এ শহরের অনেকেই কাকডাকা ভোরে ঘুম থেকে ওঠে না। ফলে বলা চলে দিনটা তখন শুরু হচ্ছে মাত্র। হঠাৎ চারিদিকে গোলাগুলির শব্দ। তথন অবশ্য পিলখানায় অনুষ্ঠান চলছে। তাই ফাবলিহা বুশরা ভেবেছিল এটা তারই অংশ হবে বোধহয়। ৯ম শ্রেণীর ছাত্রী বুশরা। মাত্র নাস্তা করতে বসছে তখনই ফোন বেঁজে উঠল। ফোন তুলতেই বাবার কণ্ঠ। বাবা তৎকালীন বিডিআর হাসপাতালের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ লেফটেন্যান্ট কর্নেল লুৎফর রহমান খান।
ফোন তুলতেই বাবা বুশরাকে বললেন, তোমার আম্মুকে দাও। তোমার আম্মুর সঙ্গে কথা বলবো। এরপর বুশরারা জানতে পারল, কি হতে চলেছে এখানে।
কিছুক্ষণ পরেই বেশি গোলাগুলি শুরু হয়ে গেল। বুশরারা চারতলায় থাকে। একটা বুলেট এসে তাদের জানালার রডটা বেকে ঘরে ঢুকে গেল। ভয়ে জড়সড় হয়ে গেল সবাই। এই বুঝি আরও কোন বুলেট এসে বুকটা ঝাঝরা করে দেয়।
আজ যেন পিলখানায় অনেক বেশি সৈনিক। তাদের কারও মুখে কাপড় বাঁধা, কারও মাস্ক পরা। দুজন সৈনিক এসে বুশরাদের ঘর থেকে বের করে নিয়ে যায়। এ সময় একজন সৈনিক এসে বুশরার মায়ের বুকে বন্দুক ধরে বলে- ‘তুই শেষ, তুই শেষ। তোর জামাই কে? তোর জামাইতো শেষ।’ মৃত্যু যেন তদের খুব কাছে। নিজে বাঁচি বা না বাঁচি সন্তানদের বাঁচাতে চান মা। তাইত এক হাতে বুশরাকে, অন্য হাতে বুশরার ছোট ভাইকে শক্ত করে ধরে রাখেন মা।
এরপর বুশরাদের নিয়ে যাওয়া হয় কোয়ার্টার গার্ড। সেখানে আগে পুরাতন ডিজি কোয়ার্টার থেকে কিছু ফ্যামিলি নিয়ে আসা হয়েছিল। এরপর লাইন ধরে ধরে রুমটার মধ্যে সবাইকে ঢুকানো হয়।
একটা রুমে ৭০/৮০ জনকে গাদাগাদি করে রাখা হয়। এরপর সেনা অফিসারদের স্ত্রী, সন্তান ও পরিবারের লোকদের পেটাতে শুরু করে সৈনিকরা। একজন বুশরার পেছনে লাথি মারে। অন্যজন কানের পেছনে বন্দুকের বাঁট দিয়ে একটা আঘাত করে।
এসময় বিডিআর জওয়ানরা উল্লাস করছিল এবং কে কয়জনকে মেরেছে সেটি জানান দিচ্ছিল। জিম্মি অবস্থায় অল্প বয়সে নৃশংস ঘটনার চাক্ষুষ সাক্ষী হয়েছিল কিশোরী বুশরা।
পিলখানায় তখন একজন ধুপী ছিলেন যিনি একজন অফিসারকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ওই ধুপী সৈন্যদের হাতে ধরা পড়ে যান। এরপর তার ওপর ২০-২৫ জন লোক ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাকে যে যে জিনিস পায় তাই দিয়ে পেটাতে থাকে। লোকটার চিৎকারে চারপাশ ভারী হয়ে ওঠে।
কোয়ার্টার গার্ডে বুশরা তার মা ও ভাইয়ের সঙ্গে একরুমে অবরুদ্ধ ছিল। সেখানে এক ঘটনা কিশোরী বুশরার জন্য মারাত্মক ভীতির সঞ্চার করেছিল।
বুশরার কথায়, ‘আমি আর আমার মা পাশাপাশি বসে ছিলাম। গরাদের দরজার ভেতর দিয়ে বন্দুক ঢুকিয়ে নল দিয়ে আমার দিকে তাক করে একজন বলছিলেন, চোখ বন্ধ কর, চোখ বন্ধ কর। হাসতেছে আর বলতেছে যে কিছু বোঝা যাবে না চোখ বন্ধ কর।’
‘দে ওয়্যার লাফিং দ্যাট ইট ওয়াজ অ্যা জোক। আমি যে ভয় পাচ্ছি, আমি যে গুটিয়ে যাচ্ছি - এই জিনিসটা দেখে ওরা খুব আনন্দ পাচ্ছিল।’
ওইদিন পিলখানায় অবরুদ্ধ পরিবারগুলোর কোন সন্দেহ ছিল না যে তাদের মেরে ফেলবে। শুধু অপেক্ষায় ছিল কখন মারবে। আর কতটা মিনিট, কতটা সেকেন্ড পৃথিবীর আলো-বাতাস দেখতে পারবে এই কথায় ভাবছিল সবাই।
বুশরা জানায়, ৩৬ ঘণ্টা অবরুদ্ধ থাকার সময় তারা দোয়া-কলেমা পড়েছে। শুধু পানি খেয়ে কাটিয়েছে পুরোটা সময়। রাতে একটু ঘুমিয়েছিল স্যান্ডেল মাথায় দিয়ে। যখন পিলখানা থেকে বের হয় তখনো আতঙ্ক কাটেনি তাদের।
‘আমাদেরকে যখন বলা হয়ছিল যে তোমরা চলে যাও। ট্রাকে করে উঠিয়ে দেয়া হচ্ছিল আমাদের। আমরা তখন যেতে চাচ্ছিলাম না। ঘটনার বীভৎসতাটা এত বেশি ছিল যে আমাদের মনে হচ্ছিল যে আমরা গাড়িতে উঠবো আর আমাদের পেছন থেকে গুলি করবে।’
‘আমার কাছে মনে হয় যে, এই সময়টা নিজেদের জিম্মি থাকার অভিজ্ঞতাটা যতটা কষ্টকর ছিল, তার চাইতে মনে হয় আমার বাবার জন্য অপেক্ষা করা - আর তারপরে তার লাশ পাওয়ার অভিজ্ঞতাটা আরো কষ্টকর ছিল।’
বুশরা বলে, আমি তিনবার আইসিইউতে গিয়েছিলাম। আমার বাবার যেদিন জানাযা ছিল সেদিন আমাকে চারটা সিডেটিভ দেয়া হয়েছিল টু কাম মাই নার্ভস। আমি কাঁদতে পারতাম না। আমি চিৎকার করতাম। আমার অনেক আউটবার্স্ট হতো। আমি এই জিনিসটা মেনেই নিতে পারিনি।’
ওই ঘটনার পর ৭ বছর পর্যন্ত টানা মানসিক চিকিৎসা আর থেরাপির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে বুশরাকে।
তবে ২০০৯ সালের ঘটনাকে বিদ্রোহ বলতে চান না বুশরা। তার ভাষায়, ‘আমরা যারা ভেতরে ছিলাম আমরা কোনো বিদ্রোহ দেখিনি। কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া দেখিনি। আমরা মানুষ মারার পর তাদের উল্লাস দেখেছি। আমরা মানুষকে নির্যাতন করা দেখেছি। ছোট ছোট বাচ্চাকে গিয়ে গালিগালাজ করা, নারীদের গায়ে হাত দেয়া - এটা কী ধরনের প্রতিবাদ?’
‘আমি এটাকে বিদ্রোহ বলতে চাই না, আমরা কেউই এটাকে বিদ্রোহ বলতে চাই না। আমি এটাকে কারনেজ বলতে চাই। আমি এটাকে ম্যাসাকার বলতে চাই।’
বিদ্রোহ করা হয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে। আমার বাবা কী অন্যায় করেছিলেন?- বুশরার এ প্রশ্নের উত্তর আজও আমরা জানি না।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০ রাত ১০:৪১