বাঙালি জাতি হিসেবে যে বেদনাগুলো আমাদের জন্য অত্যন্ত গভীর এবং দুঃসহ তার একটি হলো মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের দোসর আল-বদরের সহযোগীতায় বাংলাদেশের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ও মেধাবী সন্তানদের হত্যাকাণ্ড।
আর কোন জাতির জীবনে এত বড় ঘৃণ্য, নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনা আছে কী না আমার জানা নেই। পৃথিবীর দুটি বিশ্বযুদ্ধেও যুদ্ধরত দেশগুলোর বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো নিরাপদ ছিলো। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে, বাড়ি থেকে অপহরণ করে নিরস্ত্র, নিরীহ শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক এবং অন্যান্ন পেশাজীবী বিশিষ্ট ব্যক্তিদের তুলে নিয়ে যাওয়া এবং নির্মমভাবে হত্যা করার ঘটনা ইতিহাসে বিরল।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার যে চক্রান্ত করেছিল, সেই কাজে হয়তো তারা সফল হতো না, যদি এদেশীয় আল-বদরেরা সহযোগীতা না করতো। এই ঘটনা থেকে বাঙালি জাতির ভিতরে একটি নিকৃষ্ট, কুটিল, বিষাক্ত ও কুচক্রী গোষ্ঠির পরিচয় পাওয়া যায়। এদেরকে যুগে যুগে চিহ্নিত করা এবং বিচারের আওতায় নিয়ে আসা বাঙালি জাতির আত্মপরিচয়েরই একটি অংশ।
গত দুদিনে অবাক হয়ে লক্ষ করলাম যে ব্লগে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে একটা কোন পোস্ট পর্যন্ত নেই। প্রথম আলো সহ অন্যসব গুরুত্বপূর্ণ দৈনিকগুলোতেও গতবাধা স্মরণিকা প্রকাশ ছাড়া বিশেষ কোন কথা নেই। নিজের শক্তি ও সত্তাকে ভুলে যাওয়া আত্মবিস্মৃত জাতি যখন গভীর নিদ্রায় মগ্ন ঠিক তখনই জঙ্গি মৌলবাদের শক্তি একটা জাতির মাথায় আঘাত করে। লক্ষ করলাম বুদ্ধিজীবী দিবসে এ সময়ের আল-বদরেরা কিন্তু ঘুমিয়ে নেই। ফেসবুক খুললেই এরকমের মৌলবাদীদের চোখে পড়ে।
বাংলাদেশে শিক্ষার হার কম হওয়াটা একটি সমস্যা বটে, কিন্তু তার চেয়েও বড় সমস্যা হল শিক্ষিত অশিক্ষিতেরা। স্বাধীনতা বিষয়ে, সংস্কৃতি বিষয়ে, শিক্ষা বিষয়ে, নারী স্বাধীনতা বিষয়ে এই শিক্ষিত অশিক্ষিতদের বয়ানের শেষ নেই। এদের ধারনা এমন যে অত্যন্ত মানবেতর জীবন যাপন করা, নারীদের দাস হিসেবে গন্য করা তালেবানদের আফগানিস্তান থেকে সভ্যতার সূচনা হবে। ফেসবুকে এরকমই একজন জঙ্গি মৌলবাদীর একটি লেখা চোখে পরলো। লেখাটা নিম্নরূপ:
"যেহেতু বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ করি, সেই অর্থে আমি একজন বুদ্ধিজীবী। স্বাধীনতার এতো বছর পরও জালিম এবং জুলুমের বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য আমার মত অনেককেই গ্রেপ্তার আতঙ্কে থাকতে হয়। আমরা প্রান খুলে কথা বলতে পারিনা, যেমন পারতেন না আমাদের পূর্বপুরুষেরা । ৭১ আর ২৩ এর মধ্যে কি অবস্থা খুব একটা বদলেছে ! অনেক কালা কানুনের ভিড়ে আমরা সাহস করে লিখি, আমাদের লেখা পড়ে আমাদের প্রিয়জনেরা আতঙ্কে থাকে। শঙ্কায় থাকে, যে কোন রাতে দরজায় ঠক ঠক করে কেউ কড়া নাড়বে, তারপর সাদা মাইক্রবাসে করে তুলে নিয়ে হাওয়া হয়ে যাবে।"
সহস্রাধিক বুদ্ধিজীবী হত্যা করে একটি জাতিকে মেধাশুন্য করা আর বাক স্বাধীনতাকে খর্ব করা ও প্রতিহিংসার রাজনীতিকে এক করে দেখার সুযোগ নেই। এটি একটি অপতৎপরতা এবং শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি অসম্মান। এই ধরনের ফেসবুকি লেখার মাধ্যমে আত্মবিস্মৃত ও নিদ্রামগ্ন জাতিকে সহজে ধোকা দেওয়া যায়। যারা এই ধোকাগুলোকে ধরতে পারে, তাদের পক্ষে জঙ্গি মৌলবাদীদের চিহ্নিত করাটা সহজ হয়।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৩ সকাল ১০:১৫