জাতি হিসেবে আমরা সবসময় সুগারকোটেট লেখা,মন্তব্য,বক্তব্য চালিয়ে খুব স্বস্তিতে থাকি।মনের কথাটা আমরা কখনো সরাসরি বলার সাহস দেখাই না।ব্যাতিক্রম যদিও আছে,তবুও এই ব্যাতিক্রমী মানুষের সংখ্যা হাতে গোনা।আমি আমার এই দুই সেকেন্ডের জীবনে সবসময় তাদেরকেই সম্মান দিয়ে এসেছি,কারন তারা সত্যটা মুখে আনার সাহস দেখিয়েছেন।আমি সবসময় বিশ্বাস করি,সত্য বলে দিলে মন শুদ্ধ থাকে।বাস্তব জীবনে আমার মতো মিথ্যাবাদী খুব কম থাকলেও অন্তর থেকে কখনো মিথ্যা বলিনাই আজ পর্যন্ত,তাই আজকে আমি ঠিক করেছি নিশিকন্যাদের নিয়ে ভাববো............
নিশিকন্যা,শব্দটার মধ্যে একটা কাব্যিক ভাব থাকলেও এই শব্দটার মধ্যে কতোটা কষ্ট,কতোটা ঘৃণা,যন্ত্রণা,অসহায়ত্ব আছে,সেটা একজন নিশিকন্যা ছাড়া কেউ কল্পনা করতে পারেনা।আমি একটা ব্যাপার খুব অবাক হয়েই খেয়াল করেছি,আমি যেই মানুষগুলোর লেখাকে ভক্তির পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছি,তাদের প্রায় সবাই নিশিকন্যাদের নিয়ে লিখে গেছেন।আমার সবচেয়ে প্রিয় লেখকদের মধ্যে একজন,মার্কেজের সবচেয়ে জনপ্রিয় উপন্যাস কিন্তু তাদের নিয়েই।অবশ্য মার্কেজ কিন্তু এইরকন কাব্যিক শব্দ দিয়ে তাদের ডাকেননি,তিনি সরাসরি লিখেছেন "মিয়ের্দা" ,যার সহজ বাংলা হচ্ছে বেশ্যা............
বেশ্যা,অনেক পরিচিত একটা গালি,তাইনা?কোন মেয়ের "চলন" খারাপ দেখলেই কিছু মানুষের মুখ দিয়ে এই শব্দটা এবং আরও কিছু সমার্থক শব্দ এসে পড়ে।বেশ্যা,শুনলেই চোখের সামনে ভাসতে থাকে "শরীর বেইচা খাওয়া" কিছু নারীর কথা,তাইনা?ভাবাটা অস্বাভাবিক না,আমাদেরকে ভাবতে শেখান হয়েছে এইভাবে,সমাজের পকেট ভর্তি প্রোপ্যাগান্ডাওয়ালা মানুষগুলোই আমাদের এই শিক্ষা দিয়েছে যদিও খেয়াল করলে তাদেরকেই দেখা যায় বেশ্যাদের সাথে দরদাম করতে,রেট একটু কমানোর চেষ্টা করতে।অথচ নিজের মনকে একবার জিগ্যেস করে দেখেন তো,বেশ্যা/নিশিকন্যা আসলে কারা?তারা কেন নিশিকন্যা নামের একটা মায়াময় শব্দ দখল করে রেখেছে?
বাবা মারা গেছে,কিন্তু প্রফিডেন্ট ফান্ডের টাকাগুলো তোলা যাচ্ছেনা।মা এখন চোখে ঠিক মতো দেখতে পারেনা,ঘরে তাই ভালো রান্নার আশা করা যাচ্ছেনা।ছোট ভাইটা প্রত্যেকদিন একজোড়া কেডস কেনার টাকা চাচ্ছে,কেডস ছাড়া তাকে পিটি ক্লাসে যেতে দেয়া হয়না।একটা মাত্র টিউশনি করে ভার্সিটি পড়ুয়া মেয়েটা,কিন্তু মাস শেষ সেই সামান্য টাকাটা পাওয়ার জন্য যেন যুদ্ধ করতে হয়।প্রত্যেকমাসে বাড়িওয়ালা ভাড়া নিতে আসার সময় কথা শুনিয়ে যাচ্ছে,কিন্তু যাওয়া আগে মেয়েটার পিঠে হাত বুলিয়ে যেতে ভুলছে না।অবশেষে মেয়েটা খুব ঠাণ্ডা মাথায় একটা সিদ্ধান্ত নেয়।একদিন বিকালে বিপত্নীক বাড়িওয়ালার ঘরে গিয়ে বাড়িওয়ালার সামনে দাড়ায়।তার পরের একঘণ্টা মেয়েটার চোখের প্রত্যেক ফোঁটা পানিতে লেখা ছিল,আমি নিশিকন্যা হতে চাইনি কখনোই..................
বাবা সামান্য দিনমজুর হিসেবে ক্ষেতে কাজ করে,মা গ্রামের অবস্থাসম্পন্ন বাড়িতে ছুটা কাজের বুয়া।এর মধ্যে ১৪-১৫ বছরের মেয়েটার দিকে এলাকার উঠতি বয়সের ছেলেরা নজর দিচ্ছে।এই সময় দূর সম্পর্কের এক চাচা এসে বাপের কানে কথা তুললো,মেয়েকে শহরের গার্মেন্টসে দিলে কোন চিন্তা থাকবে না আর।এর এক সপ্তাহ পরে মেয়েটা ঢাকার কোন এক তৃতীয় শ্রেণীর হোটেলে বিক্রি হয়ে গেলো।প্রথম দিকে সে অনেক কাঁদতো,কিন্তু এখন যখন তার শরীর খুবলে খাওয়া হয়,তখন কেউ তার চোখের দিকে তাকায় না।তাকালে স্পষ্ট দেখা যেতো,মৃত মানুষের চোখের একজন নিশিকন্যার উপর তারা ঝাঁপিয়ে পড়েছে.....................
এইরকম কেস স্টাডির সংখ্যা অসংখ্য,আমরা হয়তো জানিও না কতো লক্ষ পতিতা/দেহপসারিণী/বেশ্যা/নিশিকন্যারা এইরকম চোখ নিয়ে বেঁচে আছেন।জগতের প্রত্যেকটা নিশিকন্যা অসহায় হয়ে এই পথে এসেছেন,তাদের জোর করে এই পথে নিয়ে আসা হয়েছে,তাদের সেক্স স্লেভ বানানো হয়েছে।খোলাখুলিই বলছি,সেক্সুয়াল স্যাটিসফেকশনের জন্য আজ পর্যন্ত কোন নারী এই পথে আসেনি,এসেছে পেটের সারভাইভাল আর স্যাটিসফেকশনের জন্য।এটাকে দেহ ব্যাবসা বলা যায়না,এটা হচ্ছে সমাজের সকল ভাদ্র মাসের কুকুরের বানানো একটা জাহান্নাম..................
অনলাইন এবং অফলাইনে "সুশীল" জিনিসটার কোনই কমতি নাই।ত্যানা পেচানি লোক সবখানেই থাকে।এইরকম কোন লেখায় যদি কেউ এসে বলে,"তাহলে আমরা এদের পুনর্বাসনের কাজ করছি না কেন/বেশ্যারা কেন অন্য পেশায় যাচ্ছে না,নিশ্চয়ই তারাও মজা পেয়ে গেছে/আপনি জানেন ক্যামনে,আপনিও কি" টাইপ মন্তব্য করে,আমি অবাক হবো না।কারন নিশিকন্যার মতো একটা যন্ত্রণাদায়ক অনুভূতির নাম শুনলেই তাদের মনে টানবাজার,পুলক হোটেল,বনানি মাগিপাড়া নামের শব্দ গুলো লালার সাথে বেয়ে বেয়ে পড়তে থাকে........................
আমাদের এই সমাজে আমরা কখনো নিশিকন্যাদের কষ্ট বুঝতে পারিনি,কারন যাদের বোঝার দায়িত্ব,তারা কোনদিন নিশিকন্যাদের চোখ দেখেনাই।বরং তারা দেখেছে নিশিকন্যাদের ব্লাউজের বোতাম কোনটা ছেঁড়া আছে কিনা,বাসায় মা-বোন- বউদের সাথে এদের দেহের বিশেষ বিশেষ বাঁকের কোন পার্থক্য আছে কিনা।তারা শুধু নিশিকন্যাদের সেক্স মেশিন ভেবেছে,কখনো প্রেমিকা অথবা ভালোবাসার মানুষের নজরে দেখেনি।তারা কখনো তারা কখনো কলেজ পড়ুয়া কাজল দেয়া চোখের সেই মেয়েটির মনে ক্লাসের সবচেয়ে সুন্দর ছেলেটির জন্য অব্যাক্ত ভালোবাসাটা দেখেনি।তারা কখনো বিক্রি হয়ে যাওয়া সেই কিশোরী মেয়েটির বাবা-মায়ের কাছে যাওয়ার আকুলতাটুকু দেখেনি।দেখবেই বা কি করে,তাদের চোখ তো নিশিকন্যাদের খুবলে খাওয়ার নেশায় ইতিমধ্যেই আয়েশের চোটে বন্ধ হয়ে আসছে............
দুই নাম্বার কেসের মেয়েদের কথা আমি শুধু শুনেছি,কিন্তু এক নাম্বার ঘটনাটা মিথ্যা না-এটা আমার নিজের চোখে দেখা।একটা সময় ছিল যখন আমি মাগিদের মাগির নজরে দেখতাম,কিন্তু যেই মুহূর্তে আমি সেই চোখজোড়ার দিকে তাকিয়েছিলাম,আমার অস্তিত্ব পর্যন্ত কেঁপে উঠেছিল।এতোটা আবেগ কোন মানুষের চোখে থাকতে পারে?এতোটা আবেগ থাকার পরেও সেই চোখের ভাষা শুন্য হয় কিভাবে?শুধুমাত্র নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার জন্য রাতের অন্ধকারে একটা পরী নিজের দেহকে বিলিয়ে দিতো নরখাদকদের মাঝখানে,শুধু কয়েকটা কাগজের টুকরোর জন্য।অথচ আমি আমার সমস্তটুকু জ্ঞান দিয়ে চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি,এইরকম একটা পরীর মনে একটু জায়গা করে নেয়ার জন্য একিলিস এক হাজার ট্রয় ধ্বংস করতে পারতো,হেলেনের সৌন্দর্যটুকু ধুয়ে যেতো এইরকম একটা পরীর একফোঁটা চোখের পানিতে.....................
দিন শেষে দেহের তৃষ্ণাটাই বড় হয়ে যায় সেই নরখাদকের দলের কাছে।মামা চল লাগাইয়া আসি বলে তারা কিছু পরীর দেহ ভোগের নেশায় ছুটে।কিন্তু মনের তৃষ্ণা মিটাতে শুকনো মন নিয়ে আমরা কখনো এই পরীদের খোঁজে যাই না।যাবোই বা কেন?তারা যে বেশ্যা.........
জগতের সমস্ত নিশিকন্যাদের উৎসর্গ করলাম এই লেখা।আপনারা আমাকে কখনো সামনাসামনি দেখেননি,কিন্তু আপনাদের মধ্যে কারও একজোড়া চোখ দেখেছিলাম আমি।সেই নাম না জানা চোখ জোড়ার অধিকারী এক পরী আমাকে দিয়ে আজ লেখাটা লিখিয়ে গেছে.....................
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মে, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:২১

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



