এক দূর তেপান্তরের মাঠে একজোড়া তরুণ তরুনি বসে আছে । দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছে কি ভালবেসেই না তারা একে অপরের মাঝে মগ্ন হয়ে বসে আছে । মনে হচ্ছে যেন নিজেদের প্রেমে মগ্ন হয়ে এই বিশ্ব চরাচর ভুলে বসেছে দুজন । যেন ভালবাসায় নিমগ্ন দুটি প্রান ।
হঠাৎ করেই মেয়েটি উঠে দৌড়ে চলে গেল ছেলেটির কাছ থেকে আর ছেলেটি বোকার মত হাতে হাত রেখে বসে রইল । কিছুক্ষণ একা বসে থাকার পর ছেলেটি আস্তে আস্তে উঠে চলে গেল ...............কোথায় কে জানে ?
এরা আজ আমাদের গল্পের পাত্র - পাত্রী । সাধারণত নায়ক - নায়িকা বলা হয় কিন্তু আমি এখানে তা বলতে নারাজ । কারন এখানে সময়টাই মুখ্য ভুমিকা পালন করছে । এখানে আজ আমাদের পাত্র --- নাইম ও পাত্রী --- সায়লা ।
নাইম অনেক ভাল , মেধাবী একজন ছাত্র এবং মা - বাবার একমাত্র ছেলে । ওর একটি মাত্র বোন আছে নাম নিম্মি । নাইম ইংরেজি বিষয়ের সম্মান তৃতীয় বর্ষের ছাত্র আর নিম্মি উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্রী । ওদের বাবা মোটামুটি সফল একজন ব্যবসায়ী এবং ওদের মা একটা স্কুলের শিক্ষিকা ।
এদিকে সায়লাও ভাল ছাত্রী , ও নাইমের ভার্সিটিতে নাইমের বিভাগেই প্রথম বর্ষে পড়ে । ওরা দুবোন ছোট বোনের নাম নায়লা, যে কিনা একটা গার্লস স্কুলে ক্লাস টেন এ পড়ে । ওদের বাবা একজন সরকারী চাকুরীজিবি এবং মা গৃহিনী ।
ভার্সিটির প্রায় প্রথম থেকেই সায়লা আর নাইমের পরিচয় নিজের বিভাগের সিনিয়র স্টুডেন্ট হিসেবে । তারপর ধীরে ধীরে বন্ধুত্ত এবং বন্ধত্ত থেকে প্রেম হতে বেশি দেরী লাগেনি । প্রথম থেকেই ওদের সম্পর্কটা সুন্দর, স্বচ্ছ তাই ওদের মাঝে কখনো কোন কালিমা প্রবেশ করতে পারেনি ।
ধীরে ধীরে দুজনের বাসায়ও ওদের সম্পর্কের কথা জানা জানি হয়ে যায় । কিন্তু কোন পরিবার থেকেই কোন আপত্তির কোন আওয়াজ উঠে না । তাই সবাই এক রকম ধরেই নেয় যে শুধু সঠিক সময়ের অপেক্ষা , তারপরই ওরা দুজন এক হয়ে যাবে ।
কিন্তু জীবনের হিসাব কি এতই সহজ সমীকরণে সমাধা করা যায়,না গিয়েছে কখনো ?
হঠাত করেই একদিন সায়লা , নাইম কে ফোনে পাচ্ছে না , ভার্সিটিতেও আসছে না নাইম । দুদিন অপেক্ষা করে সায়লা নাইমদের বাড়ি চলে যায় । কিন্তু, গিয়ে সায়লা জানতে পারে নাইমরা পুরো পরিবার দেশের বাইরে চলে গিয়েছে । কবে আসবে কেউ বলতে পারে না ।
একথা শুনে সায়লা একেবারে ভেঙ্গে পড়ে । আর সায়লাদের পুরো পরিবারও খুব হতবাক হয়ে পড়ে । এরপর সায়লার বাবা নাইমের বাবার অফিসে গিয়ে শুধু এ টুকু জানতে পারে, যে ওরা সিঙ্গাপুর গিয়েছে । কিন্তু , কবে আসবে বা কেন গিয়েছে এসব কেউ বলতে পারে না ।
প্রায় দুমাস পর নাইম ভার্সিটিতে আসে । কিন্তু সায়লার সাথে দেখা করে না । সায়লার বান্ধবী নাইম কে দেখে সায়লাকে এই খবর দেয় । সায়লা শুনে বিশ্বাস করতে পারেনা , যে নাইম দেশে আসার পর ও ওর সাথে দেখা না করে থাকতে পারল । সায়লা তাড়াতাড়ি নাইমদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয় ।
গিয়ে অবশ্য কোন লাভ হয় না কারন ,নাইম বাসায় ছিল না । আর নাইমের মা কে জিজ্ঞেস করেও কোন উত্তর পাওয়া যায় না । নাইম নাকি সবাইকে মানা করে দিয়েছে সায়লাকে কিছু বলার জন্য । ব্যর্থ , হতাশ সায়লা এবার একেবারে ভেঙ্গে পড়ে । বাসায় যেয়ে কাওকে কিছু না বলে নিজের রুমে নিজেকে বন্দী করে রাখে সায়লা ।
মেয়ের এই অবস্থা দেখে সায়লার বাবা আবারো নাইমের বাবার অফিসে যান ওনার সাথে দেখা করতে । কিন্তু তিনিও ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসেন । নাইমের বাবাও কোন কিছু জানাতে অপরাগতা প্রকাশ করেন । শত অনুরোধেও কোন কিছু জানতে পারেন না সায়লার বাবা । আসার আগে মেয়ের খারাপ অবস্থার কথা ভাল ভাবে বলে আসেন তিনি নাইমের বাবা কে।
এভাবেই দুদিন কাটার পর সায়লার মোবাইলে কল আসে নাইমের , ও সায়লাকে দেখা করতে বলে আগামী কাল । একথা শুনে তো সায়লার বাসার সবাই অনেক খুশি হয়ে উঠে , কিন্তু সায়লা কি যেন এক আশংকায় ভয় পেতে থাকে । ওর মনে হতে থাকে যেন খারাপ খবর ওর জন্য ওত পেতে আছে ।
যাই হোক পরদিন সায়লা সময়মত নাইমের সাথে দেখা করতে যায় । ওকে দেখে নাইমের মাঝে কোন ভাবান্তর হয় না । কেমন যেন এক শীতল ব্যবহার চোখে পরে সায়লার । নাইম সায়লাকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বলে উঠে ," দেখ সায়লা, আমার পক্ষে আর তোমার সাথে সম্পর্ক রাখা সম্ভব না । কেন ,কি কারনে এসব নিয়ে সময় নষ্ট করার কোন মানে আমি দেখি না । শুধু এটুকু জেনে রাখো এই সিদ্ধান্ত শুধু আমার এবং এর কারন ও শুধু আমি । পারলে আমাকে ভুলে নতুন করে ভাবার চেষ্টা কোরো । "
এতকিছু শুনে সায়লা আর কিছু বলার মত ভাষা খুঁজে পায় না শুধু এতটুকু বলে যে," শুধু এসবের কারন টা তো আমাকে জানাতেই পারো , তাই না ? "
এর উত্তরে নাইম শুধু বলে ," আমি অপরাগ ...আমি কিছু বলতে পারব না ।"
একথা শুনার পর সায়লা কাঁদতে কাঁদতে ওখান থেকে ছুটে চলে যায় এবং এরপর আর কখনো নাইমের সামনে আসে না ।
পাঁচ বছর পরঃ-
নাইম তার ব্যবসার কাজে সিঙ্গাপুর যাবার জন্য এয়ারপোর্ট এসেছে , কিছুক্ষন পর ওর ফ্লাইট তাই বোর্ডিং পাস করিয়ে প্লেনে উঠার অপেক্ষা করছে । ১০ মিনিট পর প্লেনে উঠার জন্য সবাইকে অনুরোধ করা হলে ও প্লেনে যেয়ে বসে পরে । প্লেন টেক অফ করার কিছুক্ষন পর নাইম ওয়াশ রুমে যাওয়ার সময় হঠাত দেখে সায়লাও পাশের রো তে বসে আছে । ও তাড়াতাড়ি নিজেকে আড়াল করে ওয়াশ রুমের দিকে পালিয়ে যায় ।
কিছুক্ষন অপেক্ষা করার পর নাইম খুব সাবধানে বের হতে যাবে, কিন্তু বের হয়েই সামনে সায়লাকে দেখতে পায় । সামনে সায়লাকে দেখে ভ্যবাচ্যাকা খেয়ে যায় নাইম । কিন্তু সায়লা মুচকি হেসে জানতে চায়, " কেমন আছ? "
উত্তরে নাইম কোন রকমে " ভাল" বলেই নিজের সিটের দিকে চলে যায় ।
কিছুক্ষন পর সায়লা নাইমের সিটের পাশে এসে বলে, " বসতে পারি ?"
নাইম অবাক হয়, বলে, " বস।"
পাশে বসে সায়লা জানতে চায়, "বাসার সবাই কেমন আছে ? নিম্মি কেমন আছে ?"
নাইম ব লে, " ভাল আছে সবাই । নিম্মির বিয়ে হয়ে গেছে ।"
সায়লা বলে উঠে, " যাক ভালই হল , এখন আর কোন সমস্যা নাই তো ?"
নাইম আবার ও অবাক হয়ে জানতে চাইল , " সমস্যার কথা আসছে কেন ?"
সায়লে হেসে উঠে বলল , " যে কারনে তুমি আমাকে ছেড়ে চলে গেলে , যোগাযোগ রাখলে না সেটা সমস্যা ই তো তাই না । তুমি কি ভেবেছ , তুমি না বললে আমি কোন দিন জানতে পারবো না ? "
নাইম চোখ পাকিয়ে বলে উঠল , "কি জানো তুমি?"
সায়লা উত্তর দিল , " সবটাই জানতে পারেছি আমি । নিম্মির অসুস্থ হওয়া, কিডনি নষ্ট হওয়া, সিঙ্গাপুর গিয়ে তোমার ওকে কিডনি দেয়া ... সব । শুধু এটা জানি না এখানে আমার অপরাধটা কোথায় ? আজও কি আমার এই শাস্তির কারনটা জানানো যাবে না ?"
নাইম হালকা হেসে জবাব দিল , " শাস্তি কি তোমার না আমার । তোমাকে না করে , না পেয়ে কি আমি ভাল আছি ? কিন্তু , কি বা করতে পারতাম আমি । নিজের এই অসম্পূর্ণ শারীরিক অবস্থায় তোমাকে জড়িয়ে , তোমার জীবনে কোন অঘটনের ছোঁয়া লাগাতে চাইনি বলেই তোমার কাছ থেকে দূরে সরে গিয়েছিলাম ।"
সায়লা বলল, " সুধু একটা কথার জবাব দাও , আমার এমন কিছু হলে কি তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যেতে ?
এবার নাইম আর কোন কথা বলে না, চুপ করে থাকে ।
সায়লা উঠে দাঁড়ায় আর ব্যাগ থেকে একটা কার্ড বের করে বলে ," যদি মনে কর আমার ভালবাসা , আমার অপেক্ষার দাম দিতে পারবে তবে যোগাযোগ কোরো । আসি , ভাল থেক ।"
একথা বলে সায়লা নিজের সিটে যেয়ে বসে পরে আর নিরবে কাঁদতে থাকে এবং নাইম নিজের ভুল আর সায়লার এতদিনের অপেক্ষার কাছে নিজেকে কেমন ছোট ভাবতে থাকে ।
এ ঘটনার ঠিক দুদিন পর সায়লার কাছে নাইমের কল আসে । নাইম বলে , " আমার এতদিনের ভুল শোধরানোর একটা সুজোগ চাই ......... পাব কি ??"
সায়লা মুচকি হেসে বলে ," হুম্মম্মম্ম।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জুলাই, ২০১৫ দুপুর ২:৪১