রিকশা দিয়ে যাচ্ছিলাম আর ভাবছিলাম ঢাকা শহরে কি বেশি,,,, মানুষ না যানবাহন? ৩০ মিনিটের পথ ১ ঘন্টা ধরে বসে থেকেও পৌছাতে পারছি না। আর এমন এক জায়গায় আটকে আছি যে ইচ্ছা থাকা স্বত্তেও নেমে হাটতে পারছি না। পার হবার মত অবস্থা ও নেই।
হঠাৎ করেই একটু একটু করে চলতে শুরু করলো রিকশা,,, কিছু দুর গিয়ে আবার দাড়িয়ে পড়ল। এবার আর বসে না থেকে হাটতে শুরু করলাম। হাটলে আর ১০ মিনিটেই পৌছে যাবো কলেজে।
হাটতে হাটতে হঠাৎ করেই চোখে পড়লো রাস্তার ধারে বসা ছোট ছোট দু'টো বাচ্চার দিকে। একটা ছেলে (মনে হয় ৮ কি ৯ বছর হবে) পাশে বসা মেয়েটি (যার বয়স হবে ৫ কি ৬) কে হাতে তুলে খাইয়ে দিচ্ছে আর গল্প করছে।
দেখে আমার খুব ভালো লাগলো,,,,,, কি বলছে
তা শুনার জন্য ওদের কাছে গিয়ে বসলাম। আমাকে বসতে দেখে ওরা খুব অবাক হলো। ওদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিয়ে জানতে চাইলাম, " কি গল্প কর দুজন মিলে?? "
ছেলেটা পাল্টা হেসে উত্তর দিলো, " আর বইলেন না ভাইয়া পত্যেক দিন গপ্প না কইলে এই মাইয়া খায়ই না। "
তখন মেয়েটা ফিক করে হেসে উঠে বলে উঠলো, "কি করুম কও,তোমার গফগুলি এত্ত মজা লাগে যে অইডি না শুইনা খাইয়া মজাই পাইনা। "
আমি জোরে হেসে উঠে বলে উঠলাম," কি নাম তোমাদের ? "
ছেলেটি বলে উঠলো, "আমার নাম রজব আর অয় আমার বইন পরী। "
আমি বল্লাম, "বাহ, কি সুন্দর নাম, পরী। কে রেখেছে এই নাম ? "
পরী হেসে উঠে বলে, " আমাগো মায় রাখছে। "
জানতে চাইলাম, " মা কোথায় ? দেখি না যে ? "
একথা শুনে পরী মন খারাপ করে বলে উঠে," হেয় তো আমাগেরে ছাইড়া দুরে গেছে গা আর আইতে পারবো না। "
আর রজব বলল," পরীর জন্মের সময় মায় মইরা গেছে "
জানতে চাইলাম , " তোমাদের বাবা কোথায় ? "
রজব উত্তর দিল, "হেয় তো আরো আগেই আমাগোরে রাইখা ভাগছে। "
একথা শুনে আমার মনটাই ভারী হয়ে গেল। এবার জানতে চাইলাম, "তোমরা থাকো কার সাথে ? "
এবার হেসে উঠে রজব বরল, " কি যে কন ভাই কার লগে থাকুম, আমরা দু'জনেই থাকি। "
এমন সময় রাস্তায় হঠাৎ লালবাতি জ্বলে উঠলো আর পুরো রাস্তা যানবাহনে ভরে গেলো। তখুনি রজব পাশে পড়ে থাকা একটি কাপড় তুলে নিয়ে উঠে দাড়ালো আর বলল, "ভাই আফনে এট্টু পরীর লগে বহেন আমি আইতাছি। " একথা বলে গাড়ীগুলোর দিকে এগিয়ে গেল আর চিৎকার করতে লাগলো, " গাড়ী মোছা ১০ টাকা, ১০ টাকা। "
এবার আমি পরীকে বললাম, "তোমরা স্কুলে যাও?? "
পরী বলল, "হ যাই। না গেলে কি আর শান্তি আছে? ভাইজান তো সারাদিন খালি পড়ার কথাই কইতে থাকে। "
" কয়, আমারে নাকি ডাক্তর বানাইবো। যত কষ্টই করা লাগুক আমারে ডাক্তর না বানাইয়া বলে তার শান্তি নাই। "
আমি আবার জানতে চাইলাম, "তোমার ভাল লাগে পড়তে?"
পরী বললো, "অত ভাল লাগে না, কিন্তু কি করুম ভাইজানের লাগি পড়তে হয়। "
কথা বলতে বলতে রজব এসে পড়লো, আবার পরীকে খাওয়াতে শুরু করলো। এবার ওর কাছে জানতে চাইলাম, " তোমার স্কুলে যেতে ইচ্ছা করে না? "
রজব বললো," ইচ্ছা করলে কি হইবো কন ভাইয়া মা বাপ থাকলে হয়তো পড়তে পারতাম।কিন্তু এহন তো পরীর দেখ ভাল করাতে হয়। এহন ওরে পড়াইতে পারলেই হইলো। "
" ওরে আমি ডাক্তর বানামুই বানামু। "
একথা শুনে আমি চিন্তা করতে লাগলাম, যেখানে সভ্য শিক্ষিত সমাজের মানুষেরা সামান্য আর্থিক লোভের জন্য ভাই ভাইকে,,,, সন্তান পিতাকে মেরে ফেলছে, সেখানে রজবের মত সহায়সম্বলহীন এক ছোট্ট বড় ভাই কিভাবে পারে এমন কঠিন কিন্তু আন্তরিক স্বপ্ন দেখতে??
আজকালের সমাজে আমাদের এমন নিঃস্বার্থ বড় ভাইয়েরই বুঝি বেশি দরকার। যে নিজেকে ভুলে পরিবারের জন্য বেঁচে থাকবে।
মনে মনে প্রার্থণা করলাম, " হে সৃস্টিকর্তা, তুমি এই নিষ্পাপ শিশুর নিষ্পাপ আশা টুকু পূর্ণ করে দিও। আমীন। "
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জুন, ২০১৫ সকাল ১০:১৫