ছবিঃ আনন্দবাজার পত্রিকা।
একদিন রাত একটায় মামা বাড়ি গেলাম।
আমার ছোট মামা টর্চ জেলে আমাকে দেখলেন। দেখে আনন্দে কেঁদে ফেললেন। আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। তখন আমি ইন্টারমিডিয়েট পড়ি। মেসে কাউকে না বলেই গ্রামে চলে গেলাম। ঢাকায় অসহ্য লাগছিলো। খুব ভালোবাসার অভাব বোধ করছিলাম। জানি মামা বাড়িতে এলে ভালোবাসার অভাব হবে না। মামা- মামীকে বললেন, মূরগি জবাই করো। ডিমের সালুন করো। পোলাউ রান্না করো। মামী রান্না শুরু করলেন। মাটির চুলায়। মামা বললেন, তুই গোছল করে নে শাহেদ। মামা নিজে চাপকল চেপে বালতি ভরলেন। মামা কলপাড়ে বসে রইলেন। আমি গোছল করলাম। মা বললেন, দাড়া আমি তোর পিঠ ঢলে দিচ্ছি। আমি যতই মানা করছি, মামা আমার মানা শুনলেন না। ছোট বাচ্চাদের মতো আমাকে গোছল করিয়ে দিলেন।
রান্না শেষ হলো- রাত তিনটায়।
আমি রান্না ঘরেই খেতে বসলাম। মামা বললেন, ছেলেটা একাএকা খাবে, আমাকেও দাও। সেই ভোররাতে আমি আর মামা আরাম করে খেলাম। মামীর রান্না ভালো। সবচেয়ে বড় কথা মাটির চুলার রান্না স্বাদ হয়। মেসের খাবার অতি অখাদ্য। দেশে হরতাল-অবরোধ। কলেজ বন্ধ। মেসে মন টিকছিলো না। তাই হুট করে গ্রামে চলে আসি। ভেবেছিলাম তিন থাকবো, কিন্তু থেকে গেলাম পনের দিন। তবু চলে যাওয়ার সময় মামা মামী বললেন, এত তাড়াতাড়ি চলে যাবি শাহেদ? আর ক'টা দিন থেকে যা বাবা। আমি বললাম, মামা ক্লাশ শুরু হয়ে গেছে। মামা মন খারাপ করে বললেন, চল তোকে এগিয়ে দিয়ে আসি। মামা একদম লঞ্চে উঠিয়ে দিয়ে গেলেন। সাথে নারকেলের নাড়ু, পিঠা, পেয়ারা ইত্যাদি দিয়ে দিলেন।
মেয়েটার নাম জ্যোস্না।
কিন্তু আমি মেয়েটাকে ডাকতাম বনজ্যোস্না বলে। গ্রামের মেয়ে। সহজ সরল। এবার মামা বাড়ি এসে মেয়েটার সাথে খুব ভাব হয়ে গেলো। বনজ্যোস্নাকে চোখে কাজল দিলে একদম মনে হতো যেন- দেবী সরস্বতী। শুধু একটা পার্থক্য। দেবী সরস্বতীর মুখে কোনো তিল নেই, আর বনজ্যোস্নার ঠোটের নিচে একটা তিল আছে। মেয়েটার মাথা ভরতি চুল। দেবযানী খালে নৌকা করে আমরা অনেক দূর পর্যন্ত গিয়েছিলাম। আমি নৌকা বাইতে পারি না। বনজ্যোস্নার পারে। তার অনেক গুণ। সে ভালো সাঁতার পারে। পুকুরে ডুব দিয়ে মাছ ধরতে পারে। গাছে উঠতে পারে। অল্প বিস্তর রান্নাও জানে। দেবযানী খালে যখন নৌকা বাইছিলো বনজ্যোস্না আমি তাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়েছিলাম। তার নরম বুকে মুখ ঘসেছিলাম। সে আমাকে বাঁধা দেয়নি। ভীষন লজ্জা পেয়েছিলো। অথচ আমরা দুজন প্রেমিক প্রেমিকা নই। আমাদের মধ্যে কোনো ভালোবাসার কথাও হয়নি।
এরপর বিশ বছর পার হয়ে গেছে।
আমি বনজ্যোস্নার কথা ভুলে গেছি। নীলা নামে একটা মেয়ের সাথে প্রেম ভালোবাসায় জড়িয়ে গেছি। মামা মামী দুজনেই মারা গেছেন। তাই আর গ্রামে যাওয়া হয় না। আমি এখনও মেসে থাকি। ঢাকাতে আমার বেশ কিছু আত্মীয়স্বজন আছে। কিন্তু আমি মেসেই থাকি। মেসে যারা থাকে তাঁরা আত্মীয়স্বজনের বাসায় থেকে মজা পাবে না। মেসের লাইফে অনেক মজা। শুধু খাওয়া নিয়ে সমস্যা। অবশ্য যাদের প্রচুর টাকা আছে, তাদের কথা আলাদা। তাঁরা রেস্টুরেন্টে গিয়ে খেয়ে নিতে পারে। সব মিলিয়ে যারা মেসে থাকেনি তাঁরা বিপুল আনন্দ থেকে বঞ্চিত। ঢাকা শহরের অনেক এলাকাতেই আমি থেকেছি। আমার সমস্যা হলো আমি এক মেসে দীর্ঘদিন থাকি না। দীর্ঘদিন থাকলে মায়া জন্মে যায়। মায়া খুব খারাপ। বনের পাখি বনে উড়ে যাবে। এটাই স্বাভাবিক। মায়া করে লাভ নাই।
এক কাজে সাভার গিয়েছিলাম।
ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে গেলো। আমি যখন প্রেস ক্লাবের সামনে বাস থেকে নামলাম তখন রাত বারোটা। একটাও রিকশা নেই। যাবো গোলাপবাগ। ফুটপাত ধরে হাঁটছি। ছিনতাইকারী ধরলে ধরুক। সাথে বেশি টাকা নেই। সব মিলিয়ে হয়তো সাত শ' হবে। সাথে একটা কমদামী নষ্ট মোবাইল আছে। সে নিয়ে গেলে, নিয়ে যাক। তাহলে আমি বেঁচেই যাই। বিজলি চমকাচ্ছে। ঠান্ডা বাতাস বইছে। আজ বৃষ্টি হবে। পকেটে একটা সিগারেট ছিলো। সেটা ধরালাম। গুণগুণ করে গান গাইছি- 'পদ্মার ঢেউ রে, মোর শূণ্য হৃদয়–পদ্ম নিয়ে যা, যা রে'। গানটা ভালো। সুরটাও খুব সুন্দর। হঠাত একটা মেয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। অফ হোয়াইট একটা শাড়ি পরা। খুব সুন্দর করে সেজেছে। মাথায় বড় একটা খোপা। খোপাতে বেলী ফুল। চোখে কাজল। দুই হাত ভরতি চুড়ি। ঠোঁটে গাঢ় লাল লিপস্টিক। অনেকখানি পেট দেখা যাচ্ছে। সেটা নিয়ে তার কোনো সংকোচ নেই। বয়স কত হবে মেয়েটার বুঝতে পারছি না।
মেয়েটা কোনো রকম ভনিতা না করে বলল-
আজ রাতে জন্য আমায় নেবে? আমার নাম লতা। জানি নকল নাম। এত সুন্দর একটা মেয়ে! কি সুন্দর করে বলছে আজ রাতের জন্য আমায় নেবে? মেয়েটা তো জানে না আমি মেসে থাকি। অনেক মাসের মেস ভাড়া বাকি জমে গেছে। আমার যদি নিজের একটা বাসা থাকতো- আমি মেয়েটাকে অবশ্যই সাথে করে নিয়ে যেতাম। তাহলে যখন খুশি মেয়েটাকে আদর করা যেতো। চা খেতে ইচ্ছা করলে মেয়েটাকে বলতাম- লতা চা বানাও। চিনি কম দেবে। রাতে ঘুম না এলে লতাকে নিয়ে ব্যলকনিতে বসতাম। সারারাতা দুজনে মিলে গল্প করতাম। যাইহোক, আমি লতার দিকে ভালো করে তাকালাম। মেয়েটাকে চেনা চেনা লাগছে। কোথায় দেখেছি মনে করতে পারছি না। একটা মেয়ে কতটা অসহায় হলে এরকম বৃষ্টির রাতে রাস্তায় নামে। মেয়েটার জন্য আমার ভীষন মায়া হচ্ছে। এই মেয়েটার থাকা উচিৎ ছিলো কোনো হৃদয়বান পুরুষের বুকে।
লতা আমার পকেটে সাত শ' টাকা আছে।
এই টাকা আমি তোমাকে দিয়ে দিচ্ছি। তুমি বাসায় চলে যাও। আকাশের অবস্থা ভালো না। বৃষ্টি বাদলার দিনে রাস্তায় থেকো না। আর শোনো, আমি মেসে থাকি। মেসে তো তোমাকে নিয়ে যেতে পারি না। তাছাড়া আমার একজন প্রেমিকা আছে। তার নাম নীলা। সে অনেক সুন্দরী। আমি তাকে খুব ভালোবাসি। চাকরিটা পেয়ে গেলেই আমি তাকে বিয়ে করবো। লতা বলল, আমার চেয়ে সুন্দরী? আমি বললাম, আসলে প্রতিটা মেয়েই সুন্দর। শুধু দেখার মতো চোখ থাকতে হয়। লতা বলল, আপনাকে আমার ভীষন চেনা চেনা মনে হচ্ছে। কোথায় দেখেছি বলুন তো? আমি বললাম, আমাকে কোথাও দেখেননি। আমি কখনও নিশিকন্যাদের সাথে রাত কাটাইনি। লতা বলল- আমি অবশ্যই আপনাকে দেখেছি। আমি বললাম- যাইহোক, লতা আমি বিদায় নিচ্ছি। লতা বলল, আমি এমনি এমনি কারো কাছ থেকে টাকা নিই না। আমি বললাম, পরে একসময় ফেরত দিয়ে দিও। লতা বলল, আপনাকে কোথায় পাবো? আমি হাঁটতে হাঁটতে পেছন ফিরে তাকিয়ে বললাম, এই শহরেই আমাদের আবার দেখা হবে।
রাত একটায় মেসে ফিরলাম একদম কাক ভেজা হয়ে।
খাওয়া শেষ করে বারান্দায় এসে একটা সিগারেট ধরালাম। বাইতে তুলুম বৃষ্টি হচ্ছে। খানিক পরে-পরে বিজলি চমকাচ্ছে। সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে মনে মনে ভাবছি, আজ রাতে খুব ভালো ঘুম হবে। যে রাতে বৃষ্টি হয়, সে রাতে আমার ঘুম ভালো হয়। কোনো দুঃস্বপ্ন দেখি না। ঠিক এই সময় দূরে কোথাও একটা বজ্রপাত হলো। এবং আমার মনে পড়ে গেলে লতার ভালো নাম জ্যোস্না। যাকে আমি বলতাম- বনজ্যোস্না বলে। আমার জীবনের প্রথম চুমু আমি লতাকে দেই। অর্থ্যাত বনজ্যোস্নাকে দেই। আমার ইচ্ছা করছে এখনই ছুটে যাই তার কাছে। এই ঝড় বৃষ্টির রাতে বনজ্যোস্নাকে কোথায় পাবো? হাতের কাছে পেয়ে তাকে হারালাম! দেবযানী খালে লতা আমাকে একটা কবিতার কয়েকটা লাইন শুনিয়ে ছিলো। জীবনানন্দের কবিতা। কবিতার নাম ছিলো- অনেক আকাশ। কবিতার কয়েকটা লাইন এই রকম ছিলো-
সে এসে পাখির মতো স্থির হয়ে বাধে নাই নীড়, -
তাহার পাখায় শুধু লেগে আছে তীর- অস্থিরতা!
অধীর অন্তর তারে করিয়াছে অস্থির অধীর!
তাহারি হৃদয় তারে দিয়েছে ব্যাধের মতো ব্যথা!
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ রাত ১১:২৯