নিত্যপ্রয়োজনীয় কোনো জিনিসের দামই মানুষের স্বাভাবিক ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নেই। তা সত্ত্বেও পণ্যের দাম বাড়ছে প্রতিদিন। মানুষের আয় বাড়ছে না, বেকাররা চাকরি পাচ্ছে না কিন্তু ব্যয় বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। সমাজে অপরাধও বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। মানুষের জানমালের নিরাপত্তা কল্পনার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। ছিনতাই-ডাকাতি এখন সাধারণ ব্যাপার, প্রতিদিন ১২টি খুন এবং ৮টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। ক্রসফায়ার এবং এনকাউন্টারের নামে র্যা বের গুলীতে বিনাবিচারে মৃত্যু ঘটছে সন্ত্রাসী নামধারীদের। নিরীহ অনেকেও র্যা বের শিকার হচ্ছে, সাংবাদিকরাও নির্যাতন থেকে রেহাই পাচ্ছেন না। অন্যদিকে জনগণের প্রতি দায়িত্ব পালনের পরিবর্তে সরকার ব্যস্ত রয়েছে তার রাজনৈতিক এজেন্ডা নিয়ে। প্রধানমন্ত্রী ও তার বোন শেখ রেহানা এবং তাদের সন্তান-সন্ততীদের জন্য আজীবন রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে সংসদে আইন পাস করা হয়েছে। মুজিব হত্যার দায়ে সাজাপ্রাপ্তদের ফাঁসির রায় কার্যকর করতে তৎপর সরকার। অভিযুক্তদের আত্মীয়-স্বজনদেরও খুঁজে খুঁজে গ্রেফতার করছে। চার মাসের শিশুকে পর্যন্ত কারাগারে ঢোকাচ্ছে। অজুহাত হিসেবে এমপি তাপসের ওপর বোমা হামলার প্রশ্নসাপেক্ষ ঘটনাকে ব্যবহার করছে সরকার।
সব মিলিয়েই দেশে এক নিরাপত্তাহীন ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। মানুষ এমনকি মূল্যবৃদ্ধির ব্যাপারেও টু শব্দটি করার সাহস পাচ্ছে না। খুন-ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের মতো অপরাধের মুখেও মানুষকে মাথা নিচু করে চলতে হচ্ছে। কারণ, কথা বললেই বা প্রতিবাদ জানালেই বিপদ নেমে আসতে পারে। কখন কাকে কোন্ অভিযোগে জেলের ভাত খাওয়ানো হবে- সে কথা কারো জানা নেই। সরকার যেন ঠিক এমন পরিস্থিতির জন্যই অপেক্ষায় ছিল! পরিস্থিতির সদ্ব্যবহারও সরকার যথেচ্ছভাবেই করছে। মানুষ দুরবস্থায় পড়ায় এবং বিরোধী দল এখনো আন্দোলনের উদ্যোগ না নেয়ায় সরকার একের পর এক তার রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে চলেছে। এশিয়ান হাইওয়ের আড়ালে ভারতকে করিডোর ও সমুদ্র বন্দর ব্যবহার করার সুযোগ দেয়া এবং তেল ও গ্যাস সম্পদ বিদেশীদের হাতে তুলে দেয়ার মতো এমন অনেক পদক্ষেপই সরকার নিয়েছে ও নিতে যাচ্ছে- যেগুলো শুধু অর্থনৈতিকভাবেই দেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে না, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বকেও বিপন্ন করবে।
ঘটনাপ্রবাহে বিশেষ কারণে পিলখানা হত্যাকান্ডের বিচারের প্রশ্নটি গুরুত্ব অর্জন করেছে। সরকারের সুচিন্তিত সিদ্ধান্তে বিডিআর সৈনিকরা এখনো সীমান্তে প্রায় নিরস্ত্র অবস্থায় রয়েছে। ফলে হঠাৎ আক্রান্ত হলে বিডিআরের পক্ষে দেশের সীমান্ত রক্ষা করা সম্ভব হবে না। এমন অবস্থার কারণ নিয়ে আলোচনা চলছে সাধারণ মানুষের মধ্যেও। পিলখানা হত্যাকান্ডে বিক্ষুব্ধ জাতি যখন ঘাতকদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠেছিল, সরকার তখন বিডিআরের বিলুপ্তি ঘটিয়ে ভারতের সাহায্যে নতুন একটি বাহিনী গঠনের ঘোষণা দিয়েছিল। সে লক্ষ্যে কাজেও নেমে পড়েছিল সরকার। আয়োজন পাকাপাকি করতে দিল্লী সফরে গেছেন বিডিআরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মইনুল ইসলাম। তার মধ্যেও বিডিআরের বিলুপ্তি ঘটানোর ব্যাপারে বিপুল উৎসাহ লক্ষ্য করা গেছে। ‘রক্তের দাগ লেগে রয়েছে'- এমন এক বিচিত্র অজুহাত দেখিয়ে তিনি বিডিআরের পোশাক পরতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন এবং শেষ পর্যন্ত গোপনে গোপনে নতুন পোশাক পরে ছেড়েছেন। অথচ হত্যাকান্ডের রহস্য এখন পর্যন্তও সম্পূর্ণরূপে উদঘাটিত হয়নি। এখনো নতুন নতুন তথ্য বেরিয়ে আসছে- সব কিছুর পেছনে ভারতের কালো হাত এবং এদেশেরই একটি গোষ্ঠীর সহযোগিতা রয়েছে বলে জানা যাচ্ছে। এজন্যই ষড়যন্ত্র উদঘাটন করার এবং অপরাধীদের শাস্তি দেয়ার আগে পুরো বিডিআরকে দায়ী করার চেষ্টা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। ঘটনাপ্রবাহেও প্রমাণিত হয়েছে, পিলখানা হত্যাকান্ডের জন্য বাহিনী হিসেবে সম্পূর্ণ বিডিআরকে দায়ী করার সুযোগ নেই। কারণ, বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও সেনাবাহিনীকে দুর্বল করার উদ্দেশ্যে সুচিন্তিতভাবে পিলখানা হত্যাকান্ড ঘটানো হয়েছে। হত্যাকান্ড শুরু হওয়ার পর মুহূর্ত থেকে ভারতীয় প্রচার মাধ্যমের বাড়াবাড়ি এবং শেখ হাসিনা ও তার সরকারকে ‘সাহায্য' করার জন্য ভারতের সামরিক প্রস্তুতির মতো বিষয়গুলোতেও পরিষ্কার হয়েছে, হত্যাকান্ডের সঙ্গে ভারতের বিশেষ সম্পর্ক ছিল। এর পর পরই হঠাৎ বিডিআরের বিলুপ্তি ঘটানোর তোড়জোড় শুরু হয়েছে।
প্রথম থেকেই দেখা গেছে, সরকার একদিকে পিলখানা হত্যাকান্ডের খুনি-ঘাতকদের গ্রেফতার করার এবং শাস্তি দেয়ার ব্যাপারে রহস্যজনক ভূমিকা পালন করে এসেছে, অন্যদিকে বেশি তৎপরতা চালিয়েছে বিডিআরকে বিলুপ্ত করার ব্যাপারে। কিন্তু দেশপ্রেমিকদের প্রতিবাদের মুখে সরকারকে সময়ে সময়ে লোক দেখানো পদক্ষেপ নিতে হয়েছে। এরকম একটি পদক্ষেপ সম্পর্কে কিছু কথা জানা গেছে গত কয়েকদিনে। যেমন- ২১ অক্টোবর আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ জানিয়েছেন, নবেম্বরে পিলখানা হত্যাকান্ডের- সরকারের ভাষায় ‘বিডিআর বিদ্রোহের' বিচার শুরু হবে। প্রায় সাড়ে তিন হাজার জওয়ানের বিচার করার জন্য ঢাকায় চারটিসহ ছয়টি পৃথক আদালত বসবে। এছাড়া হত্যা-লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগসহ অন্যান্য অপরাধে জড়িতদের বিচারের জন্য বিশেষ দ্রুত বিচার আদালত বা ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হবে। ‘বিডিআর বিদ্রোহের' সঙ্গে জড়িতদের বিচার হবে বিডিআর আইনে। এজন্য আদালত হবে বিডিআরের ডিজি'র নেতৃত্বে। তাকে সহযোগিতা করার জন্য আইনজীবী নিয়োগ দেয়া হবে। এটাই বিডিআরের আইন। বিদ্রোহের অভিযোগে যে আদালতে বিচার হবে সে আদালতের নাম ‘বিডিআর আইনে গঠিত বিশেষ আদালত'। এর বিচারকও নিযুক্তি দেবেন বিডিআরের ডিজি। সরকার ‘আইনের শাসনে বিশ্বাসী' বলেই ডিজি'র নেতৃত্বে গঠিত আদালতে বিচার করা হবে। এতে নাকি নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ণ হওয়ার সম্ভাবনা নেই। অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস থেকে ১৫ জন প্রতিনিধি নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। এর বাইরেও ১০ জন আইনজীবীকে নিয়োগ দেয়া হবে। অন্য একটি বিস্ময়কর কথাও শুনিয়েছেন আইনমন্ত্রী। যে আদালতে ‘বিডিআর বিদ্রোহের' বিচার হবে সে আদালতে সাংবাদিকরা প্রবেশ করতে পারবেন না। প্রতিদিনকার বিচার কাজ সম্পর্কে সাংবাদিকদের অবহিত করা হবে আদালতের বাইরে। আইনমন্ত্রী আরো জানিয়েছেন, অক্টোবরের মধ্যেই সিআইডির তদন্ত রিপোর্ট পাওয়া যাবে। সে অনুযায়ী চার্জশিট পেশ করা হবে। চার্জশিট পেশ করার পরই অভিযোগ আমলে নিয়ে বিচার কাজ শুরু হবে। বিডিআরের পক্ষ থেকেও পৃথকভাবে তদন্ত চলছে বলেও জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী। এ তদন্তও অক্টোবরেই শেষ হয়ে যাবে।
বিচার শুরু হওয়ার এই খবরে দেশপ্রেমিকরা কিন্তু উৎসাহিত হতে পারেননি। কারণ সরকারের পক্ষ থেকে হস্তক্ষেপ ও জটিলতা সৃষ্টি করার মাধ্যমে পিলখানা হত্যাকান্ডের তদন্ত প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার এবং ক্ষেত্রবিশেষে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা চালানোর গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। সরকারের প্রভাবে সুষ্ঠু তদন্ত যেমন হতে পারেনি তেমনি প্রকৃত অপরাধীদের জন্যও পার পেয়ে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। এমন অভিযোগ ওঠার কারণ হলো, পিলখানায় সেনা অফিসারদের হত্যাকান্ডের ব্যাপারে প্রথম থেকেই সরকারকে দ্বিধান্বিত ও কম আগ্রহী দেখা গেছে। সরকার ধীরে এগোনোর কৌশল নিয়েছে এবং সে কৌশলের অংশ হিসেবে তিনটি পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। প্রতিটি তদন্ত কমিটির জন্যই আবার কঠিন টার্মস অব রেফারেন্স জুড়ে দিয়েছে সরকার। তাদের এখতিয়ার ও ক্ষমতাই শুধু সীমিত করে দেয়া হয়নি, গোপনে এমন আয়োজনও করা হয়েছে, যাতে কোনো কমিটিই স্বাধীনভাবে কাজ করতে না পারে এবং প্রয়োজনীয় সকলের সহযোগিতা না পায়। এসব জানা গেছে তদন্ত কমিটিগুলোর বক্তব্যে। যেমন ২৭ মে প্রকাশিত রিপোর্টে সরকারি তদন্ত কমিটি পরিষ্কার ভাষায় বলেছে, হত্যাকান্ড সম্পর্কে ‘আরো তদন্ত হওয়া দরকার'। এর মধ্য দিয়ে তদন্ত কর্মকর্তারা নিজেদের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে জানিয়ে দিয়েছেন। বোঝা গেছে, তদন্ত বলতে যা বোঝায় তার কিছুই কমিটিকে করতে দেয়া হয়নি। তদন্ত কমিটি এনএসআই, ডিজিএফআই, র্যা ব, সিআইডি ও এসবিসহ গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা পায়নি। কমিটিকে টিএফআই সেলের ইন্টেরোগেশন রিপোর্টও দেখতে দেয়া হয়নি। এজন্যই বাধ্য হয়ে তদন্ত কর্মকর্তারা রিপোর্টে বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করেছেন। বলেছেন, ‘আরো তদন্ত হওয়া দরকার'।
লেফটেন্যান্ট জেনারেল জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত সেনাবাহিনীর তদন্ত কমিটিও গাইডলাইন এবং কঠিন টার্মস অব রেফারেন্সের কারণে বিস্তারিতভাবে তদন্ত করতে পারেনি। কমিটির রিপোর্টও পূর্ণাঙ্গ হয়নি। তদন্তকালে অনেক গোপন তথ্য বেরিয়ে এলেও এবং ক্ষমতাসীন দলের বিশেষ কয়েকজন নেতার জড়িত থাকার ব্যাপারে সুনির্দিষ্টভাবে জানতে পারলেও এখতিয়ার না থাকায় রিপোর্টে সে সবের উল্লেখ করা হয়নি। কারো ব্যাপারে কমিটি কোনো ব্যবস্থাও নিতে পারেনি। সেনা তদন্ত রিপোর্টে অবশ্য এটুকু বলা হয়েছে, ওই হত্যাকান্ডের পেছনে ছিল সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। বিডিআর সদস্যরা বিশেষ কিছু রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে এসেছে। সে সব নেতার নাম এবং তাদের সঙ্গে বিডিআর সদস্যরা কি বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছে- সবই জানতে পেরেছে সেনা তদন্ত কমিটি। আওয়ামী লীগের একজন এমপির সঙ্গে ঘাতকদের বৈঠকের প্রমাণ পেয়েছে কমিটি। সেনা তদন্ত কমিটি জানতে পেরেছে, ষড়যন্ত্রকারীদের পরিকল্পনা ছিল ঘটনায় সেনাবাহিনীকে জড়িয়ে ফেলা। সেনাবাহিনী জড়িয়ে পড়লে দেশে বিশৃংখলার সৃষ্টি হতো এবং পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হয়ে পড়ত। এতে সেনাবাহিনী দুর্বল হয়ে যেত। রিপোর্টে বলা হয়েছে, শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধানের নামে যে দীর্ঘ সময় নেয়া হয়েছে ঘাতকরা তারই সদ্ব্যবহার করেছিল।
সরকারি তদন্ত কমিটির রিপোর্টেও একই ধরনের বিশ্লেষণ রয়েছে। তদন্ত কমিটির রিপোর্ট পড়লে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, পেছনে ছিল সুচিন্তিত পরিকল্পনা। রিপোর্টের কিছু তথ্য ও দু'চারজনের স্বীকারোক্তিমূলক বক্তব্যে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে গেছে। যেমন ৩৯ রাইফেলস ব্যাটালিয়নের মো. আশরাফুল আলম ও মো. আলমগীর শেখ জানিয়েছে, নির্বাচনের কয়েকদিন পর থেকেই আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস ও প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানকের সঙ্গে তাদের বৈঠক ও আলোচনা হয়েছে। গুলশানের একটি বাসভবনেও বৈঠকের উল্লেখ করেছে তারা। ডিএডি হাবিব তার অডিও স্বীকারোক্তিতে বলেছে, ব্যারিস্টার তাপস এবং শেখ সেলিম এমপির সঙ্গেও তারা বৈঠক করেছে। সরকারি তদন্ত রিপোর্টে বলা হয়েছে, প্রতিমন্ত্রী নানক এবং এমপি তাপসের সঙ্গে ২২ ফেব্রুয়ারি রাতে ‘বিদ্রোহীদের' বৈঠক হয়েছে। সে বৈঠকেই সেনা অফিসারদের হত্যাকান্ডের চূড়ান্ত পরিকল্পনা ‘অনুমোদন' করা হয়েছিল। ২৫ ফেব্রুয়ারি রাতেও ব্যারিস্টার তাপস পিলখানায় প্রবেশ করেছিলেন। তদন্ত রিপোর্টের ভাষায় তার উদ্দেশ্য ছিল ‘মপিং আপ' অর্থাৎ সব কাজ শেষ করার নির্দেশ দেয়া ও আয়োজন নিশ্চিত করা। তিনি দ্রুত সব কাজ শেষ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন বলেও তারা স্বীকারোক্তি দিয়েছে। উল্লেখ্য, ২৬ তারিখে এই এমপি তাপসই তিন কিলোমিটার পর্যন্ত এলাকা খালি করার ঘোষণা প্রচার করিয়ে জনমনে আতংক ছড়িয়েছিলেন। প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল ঘাতকদের পালিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা। সরকারি তদন্ত রিপোর্টে বলা হয়েছে, পিলখানা গেইটের অদূরে পুলিশ ও র্যা ব অবস্থান নিলেও বিডিআর সদর দফতরের চারদিকের দেয়াল ছিল অরক্ষিত। ফলে ঘাতকরা নির্বিঘ্নে দেয়াল টপকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। সন্ধ্যায় উদ্দেশ্যমূলকভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করা হয়েছিল। এতে লুটের মালামালসহ বেরিয়ে যেতেও ঘাতকদের পক্ষে সুবিধা হয়েছে।
রাজনৈতিক সমাধানের নামে সময় ক্ষেপণেও বিস্মিত হয়েছে তদন্ত কমিটি। কমিটির মতে, কম করে হলেও ২৯ ঘণ্টা সময় পেয়েছিল ঘাতকরা। এ সময়ের মধ্যে তারা ধীরে সুস্থেই হত্যাকান্ড ঘটানোর, লাশ গুম করার, নির্যাতন ও লুটতরাজ করার এবং সবশেষে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিল। খুবই বিস্ময়কর হচ্ছে, সমঝোতা আলোচনার জন্য ডিএডি তৌহিদের নেতৃত্বে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন যমুনায় যে ১৪ জন ঘাতক গিয়েছিল তাদের কারো নামই কোথাও পাওয়া যায়নি। অথচ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের ক্ষেত্রে রেজিস্টারে নাম লেখানো এবং সাক্ষাৎকারীর স্বাক্ষর নেয়া বাধ্যতামূলক। কিন্তু হত্যাকান্ডের দিন ১৪ জন বিডিআর সদস্য গেলেও তাদের কারো নামই বাসভবনের রেজিস্টারে পাওয়া যায়নি। বাসভবনের ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরাতেও তাদের কারো ছবি পাননি তদন্ত কর্মকর্তারা। এমনটা শুধু তখনই সম্ভব যখন পেছনে সুনির্দিষ্ট আয়োজন থাকে এবং সে আয়োজনের ভিত্তিতে ছবিগুলো মুছে ফেলা হয়। সরকারি তদন্ত কমিটির মতে বিষয়টি ‘খুবই রহস্যজনক'।
তদন্ত কমিটির দৃষ্টিতে আরো অনেক বিষয়ই রহস্যের সৃষ্টি করেছে। যেমন ডিএডি হাবিবের অডিও স্বীকারোক্তির কোনো খোঁজই পায়নি তদন্ত কমিটি। অথচ ওই স্বীকারোক্তিতে ডিএডি হাবিব জানিয়েছিল, তারা ব্যারিস্টার তাপস ও শেখ সেলিম এমপির সঙ্গে বৈঠক করেছে। ডিএডি হাবিবের সে অডিও স্বীকারোক্তি যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে! তাছাড়া হত্যাকান্ড চলার সময় এবং হত্যাকান্ডের আগে-পরে ঘাতকরা মোবাইলে যেসব কথা বলেছে সেগুলোর ভয়েস রেকর্ডও পাওয়া যায়নি। এগুলো সম্ভবত ধ্বংস করা হয়েছে। সেনা অভিযান না চালানোর সিদ্ধান্তেও বিস্মিত হয়েছে সরকারি তদন্ত কমিটি। ভৌগোলিক অবস্থান ও ঘনবসতীর যে যুক্তিকে অভিযান না চালানোর অজুহাত বানানো হয়েছে তাকে তদন্ত কমিটির কাছে ‘যুক্তিযুক্ত' মনে হয়নি। কারণ, সকাল সাড়ে নয়টায় র্যা বের প্রথম দল পৌঁছে গিয়েছিল। এরপরপর গিয়েছিল সেনাবাহিনীর ৪৬ ব্রিগেডের পাঁচশ সেনা। কিন্তু ‘রাজনৈতিক সমাধানের' স্বার্থে তাদেরকে বিডিআরের ‘দৃষ্টি সীমার' বাইরে চলে যওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। তদন্ত রিপোর্টের অন্য কিছু তথ্যও উল্লেখ করা দরকার। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রিপোর্টের নির্বাচিত যে অংশটুকু প্রকাশ করেছেন তার মধ্যে ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস, প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক ও ফজলুল করিম সেলিমের নামই উল্লেখ করা হয়নি। অথচ রিপোর্টে তাদের নাম এসেছে কয়েকবার।
তদন্তের নামে এমন কিছুই যে শেষ পর্যন্ত করা হবে সে সম্পর্কে বোঝা যাচ্ছিল প্রথম থেকে। বিশেষ কোনো কারণ বা দায়বদ্ধতার কারণে সেনা অফিসারদের হত্যাকান্ডের তদন্ত ও মামলাকে মূল জায়গা থেকে সরিয়ে দেয়ার জন্য মন্ত্রীদের অনেককেই দৌড়-ঝাঁপ করতে দেখা গেছে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত ‘খেলনেওয়ালাদের' ঘাড়ে দোষ চাপানোর মাধ্যমে তার উদ্দেশ্যের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। এখানে পুলিশের সাবেক এএসপি আবদুল কাহার আকন্দকে প্রধান করে সিআইডির নামে তৃতীয় একটি তদন্ত কমিটি গঠনের কথাও উল্লেখ করা দরকার। আওয়ামী লীগের ‘লোক' হিসেবে কাহার আকন্দের প্রমাণিত পরিচিতি রয়েছে। তিনি গত সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন। অমন একজন দলীয় লোককে অবসর থেকে ডেকে এনে সিআইডির তদন্ত কমিটির প্রধান করায় সরকারের উদ্দেশ্য এবং তদন্তের পরিণতি সম্পর্কে সংশয় বেড়েছে বহুগুণে। কিছু ঘটনায় এর প্রমাণও পাওয়া গেছে। তদন্তকালে সরকারি ও সেনা তদন্ত কমিটির মতো সিআইডিও বর্তমান ও প্রাক্তন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীসহ ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজনের জড়িত থাকার তথ্য-প্রমাণ পেয়েছে। বিশেষ করে এসেছে ব্যারিস্টার তাপস, জাহাঙ্গীর কবির নানক, মির্জা আযম ও শেখ সেলিমের নাম। কিন্তু এসব বিষয়ে তদন্ত কমিটিকে ‘ওপরের নির্দেশনা' মেনে চলতে হয়েছে। সেই সাথে যুক্ত হয়েছে তড়িঘড়ি করে তদন্ত শেষ করার নির্দেশ। শুধু তা-ই নয়, সিআইডির তদন্ত কমিটিও ক্ষমতাসীন দলের কোনো নেতা বা মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীকে আটক বা জিজ্ঞাসাবাদ করেনি। ফলে ধরে নেয়া হচ্ছে, চার্জশীটেও তাদের কারো নাম উল্লেখ করা হবে না। অর্থাৎ তারা ‘পার' পেয়ে যাবেন। ঘটনাপ্রবাহে এর প্রমাণও পাওয়া যাচ্ছে। যেমন প্রায় ধামাচাপা পড়ে যাওয়া সরকারি তদন্ড কমিটির রিপোর্টে ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস, জাহাঙ্গীর কবির নানক, মির্জা আযম ও শেখ সেলিমসহ অনেকের নামই এসেছে। কিন্তু তাদের কাউকে তদন্ত কমিটির সামনে হাজির করে জিজ্ঞাসাবাদ করতে দেয়া হয়নি। ৩৫ জনের বেশি বিডিআর সৈনিকের বন্দি অবস্থায় রহস্যজনক মৃত্যুর বিষয়টিও যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ- যাদের কাছে থেকে সত্য কথা জানার সম্ভাবনা ছিল। সব মিলিয়েই এমন ধারণা শক্তি অর্জন করেছে যে, পিলখানা হত্যাকান্ডের প্রকৃত ষড়যন্ত্রকারী ও ঘাতকরা তো বটেই, তাদের পৃষ্ঠপোষকরাও বিনা বিচারে ‘পার' পেয়ে যাবে।
এমন এক অবস্থার মধ্যেই পিলখানা হত্যাকান্ডের বিচার শুরু করার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। ফলে সঙ্গত কারণেই জনমনে সংশয় বাড়ছে। বড় কথা, দ্রুত বেড়ে দ্রব্যমূল্য ও খুন-ডাকাতিসহ নানামুখী অপরাধের মধ্যে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়ার পরিবর্তে সরকার নিজেও হঠাৎ নানা অজুহাতে গ্রেফতার ও নির্যাতন বাড়িয়ে দেয়ায় এমন আশংকাই শক্তিশালী হয়েছে যে, মূল সমস্যাগুলো থেকে জনগণের মনোযোগ ঘুরিয়ে দেয়ার কৌশল নিয়েছে সরকার। বিরোধী দলের আন্দোলনবিমুখ অবস্থানকেও কাজে লাগাচ্ছে সরকার। । সবই সরকারের ইচ্ছা ও পরিকল্পনা মতো চলবে- এমন ভাবনার পরিণতি ধ্বংসাত্মক হয়ে উঠতে পারে