আমি মাঝে মাঝে একটা চায়ের দোকানে যাই।
চায়ের দোকানটা খিলগাও এর তিলপাপাড়া এলাকাতে। গলির অনেক ভিতরে চায়ের দোকান টা। বেশ নিরব জায়গা। রাস্তাটা বেশ পরিস্কার। সবচেয়ে বড় কথা ফুটপাত গুলো দখল মুক্ত। ফুটপাতে লাগানো গাছ গুলো অনেক বড় হয়েছে। দেখতে ভালো লাগে। চায়ের দোকানের উলটো দিকে একটা ক্লাব আছে। ক্লাবের নাম এ বি সি। আসলে এটা নামে ক্লাব। এখানে খেলাধূলার কোনো ব্যবস্থা নেই। এলাকার হোমরা চোমরা ক্লাব নাম দিয়ে জায়গাটা দখল করে রেখেছে। মাঝে মাঝে তারা মদ তদ খায়। যাই হোক, আমি যে দোকানে চা খাই তার মালিকের নাম বিল্লাল। বিল্লাল নিজেই চা বানায়। সারাদিনে দোকানে বেচাকেনা মন্দ না।
বিল্লাল আমাকে খুব পছন্দ করে।
কেন পছন্দ করে আমি জানি না। বিল্লালের বয়স বেশি না। হিসাব করলে বয়স আমার চেয়ে কমই হবে। ছোট একটা চায়ের দোকান, এই দোকানে আমি চা সিগারেট খেয়ে দুই হাজার টাকা বাকি করেছি। কিন্তু বিল্লাল আমার কাছে কখনও টাকা চায় নি। গত কয়েকদিন বিল্লালের দোকানে গিয়ে দেখি দোকান বন্ধ। খোঁজ নিয়ে আমি বিল্লালের বাসায় গেলাম। গিয়ে দেখি সে অনেক অসুস্থ। আমার ধারনা, সম্ভবত বিল্লালের করোনা হয়েছে। বিল্লালকে দেখাশোনার করার কেউ নাই। সে একা একরুম নিয়ে মেসে থাকে। আমি বললাম, বিল্লাল কি খবর? সে বলল, জ্বর আছে ভাইজান, সাথে শরীর ব্যথা, কাশি হয় খুব, কোনো গন্ধ পাই না, কোনো খাবারের স্বাদ পাই না। আমি বললাম, লক্ষন তো করোনার! সে বলল, করোনা ফরোনার ভয় আমি পাই না।
যখন আমাদের দেশে লকডাউন শেষ হয়-
তখন বিল্লালের চায়ের দোকানে গেলাম। লকডাউন এর কারনে বিল্লাল প্রায় দুই মাস দোকান বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছিলো। তার মেজাজ খুব খারাপ ছিলো তখন। বিল্লাল বলল, করোনা ফরোনা কিচ্ছু না। সব ভাওতাবাজি। করোনা বলে কিছু নেই। গুজব। এই গুলা সরকারের সাজানো নাটক। আমাদের মতো গরীবদের সরকার মারার বুদ্ধি করছে। আমি বললাম, বিল্লাল করোনা গুজব নয়, বাস্তব। আমার কথা বিল্লাল কিছুতেই বিশ্বাস করলো না। আজ বিল্লালের ঠিকই করোনা হয়েছে। বিছানায় শুয়ে কুকাচ্ছে। ছটফট করছে। তবে আমি জানি সে সুস্থ হয়ে উঠবে। তার মনোবল তীব্র। ও আরেকটা কথা বলতে ভুলে গেছি। আমি সব সময় দুধ চা খাই। কিন্তু বিল্লাল আমাকে দুধ চা খেতে দেয় না। সে বেশি করে লেবু দিয়ে আমাকে চা করে দেয়। লেবু চা টা ভালো লাগে।
আমি খুব দুঃখিত। ক্ষমাপ্রার্থী।
লিখব আমার ভৌতিক কাহিনী। অথচ শুরু করেছি চায়ের দোকানের বিল্লালের গল্প। আমার দোষ হলো আজাইরা প্যাচাল আমি বেশি পাড়ি। কাজ রেখে, অকাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। স্যরি। যাই হোক, আর বক বক না করে আসল কথা শুরু করি। আমি একটা চেয়ার কিনেছি। সম্পূর্ন কাঠের চেয়ার। খুব মজবুত। চেয়ারটা ব্যলকনিতে রেখেছি। সুরভি আমাকে ঘরে সিগারেট খেতে খুব কঠিন করে মানা করে দিয়েছে। তাই আমি ব্যলকনিতে গিয়ে সিগারেট খাই এখন। চেয়ারে বসি, আরাম করে হেলান দেই আর পা রাখি গ্রিলে। সিগারেট খাই। সামনের দিকে তাকিয়ে থাকি। ভালো লাগে। হু হু করে সময় চলে যায়।
চার দিন আগের কথা।
তখন অনেক রাত। সুরভি গভীর ঘুমে। আমি সিনেমা দেখছি। সিনেমার নাম- No Mercy। ভয়াবহ সিনেমা। মুভিটা আগেও বেশ কয়েকবার দেখেছি। ভাবলাম ব্যলকনি থেকে একটা সিগারেট খেয়ে আসি। খুব চুপি চুপি ব্যলকনিতে গেলাম। বাতি জ্বালালাম না। কারন যদি সুরভির ঘুম ভেঙ্গে যায়। বেচারি সারাদিন অনেক কাজ করে। আরাম করে ঘুমাচ্ছে। ঘুমাক। তাছাড়া ব্যলকনিতে বাইরে থেকেও বেশ আলো আসে। কাজেই ঘুটঘুটে অন্ধকার না। ব্যলকনিতে গিয়ে আমি প্রচন্ড অবাক। আমার কেনা নতুন চেয়ারটায় কেউ একজন বসে আছে। কোনো ভুল না। স্পষ্ট দেখলাম। এবং ভালো করে তাকিয়ে চোখ বড় বড় করে দেখলাম। কেউ একজন চুপ করে বসে আছে। আমি এক দৌড়ে ঘরে চলে এলাম। এবং চুপ করে বিছানায় সুরভির পাশে শুয়ে থাকলাম। প্রচন্ড ভয় পেয়েছি আমি। আমার সারা শরীর কাঁপছে। এটা কি করে সম্ভব?
সুরভিকে এই ঘটনা কিছুই বললাম না।
সে আমার চেয়ে বেশি ভীতু। সামান্য লোডশেডিং হলেই ভয়ে চিৎকার চ্যাঁচামেচি করে পুরো বাড়ি মাথায় তুলে ফেলে। যাই হোক, এরপর থেকে প্রতিদিন রাতে ব্যলকনিতে যাই সিগারেট খেতে। এবং কাউকে না কাউকে ঠিকই বসে থাকতে দেখি। চুপ করে বসে থাকে। কোনো কথা বলে না। এখন আর ভয় পাই না। অভ্যাস হয়ে গেছে। আমি ধরেই নিয়েছি, যারা আমার ব্যলকনিতে বসে থাকে তারা আমার মৃত আত্মীয়স্বজন। একেকদিন একেকজন আসেন। কিছুক্ষন বসে থেকে চলে যান। তারা তো আমার কোনো ক্ষতি করছে। তারা থাকুক তাদের মতোন। কিন্তু সমস্যা হলো গতকাল। গতকাল প্রতিদিনকার মতো ঠিক রাত দুটোয় ব্যলকনিতে গিয়েছি সিগারেট খেতে। গিয়ে দেখি চেয়ারটায় বিল্লাল বসে আছে। চায়ের দোকানের বিল্লাল।
আমি জানি আমার এই ঘটনা কেউ বিশ্বাস করবে না।
সবাই বলবে মিথ্যা গল্প। বানানো গল্প। অবাস্তব। আমি নিজেও এই ঘটনা বিশ্বাস করতে চাই না। আমি একজন আধুনিক মানুষ। কোনো প্রকার কুসংস্কারে আমার বিশ্বাস নেই। তবে একথাও সত্য দুনিয়াতে অনেক কিছু ঘটে, যার ব্যখ্যা নেই। যা ব্যখ্যা করা যায় না, তাই ই তো অলৌকিক। আমার ব্যলকনিতে চেয়ারে রোজ রাতে কেউ না কেউ বসে থাকে। এটা সত্য কথা। মিথ্যা নয়। অবশ্য যদি আমাকে অন্য কেউ এই গল্প করতো- আমি এক বাক্যে তাকে ফিরিয়ে দিতাম। বলতাম- এটা আপনার মনের ভুল। এটা কখনও সম্ভব না। ইত্যাদি ইত্যাদি। সেই আমার সাথেই রোজ এই রকম ঘটনা ঘটছে। আজিব! আসলেই দুনিয়াটা অনেক রহস্যময়।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে আগস্ট, ২০২০ রাত ১১:৪১