somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাংলাদেশের রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র ঃ হত্যা আর ধ্বংশের সুতিকাগার

০৭ ই এপ্রিল, ২০১২ বিকাল ৩:১৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

পটভূমিঃ
মধ্যযুগের বিলুপ্তপ্রায় বিভিন্ন ধর্মীয় এবং সামাজিক সংগঠন সর্ম্পকে লেখাপড়া করছিলাম। এদের মধ্যে ‘কর্তাভজা সম্প্রদায়’ এর আচার-আচরণ, , রীতি-নীতি, জীবনাচরণ পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিলো এরা আসলে এখনো বিলুপ্ত হয়নি । ভিন্ন নামে এবং ভিন্ন আঙ্গিকে এখনো সমাজে প্রবলভাবেই বিদ্যমান রয়েছে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে কয়েক দশক ধরে পরিবারতন্ত্র এবং তাকে কেন্দ্র করে চাটুকার মোসাহেবদের তৎপরতা দেখলে ঐ ‘কর্তাভজা সম্প্রদায়’ এর কথা মনে পড়ে যায়। এই অসুস্থ এবং গলিত, বিকৃত রাজনীতির বিরুদ্ধে সুস্থ ধারার রাজণীতিক এবং রাজনীতির বিক্ষোভ এবং বিদ্রোহ অনেকবারই তো আমরা দেখলাম , কিন্ত কাজের কাজ তো কিছুই দেখিনি বরং আজকের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে পরিবারতন্ত্র যেনো আরো বেশী শিকড় গেঁড়ে বসেছে বলেই মনে হচ্ছে।

এই প্রেক্ষাপটে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর বর্তমান অবস্থার চাঁচাছিলা বিশ্লেষণ করা যেতে পারে।

বিএনপি ঃ

প্রথমতঃ এখনো পর্যন্ত বিএনপির মূল নীতিনির্ধারক হলেন খালেদা জিয়া, তাকে অগ্রাহ্য করে বা পাশ কাটিয়ে সিদ্ধান্ত নেবার মতো কোন শক্তি এখনো পর্যন্ত বিএনপিতে জন্ম নেইনি। অতীতে যারা সে চেষ্টা করেছিলেন তারা প্রত্যেকে ব্যর্থ এবং করুণ পরিণতির স্বীকার হয়েছেন।

দ্বিতীয়ত:- পরিবারতন্ত্রের করাল গ্রাস থেকে বিএনপিকে রক্ষা করার জন্য দলের ভিতর এবং বাইরে থেকে অনেক হেভিওয়েট নেতা এবং প্রভাবশালী শুভানুধ্যায়ী বিএনপিকে ভালবাসে এমন নেতা কর্মীদের পরিবারতন্ত্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবার কথা বলেছেন অনেকবারই কিন্ত বাস্তবতা হলো লক্ষ লক্ষ তৃণমূল পর্যায়ের নেতা ও কর্মী এখনো জিয়া পরিবারের যাদুতে আচ্ছন্ন । এসব নেতা /কর্মী মনে করে যে দলের সংহতি এবং শক্তি আসলে জিয়া পরিবারের উপরেই নির্ভরশীল, শুধু এরাই নয় বর্তমান বিএনপির উচ্চ পর্যায়ের নেতারাও অনেকেই এ কথাটি বিশ্বাস করেন যে তারেক জিয়া ফিরে এলেই লক্ষ লোকের মহাসমাবেশ হবে এবং মহাজনতার যে শক্তি এবং সমর্থন বিএনপি ফিরে পাবে তা দিয়েই তারা ক্ষমতার মসনদ থেকে অনায়াসে আওয়ামী লীগকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারবে। এরা বিশ্বাস করে যে এজন্যই হয়তো বর্তমান সরকার জিয়া পরিবারকে রাজনীতি থেকে বাইরে রাখার জন্য একের পর এক বিভিন্ন মিথ্যা মামলা দিয়ে খালেদা এবং তারেক বিহীন একটি নির্বাচনের ব্যাকগ্রাউন্ড তৈরী করার চেষ্টা করছে। আর এই বিশ্বাসের প্রতিধ্বণি করেই হয়তো বিএনপি’র শীর্ষ পর্যায় থেকে বারবার বলা হচ্ছে যে-‘খালেদা ও তারেককে রাজনীতির বাইরে রেখে সরকার ফাঁকা মাঠে গোল দিতে চায়।’

এ প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ডঃ শাহনেওয়াজ স্যার কিছুদিন আগে কালের কন্ঠে ‘দুজন বিহনে ফাঁকা রাজনীতির মাঠ’ শির্ষক নিবন্ধে বলেছিলেন যে-‘এটি আঁতকে যাওয়ার মতো কথা, বিএনপির মতো একটি বড় দলের কি তাহলে এখন এই দশা যে খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানের অনুপস্থিতিতে বিএনপির রাজনীতির মাঠ পুরোটাই ফাঁকা হয়ে যায়! তাহলে এতসব হেভিওয়েট নেতার দলে থাকা কেন! গোলপোষ্ট আগলে রাখার কোন যোগ্যতাই কি তাদের নেই?”

তার প্রশ্নের উত্তরে শুধু এটুকু বলা যায় যে এদের গোল পোষ্ট আগলে রাখার মতো যোগ্যতা আছে কিনা জানিনা, সময়ই এ প্রশ্নের উত্তর দেবে, তবে কিনা শুধু গোল পোষ্ট আগলে রাখলে তো আর গোল দেয়া যায়না, আর গোল না দিতে পারলে তো আর বিজয়ী হওয়া যায়না ! আর আমার মনে হয় বর্তমানে কোন রাজনৈতিক দলই এ কথা বিশ্বাস করেনা যে ‘বিজয় মহান, কিন্ত বিজয়ের সংগ্রাম মহত্তর।’ আমরা বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করি যে ছলে বলে কৌশলে ক্ষমতার মসনদে বসাটাই হলো বর্তমান রাজনৈতিক দলগুলোর মূল উদ্দেশ্য এবং তা করতে গেলে শুধু গোলপোষ্ট আগলে রাখলেই চলেনা। আর ঠিক এই কথাগুলোই বর্তমান বিএনপির নেতৃত্বও বিশ্বাস করে।

আওয়ামী লীগঃ এবার আওয়ামী লীগের কথা আলোচনা করা যেতে পারে।

প্রথমতঃ বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর তার রক্তের দাগ শুকাতে না শুকাতেই মোসতাকের মন্ত্রীসভায় যোগদানের জন্য বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রীসভার কারা দৌড় দিয়েছিলো সে সবই বাংলাদেশের জনগণ জানেন । দীর্ঘদিনের ঐতিহ্যবাহী দল আওয়ামী লীগ যখন চ্ছিন্ন-ভিন্ন, দুর্বল এবং অপারগ তখন দলকে শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে আসার জন্য শেখ হাসিনা ছাড়া আর কোন উপায় ছিলোনা। এ ছিলো দলের লক্ষ লক্ষ সাধারণ নেতা কর্মীর আকাঙ্খা। বাস্তব সত্য হলো বঙ্গবন্ধু পরবর্তী আওয়ামী লীগ যতদিন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুকণ্যা কে কান্ডারী হিসেবে না পেয়েছে ততদিন দলটি ছিলো গতিহীণ, অশক্ত , এবং অসমর্থ।

দ্বিতীয়তঃ এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য বঙ্গবন্ধুর রক্তের কাউকে যখন তীব্র ভাবে আকাঙ্খা করা হচ্ছিলো তখন সেই আকাঙ্খার ফলশ্রতিতেই জাতীয় রাজনীতিতে নিতান্ত অনভিজ্ঞ শেখ হাসিনা এসে আওয়ামী লীগের হাল ধরলেন,তাকে কেন্দ্র করে লক্ষ লক্ষ নেতা কর্মী নতুন আশা ও উদ্দীপনায় দলকে প্রাণবন্ত করে তুললো। এবং আওয়ামী লীগের যেনো পূর্নজীবন ঘটলো শেখ হাসিনার হাত ধরে।এবং আজ পর্যন্ত শেখ হাসিনাই দলটির প্রাণ-ভোমরা। নিজের প্রাণপ্রবাহ দিয়ে দলের জীবনীশক্তি বজায় রেখেছেন তিনি।

তৃতীয়তঃ তার একক যোগ্যতায় স্থবির আওয়ামী লীগ আজ গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসে দৌড় শুরু করেছে। তথাকথিত হেভিওয়েট নেতাদের এতে কতটুকু অবদান রয়েছে? তাদের বিহনেও যে দল প্রাণবন্ত ভূমিকা রাখতে পারে এবারের মন্ত্রীসভাই তো তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। শুধুমাত্র শেখ হাসিনার প্রতি দলের সর্বস্তরের নেতা কর্মী এবং কোটি কোটি সাধারণ মানুষের আস্থায় তা প্রমানিত হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে শেখ হাসিনার নিজস্ব অতুুলনীয় যোগ্যতার কথা ভুললে চলবেনা সত্য কিন্ত পাশাপাশি তিনি যে বঙ্গবন্ধু কণ্যা সেই বিষয়টিও কি একটি বিশাল ভূমিকা রাখেনি? সেজন্য যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র তার মনোরঞ্জনের জন্য বাঁশি বাজিয়ে দৌড় প্রতিযোগীতার বিজয়ীকে তিনি যখন মন্ত্রী করেন এবং সেই মন্ত্রীর বিরুদ্ধে যখন এমনকি বিশ্বব্যাংক থেকেও দুর্ণিতির অভিযোগ ওঠে তখনও দলের মধ্যে কোথাও প্রকাশ্যে কোন টুঁ শব্দটিও ওঠেনা ।

জাতীয় পার্টিঃ
পতিত স্বৈরাচার এরশাদের কাহিনী তো আরো ভয়াবহ। এরশাদ প্রহরে প্রহরে গিরগিটির মতো রঙ বদলান। এবং প্রায়সই দলকে তিনি তার বেডরুমের চাদর বদলানোর মতই বদলে ফেলেন । দুঃখ লাগে এই যে এখনো তার সাথে জতীয় রাজনীতিতে অবদান রেখেছেন এমন অনেক নেতা কর্মীই রয়েছেন কিন্ত এরা সবাই নপুংশকের ভূমিকা পালন করেন। অথবা এরা সত্যি সত্যি নপুংশক।

দ্বিতীযতঃ এরশাদের ক্ষমতাকালীন সময়ের কথা বাদ দেয়া গেলো কিন্ত এই মহাজোটের মধ্যেও ভাগবাটির হিসসা হিসাবে তিনি তার ভাইকে মন্ত্রী করেছেন,পরকীয়ার প্রায়শ্চিত্ত্ব স্বরুপ প্রথম বউকে দলের বড় পোস্ট এবং সাংসদ করে রেখেছেন দীর্ঘদিন থেকে।

এই বাস্তবতায় অনুমান করা যায় যে প্রবাহমান ধারায় আজকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ হাসিনা নিষ্ক্রিয় হয়ে গেলে সজিব ওয়াজেদ জয়ের মাধ্যমে নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগের রাজনীতির আর এক অধ্যায় শুরু হবে এবং খালেদা জিয়া নিষ্ক্রিয় হয়ে গেলে তেমনি ভাবেই তারেক রহমান ছাড়া বিএনপিকে ধরে রাখার আর কোন উপায় থাকবেনা। যেমন বঙ্গবন্ধুর পরে দলের হাল ধরেছেন শেখ হাসিনা এবং জিয়ার পরে দলের হাল ধরেছেন খালেদা জিয়া।

বিদ্যমান পরিবারতন্ত্রের তুলনামূলক বিশ্লেষণঃ
তুলনামূলক বিশ্লেষণে আমার কাছে মনে হয় যে বিএনপির পরিবারতন্ত্রের চাইতে পরিবারতন্ত্রের প্রভাব এবং তার কুফল বরং আওয়ামী লীগের মধ্যেই বেশী। আর একথাও বোধহয় সত্য যে পরিবারতন্ত্রের কারণে যতবড় ক্ষতি বঙ্গবন্ধু পরিবার তথা আওয়ামী লীগ তথা দেশ ও জাতির হয়েছে পৃথিবীর ইতিহাসে তার কোন তুলনা নেই। বঙ্গবন্ধু হত্যার পরবর্তী অবস্থাটাও বিবেচনা করা যেতে পারে ! শেখ হাসিনা ছাড়া মৃতপ্রায় এই দল কখনো রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসতে পারতোনা, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার এবং ৭১ এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার তো অনেক দুরের বিষয়। তাই দেখা যায় বাংলাদেশের শেকড়ে প্রোথিত বঙ্গব›ধুর স্মৃতি,তার প্রতি জাতির ভালবাসা আর সাধারণ মানুষের তীব্র আকাঙ্খার কারণে দীর্ঘদিনের ঐতিহ্যবাহী দলে প্রাজ্ঞ এবং জনঘণিষ্ঠ বহু বলিষ্ঠ নেতা থাকা সত্ত্বেও দলের প্রয়োজনে শেখ হাসিনাকে এর সভানেত্রী করতে হয় এবং তাকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের রাজনীতির যে নতুন অধ্যায় শুরু হয় সেটি হয়ে ওঠে দলের মূল স্রোতধারার রাজনীতি। এর সাথে যারা পুরোপুরি সম্পৃক্ত হতে পারেননি কালের পরিক্রমায় তাদের অবস্থান আজকে কত গৌণ তাতো সবাই জানেন। বঙ্গবন্ধুর সহচর এবং এক সময়ের হেভিওয়েট ঐসব নেতারা এখন নতুন প্রজন্মের কাছে বিস্মৃতপ্রায়।

উপমহাদেশের পরিবারতন্ত্রঃ
এতো গেলো আমাদের দেশের অবস্থা কিন্ত সত্যিকার অর্থে গোটা উপমহাদেশের অবস্থাই কি এক নয়? বহু মত, পথ এবং বলিষ্ঠ গণতন্ত্র চর্চার দেশ ভারতেও স্বাধীনতার পর থেকে নেহেরু পরিবারই এখনো পর্যন্ত ক্ষমতার মূল স্রোত ধারাটি নিয়ন্ত্রন করছে। পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশগুলির মধ্যে একটি ভারত, কিন্ত সেখানেও পরিবারতন্ত্রের প্রভাব এতই প্রবল যে মেনকা গান্ধী বিদেশিনী হওয়া সত্তেও শুধুমাত্র গান্ধী পরিবারের পুত্রবধু হবার সুবাদে তাকে দিয়ে দলের বিপদমুহুর্তে ঐক্য ধরে রাখবার তাগিদে কংগ্রেসের মতো বিশাল ঐতিহ্যবাহী দলের বাগডোরটি হাতে ধরিয়ে দেয়া হয়, এবং বহু বহু ঝানু পলিটিশিয়ানদের পাশে সরিয়ে দিয়ে দলটির বাগডোর মূলতঃ এখনো তারই হাতে। পাকিস্তানে ভুট্টো পরিবার কিভাবে দীর্ঘদিন পাকিস্তানী রাজনীতির মূল স্রোতধারা নিয়ন্ত্রন করেছে এতো আমাদের সবারই জানা।

পরিবারতন্ত্রের প্রভাবের কারণঃ
কিন্ত পরিবারতন্ত্র এতো প্রভাব বিস্তার করতে পারছে কেনো ? কেনো জনগণ তাদের সুখে দু:খে পাশে দাঁড়ানো নিবেদিত প্রাণ জননেতাদের কথা ভুলে হাসিনা আর খালেদার পুত্রবন্দনায় মেতে ওঠেন। এমনকি তৃণমূল নেতাকর্মী থেকে একেবারে প্রথম সারির নেতৃবৃন্দ পর্যন্ত নিজেদের সম্ভ্রমবোধ ধুলোয় লুটিয়ে দিয়ে এই ধরণের ঘৃণ্য বোংগারিং করতে বাধ্য হন! (আফ্রিকান জুলু উপজাতির মধ্যে এই প্রথা প্রচলিত আছে,সম্ভ্রান্ত, গোত্র প্রধান এবং রাজার উদ্দেশ্যে এক ধরণের অসম্ভব অতিশোয়াক্তি সম্পন্ন প্রশংসা এবং স্তুতি বাক্য আওড়ানো হয়, শুধু রাজা নয় এর আওতায় পড়েন রাজার উর্দ্ধতন পঞ্চম পুরুষ পর্যন্ত এবং রাজার জীবিত সকল আত্মীয় স্বজন এবং পুত্র কণ্যা। জুলু ভাষায় এর নামই বোংগারিং।)

দেশ ও জাতির স্বার্থেই এর কারণ এবং প্রতিকারের উপায় নিয়ে ব্যপক আলোচনা হওয়া উচিত। আমার কাছে যা মনে হয় তা তুলে ধরছিঃ

প্রথমটি এ দেশের কোটি কোটি সাধারণ জনগণের জন্য প্রযোজ্য। রাজার ছেলে রাজা হয় হাজার বছর থেকে এ দেশের সাধারণ জনতা এমনটাই দেখে আসছে। এবং আমার মনে হয় এটা দেখতেই তারা পছন্দ করে। বিশেষ করে রাজা যদি পছন্দসই এবং প্রজাহিতৈষী হয় তাহলে তো কথাই নেই। সে কারণেই হয়তো প্রায় চারশো বছর ব্যপী পৃথিবীর দীর্ঘতম রাজবংশের উত্থান এবং পৃষ্ঠপোষকতা এই বাংলার মাটিতেই সম্ভব হয়েছে।

এছাড়া মৌর্য, গুপ্ত, পাল ,সেন এ সমস্ত রাজবংশ তথা পরিবারগুলোই তো বাংলাদেশকে শাষন করেছে হাজার বছর ধরে। গজনী বংশ, ঘোরী বংশ , মামলুক বংশ , খলজি বংশ ,তুঘলক বংশ সৈয়দ আর লোদী বংশ, এদিকে বাংলার ইলিয়াস শাহী বংশ, যদু বংশ , হুসেনশাহী বংশ, অন্যদিকে দিল্লীর সালতানাতের পতনে উদ্ভুত বহমনী রাজ্যকেন্দ্রিক শাহ বংশ, বিজয় নগরের সঙ্গম বংশ, তুলুঘ আর বিভু বংশ,মোগল সম্রাটদের সুদীর্ঘ প্রায় আটশত বছরের পরিবারতন্ত্র, দক্ষিণ পূর্ব বাংলার খড়গ বংশ,দেব বংশ, হরিকেলের দেব রাজবংশ, চন্দ্র বংশ বর্ম বংশ, শুর আর কররানী বংশ আরো আরো কত কত নাম ভেসে আসছে স্মৃতির পর্দায়। এরাই তো হাজার হাজার বছর ধরে শাষন করেছে এ দেশের জনগণকে।

এসব রাজবংশ আর পরিবারতন্ত্রই তো আবহমান কাল থেকে আমাদের দেশের রাজনীতি, সমাজনীতি এমনকি ধর্মবোধ পর্যন্ত নিয়ন্ত্রন করেছে। এদের প্রভাব এবং প্রতিপত্তি আমাদের রক্তের ভিতরে এমনভাবে ডালপালা শুদ্ধ শেকড় গেড়ে বসেছে যে আমরাও এদের শাষনে অভ্যস্ত এবং স্বাচ্ছন্দ বোধ করে থাকি। রাজতন্ত্র বা পরিবারতন্ত্রের প্রতি আমাদের অকুন্ঠ সমর্থনের এই রক্তসঞ্জাত কারণ তাই সহজাত এবং স্বাভাবিক।

দ্বিতীয়তঃ আদিম কাল থেকে আমাদের দেশের শাষন পদ্ধতি মূলতঃ স্বৈরতান্ত্রিক। বর্তমানেও তার কোন ব্যতিক্রম হয়েছে বলে মনে হয়না। সেনা ছাউনি থেকে যে সব একনায়কেরা এসেছিলেন তাদের একনায়ক সুলভ শাষনের সাথে গণতন্ত্রের লেবাস পরা স্বৈরশাষকদের খুব বেশী একটা তফাৎ নেই।গণতন্ত্রের লেবাস পরা স্বৈরতন্ত্র বরং আরো বিভীষণ। এ ধরণের স্বৈর শাষকেরা প্রত্যেকে চাটুকার, তোষামদকারী আর একান্ত নিজস্ব বলয়ের লোকজনদের দ্বারা পরিবৃত হয়ে থাকেন। এবং ঐ সমস্ত ব্যক্তিবর্গের দ্বারা প্রভাবিত হন। ফলে একনায়কসুলভ সিদ্ধান্ত দ্বারা দল, দেশ এমনকি জাতিও পরিচালিত হয়। এরা কারো কাছে তাদের কর্মকাণ্ডের জবাবদিহি করতে পছন্দ করেন না । তাই দেখা যায় গণতন্ত্রের সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী দেশ এবং জাতির জন্য প্রযোজ্য কোন গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি বা সিদ্ধান্ত যা জনসমক্ষে আলোচনা হওয়া উচিত তা না করে এমনকি সংসদ বা মন্ত্রীসভায় পর্যন্ত আলোচনা না করে দু একজন পছন্দসই ব্যক্তিবর্গের সহায়তায় চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবার চেষ্টা করা হয় । তাতে দেশ এবং জাতি চুলোয় গেলেও তাদের কোন যায় আশে না।এ রকম দৃষ্টান্ত আমরা নিকট অতীতেই দেখেছি। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে বরং বিরাগভাজন হতে হয় তাই এহেন স্বৈরশাষকদের পদলেহন ছাড়া দল বা সরকার বা রাষ্ট্রের কোন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে নিয়োগ পাওয়া বা নিজের উজ্জল অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা কি আদৌ সম্ভব ?

তাই আমাদের দেশে যারা রাজনীতি করেন অন্ততঃ উচ্চপর্যায়ে, তাদের রাজনীতির মূল মন্ত্রই হচ্ছে পদলেহন করা। এরা মানুষের কল্যাণের রাজনীতির কথা আর চিন্তা করতে পারেন না , কারণ তা করতে গেলে নিজেদের অস্তিত্ব নিয়ে টানা টানি পড়ে । অনেক তা-বড় তা-বড় নেতা এই পথে চলতে না পেরে তাদের অস্তিত্ব হারিয়েছেন। মূল স্রোতধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অন্ধকার চোরাবালির মধ্যে ঘুরপাক খেয়ে মরেছেন। এরা এখন এতো অপাংক্তেয় যে এদের খোঁজও আর কেউ রাখেননা। সবাই এদেরকে ভুলেই গেছেন। মাঝে মাঝে চ্যানেলগুলোর টকশোতে টক ঢেকুর উদগীরণের জন্য এদের ডাকা হলে তখন নতুন প্রজন্মের সচেতন কারো মনে হয় ‘আরে ইনিতো বিরাট জাঁদরেল নেতা ছিলেন!’

তাই এহেন পরিণতির কবল থেকে বাঁচতে চলে নির্লজ্জ চাটুকারিতা। রাজণীতি গৌণ হয়ে যায়, রাজতোষন হয়ে ওঠে ধ্যান জ্ঞ্যান এবং মুখ্য কর্ম। আর স্বৈরশাষকদের মন পাবার সবচেয়ে ভালো বুদ্ধি হলো তাদের ঔরষজাত বা গর্ভজাত সন্তানদের নামে জয়ধ্বজা তুলে ধরা। হোক তারা অপরিশীলিত, অশিক্ষিত, চরম দুর্ণীতিপরায়ন বা শেকড়বিচ্ছিন্ন অপরিপক্ক মাকালফল, তাদের একমাত্র যোগ্যতা তারা রাজপুত্র,তাই ক্ষমতা, মসনদ আর অর্থলিপ্সু চরিত্রহীণ নেতাদের তাদের মাতৃদেবদের কাছে গিয়ে বোংগারিং করে বলতে হয়-‘ আপনি ভালো আপনার মলও ভালো।’

উপসংহারঃ
কাজেই মনে হচ্ছে জনগণ আরো বেশী স্বশিক্ষিত হয়ে না উঠলে বাংলাদেশে পরিবারতন্ত্র আছে এবং পরিবারতন্ত্র থাকবে। এটাকে মেনে না নিলে সাধারণ জনগণের স্বত:র্স্ফুত অংশগ্রহণে এর বিরুদ্ধে সুস্থ এবং গণতান্ত্রিক প্রতিবাদ গড়ে তোলার দায়ীত্ব এখন জাতির সকল সচেতন ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানের ।

কারণ এই পরিবারতন্ত্রের কারণেই সপরিবারে প্রাণ দিতে হয় হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ , বাঙালী জাতির জণক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে !

এই পরিবারতন্ত্রের কারণেই বারবার এ দেশে ধর্ষিত হয় গণতন্ত্র আর নেমে আসে সামরিক শাসনের দুঃসহ কাল!

এই পরিবারতন্ত্রের কারণেই লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা বারবার বিপন্নপ্রায় হয়ে পড়ে ! মানচিত্রের উপরে ছায়া দেখা যায় অশুভ শকুনের।

এই পরিবারতন্ত্রের কারণেই নেমে আসে ওয়ান ইলেভেন আর তৈরী হয় মাইনাস টু ফর্মুলা ! দুখি মানুষের পাশে দাঁড়ানো ,স্বজন হারানো পারুল বোনদের হত্যা আর নির্বাসনে পাঠানোর ষড়যন্ত্র করা হয় !

তাই পরিবারতন্ত্র থাকবে কিনা , থাকলে কিভাবে থাকবে মানুষকে আজ তার সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এই মুহুর্তে এটাই জাতির সবচেয়ে জরুরী কাজগুলোর একটা। কারণ জাতির জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পালাবদল গুলো সংঘটিত হয়েছে পরিবারতন্ত্রের কারণে। তা নাহলে ইতিহাস হয়তো তার পূনরাবৃত্তি করবে। ম্যালথাসের অমোঘ তত্ত্বে দেখা যায় নিয়ন্ত্রনের ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও মানুষ যদি নিয়ন্ত্রন না করে তাহলে নেমে আসে প্রকৃতির নিরোধ । আর তা মানুষের জন্য নিয়ে আসে তাণ্ডব আর ধ্বংস।
ইতিহাস তার পুনরাবৃত্তি করবে কিনা তা কালই বলে দেবে তবে এবার এ রকম কিছু হলে তাতে দেশ, জাতি ,কোটি কোটি সাধারণ জনগণ, স্বাধীনতা , এমনকি রাষ্ট্র কতটা ক্ষতিগ্রস্থ হবে তা নিয়ে ভীষণ শংকা,বোধ হয়। তাই বলছিলাম এই আলোচনা আসলে আইসবার্গের চুড়ো, এ নিয়ে আরো আলোচনা হওয়া দরকার তাহলে হয়তো আইসবার্গটাকে গোটা দেখতে পাওয়া যাবে। দেশ জনগণ এবং জাতির স্বার্থে এই মুহুর্তে যা একান্ত প্রয়োজন। আগামী দিনের ইতিহাস তাহলে হয়তো আরো একটি রক্তøাত উষার আগমনী বার্তা শোনাতে ব্যর্থ হবে।
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

প্রজাতির শেষ জীবিত প্রাণ !

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৩ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৫১



বিবিসির একটা খবর চোখে এল সেদিন । উত্তরাঞ্চলীয় সাদা গন্ডার প্রজাতির শেষ পুরুষ গন্ডারটি মারা গেছে । তার নাম ছিল সুদান । মৃত্যুর সময় তার বয়স ৪৫। বিবিসির সংবাদটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশে সবচেয়ে ক্রিয়েটিভ এবং পরিমার্জিত কনটেন্ট ক্রিয়েটর মধ্যে সে একজন ।।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ১৩ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৯



আপনারা কতজন Umma Kulsum Popi চেনেন, আমি ঠিক জানি না। আমার পর্যবেক্ষণ মতে, বাংলাদেশে সবচেয়ে ক্রিয়েটিভ এবং পরিমার্জিত কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের একজন হলেন উনি। যদি বলি দেশের সেরা পাঁচজন কনটেন্ট... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদিস অস্বীকার করে রাসূলের (সা.) আনুগত্য সম্ভব

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৩ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সূরাঃ ৪ নিসা, ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ-
৫৯। হে মুমিনগণ! যদি তোমরা আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাস কর তবে তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর, আর আনুগত্য কর রাসুলের, আর যারা তোমাদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

=কবিতাগুলো যেনো এক একটি মধুমঞ্জুরী ফুল=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৩ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:২০



©কাজী ফাতেমা ছবি
মনের মাধুরী মিশিয়ে যে কবিতা লিখি
কবিতাগুলো যেনো আমার এক একটি মঞ্জুরী লতা ফুল,
মনের ডালে ডালে রঙবাহারী রূপ নিয়ে
ঝুলে থাকে কবিতা দিবানিশি
যে কবিতার সাথে নিত্য বাস,
তাদের আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

পোষ্টে যদি ক্রমাগতভাবে ০ কিংবা ২/১'টি মন্তব্য পেতে থাকে, বুঝবেন যে, সোনাগাজী সেমি-ব্যানে আছে!

লিখেছেন সোনাগাজী, ১৩ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:২৭



আপনার পোষ্ট যদি ক্রমাগতভাবে ০ কিংবা ১'টি মন্তব্য পেতে থাকে, তখন খোঁজ নিলে দেখবেন যে, সোনাগাজী সেমি-ব্যানে আছে!

কোন বিষয়ের উপর অনেক মানসম্পন্ন পোষ্ট লিখলেও সামুতে আপনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×