ইসলামে হারাম উপার্জন ও ভক্ষণ সম্পূর্ণ
নিষেধ,
রাসুলের [সা.] নবুয়তির সর্বোচ্চ
উদ্দেশ্যগুলোর একটি হলো যা কিছু পবিত্র,
তাকে ‘হালাল’
বলে ঘোষণা দেয়া এবং যা কিছু অপবিত্র,
তাকে ‘হারাম’ বলে ঘোষণা দেয়া। জীবন-
জীবিকায় উপার্জন করা আল্লাহ মহানের
আদেশ এবং প্রিয় নবিজির [সা.] সুন্নাত।
আমাদের নবিজিও [সা.] নিজে কর্ম
করে জীবিকা উপার্জন করেছেন।
তিনি ছিলেন হালাল রিজিকের
উপার্জক। হারাম কখনো তিনি উপার্জন
করেননি এবং হারাম
উপার্জনকে কখনো তিনি সমর্থনও
করেননি; বরং হারাম উপার্জন ত্যাগ করার
ভয়াবহতা বর্ণনা করে সতর্ক করেছেন।
হারাম অর্থ দান করলেও গুনাহ হবে
হালাল পন্থায় জীবিকা উপার্জন
করা যেমন ইবাদাত ও পুণ্যের কাজ,
তেমনি অসৎ পন্থায় জীবিকা উপার্জন
করা গুনাহ ও অন্যায় কাজ। অবৈধ পন্থায়
উপার্জনের মাধ্যমে সম্পদের
প্রাচুর্যতা যেমন দুনিয়ায় অশান্তির কারণ
হয়, তেমনি আখেরাতে তার জন্য
অপেক্ষা করছে ভয়াবহ শাস্তি ।
যারা মনে করে হারাম পথে সম্পদ-অর্থ
উপার্জন করে সম্পদের পাহাড়
গড়ে তুলে তার অংশ বিশেষ দান-খয়রাত
করলেই আল্লাহ মাফ করে দেবেন,
এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। কেননা হারাম
পন্থায় যত উপার্জনই করা হোক না কেন
তা সবটাই হারাম ও অবৈধ। হারাম
উপার্জন নিজের জন্য ব্যয় করা যেমন
হারাম, অন্যকে দেওয়াও তেমন হারাম।
এমনকি অর্থ থেকে দান-খয়ারত করাও
ইসলামে হারাম। অবৈধ উপার্জনের
মাধ্যমে অজির্ত সম্পদ থেকে দান-খয়রাত
করে সওয়াবের আশা করাও গুনাহের কাজ।
ইসলাম হারাম উপার্জ, অবৈধ অর্থ-সম্পদের
ব্যপারে খুবই কঠিন। একজনের হারাম
উপার্জনের দ্বারা অন্যের হালাল
উপার্জনের দান নষ্ট হয়ে যায়। যেমন,
শরিকানা কোরবানির কোনো এক
শরিকের দেয়া টাকার এক অণু পরিমাণ
হারামের মিশ্রণ থাকলে সবার
কোরবানিই নষ্ট হয়ে যাবে।
সুতরাং হারাম বা অবৈধ পন্থায়
উপার্জিত সম্পদ নিজের জন্য যেমন
ক্ষতিকর,অন্যের জন্যও তা ক্ষতির কারণ
হয়ে থাকে।
হারাম উপার্জনের ক্ষতিকর দিকসমূহ
ক. আল্লাহর নির্দেশ অবজ্ঞা করার
শামিল : আল্লাহ
তাআলা কোনটি হালাল ও
কোনটি হারাম তা নির্ধারণ
করে দিয়েছেন। যে হারাম পথ
বেছে নিবে সে আল্লাহর
নির্দেশকে অবজ্ঞা করলো এবং শাস্তিযোগ্য
অপরাধ করলো। উপার্জনের
ক্ষেত্রে হালাল উপায় অবলম্বন
করতে হবে। যারা হালাল ও হারামের
প্রশ্নে সতর্কতা অবলম্বন করে না, তাদের
ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম সতর্ক করে বলেন,
‘মানুষের নিকট এমন একটি সময় আসবে, যখন
ব্যক্তি কোনো উৎস থেকে সম্পদ আহরণ
করছে, তা হালাল না হারাম,
সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ
করবে না।’ [বুখারি : ২০৫৯]
খ. জাহান্নামে যাওয়ার কারণ : হারাম
উপার্জন জাহান্নামে যাওয়ার কারণ হবে।
এ বিষয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,আর
যে দেহ হারাম খাদ্য
দ্বারা গড়ে ওঠে তার জন্য দোযখের আগুনই
উত্তম। [সহিহ জামিউস সগির : ৮৬৪৮]
গ. জান্নাতে যাওয়ার প্রতিবন্ধক : হারাম
উপার্জন জান্নাতে যাওয়ার প্রতিবন্ধক
হবে। এ বিষয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, হে কাব
ইবন উজরাহ,যে দেহ হারাম খাদ্য
দ্বারা গড়ে উঠে তা জান্নাতে যাবে না।
[দারেমি : ২৮১৮]
ঘ. হারাম উপার্জন জালিমের হাতিয়ার :
যখন সমাজে হারাম উপার্জন করার সুযোগ
থাকে তখন জুলুম-নির্যাতন
ব্যাপকভাবে প্রসার লাভ করে। আর
জুলুমের মাধ্যমে অসহায় মানুষ নানাবিধ
অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়।
ঙ. হারাম উপার্জনের দান আল্লাহ গ্রহণ
করেন না : হারাম উপার্জন এমন খারাপ
জিনিস যা থেকে দান করলেও
কোনো লাভ নেই এবং আল্লাহ
তাআলা তা গ্রহণ করেন না। আবু
হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন,
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ
তাআলা পবিত্রতা ছাড়া কোনো সালাত
কবুল করেন না, আর হারাম উপার্জনের
দানও আল্লাহ তাআলা কবুল করেন না।
[সহিহ ইবনে খুজাইমাহ : ১০]
পবিত্র কোরানের আলোকে হারাম
খাদ্য, হারাম বস্তু
মানুষের জন্য উপকারী ও পবিত্র সব ধরনের
খাদ্যের ব্যাপারে ইসলামের বিধান
হচ্ছে হালাল ও বৈধ। প্রমাণ্য ও গ্রহণযোগ্য
দলিল ব্যতীত কোন প্রকার খাদ্য হারাম
বলা যাবে না। আল্লাহ তাআলা বলেন,
বল,আমার নিকট যে অহি পাঠানো হয়,
তাতে আমি আহারকারীর উপর কোন
হারাম পাই না, যা সে আহার করে।
তবে যদি মৃত কিংবা প্রবাহিত রক্ত
অথবা শূকরের গোশ্ত হয়- কারণ, নিশ্চয়
তা অপবিত্র। [আন-আম : ১৪৫] এ আয়াত
দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, যেসব খাদ্যের
ব্যাপারে হারামের কোন দলিল নেই,
তা হালাল ও বৈধ। আমরা যেসব খাদ্য
গ্রহণ করি,তা দু’প্রকার : প্রথম প্রকার : পশু
ও পাখপাখালি। দ্বিতীয় প্রকার : উদ্ভিদ
ও শাকসবজি।
প্রথম প্রকার : পশু ও পাখপাকালি : পশু ও
পাখপাখালির
ব্যাপারে ওলামায়ে কেরাম অনেক
লেখালেখি করেছেন এবং এর
মধ্যে যা যা হারাম তার জন্য কিছু নিদর্শন
ও বিধিবিধান প্রনয়ন করে দিয়েছেন,
যে প্রাণীর মধ্যে হারামের কোন আলামত
পাওয়া যাবে,তা খাওয়া হারাম।
নিম্নে আমরা সেসব বিধিবিধান
নিয়ে আলোচনা করছি :
(১) দাঁত বিশিষ্ট হিংস্র জন্তু ভক্ষণ
করা হারাম। যেমন, বাঘ, চিতা বাঘ, সিংহ
ও কুকুর ইত্যাদি।
(২) থাবা বা পাঞ্জা বিশিষ্ট হিংস্র
পাখি ভক্ষণ করা হারাম। যেমন, ঈগল, বাজ,
শ্যেন, পেঁচা ও শাহীন পাখি ইত্যাদি।
দলিল : ইবনে আব্বাস রা. বলেন, রাসূল সা.
দাঁত বিশিষ্ট প্রত্যেক হিংস্র জন্তু ও
থাবা বিশিষ্ট প্রত্যেক হিংস্র
পাখি খেতে নিষেধ করেছেন। [মুসলিম :
১৯৩৪]
(৩) নির্দিষ্টভাবে যেসব পশু খেতে নিষেধ
করা হয়েছে, তা খাওয়া হারাম। যেমন, গৃহ
পালিত গাধা।
দলিল : জাবের রা. বলেন, রাসূল সা.
খায়বরের দিন গৃহ পালিত
গাধা খেতে নিষেধ করেছেন
এবং ঘোরার গোস্ত
খেতে অনুমতি দিয়েছেন। [বুখারি:৪২১৯,
মুসলিম:১৯৪১]
আরেকটি দলিল : যেমন শূকর। আল্লাহ
তাআলা বলেন, তোমাদের জন্য হারাম
করা হয়েছে মৃত প্রাণী, রক্ত ও শূকরের
গোশত ... [সুরা মায়েদা : ৩]
(৪) আরবরা যেসব প্রাণীকে খবিস ও
নাপাক বলত, তা খাওয়াও হারাম।
দলিল : আল্লাহ তাআলা বলেন, (রাসূল
সা.) তাদের জন্য পবিত্র বস্তু হালাল
করে আর অপবিত্র (খবিস) বস্তু হারাম করে।
[আরাফ : ১৫৭] অপবিত্র বস্তু যেমন, পোকা-
মাকড়, কীট-পতঙ্গ ও শকুন। যেহেতু এগুলোর
খানাখাদ্য অধিকাংশই নাপাক ও
আবর্জনা, তাই এগুলোকে খবিস বা নাপাক
বলা হয়।
(৫) শরিয়ত যেসব
প্রাণী হত্যা করতে নিদের্শ
দিয়েছে বা যেসব
প্রাণী হত্যা করতে নিষেধ করেছে,
তা খাওয়া হারাম। যেমন,
হাদিসে নিষিদ্ধ পাঁচটি প্রাণী। যথা :
ইদুর, বিচ্ছু, পাগলা কুকুর, কাক ও চিল
ইত্যাদি।
উল্লেখিত বিধান ও নিয়মের
ভিত্তিতে প্রমাণিত হয় যে, এ ছাড়া যেসব
পশু ও পাখপাখালি রয়েছে, তা হালাল ও
বৈধ। যেমন, ঘোরা, চতুষ্পদ জন্তু, মুরগি,
উটপাখি, খরগোস ও জঙ্গলী গাধা এবং এ
জাতীয় অন্যান্য প্রাণী। কারণ, কোরান-
হাদিসের দলিল এর বৈধতা ও হালালকেই
প্রমাণ করে।
দ্বিতয় প্রকার : উদ্ভিদ জাতীয় খাদ্য :
উদ্ভিদ জাতীয় খাদ্য যেমন, বিভিন্ন
উদ্ভিদ, ফল, শষ্য ইত্যাদি খাদ্যদ্রব্য ও
তৈরিকৃত পানীয় হালাল। কারণ, খাদ্য ও
পানীয়র মূল প্রকৃতি হচ্ছে বৈধ ও হালাল
হওয়া। হ্যাঁ, যেসব খাদ্য নেশার সৃষ্টি করে,
তা ব্যতীত। যেমন, গাঁজা ও আফিম এবং এ
জাতীয় অন্যান্য নেশাদ্রব।
অথবা যা শরীরের জন্য খুবই ক্ষতিকর,
তা ব্যতীত। যেমন, বিষ, সিগারেট ও এ
জাতীয় অন্যান্য খাদ্য, যার ক্ষতি ও
অপকারিতা সবার নিকট স্বীকৃত| এ সব
কিছুই হারাম। কারণ এগুলো হয়তো নেশার
সৃষ্টি করে অথবা শরীরের জন্য খুব
ক্ষতিকর।
সন্দেহ নেই যে, আমাদের কোন না কোন
স্বার্থ ও কল্যাণের জন্যই আল্লাহ
তাআলা এ সব কিছু হারাম করেছেন। কারণ,
তিনি হেকমত ছাড়া কোন জিনিসের
নির্দেশও দেন না, আবার হেকমত
ছাড়া কোন জিনিস থেকে নিষেধও করেন
না। এসব হেকমত মানুষ কখনো বুঝতে সক্ষম
হয় কখনো হয় না। মানুষ কোন জিনিসের
হেকমত বুঝতে সক্ষম না হওয়ার অর্থ এ নয়
যে, তাতে কোন হেকমত নেই। মানুষের
শরীর যেসব খাদ্য গ্রহণ করে, সেসব
জিনিসের প্রভাবই তার ওপর পড়ে।
যে ভাল খাদ্য গ্রহণ করবে, তার ওপর ভাল
প্রভাব পড়বে, আর যে খারাপ খাদ্য গ্রহণ
করবে, তার ওপর খারাপ প্রভাব পড়বে,
এটাই স্বাভাবিক।
সমাজ ও ব্যক্তিজীবনে হারাম উপার্জনের
প্রভাব
ব্যক্তি ও সমাজের ওপর হারাম উপার্জনের
প্রভাব খুবই মারাত্মক। হারাম উপার্জনের
ফলে মানবজীবনের সব ধরনের বরকত
ছিনিয়ে নেয়া হয়। রোগ-
ব্যাধি ছড়িয়ে পড়ে। প্রাকৃতিক
দুর্যোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। আর্থিক
অনটন-সংকট দেশে-
সমাজে শক্তভাবে শিকড় গেড়ে বসে।
বেকারত্ব অভিশাপ আকারে প্রকাশিত হয়।
জুলুম, অন্যায়, প্রতিহিংসা ও রেষারেষির
সয়লাব ঘটে। যারা হারাম খায়, পরিবার-
পরিজন, ছেলে-সন্তানদের হারাম
অর্থে লালন করে, তারা মারাÍক ক্ষতির
মধ্যে নিমজ্জিত হয়। তাদের উদাহরণ
সাগরের পানি পানকারীর মতো। যতই
সে পান করে, ততই তার তেষ্টায় আগুন
ধরে। এরা অল্পে তুষ্ট হতে নারাজ, আবার
অধিক পেয়েও থেকে যায় অখুশি।
এরা হারামকে মনে করে সুস্বাদু-সুখাদ্য।
বর্তমান যুগে তো হারাম খাওয়ার জন্য
রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলে।
কলাকৌশলে যে যত বেশি সম্পদ একত্রিত
করতে পারে মানুষ তাকে তত
বেশি চালাক ও বিচক্ষণ বলে। আর হালাল
খেয়ে অল্পে তুষ্ট থাকা মানুষকে বর্তমান
সমাজে বোকা বলে অভিহিত করা হয়। বড়ই
আফসোসের বিষয় হচ্ছে বর্তমান যুগের
স্ত্রীরাও তাদের পুরুষদের হারাম সম্পদ
দু’হাতে লুটে নিতে উৎসাহ জোগায়।
বর্তমান যুগে হারাম খেয়ে কেউ
বমি করা তো দূরে থাক, সবাই বরং তৃপ্তির
ঢেঁকুর তোলে। জনৈক নেককার ব্যক্তির
স্ত্রী তাকে উপদেশ দিয়ে বলেছিল,
হে আমার প্রিয় স্বামী! আমাদের
রিজিকের
ব্যাপারে আপনি আল্লাহকে ভয় করুন।
কেননা আমরা ক্ষুধায় ধৈর্য ধারণ
করে থাকতে পারব, কিন্তু জাহান্নামের
আগুনে জ্বলার ব্যাপারে ধৈর্য ধারণ
করা আমাদের সাধ্যের বাইরে। আল্লাহ
আমাদের সবাইকে হারাম উপার্জন
থেকে দূরে থাকার তাওফিক দান করুন।
আমিন।