somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আধ্যাত্মিক, আধিদৈবিক ও আধিভৌতিক তিনটি ঘটনা - ২

২৫ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১:২৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



বিভূতিভূষণের দৃষ্টি-প্রদীপ উপন্যাসে হীরুঠাকুর বলে একটা চরিত্র আছে। হীরুঠাকুর সহায়-সম্পদ হারানো আধাপাগল মানুষ। দুঃসময়ে হরিবল্লভ নামে একজন ধনী লোকের কাছে পৈত্রিক জমিজমা, আম-কাঠালের বাগান বন্ধক রেখে হীরুঠাকুর টাকা ধার করেন। ধারের টাকা সময়মত পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলে হরিবল্লভ মামলা করে হীরুঠাকুরের পৈত্রিক ভিটেসহ অন্য সব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেন। পরে হীরুঠাকুরের অবস্থা কিছুটা ভালো হয়। তখন ধারের টাকা শোধ দিয়ে তার সম্পত্তি ফিরিয়ে নিতে চান। কিন্তু তখন আর হরিবল্লভ রাজি হয়না। হীরুঠাকুরের মাথায় গন্ডগোল দেখা দেয়। মৃত্যুর আগে হীরুঠাকুর হরিবল্লভকে এই বলে অভিশাপ দেন যে "আমি বলে যাচ্ছি নির্বংশ হবে, নির্বংশ হবে"।

আমার গল্পের কাহিনী একই ধরনের, শুধু পাত্রপাত্রী আর স্থান-কাল ভিন্ন। এটিও শোনা গল্প, তবে গল্পের বিস্তার আগের গল্পের চেয়ে বেশি। আমাদের এলাকার বালক বৃদ্ধ স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলে ঘটনাটি শুনেছেন এবং মানুষগুলোকে চেনেন। গল্পের ভিলেন ডাকসাইটে উকিল। তিনি গরীব প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে ভিটে-মাটি দখল করে নেন। মামলার রায়ের দিনে ভিটে-মাটি হারানো লোকটি রাস্তায় কাঁদতে কাঁদতে এই বলে অভিসম্পাত দেন যে, উকিলের বংশ নির্বংশ হবে।

পরবর্তীতে দেখা গেল সেই উকিলের সন্তানেরা সকলে দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত আর তারা কেউ দীর্ঘজীবী হলেন না।

ঘটনাটি যাদের কাছে খুব ক্লিশে (cliche) লাগছে তাদের আর একটি ঘটনা বলি। ঘটনাটি নিজের জীবনের, তবে একেবারে ভিন্ন ধরণের। প্রায় বিশবছর আগে সবে ছাত্রজীবন শেষ করে সওদাগরী একটা লোকাল কোম্পানিতে কাজে ঢুকেছি। কোম্পানির অফিস কাকরাইল মোড়ের কাছে একটা বিল্ডিংয়ে। কোম্পানির একাউন্টস ডিপার্টমেন্টে কাজ করি, বড় বড় বাধাই খাতায় ভাউচার লেখা এই মোটের উপর আমার কাজ। বড় হলরুম জুড়ে একাউন্টসের অফিস। সেখানে ৮-১০ জন লোক আয়তাকার ঘরে কতগুলো ছোট-ছোট ডেস্কে বসে কাজ করে।

আমার একপাশে বসেন সাজ্জাদ নামের একজন সহকর্মী, আরেকপাশে শাহাবুল। প্রতি বৃহস্পতিবার অফিস ছুটি হলেই সাজ্জাদ সদরঘাটে লঞ্চ ধরতে ছোটেন, সেখানে দেশের বাড়িতে তার স্ত্রী কন্যা আছে। শাহাবুল চৌকস কর্মী। কোন জাবেদা ভুল-টুল হলে তিনি ঠিক করে দেন।

আমাদের কোনাকুনি ম্যানেজারের টেবিল। টেবিলটি ডেস্কগুলোর চেয়ে বেশ বড়। শাহাবুলের উলটো দিকে বসেন ইউসুফ। তিনি বিশিষ্ট গীতিকার এবং সুরকার। নিজের লেখা গানে সুর বসিয়ে তিনি প্রায়ই আমাদের গেয়ে শোনান। তারপাশের ডেস্কে সুমি নামের একটি মেয়ে বসেন। আমরা ডাকি সুমি ম্যাডাম বলে। সুমি বাকপটিয়সী, কারণে অকারণে প্রচুর বকেন। ইউসুফের লেখা ও সুর করা প্রেমের গান শুনতে শুনতে বিরক্ত হয়ে তিনি তাকে কিছু ছড়া-গান লেখার ফরমায়েশ দিয়েছেন। রুমের বামপাশে সব মিলিয়ে আরো প্রায় পাঁচ-ছয় জন সহকর্মীর বসার জায়গা।

সেই কোম্পানিতে তখন আমার দ্বিতীয় বা তৃতীয় সপ্তাহ চলছে। সেই সময়টায় আমি অন্তর্মুখী এবং অসামাজিক জীবনযাপন করতাম। মানুষের সাথে মিশতে পারতাম না। কাছের দুচারজন বন্ধুবান্ধব ছাড়া অপরিচিত সহকর্মীদের সাথে কি করে ভালো করে কথা বলতে হয় এটা আমার জানা ছিল না। আমার এই উদ্ভট অদ্ভুত আচরণ আমার সহকর্মীদের বিক্ষুব্ধ করে তুলেছিলো। আমি কথা বলতাম খুবই কম, অতএব আমি মানুষটা ঠিক কেমন এটা তার বুঝে উঠতে পারছিলেন না।

সেদিন আমি অফিস রুম থেকে কি একটা কাজে বের হয়েছি। বিল্ডিংয়ের প্রথম তলায় একাউন্টসের আরেকটা অফিস ছিল, সেখানে অফিসের জিএম বসতেন। বোধহয় কোন কারণে সেই অফিসে আমার ডাক পড়েছিল। পনের-বিশ মিনিট পরে যখন চারতলায় আমাদের অফিসে ফিরলাম তখন মনে হলো আমি একটা গ্যাস বেলুনের মধ্যে ঢুকে পড়েছি। বেলুনের ভিতরে যে হাওয়া তার প্রতিটি অনু-পরমাণু অনুভব করতে পারছিলাম। সে হাওয়া স্নিগ্ধ হাওয়া নয়, সীসা মেশানো বিষাক্ত তার প্রতিটি কণা। ঘরের একদিক থেকে আরেকদিকে যেতে যেতে মনে হচ্ছে সেই বিষাক্ত গ্যাস গায়ে লাগছে। আরো আশ্চর্য এই যে সেই বিষের ভাষা যেন আমি বুঝতে পারছি।

আমি বুঝতে পারলাম যে আমার অনুপস্থিতিতে আমাকে নিয়ে সহকর্মীদের মধ্যে একটা ভীষণ সমালোচনার ঝড় বয়ে গেছে। ঘরের বাতাসে সেই রুক্ষ, অপ্রিয় কথাগুলো যেন বিষাক্ত গ্যাসের মত ভারী হয়ে আছে। স্পষ্ট অনুভব করলাম রূঢ় ভাষণের নেতৃত্ব দিয়েছেন স্বয়ং ম্যানেজার। আর আমার সহকর্মীরা তাদের শানিত জিহ্বা নিয়ে আমার সমালোচনায় ঝাপিয়ে পড়েছিলেন। আরো অনুভব করলাম, এই সময়ে শুধু একজন চুপ হয়ে ছিলেন, তিনি সুমি ম্যাডাম। অন্যসময়ে যার কথা ফুরোয় না, রূঢ় কথনের সময়টিতে সেই তিনি নীরবে বসে ছিলেন। মনে মনে তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ডেস্কে বসে জাবেদার বই খুললাম।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৮:০২
২১টি মন্তব্য ২১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

যেকোন বাংগালীর ইন্টারভিউর সময়, 'লাই-ডিটেক্টটর' যোগ করে ইন্টারভিউ নেয়ার দরকার।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৫ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০৭



আপনার এনলাকার এমপি, প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী কামাল সাহেব, যেকোন সেক্রেটারী, যেকোন মেয়র, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান, বিএনপি'র রিজভী, আওয়ামী লীগের ওয়ায়দুল কাদের, আপনার থানার ওসি, সীমান্তের একজন বিজিবি সদস্য, ঢাকার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা সকলের দায়িত্ব।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৩৮



এগুলো আমার একান্ত মতামত। এই ব্লগ কাউকে ছোট করার জন্য লেখি নাই। শুধু আমার মনে জমে থাকা দুঃখ প্রকাশ করলাম। এতে আপনারা কষ্ট পেয়ে থাকলে আমি দায়ী না। এখনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

এখনো নদীপারে ঝড় বয়ে যায় || নতুন গান

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:২০

এ গানের লিরিক আমাকে অনেক যন্ত্রণা দিয়েছে। ২৪ বা ২৫ এপ্রিল ২০২৪-এ সুর ও গানের প্রথম কয়েক লাইন তৈরি হয়ে যায়। এরপর ব্যস্ত হয়ে পড়ি অন্য একটা গান নিয়ে। সে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফেতনার সময় জামায়াত বদ্ধ ইসলামী আন্দোলন ফরজ নয়

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ১১:৫৮



সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ১০৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
১০৩। তোমরা একত্রে আল্লাহর রজ্জু দৃঢ়ভাবে ধর! আর বিচ্ছিন্ন হবে না। তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর।যখন তোমরা শত্রু ছিলে তখন তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×