
আমাদের ব্রেইন বা মস্তিষ্ক কিভাবে কাজ করে লেখাটি সে বিষয়ে। এখানে এক শিম্পাঞ্জির কথা উদাহরণ হিসেবে টেনেছি মাত্র।
ধরুন ব্লগে ঢুকে আপনি দেখলেন, আপনার পোস্টে মন্তব্যকারীর নামের মধ্যে "জেন একাত্তর" ওরফে চাঁদগাজীর নাম দেখাচ্ছে। মুহূর্তেই আপনার দাঁত-মুখ শক্ত হয়ে গেল। তার মন্তব্য পড়ার আগেই আপনার মস্তিষ্ক সংকেত দিচ্ছে "বিপদ"! মস্তিষ্কের এই আচরণকে বলে লড়াই বা পালানোর (fight-or-flight) মানসিক অবস্থা। মন্তব্যে চাঁদগাজী কী বলেছেন সেটা পড়ার আগেই আপনি ঠিক করছেন, শিম্পাঞ্জিটাকে ঘুসি বাগাবেন, নাকি এই পরিস্থিতি থেকে দ্রুত কেটে পড়বেন।
মস্তিষ্কের এই মানসিক অবস্থার কারণ আমাদের মানব প্রজাতির হাজার বছরের বিবর্তনের ফল। অনেক দিন আগে বনবাসী পূর্বপুরুষেরা কোনো এক সকালে যখন জঙ্গলে খাবার খুঁজতে বেরিয়েছিল, তখন হঠাৎ ঝোপের আড়াল থেকে শব্দ। বাঘ না সাপ, হরিন না ভাল্লুক সেটা বোঝার সময় নেই। মস্তিষ্ক তখন প্রশ্ন করে না। হার্টবিট যায় বেড়ে, পা দুটো যায় থমকে।তখন দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হয়। দৌড়াবো নাকি লড়বো? এটার আরেকটি নাম দ্রুত ও স্বয়ংক্রিয় (অটোমেটিক) অবস্থা। এই মানসিক ধরনটা দ্রুত এবং প্রতিক্রিয়াশীল, চিন্তা-ভাবনার সুযোগ এখানে নেই।
কিন্তু মানুষের ইতিহাস এখানেই থেমে যায়নি। আগুন জ্বালানো, ভাষার সৃষ্টি, সমাজ গঠন - এসবের সাথে সাথে মস্তিষ্কের আরেকটি অংশ শক্তিশালী হয়েছে। সেটি চিন্তাশীল মস্তিষ্ক। এখান থেকে আসে চিন্তা, সহমর্মিতা এবং কোনো কিছু গভীরভাবে বোঝার ক্ষমতা। এই অবস্থাকে বলে চিন্তাশীল ও সংযত মানসিক অবস্থা (calm-and-connect)। মানসিক এই অবস্থা কিন্তু আগেরটার মত অটোমেটিক নয়। এটিকে সক্রিয় করতে সময় লাগে। আবার তার জন্য নিরাপত্তার প্রয়োজন হয়। আপনি যদি কোথাও সুস্থির হয়ে বসতে না পারেন, তাহলে মস্তিষ্কের এই অবস্থা তৈরি হবে না।
ধরা যাক চা হাতে নিয়ে আপনি সাম্প্রতিক রাজনীতি নিয়ে একটা লেখা পড়ছেন। লেখাটি আপনাকে রাগিয়ে দিতে পারে, কিন্তু আপনি প্রতিক্রিয়া দেখান না। আপনি থামেন, ভাবেন। লেখক কেন এমন বলছেন? তথ্যগুলো কোথা থেকে এসেছে? একমত না হলেও এখানে নতুন কোন চিন্তার বিষয় আছে কি? এই যে থামা, এই যে প্রশ্ন করা, এটাই চিন্তাশীল মোড।
কিন্তু মস্তিষ্ককে সক্রিয় করে চিন্তাশীল অবস্থায় নিয়ে যাওয়া সহজ নয়। এতে পরিশ্রম লাগে, মনোযোগ লাগে। সে কারণেই চাঁদগাজীর সবেগে বায়ুত্যাগ ধরনের পোস্টগুলোতে পাঠক হয় বেশি। কাজী ফাতেমা ছবির সহজ-সরল প্রার্থনার মতো কবিতাগুলো পাঠকপ্রিয় হয় না। কিন্তু তিনি যখন চাঁদগাজী নামক শিম্পাঞ্জির থাবার আচরণ নিয়ে পোস্ট দেন তখন অনেকে পড়েন এবং মন্তব্য করেন। তাই দেখে শিম্পাঞ্জিটি ভাবে, সে একজন বিরাট ব্লগার এবং বোদ্ধাও বটে!
বিষয়টা শুধু চাঁদগাজীর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে ভুল বোঝার সম্ভাবনা। বাঘ নেই, কিন্তু মস্তিষ্ক এখনো বাঘ নিয়ে পড়ে আছে। কেননা নিরাপত্তার ভাবনাটা সবচেয়ে আগে। বনের বাঘ-ভাল্লুক যদিও বা দূরে, কিন্তু ইন্টারনেট ঘিরে লড়াই বা পালানোর মানসিক অবস্থা চালু আছে। বাঘের বদলে এখন ট্রিগার হয় শব্দে, পোস্টে, মতাদর্শে।
কিন্তু সভ্যতা টিকে আছে লড়াই বা পালানোর মানসিক অবস্থার ওপর নয়। এটি টিকে আছে চিন্তাশীল মানসিক অবস্থার ওপর। সমস্যা শুরু হয় তখনই, যখন আমরা সারাক্ষণ লড়াই বা পালানোর মানসিক অবস্থাতে আটকে থাকি। সংবাদ, ব্লগ, ফেসবুক পোস্ট কিংবা রাজনৈতিক বয়ান তখন আর বিশ্লেষণের বিষয় হয়ে ওঠে না, হয়ে ওঠে বাঘ-ভাল্লুকের মতই কেবল বিপদ সংকেত মাত্র!
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ২:০৬

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



