দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর শুরু হয় স্নায়ুযুদ্ধ নামক দুই মাথাওয়ালা এক বিশ্বব্যবস্থা। ব্যক্তিগত থেকে অন্তর্জাতিক সবখানেই তখন সোভিয়েত-মার্কিন টান টান স্নায়ু উত্তেজনা। সবখানেই পুঁজি আর সাম্যের মত দ্বিকেন্দ্রিক দ্বন্দ্ব। সে যুগ তো কবেই বাসি হয়েছে। কিন্তু এখন তো কিছু একটা চলছে নিশ্চই। কি চলছে...?? এককেন্দ্রিক মার্কিন দুনিয়ায় এখন পুঁজিপতিরা ক্ষমতায়, আবার তেমন কোন শক্তি নেই যে সেটা কেঁড়ে নেবে। তাই পুঁজিপতিদের বিশ্বে এখন চলছে নাট্যযুদ্ধ। নতুন নতুন নাটক জন্ম দেয়ার বিশাল বিশাল প্রস্তুতি এবং ভয়াবহ প্রতিযোগিতা। আছে আন্তর্জাতিক নির্মাতা এবং স্থানীয় নির্মাতা এবং হরেক রকম নাট্যগোষ্ঠী। এর অবশ্য প্রয়োজনও আছে। গণতন্ত্র নামক অস্ত্র ব্যবহারের ও একটা সমস্যা আছে। প্রতিদিন শৌচাগারে যাওয়ার মত ক্ষমতা রিনিউ করার জন্য নির্দিষ্ট কিছুদিন পর পর জনগণ নামক শৌচাগারের মুখোমুখি হতে হয়। পুঁজিপতিরা জানেন এই শৌচাগার গুলি একত্রিত হলে সোভিয়েতের থেকেও ভয়াবহ শক্তি হতে পারে। সে সম্ভাবনা নেই বললেও চলে। কিন্তু রিস্ক নেওয়া ঠিক নয়। তাই এদের সবসময় ব্যস্ত রাখতে হবে, খাবার এক বেলা কম পেলেও বিনোদন দিতেই হবে, মুগ্ধ করে রাখতে হবে নতুন নতুন নাটক দেখিয়ে। "কৌন বানেগা পুঁজিপতি" এর মত সিস্টেম রাখতে হবে। পুঁজি আর ক্ষমতার দেখা পাবে এক দুইজন কিন্তু সেই স্বপ্নে বিভোর থেকে স্বপ্নে বুঁদ হয়ে থাকবে সবাই। সবাই নিবিষ্ট থাকবে শুধু ভোগ আর পণ্য ক্রয়ের জন্য, ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধি করার যুদ্ধে। ক্রয় ক্ষমতা যতই বারুক না কেন সেই অর্থ তারা আবার পুঁজিপতিদের কেই দিবে ভোগ আর পণ্য ক্রয়ের জন্য। কিন্তু সেটা চিন্তা করবে না কেউ। সবাই শুধু এই পণ্য তো ঐ পণ্যের পিছনে ছুটবে। এই যে জনগণ বা শৌচাগারে পরিণত হয়ে থাকার চক্রের মাঝে ঘুরতে ঘুরতে মানুষ বিরক্ত হয়ে গেলে চেষ্টা করবে চক্র থেকে বের হয়ে যাওয়ার। সবাই চেষ্টা করলেই তো এত সুন্দর সিস্টেমটা চুর্ণবিচুর্ণ হয়ে যাবে। তাই নতুন নতুন নাটক বানিয়ে সবাইকে বিনোদনের ব্যবস্থা করা হয়। নাটকে সবাই অভিনয়ের সুযোগ না পেলেও নাটকের অংশ হয়ে যায় সবাই। বিনোদন পাওয়ায় শৌচাগার চক্রে কেউ আর বিরক্ত হয় না । নাটক দেখে আর নতুন পণ্য আসবে কবে সেই অপেক্ষায় থাকে।
পুঁজিপতি নাট্যনির্মাতারা নির্মাণ করে যায় ইসরাইল, প্যালেস্টাইন, ইরাক, সুদান, কঙ্গো, ইথিওপিয়া, সোমালিয়া, কাশ্মীর, মিয়ানমার, পাকিস্তান, আফগানিস্থান, মধ্যপ্রাচ্য (এশিয়া, আফ্রিকা) আরও অনেক নাট্যমঞ্চ। ৯/১১ ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার হামলা, আল-কায়েদা, ওসামা বিন লাদেন, তালেবান, হিজবুল্লাহ, সাদ্দাম হোসেন, ইয়াসির আরাফাত, মুগাবে, বিবিসি, সিএনএন, আলজাজিরা, রাসায়নিক অস্ত্র, পারমাণবিক অস্ত্র, জর্জ বুশ (সিনিয়র-জুনিয়র), বারাক ওবামার শান্তিতে নোবেল প্রাপ্তি, আরব বসন্ত, হোসনী মোবারক, মুয়াম্মার গাদ্দাফি, অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তি, পরিবেশ রক্ষা প্রোটোকল, জাতিসংঘ, ইমরান খান, ব্রাদারহুড, মুরসি, খোমেনি, বাশার আল আসাদ, মালালা ইয়ুসুফ...... সহ আরও অনেক অনেক নাটক। একের পর এক নাটক নতুন নতুন বিনোদন এনে দেয় আর শৌচাগার বা জনগণ পুর্বের নাটকের কাহিনী ভুলে যেয়ে নতুন নাটকে মেতে ওঠে এবং মুগ্ধ হয়ে দেখে।
প্রতিটি দেশের মত আমার দেশেও নাটকের অভাব নেই। বিচার পতির বয়স বৃদ্ধি, মহামান্য প্রেসিডেন্টের নির্বাচনকালীন ক্ষমতা গ্রহণ, জরুরী অবস্থা-১/১১, মাইনাস, প্লাস, তত্বাবধায়ক, অন্তর্বর্তীকালীন, আলু খাওয়া, ৪০ পার হওয়া তরুণ নেতৃত্ব(পারিবারিক), নির্বাচনের কারচুপির সুক্ষ ও স্থুলতা, বিডিআর বিদ্রোহ, গুম, ক্রসফায়ার, টিপাইমুখ বাঁধ, শেয়ার বাজার, মমতা ব্যনার্জি, ট্রানজিট, সাংবাদিক নির্যাতন ও হত্যা, টকশো, গণজাগরণ মঞ্চ, হেফাজত ইসলাম, লাশের সংখ্যা, ডিজিটাল, পদ্মাসেতু, গ্রামীন ব্যাংক, হলমার্ক, যুদ্ধাপরাধ, আদালত অবমাননা, সীমান্ত হত্যা, বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও আমদানি, নির্বাচন, সংসদ এবং ২৫ অক্টোবর... প্রতিদিন সকাল হয় আর শুরু হয় নতুন নতুন নাটক দেখা... ব্যক্তিগত, পারিবারিক, আঞ্চলিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়, রাষ্ট্রীয়, জাতীয়, আন্তর্জাতিক...(আরও অনেক প্রকার),... এই সব নাটকের একটাই উদ্দেশ্য সেটা ক্ষমতায় থাকা আর ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ। এত নাটকের মাঝে থাকতে থাকতে সবাই অভিনয় শিখে গেছি... যে যার স্থানে সবচেয়ে বেশি ভালো অভিনয় করতে পারে সেই বেশি শক্তিশালী। আমরাও নিজেদের টিকিয়ে রাখতে পিতা-মাতা, ছেলে-মেয়ে, স্বামী-স্ত্রী, সহকর্মী, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, প্রেমিক-প্রেমিকা সবার সাথে অভিনয় করেই খ্যান্ত হইনা নিজেদের সাধ্যমত নাটকও বানাই। শেক্সপিয়ারের একটা বিখ্যাত উক্তি আছে, “এ পৃথিবীটা একটা বিরাট নাট্যমঞ্চ, আর আমরা সবাই সেই মঞ্চের এক একজন অভিনেতা।"
তিনি এইসময় জিবিত থাকলে তার কথার সাথে যুক্ত করতেন, "আমরা সবাই সেই মঞ্চের এক একজন অভিনেতা এবং নাট্য নির্মাতা"