোমাকে ভাবি, দেখি তোমার বিষাদ ভরা মুখ।
আকাশে পাখি উড়ে যেতে দেখলে বলতে ইচ্ছে করে, পাখি! তোর পায়ে করে নিয়ে যা আমার স্বপ্নকন্যার কাছে। তোমাকে ঘিরে হাজারও স্বপ্ন সাজিয়েছিলাম...। জানিনা, হয়তো আজও তুমি আমার পথ পানে চেয়ে আছো কিংবা হয়তো অনিচ্ছা সত্ত্বেও তুমি অন্য কারো স্ত্রী হয়ে গিয়েছ। এজন্য কাকে দায়ী করবো?
একাই এ পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে। সে চিন্তা আমার মনে বিষাদ এনে দেয় না। আমার মন থাকে শান্ত, স্থির। জানতে ইচ্ছা করে আমার আয়ু সীমারেখা। কেউ যদি বলে দিত আমি আর কতো ঘণ্টা বাচবো? অথবা কতো মিনিট?
আমার জীবনে যে জটিল একটা অধ্যায় হবে সেটা, শুরুতে বুঝতে পারিনি।
সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই। তাই যদি হয় তাহলে তুমি কি বলতে পারো, মানুষে মানুষে কেন এত ব্যবধান? কেনই বা এত অধিকারের প্রশ্ন....?
নিয়মের এ পৃথিবীতে অনেক অনিয়ম লুকিয়ে আছে। এ কারণে যেমন কর্ম তেমন ফল, সব সময় পাওয়া যায় না। ভেবেছিলাম, তোমার বুকে মাথা রেখে জীবনের শেষ নিঃশ্বাস নেব। কিন্তু এই ছোট চাওয়াটাও বোধ হয় আর পূরণ হবার নয়। এটা ভাগ্যের নির্মম পরিহাস ছাড়া আর কিছুই নয়। তাই জীবনের উপর দিয়ে যা ঘটে গেল তা মেনে নিয়েছি। তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা তেমনই আছে, একটুও কমে যায়নি।
আমি তোমার মাঝে অমর হতে চাই না। আমাকে একটা গভীর রাতের দুঃস্বপ্ন ভেবে, পারলে ভুলে যেও।
তবে এতটুকু দোয়া করো, যাদের কারণে তোমাকে আজ হারাতে বসেছি, সঠিক তদন্তের মাধ্যমে তাদের বিচার হোক। বেচে থাকুক আমার মতো অসহায়, নিরপরাধ কিছু প্রাণ। তারা ফিরে পাক হারানো সব ভালোবাসা।
ইতি
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক।
লেখার সূত্র
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০০৯ বিকাল ৪:২৬