পৃথিবীটা বড় বিচিত্র। খুব পুরান কথা। এর যা কিছু আমরা খালি চোখে দেখি তার সবটুকু সবসময় সত্য হয় না। মাঝখানে কেবল পৃথিবীতে আসা যাওয়াটাই নিখাদ সত্য। এর মাঝখানে আমরা রং মেখে সং সাজি; ভালো হওয়ার ভান করি; অনেক সময় ইচ্ছে করে খারাপ সাজি; খারাপ হওয়া দেখাই; সাদাকে কালো করি, কালোকে সাদা; সত্য চেহারাটা ঢাকার জন্য মুখে মাখামাখি করি; ছোট্ট একখানা মুখে রংয়ে রংয়ে ক্যানভাস করে তুলি; সবকিছুই শুধু আসল চেহারাটাকে পরিবর্তন করে নতুন রূপ দেয়ার জন্য। যে এমনিতেই অনেক সুন্দর সে আরো সাজে; যার কিছুটা ঘাটতি আছে সে ঐটা পূরণ করতে সাজে; যে লম্বা সে একটু খাটো হইতে চায়, যে খানিকটা বেটে সে হাই হিল পড়ে লম্বা হইতে চায়।
সব কথার শেষ কথা হইতেছে কেউ কোনো কিছুতে সন্তুষ্ট নয়; পরিপূর্ণ সুখী নয়। আবার একই চরিত্রের বিপরীত রুপ হইতেছে আমাদের লোক দেখানো সুখ আহ্লাদ।
মনের মধ্যে এক ফোঁটা সুখ নাই, একজনরে আরেকজন ছিটেফোঁটা ও সহ্য করতে পারে না। কিন্তু দুইজনের গলা ধরাধরি ফটু; পিথ্থিবীতে আমার 'হাবিই' একমাত্র প্রাণী যে তার বউকে 'লাইলি মজনু' 'শিরি ফরহাদের' চাইতে ও বেশি ভালোবাসে। "আই লাভ ইউ হাব্বি! আমার জানু!" এইসব ডায়লগ দিয়ে মহাসুখী মানুষের ভান করে। অথচ ঘরের চেহারা এক্কেবারে ভিন্ন। ঐ ভিন্ন চেহারাটা লুকানোর জন্য কত্ত কত্ত অভিনয়! এইসব দিয়ে মহাসুখী মানুষের ভান । এইসব দেখলে মনে হয় পৃথিবীর তাবৎ পরিবারে কত্ত কত্ত সুখ! সুখ যেন উপচাইয়া উপচাইয়া পড়তেছে। আহা! পৃথিবীটা যদি এতই সুখের হইতো! সত্যিই যদি হইত! !
আসল কথা হচ্ছে আমরা অধিকাংশই সুখের ভান করি। আমরা সবাই কোনো না কোনোভাবে বর্ণচোরা। আমরা প্রায় সবাই যা সত্য, যা বাস্তব তাকে পরিবর্তিত করে দেখাতে পছন্দ করি। আবার কেউ কেউ খালি স্বপ্ন দেখতে দেখতেই জীবন পার করে দিই। যখন সংসারে আর্থিক টানাপোড়ন থাকে, তখন অপেক্ষা করি একটু স্বচ্ছলতার; ভাবি আর্থিক টানাপোড়ন টা শেষ হইলেই বুঝি সংসারের সকল অশান্তি দূর হবে। যে সংসারে আর্থিক কোনো টানাপোড়ন নেই, সে সংসারে সমস্যা থাকে অন্যরকম। শ্বাশুরি মা আমাকে একদম পছন্দ করে না। ওকে নিয়ে আলাদা হয়ে যাইতে পারলেই আমাদের সংসারে সুখ চুইয়ে চুইয়ে পড়বে। অপেক্ষায় থাকি সেই দিনের। যখন টাকা পয়সা, শ্বাশুরি মাতা, শ্বশুর মশাই কোথাও কোনো সমস্যা নেই, তখন সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় আত্মীয় স্বজন; সবার জন্য ও করতে করতে জান শেষ; অথচ আমার জন্য আর আমার বাপের বাড়ির জন্য কিছু করতে বললেই ওর মাথা খারাপ হয়ে যায়। সে ও অপেক্ষা করে একটা পরিবর্তনের; একটা নতুন দিনের। এসব কোনো সমস্যা নেই যেখানে, সেখানে ও সমস্যার অভাব নেই। অনেক সময় স্ট্যাটাস সমস্যা বড় হয়ে দাঁড়ায়। আত্মীয় স্বজন কিংবা বরের কলিগ, পাশের বাড়ির ভাবি ওদের স্ট্যাটাস মনে বড় জ্বালাতন দেয়। সেই পর্যন্ত না পৌঁছানো পর্যন্ত নিজের ও শান্তি নাই, পরিবারে ও শান্তি নাই, অনেক আদরের হাব্বি টার ও শান্তি নাই।
এইভাবে পরিবারে একদিন আর্থিক সচ্ছলতা আসে, পারিবারিক জটিলতা দূর হয়, স্ট্যাটাস সমস্যা দূর হয়, কিন্তু শান্তি আসে না। নিজের জ্বালানো আগুনে জ্বলতে থাকি দিন রাত। মনের সমস্ত জ্বালাতন নিয়ে সুখের ভান করতে করতে সুখটাকেই আর অনুভব করতে পারি না।
আবার এমন ও অনেকে আছি যাদের সত্যিকার অর্থেই কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু সমস্যা নেই বলে সমস্যা তৈরি করি সময় কাটানোর জন্য। এই ভাবে সমস্যা তৈরি করতে করতে নিজের জীবনকে যেমন বিষিয়ে তুলি, পাশের মানুষটাকে ও শান্তি দিই না। আবার অনেকে আছি প্রত্যাশা কিংবা যোগ্যতার চেয়ে বেশি পেতে পেতে কৃতজ্ঞতাবোধই নষ্ট হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত জীবনে শান্তি আর হয় না, জীবন সঙ্গীটাকে ও অশান্তির আগুনে জ্বালাতে থাকি।
কিন্তু ঐ যে লোক দেখানো সুখের ভান চলতেই থাকে। "আমার হাব্বি/জানের জান/কইলজ্জার আধ্ধান। তোমারে ছাড়া জীবন আমার খানখান।" চলতেই থাকে মিথ্যে কাব্য গাঁথা। এভাবেই বিচিত্র পৃথিবীতে মিথ্যে কাব্য রচনা করতে করতে জীবন প্রদীপে তেল দিতে থাকি।
আহা জীবন! তুমিই জীবন !!