একজন মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হচ্ছে।
রাস্তায় ধরা পরা চোর ছিনতাইকারীকে যেভাবে মারা হয়, ঠিক সেভাবে মেরে ফেলা হচ্ছে। উত্তেজিত জনতা বড় কঠিন জিনিস। কেউ না খেয়ে থাকলে, কেউ চিকিৎসার অভাবে মরতে বসলে, কেউ ক্ষুধায় কষ্ট পেলে উত্তেজিত জনতা নড়াচড়া দেয় না। কিন্তু একজনকে পিটিয়ে মেরে ফেলতে উত্তেজিত জনতা দারুন ভূমিকা রাখে। যাকে মারা হচ্ছে তার বয়স পঁচিশ বছর। সে একজন ইমাম। যে গ্রামের লোকজন ইমামকে মারছে, সেই গ্রামের মসজিদের ইমাম সে। তার নাম শফিকুল ইসলাম। সহজ সরল একটা ছেলে। শফিক মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে। তার সারা শরীরে রক্ত। তবু লোকজন তাকে মেরেই চলেছে। সে মৃত্যুর খুব কাছে চলে গেছে। এখন শফিকের কোনো ব্যথা বোধ হচ্ছে না। সে উত্তেজিত জনতাকে চোখে দেখতে পাচ্ছে না, সে দেখছে রাতের আকাশ। রহস্যময় আকাশ। যে আকাশে থেকে জোছনা এসে পড়ছে এই পৃথিবীতে।
গ্রামের নাম রয়না।
অতীব সুন্দর গ্রাম। গ্রামের একপাশ দিয়ে বয়ে গেছে চিত্রা নদী, অন্য পাশ দিয়ে গেছে চন্দনা নদী। আমি খেয়াল করে দেখেছি যে গ্রামের পাশ দিয়ে নদী বয়ে যায়, সে গ্রামের মানুষদের দুঃখ কষ্ট কম। এবং গ্রামের মানুষ গুলো ভালো হয়। মানবিক হয়। হৃদয়বান হয়। রয়না গ্রামের চেয়ারম্যান হচ্ছেন এজাজ উদ্দিন। উনি নিজের টাকায় একটা পাকা মসজিদ করেছেন। মসজিদের নাম রেখেছেন নিজের মায়ের নামে কিন্তু তার দুঃখ গ্রামের মানুষজন শুক্রবার ছাড়া প্রায় মসজিদে আসেই না। দিন দিন মানুষ আল্লাহ খোদার নাম ভুলেই যাচ্ছে। কি এক যন্ত্র এসেছে ইন্টারনেট। ফেসবুক, টিকটক আর ইউটিউবে ব্যস্ত পোলাপান। সারাক্ষণ চোখের সামনে মোবাইল ধরে থাকে। এজাজ উদ্দিন তার মসজিদের জন্য শহর থেকে একজন ইমাম এনেছেন। ইমামের নাম শফিকুল। অল্প বয়স। একদম চ্যাংড়া। ঢাকার বাগিচা মসজিদের মোয়াজ্জেম সাহেব তাকে পাঠিয়েছেন। শফিকুল নাকি অনেক জ্ঞানী মানুষ। খুব ভালো ছেলে।
ভনিতা বাদ দিয়ে, মূল গল্পে প্রবেশ করি।
শফিকুল কোরানে হাফেজ হলেও সে বাইবেল, ত্রিপিটক পর্যন্ত তার মুখস্ত। ফিজিক্স কেমিস্ট্রি সম্পর্কে তার জ্ঞান আছে। একবার গ্রামের এক কৃষক পেটের তীব্র ব্যথা নিয়ে তার কাছে আসে পানিপড়ার জন্য। শফিক হুজুর স্পষ্ট বলে দেয়, পানি পড়ায় কাজ হবে না। আপনি ডাক্তারের কাছে যান। আরেকবার গ্রামের এক স্ত্রীলোক তাবিজের জন্য তার চার বছরের ছেলেকে নিয়ে আসে, ছেলে বিছানায় প্রস্বাব করে দেয়। শফিক হুজুর বলে তাবিজ কোনো কাজের জিনিস নয়। তাবিজ দিয়ে দুনিয়ার কোনো সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। গ্রামের কাঠ ব্যবসায়ী সলিমুল্লাহ আসে শফিক হুজুরের কাছে। তার মেয়ের আগামীকাল বৃত্তি পরীক্ষা। হুজুর যেন একটু দোয়া করে দেয়। শফিক হুজুর স্পষ্ট বলে দেন, দোয়ায় কাজ হবে না। যদি আপনার কন্যা ভালো করে পড়ে এবং সব প্রশ্নের উত্তর সঠিক ভাবে দেয় তাহলেই সে পাশ করবে। দোয়া দিয়ে তাকে পাশ বা ফেল করানো যাবে না।
শফিক হুজুরকে নিয়ে রয়না গ্রামের লোকজন কিছুটা হতাশ।
এ আবার কেমন হুজুর ফুঁ দেয় না, তাবিজ কবচে বিশ্বাস নেই, দোয়া করে না, বাচ্চাদের স্কুলে পাঠাতে বলে। গত শুক্রবার খুতবার সময় শফিক হুজুর বলেছেন, মাদ্রাসার চেয়ে স্কুলে পড়ানো ভালো। মাদ্রাসায় পড়ালে আপনার সন্তান হয়তো মসজিদে আযান দেওয়ার কাজ পাবে, অথবা মুসুল্লিদের নামাজ পড়াবে, মরা বাড়িতে গিয়ে কোরআন খতম দেবে কিন্তু স্কুল কলেজে পড়লে সে বড় চাকরী পাবে। দেশ এবং সমাজের জন্য ভালো কিছু করতে পারবে। তখন আর তাকে মানবেতর জীবনযাপন করতে হবে না। এই গ্রামের মানুষ একসময় সাবান শ্যাম্পু ব্যবহার করতো না। কিন্তু এখন করছে। একজন কৃষকের জমিতে সমস্যা হলে ইন্টারনেটের মাধ্যমে সমাধান খুঁজে নিতে পারছে। আজকের এই আধুনিক দুনিয়ার সমস্যা গুলোর সমাধান ধর্মীয় কিতাবে বা হাদিসে নেই। অর্থ্যাত মানুষকে পুরোনো ধ্যান ধারনা আগলে রাখলে হবে না। আধুনিক হতে হবে। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হবে।
রাত দুটা। শফিক হুজুর পুকুর ঘাটে বসে আছেন।
তার হাতে একটা বই। বইয়ের নাম- 'দ্য গড ইকুয়েশন'। লেখক মিচিও কাকু। চমৎকার বই। কিন্তু বই পড়লেই তার মন খারাপ হয়ে যায়। কত কিছু আছে জানার। অথচ জীবন কত ছোট। গত সপ্তাহে শফিক পড়েছে- 'প্যারালাল ওয়ার্ল্ডস'। অত্যন্ত চমৎকার একটা বই। শফিক যত বই পড়ে নিজেকে তার তত মূর্খ বলে মনে হয়। এই মধ্যরাতে শফিক হুজুর বুকের গবীর থেকে অনুভব করতে পারছে- কোরআন হাদিসের বাইরেও অনেক মহৎ বই আছে, সেগুলো পড়তে হবে। নইলে অন্ধকারে থাকতে হবে। মানুষ অন্ধকারে থাকলে জাতি পেছনে পড়ে থাকবে। মাদ্রাসার বাচ্চারা এসব বই থেকে কেন বঞ্চিত হবে? তাদের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করা দরকার। কিছু একটা করতে হবে। মানুষকে বুঝাতে হবে। মানুষ আর কতকাল অন্ধকারে থাকবে, ভুলের মধ্যে থাকবে?
এদিকে গ্রামের লোকজন শফিককে নিয়ে কঠিক একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে।
শফিক তার কিছুই জানে না। তার হাতে একটা বই। বইয়ের নাম- 'দ্য থিওরি অব এভরিথিং'। লেখক- স্টিফেন হকিং। বইটি পড়লেই বুঝা যায়- হকিং সাহেব অনেক দরদ দিয়ে বইটি লিখেছেন। বইয়ে কোনো রুপকথার গল্প নেই। শফিক হুজুর নক্ষত্র খচিত আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার মনে হয়- ফিজিক্সেই সব রহস্য লুকিয়ে আছে। অনেক পড়াশোনা করতে হবে। অনেক। ধর্মীয় বই পড়ে কোনো লাভ নেই। ধর্মীয় বই পড়া মানে সময়ের অপচয়। পুরো কোরআন তার মূখস্ত। সমস্ত হাদীস সে জানে- তাতে কি? তাতে কিছুই না। সে যদি একজন পদার্থবিদ হতে পারতো। তাহলে সে বিশ্বের জন্য কিছু করতে পারতো। একজন হুজুর হয়ে কিছুই করা সম্ভব না। এই পৃথিবীতে হুজুরদের কোনো দরকার নেই। দরকার আছে- আলবার্ট আইনস্টাইন, আইজাক নিউটন, গ্যালিলিও গ্যালিলেই, নিকোলা টেসলা, টমাস আলভা এডিসন ইত্যাদি মহান ব্যাক্তিদের।
(দ্বিতীয় পর্ব আগামীকাল।)
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে মে, ২০২৩ রাত ১১:৪৫