somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কানাডায় ৭০ দিন - ১৩ তম পর্ব

০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০১২ সকাল ১০:২৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমার বাবা (তারেক-উল আলম) গত বছর কেনাডা বেড়াতে এসেছিলেন। কেনাডা থেকে দেশে ফিরে একটা বই লিখেছেন – ‘কানাডায় ৭০ দিন’। আজ পড়ুন এর ১৩ তম পর্বঃ

নায়াগ্রা জলপ্রপ্রাত

আজ ১ জুলাই, কানাডার জাতীয় দিবস বা কানাডা ডে ! আমাদের সফর সূচির তালিকায় আজ নায়াগ্রা জল প্রপ্রাত দেখতে যাওয়া--পৃথিবীর সুন্দরতম মোহনীয় জল প্রপ্রাত!

বেলা ১১ টায় আমরা বাসা থেকে যাত্রা শুরু করি। এফ প্রিমিও, আনকোরা নতুন গাড়ি, রেন্ট- এ- কার থেকে নেয়া। গাড়ি চালাবে নিশু, ওয়েস্টার্ন ইউনিভাসিটিতে মার্স্টাস করছে। শুভর একান্ত স্নেহ ভাজন। আর আছে শুভর ঘনিষ্ঠ আদনান। সেও ওয়েস্টার্নে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন করছে। গাড়ির পেছনের সিটে আমরা ৩ জন, শুভ, লতা আর আমি। গাড়ি নায়াগ্রার পথে চলতে শুরু করলো।

দুপুর ১টায় আমরা হ্যামিলটন শহরে পৌঁছলাম। চমৎকার সুন্দর শহর। ডাউন টাউন অর্থাৎ শহরের কেন্দ্রস্থলে বড় বড় সু-বৃহৎ দালান কোঠা। পরিকল্পিতভাবে তৈরি সুন্দর শহর। ছবির মতো দেখতে সব কিছু। চট্টগ্রামের মতো অনেকটা পাহাড়ী এলাকায় এই শহর। পাশ দিয়ে চলে গেছে অপূর্ব সুন্দর অন্টারিও লেক !

হ্যামিলটন শহরের লোক সংখ্যা লন্ডন শহরের চেয়েও বেশি, প্রায় ৫,০৫,০০০। কিন্তু আয়তন ও পরিধিতে লন্ডনের প্রায় অর্ধেক। লোক সংখ্যা ঘনত্বের কারণ হ্যামিলটন শহরের অবস্থান লন্ডন এবং টরন্টো শহরের প্রায় মাঝামাঝি। এখান থেকে টরন্টো যেতে ৪৫ মিনিট লাগে। অনেকে হ্যামিলটন থেকে টরন্টো গিয়ে অফিস করে।

হ্যামিলটন শহরের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ এর বিখ্যাত ম্যাক মাস্টার ইউনিভার্সিটি, কানাডার অন্যতম বৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি। হ্যামিলটনের বৃহৎ অংশ জুড়ে রয়েছে এর পরিধি। বড় বড় অফিস বিল্ডিং, ডিপার্টমেন্ট, লাইব্রেরি, গবেষণাগার। বড় বড় গাছ গাছালিতে ভরা ক্যাম্পাস। দেশ-বিদেশের প্রচুর ছাত্র-ছাত্রী এখানে পড়াশোনা করছে। বাংলাদেশের অনেক শিক্ষার্থী শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে এখানে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করছে।

আমরা অল্প কিছু সময় ছিলাম হ্যামিলটনে। আসলে হ্যামিলটন শহরের উপর দিয়েই নায়াগ্রা বা টরন্টো যেতে হয়। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গেলাম। ছুটির দিন। তাই কোলাহলমুক্ত ক্যাম্পাস। দুই চারজন শিক্ষার্থী দেখা গেলো। কানাডা ডে সহ তিন দিনের ছুটি পেয়ে সবাই আনন্দ করতে চলে গেছে দূরে কোথাও। এতো লম্বা ছুটিতে এখানে খুব কম লোকই ঘরে থাকে !

আমরা দুপুরের লাঞ্চ সারলাম ক্যাম্পাসের একটি গার্ডেনে। চারদিকে ভার্সিটির অফিস বিল্ডিং, ডিপার্টমেন্ট- মাঝখানটায় চমৎকার বাগান। বসে সময় কাটানোর জন্যে অথবা খাওয়া দাওয়া করার জন্যে গাছের নিচে চেয়ার টেবিল পাতা। মনে হলো আমাদের লাঞ্চ খাওয়ার জন্যে একটু আগেই কেউ যেনো এই চেয়ার টেবিল বসিয়ে দিয়েছে। টেবিলের পাশে ম্যাপলট্রি ছায়া বিস্তার করে দাঁড়িয়ে। নিরিবিলি শান্ত পরিবেশ। কাছে ধারে কোন লোক জন নেই। বাগানের চারদিকে নানা রকমের ফুল ফুটে আছে। কি অপূর্ব দৃশ্য ! এমনি এক চমৎকার পরিবেশে আমরা পাঁচজন লাঞ্চ খেতে বসলাম ! বাসা থেকে আদনান মুরগি-বিরানী নিয়ে এসেছিলো। আমরা গাছের ছায়ায় বসে পরম তৃপ্তি নিয়ে খেলাম আদনানের স্ত্রীর রান্না করা বিরানী ! চমৎকার রান্না!

ইতিমধ্যে নিশুর ঘনিষ্ঠ এক বন্ধু ম্যাক মাস্টার ইউনিভার্সিটির ছাত্র ধ্র“ব ফোনে খবর পেয়ে ক্যাম্পাসে এলো আমাদের সাথে দেখা করতে। সে যন্ত্র কৌশলের স্নাতকোত্তরের ছাত্র। কিছুক্ষণ শহরে ঘুরে আমরা পুনরায় যাত্রা শুরু করলাম নায়াগ্রার পথে।

অন্টারিও লেকের পাশ দিয়ে গাড়ি চলছে। বিশাল লেক। এখান থেকে লেক চলে গেছে টরন্টো শহরে। পুরো অন্টারিও ঘিরে রয়েছে বিশাল বিশাল লেক। আর অন্টারিও লেক বিভিন্ন শহর উপ- শহরের মধ্য দিয়ে চলে গেছে আমেরিকার নিউইয়র্ক রাজ্যের সীমান্তে।

লেকের বিশাল ব্রীজ পার হয়ে আমরা নায়াগ্রার পথে ছুটছি। গাড়ির গতি ঘন্টায় ১২০- ১৩০ কিঃ মিঃ। জিপিএস গাড়িকে পথ নির্দেশনা দিচ্ছে। কিছু পরেই আমরা টের পেলাম গাড়ি ভুল পথে যাচ্ছে এবং ঠিক আমাদের গন্তব্যের উল্টো পথে। গাড়ি যাচ্ছে টরন্টোর দিকে আর নিশু (গাড়ি চালক) বলছে জিপিএসের নির্দেশ মতো সে ঠিক পথেই যাচ্ছে। নিশুর সাথে কথা বেশি না বাড়িয়ে আমরা চুপচাপ বসে থাকলাম। কিছুক্ষনের মধ্যে নিশুও টের পেলো সে ভুল পথে যাচ্ছে। কিন্তু হাইওয়ে রোড, পার্কিং ছাড়া গাড়ি থামানো যায় না। পার্কিং খুঁজতে খুঁজতে গাড়ি অন্টারিও লেকের পাশ দিয়ে টরন্টো শহরে এবং এক্কেবারে ডাউন টাউনে !

নিশু জিপিএস দিতে ভুল করেছে। যেখানে দেয়ার কথা ‘নায়াগ্রা ফলস অন্টারিও’ সেখানে দিয়েছে ‘নায়াগ্রা ফলস টরন্টো’। টরন্টোতে নায়াগ্রা ফলসের একটি যাদুঘর আছে, জিপিএস সেই ঠিকানাতেই নিয়ে এসেছে গাড়ি। এই একটি ভুলের জন্যে আমরা একশো কিলোমিটার উল্টো এসে গেছি ! কি আর করা ! আমরা টরন্টো শহরের ডাউন টাউনে ঘোরাঘুরি শুরু করলাম।

টরন্টো শহরের প্রাণকেন্দ্রে আমরা ঘুরছি। কিন্তু আমাদের উদ্দেশ্য ঘোরা নয়-গাড়ি ঘোরানো, গাড়ি পার্কিং করা ! কিন্তু কোথায় পার্কিং ? কিভাবে গাড়ি পার্কিং হবে, কোথায় পার্কিং করবে ! প্রতিটি পার্কিং গাড়িতে পূর্ণ। কোথাও তিল ধারণে ঠাঁই নেই। আজ কানাডা ডে বলে সবাই গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছে। তাই পার্কিং না পেয়ে আমাদেরও ঘুরতে হচ্ছে টরন্টোর ডাউন টাউনে!

সু-উচ্চ ভবন, বিশাল বিশাল রোড। গাড়ি এদিক আসছে ওদিক ছুটছে। এতো গাড়ি, এতো মানুষ ! আর কতো রকমের মানুষ--সাদা কালো, শ্যামলা পীত ! মনে হয়, পৃথিবীর সব মানুষ আজ এখানে একত্রিত কি এক মহাযজ্ঞের মহোৎসবে !

টরন্টো শহর বিশ্বের হাতে গোনা চার পাঁচটি বৃহৎ শহরের একটি। সুন্দর সাজানো গোছানো পরিপাটি। আমাদের সম্মুখে এখন সব ৪০-৫০ তলার উঁচু উঁচু দালান। সি এন টাওয়ার, বর্তমানে পৃথিবীর ৩য় সর্বোচ্চ টাওয়ার যার সামনে এখন আমরা ! রজার্স সেন্টার, বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ সর্বাধুনিক সিনেমা এবং থিয়েটার হল যা আমাদের সম্মুখেই ! আমরা সবিস্ময়ে দেখছি বিশ্বের আধুনিকতম সব নির্মাণশৈলি--আধুনিকতম সুন্দর শহর !

আজ কানাডা ডে- কানাডার জাতীয় দিবস। তাই মানুষ ঘর ছেড়ে বেরিয়েছে আনন্দ করতে। যারা শহরের বাইরে যায়নি তারা এই এলাকায় এসে ভীড় করছে ! এটাই যে টরন্টোর প্রাণকেন্দ্র ! মানুষ সিনেমা দেখবে, নাটক দেখবে, সিএন টাওয়ারে উঠবে,অন্টারিও লেকে ঘুরবে, রেষ্টুরেন্টে খাবে। তাদের কতো প্রোগ্রাম আজ! চাইনিজ, ভারতীয়, ল্যাটিন, আফ্রিকান, ইউরোপিয়ান--কতো দেশের কতো রকমের মানুষ সব মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে। ক্যাফে, রেস্তোরাঁ কোথাও তিল ধারণের ঠাঁই নেই। গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গা নেই, সব বুক হয়ে গেছে আগেই। হঠাৎ মনে হবে ঢাকার গুলিস্তান বুঝি! কিন্তু না সব সুশৃংখল ! মানুষ হাঁটছে ফুটপাত দিয়ে, গাড়ি ছুটছে রাস্তায়। সব কিছুই চলছে সুন্দরভাবে শৃংখলার সাথে। এই দৃশ্য শুধু আজকের জন্যে--কানাডা ডে বলেই। অন্য সময় এই ভীড় থাকে না।

আমাদের গাড়ি এখনো কোন পার্কিং পেলো না। পার্কিং ছাড়া গাড়ি কোথাও দাঁড়াতে পারবে না,ঘুরাতে পারবেনা। আমরা এ রাস্তা ও রাস্তা কেবল ঘুরছিই ! এভাবে ঘন্টা খানেক আমরা কেবল ডাউন টাউনেই ঘুরলাম। কিন্তু আমাদের উদ্দেশ্য তো নায়াগ্রা। আমরা তো নায়াগ্রা জলপ্রপাত দেখতেই বেরিয়েছি। জিপিএসের ভুলের কারণে আমরা এখন টরন্টোতে। অবশ্য টরন্টো দেখাও একটা দুর্লভ সৌভাগ্য। তবে টরন্টো দেখতে তো আমরা পরে আসছিই। তাই আমাদের ভাবনা এখন কেবল নায়াগ্রা ফলস !

ডলিরা ইতিমধ্যে পৌঁছে গেছে নায়াগ্রায় ! তারা গেছে নায়াগ্রা থেকে আমাদের আনতে ! এতোক্ষণে তারা নায়াগ্রায় গাড়ি পার্কিং করছে ! তারা নায়াগ্রা গেছে টরন্টো থেকে। নায়াগ্রা জলপ্রপাত এবং রাতে ফায়ার ওয়ার্কস দেখবে। আসার পথে আমাদের নিয়ে ফিরবে ব্রেমটনে। আমরা ক’দিন তাদের ওখানে বেড়াবো। মূলতঃ আমাদের আনার জন্যেই তাদের নায়াগ্রা যাওয়া। আমাদের বোকামির খবর শুনে তারা আমোদিত !

অবশেষে এক ইন্ডিয়ান টেক্সী ড্রাইভারের সহযোগিতায় আমরা এক পার্কিংয়ের মুখ থেকে গাড়ি ঘোরাতে পারলাম এবং নায়াগ্রা ফলসে যাওয়ার দিক নির্দেশনা নিলাম। সে আমাদের জানিয়ে দিলো নায়াগ্রার পথে অসম্ভব ভিড়। নায়াগ্রা পৌঁছতে অনেক সময় লেগে যাবে। কি আর করা ! আমরা হতদ্যোম না হয়ে রওনা দিলাম।

পথে ‘টিমর্হটন’ রেস্টুরেন্টে আমাদের যাত্রা বিরতি। আমরা ওয়াসরুমের কাজ সেরে ফ্রেশ হয়ে এলাম। কফি পান করলাম। জিপিএস ঠিক করে আবার নায়াগ্রার পথে ছুটলাম। নায়াগ্রার পথে গাড়ির মিছিল। সব পথের, সব গাড়ির লক্ষ্য এখন নায়াগ্রা – All Roads lead to Niagara !

কানাডা এসে এতো গাড়ির জট আর দেখিনি। শত শত গাড়ি ছুটছে নায়াগ্রার পথে। একটির পিঠে অন্যটি ! রাস্তার এক দিকেই ৫-৬টি রো ! সব রো-তেই গাড়ি সমান তালে ছুটছে। মাঝে মাঝে ওভারটেক করতে গিয়ে যানযট হয়ে যাচ্ছে কিছুক্ষণের জন্যে। কিন্তু থেমে পড়ছেনা কোন গাড়ি। চলছে ধীরে ধীরে, আবার হঠাৎ দ্রুত বেগে। অবশেষে আমরা নায়াগ্রা পৌঁছলাম বিকেল ৭টায়। ফলস্ থেকে মাইল খানেক দূরে গাড়ি পার্কিং করে আমরা পায়ে হেঁটে ফলসে পৌঁছলাম।

নায়াগ্রা জলপ্রপাত! এতোদিন কেবল বইতে পড়েছি, লোক মুখে শুনেছি, ছবিতে দেখেছি আর কল্পনা করেছি এর অপরূপ রূপলাবন্যের দৃশ্য ! এখন বাস্তবে সত্যি সত্যি এর মুখোমুখি! এতোদিনের কল্পনা, স্বপ্ন যে এভাবে ধরা দেবে-নিজকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় !

নায়াগ্রা জলপ্রপাত পৃথিবীর ৮ম আশ্চর্যের একটি। ১৮০ ফুট উচ্চতা থেকে ইরি লেকের পানি দ্রুতলয়ে সশব্দে গড়িয়ে পড়ছে নায়াগ্রা নদে। প্রায় তিন হাজার ফুট জায়গা নিয়ে এর ব্যাপ্তি ! মনে হচ্ছে বুকের জমাট বাঁধা ক্ষোভ যন্ত্রনা হাল্কা করতে বুকফাটা আর্তনাদে ইরি এবং ব্রাইডেলভেল তাদের দু’ চোখের অশ্র“ধারায় ভাসিয়ে দিচ্ছে নায়াগ্রা নদ। কি তার ক্ষোভ, কিসের জন্যে তাদের এই যন্ত্রনা ! সেই কান্নার যন্ত্রনা আমরা দূর থেকে শুনতে পাই, কাছে গিয়ে দেখতে চাই সেই কান্নার উৎস ! কিন্তু চির রহস্যময়ীর রহস্য কেউ উদঘাটন করতে পারেনা ! মানুষ সহমর্মিতা নিয়ে সহানুভূতি জানাতে কাছে আসে, তাদের যন্ত্রনা বিধূর সৌন্দর্য দেখে মানুষের হৃদয় এক ব্যথাতুর আনন্দে ভরে ওঠে।

ছোট ছোট জলকনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাচ্ছে বহুদূর পর্যন্ত। মনে হয় ঝিরিঝিরি বৃষ্টি! ইউএস এর ওপার থেকে ব্রাইডেলভেল ও আমরেকিান ফলসরে এবং কানাডার র্হস সু’র পানির কনা নায়াগ্রা নদে পড়ে এপারে যারা দাঁড়িয়ে ফলসের শোভা দেখছে মুগ্ধতা নিয়ে তাদের ভিজিয়ে দিচ্ছে। ছাতা বা রেইন কোট গায়ে অনেকে। আর যারা রেইন কোট ছাড়া তারা ভিজে একাকার। তবুও নিকটে না থেকে পারা যায় না কি এক দুর্নিবার আকর্ষনে !

লেকের পাড়ের রেলিং ধরে মানুষ অবাক বিস্ময়ে দেখছে এর মোহনীয়রূপ। কি অপূর্ব দৃশ্য ! মানুষ স্বপ্নাতুর হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় নিজেকে ‘হারিয়ে যেতে নেই মানা’ ! দু’চোখ ভরে এর ভূবনকাড়া রূপ উপভোগ করা যায় কিন্তু এর সৌন্দর্যের গভীরতা এবং বিশালতা পরিমাপ করা যায়না। এর স্বপ্নময় সৌন্দর্য দর্শনের আনন্দে কিছুক্ষনের জন্যে জাগতিক সব কিছু ভুলে গেলাম যেনো ! উপভোগের আনন্দে খেয়াল নেই কখন যে সমস্ত শরীর কাকভেজা হয়ে গেছে। ‘আব্বু চলে এসো, ঠান্ডা লাগবে’--শুভর উদ্বিগ্ন কন্ঠে চমকে উঠলাম। ফিরে দেখি শুভ তার মাকে নিরাপদ দূরত্বে রেখে আমাকে ডাকছে ! রুমাল বের করে মাথা মুছে নিলাম।

ছবি তুলছে শুভ। ছবি নিচ্ছে হাজার দর্শনার্থী। দূরদূরান্ত থেকে এসেছে তারা শুধু প্রপাতের সৌন্দর্য উপভোগ করতে। কেবল হৃদয়ের মনি কোঠায় নয়, ভিজ্যুয়ালি দেখবে। পরিচিত দুই একজনের সাথে দেখা যাদের সাথে লন্ডনে স্বল্প দিনের পরিচয়। কতো হাজার লোকের সমাবেশ, কতো হাজার জাতির মানুষ-সুন্দর ও ভালো লাগার স্থান তো এক ! কানাডায় এলো নায়াগ্রা ফল্স দেখলোনা--এমন লোক খুব কমই মিলবে। নায়াগ্রা ফল্স আনন্দ পিপাসুদের তীর্থক্ষেত্র। প্রতি বছর প্রায় ৩০ লাখ বি্দেশী র্পযটক আনন্দ পিপাসু মানুষ নায়াগ্রা ফল্সে আসে হৃদয়ের ক্ষুধা মেটাতে !

বিকেল ৭টা পর্যন্ত ‘মেড অব দ্য মিস্ট’ জাহাজে করে প্রপাতের একেবারে সন্নিকটে যাওয়া যায়। আমরা দেরিতে ফলসে পৌঁছানোয় আজ আর সেই সুযোগ পাওয়া গেলো না। সন্ধ্যা হয়ে গেছে বলে টানেল পথেও যাওয়া হলো না। তবুও উপর থেকে যা দেখা যায়। ইউএস এর বাফেলো থেকে আমেরিকান দর্শনার্থীরা দেখছে প্রপাতের সৌন্দর্য। নিজ অংশের প্রপাত তারা পুরোপুরি দেখতে পায়না, পারেনা এর সৌন্দর্য পুরোপুরি উপভোগ করতে। অনেকেই এপারে কানাডায় এসে দেখে। কানাডার দিক থেকে পুরো লেকের সৌন্দর্য, পুরো প্রপাতের সৌন্দর্য দেখা যায়, উপভোগ করা যায়। দুই দেশের একটা অপূর্ব সুন্দর মিলন ক্ষেত্র নায়াগ্রা ফলস !
সপ্ত বর্নের রং ধনু মোহনীয় জলকনার অপূর্ব খেলা ! সূর্যের আলো প্রপাতের জলকনায় পড়ে কি মোহনীয় রংধনুর সৃষ্টি ! এই অপূর্ব নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখতে দেখতে কখন যে সন্ধ্যা হয়ে গেলো খেয়াল করিনি, কেউ খেয়াল করেনি। ‘দুলা ভাই, সন্ধ্যা হয়ে গেছে, চলেন গাড়িতে যাই’--ফিরে দেখি আমার শ্যালিকা ডলি কখন কাছে এসে দাঁড়িয়ে ! আমি যেনো কোন এক স্বপ্ন রাজ্যে ! সম্বিত ফিরে পেয়ে বললাম, কখন এলে ? ‘অনেক ক্ষন। চলেন এবার গাড়িতে ফেরা যাক’। আমরা গাড়ি পার্কিংয়ের দিকে চললাম।

ডলি পুরো পরিবার নিয়ে এসেছে আমাদের নিয়ে যেতে--দু’টো গাড়ি নিয়ে। পরিবারের সদস্যরা তো আছেই, আছে আত্মীয়ের দুই কন্যা, আল-আইন থেকে বেড়াতে আসা তাদের ফিলিস্তিনি বন্ধু সুশান এবং তার ১৭ বছরের ছেলে আহমেদ। ডলি থাকে বৃহত্তর টরন্টোর ব্রেমটন শহরের অরেন্ডা কোর্টে। গাড়িতে খাবার রাখাই ছিলো। খেতে খেতে পরিচয় পর্ব শেষ হলো।

নায়াগ্রা ফলসের দ্বিতীয় আকর্ষণ আজকের ফায়ার ওয়ার্কস বা আতসবাজি। আজ কানাডা ডে। তাই কানাডার দূর দূরান্ত থেকে মানুষ এসেছে ফায়ার ওয়ার্কস বা আতসবাজি দেখতে। আমরা আজ একঢিলে দুইপাখি মারবো!

সন্ধ্যা ৯.১৫ মিনিটে শুরু হবে ফায়ার ওয়ার্কস-আতস বাজির খেলা ! এই উপভোগ্য দৃশ্য দেখার জন্যে সব লোকজন এসে হাজির হয়েছে নায়াগ্রা ফলসে। পাহাড়ের ঢালুতে, বড় বড় সব হোটেলের ব্যালকনিতে, ক্যাসিনো হোটেলে অর্থাৎ নায়াগ্রা ফলস যতো জায়গা থেকে দেখা যায় সর্বত্রই মানুষ স্থান করে নিয়েছে আতসবাজি দেখতে। নায়াগ্রা ফলসের আমেরিকান অংশেও তিল ধারণের জায়গা নেই। সবাই একত্রিত, সবাই উৎকন্ঠ অপেক্ষায়--কখন শুরু হবে।

পাহাড়ের উপর বসানো হয়েছে বড় বড় ফোকাস লাইট যার আলো লেকের উপর ফেলা হয়েছে। লাইটের মুখ লাল, হলুদ, সবুজ কাগজ দিয়ে মুড়িয়ে দেয়া। অন্য সব আলো নির্বাপিত। সৃষ্টি হয়েছে এক মায়াময় স্বপ্নময় মোহনীয় পরিবেশের।

ঠিক ৯.১৫ মিনিটে প্রথম আতস ছোঁড়া হলো লেকের নৌবহর ‘মেড অব দ্য মিস্ট’ থেকে। মানুষের উল্লাস ধ্বনির মধ্যে আতস আকাশ উদ্ভাসিত করে ছড়িয়ে পড়ল দিগন্তে, লেকের চতুর্দিকে। একের পর এক ফায়ার ওয়ার্কস চলতেই থাকলো। ভয়ে, আনন্দে মানুষ আত্মহারা। এক একটা ফায়ারের সাথে সাথে আকাশে ছড়িয়ে পড়া হাজার হাজার আলোর বর্ণ, আলোর বিচ্ছুরন, আলোর নাচন পুরো আকাশ কি যে এক মোহনীয়রূপ ধারণ করে তা ভাষায় বর্ণনা করার নয়, শুধু উপভোগ করার ! প্রতিটি ফায়ারের সাথে সাথে মানুষের গগন বিদারি চিৎকার-সেই চিৎকার, সেই ধ্বনি আনন্দের। ফায়ার ওয়ার্কের আলোর প্রতিফলন লেকের পানিতে কি এক মোহনীয় দৃশ্যের সৃষ্টি করে তা সচক্ষে না দেখলে বোঝানো যায়না যেমন বোঝানো যায় না ফলসের অপূর্ব রূপ সৌন্দর্য।

একটার পর একটা আতস ছোঁড়া হচ্ছে সাথে সাথে হাজার মানুষের আনন্দ চিৎকার ! ফায়ার ওয়ার্কের আলোয় আকাশ নানা রঙে রঙ্গীন। মুহূর্তে দিগন্তে ছড়িয়ে পড়া আলোর নৃত্য অপরূপ দৃশ্যের সৃষ্টি ! প্রাণ ভরে লক্ষ মানুষ সেই দৃশ্য উপভোগ করে, হারিয়ে যায় এক মোহনীয় আনন্দ সাগরে। মিনিট পনেরো পর এই আতসবাজির খেলা শেষ হয়। মানুষের স্বপ্ন ভাঙে, ফিরে আসে পৃথিবীর বাস্তবতায়।

এবার ফেরার পালা। সে আরেক যুদ্ধ। হাজার হাজার গাড়ি, লাখো মানুষ! নায়াগ্রা শহরের ধারণ ক্ষমতার কয়েকগুণ বেশি মানুষ। ঘন্টা দুই আপ্রাণ চেষ্টার পর আমরা প্রধান রাস্তায় উঠতে পারলাম। ডলি আমাদের নিয়ে রওনা দিলো টরন্টোর পথে আর শুভ আমাদের বিদায় দিয়ে ছুটে চললো লন্ডনের দিকে।

(ক্রমশ)
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০১২ সকাল ১০:৩৩
৪টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

লালনের বাংলাদেশ থেকে শফি হুজুরের বাংলাদেশ : কোথায় যাচ্ছি আমরা?

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৪



মেটাল গান আমার নিত্যসঙ্গী। সস্তা, ভ্যাপিড পপ মিউজিক কখনোই আমার কাপ অফ টি না। ক্রিয়েটর, ক্যানিবল কর্পস, ব্লাডবাথ, ডাইং ফিটাস, ভাইটাল রিমেইনস, ইনফ্যান্ট এনাইহিলেটর এর গানে তারা মৃত্যু, রাজনীতি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি! চুরি! সুপারি চুরি। স্মৃতি থেকে(১০)

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৪


সে অনেকদিন আগের কথা, আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। স্কুলে যাওয়ার সময় আব্বা ৩ টাকা দিতো। আসলে দিতো ৫ টাকা, আমরা ভাই বোন দুইজনে মিলে স্কুলে যেতাম। আপা আব্বার... ...বাকিটুকু পড়ুন

যেকোন বাংগালীর ইন্টারভিউর সময়, 'লাই-ডিটেক্টটর' যোগ করে ইন্টারভিউ নেয়ার দরকার।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৫ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০৭



আপনার এনলাকার এমপি, প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী কামাল সাহেব, যেকোন সেক্রেটারী, যেকোন মেয়র, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান, বিএনপি'র রিজভী, আওয়ামী লীগের ওয়ায়দুল কাদের, আপনার থানার ওসি, সীমান্তের একজন বিজিবি সদস্য, ঢাকার... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×