সময়ঃ রাত ১১টা। স্থানঃ কমলাপুর রেলস্টেশন।
ট্রেনের নাম- মহুয়া এক্সপ্রেস। যাচ্ছি সুসং দূর্গাপুর। একদম ইন্ডিয়ার বর্ডারের কাছে। শুনেছি সেখানে হাতি ঘুরে বেড়ায়। ভ্রমন নয়। অফিসের কাজে। ভোরবেলা ট্রেন নেত্রকোনা গিয়ে থামবে। আমি আমার বগিতে ঢুকেই দেখি কালো মতো একলোক বসে আছে। লোকোটাকে চেনা চেনা লাগছে। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। আমি একটু আরাম প্রিয় মানুষ। তাই শোভন চেয়ার নিইনি। সেখানে একগাদা লোক থাকে। লোকজন অকারনেই চিৎকার করে মোবাইলে কথা বলে। হইচই। এসব আমার পছন্দ না। এজন্য বেশি টাকা দিয়ে স্লিপিং বাথ নিয়েছি। আরাম করে শুয়ে বসে যাবো। কোনো হকার এসে বিরক্ত করতে পারবে না। কম্পার্টমেন্টে আমরা দুজন। ভদ্রলোক চুপ করে বসে আছেন। বসে থাকার ভঙ্গি দেখে মায়া লাগছে।
ট্রেন চলেছে। ট্রেন চলেছে।
যদিও ট্রেন ছাড়তে আধা ঘন্টা দেরী করেছে। আমি লোকটাকে বললাম, আপনাকে চেনা চেনা মনে হচ্ছে কেন? লোকটা আমার দিকে চাইলো। লোকটা মনে হয় রাতে ঘুমায় না। চোখের চারপাশ কেমন কালো হয়ে আছে। লোকটা বলল- আমার নাম হুমায়ূন আহমেদ। এবার আমি তাকে পুরোপুরি চিনতে পারলাম। বললাম, কিছু মনে করবেন না। আসলে আমি বইটই পড়ি না। তবে একবার পত্রিকায় আপনার ছবি দেখেছি। আপনি তো বিখ্যাত মানুষ। হুমায়ূন আহমেদ চুপ করে রইলেন। একটু পর কম্বল মুড়ে শুয়ে পড়লেন। অর্থ্যাত তিনি আর কোনো কথা বলবেন না। আমিও তাকে আর ঘাটালাম না। কবি সাহত্যিক নিয়ে মাতামাতি করার লোক আমি না। সে হুমায়ূন আহমেদ হোক বা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় হোক। বিখ্যাত লোক হলেই আমি আহ্লাদে গদগদ ভাব দেখাবো আমি সেরকম নই। একবার 'লেক শোর' হোটেলে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে দেখেছিলাম। ব্যস ঐ পর্যন্ত। অটোগ্রাফ চাইনি। ছবিও তুলতে চাইনি।
বিশ মিনিট পর হুমায়ূন আহমেদ উঠে বসলেন।
আমাকে বললেন, চা খাবেন? আমি ফ্লাক্সে করে চা নিয়ে এসেছি। একটু পরপর চা না খেলে আমার ভালো লাগে না। এই চা শ্রীলংকা থেকে রুপা নামের একটা মেয়ে এনে দিয়েছে আমাকে। খুব ভালো চা। আমি বললাম, প্রথম কথা হলো আমাকে আপনি করে বলবেন না। দ্বিতীয় কথা হলো- আমি চা খাবো। ট্রেনের চা ফালতু চা। আমি চায়ে চুমুক দিলাম। বললাম, আপনি কি ভূত প্রেত বিশ্বাস করেন? কারন আমি শুনেছি আপনি অনেক ভূতের গল্প লিখেছেন। এমনকি আপনার এক সাক্ষাৎকারে পড়েছি- আপনি বলেছেন, যুক্তির বাইরেও অনেক কিছু আছে? আপনি একজন বিজ্ঞানের ছাত্র হয়ে এই কথা কিভাবে বললেন স্যার? দুনিয়া চলে লজিকে। এমন সময় ট্রেনের লোক এসে জিজ্ঞেস করলো- আমাদের চা নাস্তা কিছু লাগবে কিনা? না লাগবে না হুমায়ূন আহমেদ বললেন। আমি বললাম- আপনি যা বিশ্বাস করেন না তা নিয়েও কেন লিখেছেন? হুমায়ূন আহমেদ হাসলেন। সহজ সরল সুন্দর হাসি।
আমি হুমায়ূন আহমেদকে আবারোও বললাম-
আমাকে তুমি করে বলবেন প্লীজ। আমি আপনার অনেক ছোট। হুমায়ূন আহমেদ বললেন- ওকে। ট্রেন জয়দেবপুর স্টেশন পার হয়ে গেছে। আমি বললাম, আমার সাথে স্যান্ডউইচ আছে। আসুন খেয়ে নিই। হুমায়ূন আহমেদ স্যান্ডউইচ নিলেন। এবং খেলেন। মনে হলো তিনি স্যান্ডউইচ খেয়ে মজা পেলেন। উনি আবার আমাকে চা দিলেন। আমি বললাম, আপনি আমাকে একটা ভূতের গল্প বলুন। এমন গল্প যে গল্পে আপনি আছেন। এবং যে গল্প আপনি আগে লিখেন নি। হুমায়ূন আহমেদ কিছুক্ষন চিন্তা করলেন। বললেন, হ্যাঁ লম্বা রাত। ট্রেনে আমার ঘুম আসে না। আসলে অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকি। লিখি। দীর্ঘদিনের অভ্যাস। গল্প শুরু করার আগে তোমাকে বলি- তোমাকে আমার ভালো লেগেছে। অনেকে আমাকে দেখলেই আলগা একটা খাতির দেখায়। অটোগ্রাফ চায়। ছবি তুলতে চায়। কিন্তু তুমি এদের মতো না। অনেক লোক আমার অটোগ্রাফ নেয়। শেষে সেই বই আমি নীলক্ষেত পুরান বইয়ের দোকানে দেখেছি। এই হলো তাদের ভালোবাসার নমুনা।
হুমায়ূন আহমেদ তার ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার গল্প বলতে শুরু করলেন।
তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। কয়েকটা বই মাত্র বের হয়েছে আমার। দেশের রাজনীতির অবস্থা ভালো না। হরতাল অবরোধ চলছেই। বাসে গাড়িতে আগুন। বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ ঘোষনা করা হলো। হলেও থাকা যাবে না। আমার আর ঢাকা থাকতে ইচ্ছা করলো না। আমি ট্রেনে চেপে বসলাম। ইচ্ছা কোনো নিরিবিলি পরিবেশে গিয়ে লিখব। যদি লেখা না আসে তাহলে পড়বো। সাথে অনেক গুলো বই নিয়ে গেলাম। অবশ্য আমি যেখানেই যাই- আমার সাথে অনেক গুলো বই থাকে। আকাশের অবস্থা ভালো না। থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। একদম অজপাড়া গায়ে চলে এলাম। বিদ্যুৎ নেই। পাকা রাস্তা নেই। এমনকি কোথাও থাকার জায়গাও নেই। একটা মসজিদ আছে, তাও ওটার ছাদ নেই। বাজারে গেলাম। বাজার বলতে হাতে গোনা কয়েকটা দোকান মাত্র। তেমন লোকজন চোখে পড়ছে না। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। সমানে ঝিঝি পোকা ডাকছে। অথচ বৃষ্টির সময় ঝি ঝি পোকা সাধারণত ডাকে না। ব্যাঙ ডাকে। এই গ্রামে কোনো ব্যাঙ নেই। একবারও ব্যাঙের ডাক শুনি নাই।
দোকানদারের নাম হেকমত আলী।
বয়স ৪৫ হবে। আবার পঞ্চাশও হতে পারে। কিছু কিছু লোকের বয়স বুঝা যায় না। যাইহোক, হেকমত বললেন, দরিদ্র এলাকা। এখানে কারো থাকার মতো পাকা বাড়ি পর্যন্ত নেই। বাস স্টেশন নেই, রেলস্টেশন নেই। কোনো নদীও নেই। হতভাগা গ্রাম। দুই গ্রাম পার হয়ে বাস স্টেশন আছে। হেকমত কিছুটা রাগ দেখিয়ে বললেন, হুট করে আপনার এই গ্রামে চলে আসা উচিৎ হয় নাই। হুমায়ূন আহমেদ থামলেন। সিগারেট ধরালেন। আমাকে চা দিলেন। তিনি নিজেও চা নিলেন। চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, আচ্ছা, তোমার নাম কি? বলেই তিনি আবার গল্পে ফিরে গেলেন- হেকমত আলি করুনা করে বলল, রাতটা আমার সাথে দোকানেই পার করে দেন। ঝড় বৃষ্টি হচ্ছে। বিজলি চমকাচ্ছে। ভোরে চলে চলে যাবেন। যেহেতু কোনো উপায় নেই- তাই হেকমত আলির কথা মেনে নিলাম। রাতে হেকমত আলি খিচুড়ি রান্না করলো। পাতলা খিচুড়ি। সাথে আলু ফুলকপি দিয়ে দিলো। মিথ্যা বলব না এত ভালো খিচুড়ি আমি জীবনে খাইনি।
রাত নয়টা। হেকমত আর আমি শুয়ে আছি।
দুজন দুই বেঞ্চে। হেকমত গভীর ঘুমে। আমার চোখে ঘুম নেই। দমকা বাতাস আছে, বৃষ্টি হচ্ছে কখনো জোরে, কখনও আস্তে। এমন সময় দুজন লোক এসে হেকমতকে ঘুম থেকে ডেকে তুলতো। ৬/৭ বছরের এক ছেলে বজ্রপাতে মারা গেছে আজ দুপুরবেলা। তাকে কবর দিতে হবে। হেকমত বলল, কার ছাওয়াল মরিছে বললি? মুজাফফরের ছাওয়াল জামাল। হেকমত মৃত মানুষকে কবরও দেয়। বাজারের দোকান থেকে ইনকাম নেই। মরা মানুষ কবর দিলে কিছু টাকা পয়সা পাওয়া যায়। হেকমত আমাকে বলল, আপনি থাকেন। ঘুমান। আমি গোর দিয়ে আসি। দুই তিন ঘন্টার মামলা। আমি বললাম, আমিও আপনার সাথে যাবো। এখানে আমার ঘুম হবে না। ট্রেন চলছে। ট্রেন চলছে। হুমায়ূন আহমেদ আমায় বললেন, বুঝলে তখন আমার তরুন বয়স। নতুন নতুন অভিজ্ঞতার জন্য অনেক কিছু করতে আমি রাজী। হেকমতের সাথে গেলাম। নতুন একটা অভিজ্ঞতা হোক। লেখায় কাজে লাগবে।
অন্ধকারে বৃষ্টির মধ্যে হেঁটে হেঁটে প্যাককাদা মাড়িয়ে কবরস্থানে এলাম।
হেকমত কবর খুড়ছে। পাশেই বাচ্চা ছেলেটার লাশ। বজ্রপাতে মারা গেছে। কাফনের কাপড় ভিজে একাকার। একটা হাত বের হয়েছে আছে। মুখ দেখাটা দেখা যাচ্ছে। পুরো শরীর পুড়ে গেছে। আশেপশে কেউ নেই। আমি আর হেকমত। হঠাত বিকট শব্দ করে বজ্রপাত পড়লো ঠিক মৃত বাচ্চা ছেলেটির উপর। তারপর যা ঘটলো তার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। এই ঘটনার ব্যখ্যা আমি আজও বের করতে পারিনি। মৃত ছেলেটি উঠে বসলো। এবং হাঁটতে শুরু করলো ধীর পায়ে। অন্ধকার রাত। ছেলেটি কোথায় গেলো সেটা আমি জানি না। আমার সারা শরীর কাঁপছিল। হেকমত বলল, কি হয়েছে? আপনি কাপছেন কেন? আমি হাত উঁচু করে দেখালাম। হেকমতও দেখলো ছেলেটি অন্ধকারে হেঁটে যাচ্ছে। তারপর হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। দেখা গেলো হেকমত আমার চেয়ে ভীতি। সে আমার হাত ধরে বলল, চলেন। দৌড়ান। দৌড়ান। আচানক ঘটনা।
গল্প শেষ। ট্রেন নবীনগর এসে গেছে।
এখানেই হূমায়ূন আহমেদ নামবেন। আমি নামবো পরের ষ্টেশনে। আমি ট্রেন থেকে হুমায়ূন আহমেদের ব্যাগটা হাতে করে নামলাম। ব্যাগটা তাকে এগিয়ে দেই, সাধারনত ভদ্রতা। হুমায়ূন আহমেদ আমাকে ধন্যবাদ দিলেন। আমি বললাম, স্যার সেদিন ঝড় বৃষ্টির মধ্যে যে ছেলেটাকে হেকমত কবর দেওয়ার জন্য কবর খুড়ছিলো আর আপনি বসে ছিলেন বৃষ্টির মধ্যে। তারপর বজ্রপাত হলো ঠিক ছেলেটার উপর। ছেলেটা উঠে দাঁড়ালো। সেই ছেলেটা আমি। আমার নাম শাহেদ। শাহেদ জামাল। এই দেখুন আমার শরীরে এখনও অনেক পোড়া পোড়া দাগ। ব্জ্রপাতে আমার সারা শরীর পুড়ে গিয়েছিলো। কিভাবে বেঁচে উঠলাম সেটা আমার কাছেও এক বিরাট রহস্য। ট্রেন হুইসেল দিলো। আমি ট্রেনে উঠে পড়লাম। হুমায়ূন আহমেদ আমার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছেন! তার চোখে এক আকাশ বিস্ময়! আমি ট্রেনে উঠে হুমায়ূন আহমেদের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়লাম। হুমায়ূন আহমেদ অবাক চোখে তাকিয়ে আছেন!
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ রাত ১২:৪৬