somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

‘জাগরী’র অন্তপ্রাণ ঘাত-সংঘাত

২৯ শে আগস্ট, ২০০৯ দুপুর ১:৪৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

জাগরী’র আকর্ষণীয় দিক হলো কাহিনীর প্রতিটা চরিত্রের নিজ নিজ গল্প-কথা বলার সময়-পরিধি এবং ঘটনার পটভূমি। সন্ধ্যা বেলা থেকেই প্রত্যেক চরিত্রের শুরু। কিন্তু প্রয়োজনের তাগিদেই লেখক প্রতিটা চরিত্রকে নিজ নিজ অতীতে নিয়ে গেছেন, এমনকি শৈশব পর্যন্ত। মোট চার পর্বের উপন্যাসটা প্রথম প্রকাশ পায় ১৯৪৫ সালে, রবীন্দ্র পুরস্কার পায় ১৯৫০ সালে। উপন্যাসটা উৎসর্গ করা হয় ভারত বর্ষের অজ্ঞাতনামা রাজনৈতিক কর্মীদের উদ্দেশ্যে জাতীয় ইতিহাসে-বিবরণে যাদের নাম কোনো দিনই লেখা হবে না।

সতীনাথ ভাদুড়ী তাঁর উপন্যাসের কাহিনী হিসেবে বেছে নিয়েছেন ভারত বর্ষের রাষ্ট্রীয় পরিবার বা রাজনৈতিক পরিবারকে। প্রতিটা চঢরিত্রই কোনো না কোনো রাজনৈতিব দলের সদস্য। ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময়কার কংগ্রেস, কংগ্রেস সোশ্যালিস্ট পার্টি, সর্বভারতীয় ফরওয়ার্ড ব্লক প্রভৃতি দলের কথা এসেছে, চরিত্রগুলোর সংযুক্ততার কারণেই।

‘জাগরী’ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক অনন্য স্থান দখল আছে এর পটভূমি ও বিবেচ্য সময়ের কারণেই-ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ডামাডোলে অসংখ্য পরিবারের টগবগে তরুণরা অংশগ্রহণ করে, আত্ম-বলিদান দেয়। কিন্তু লেখক সকল পরিবার থেকে একটা পরিবারকে এখানে হাজির করেছেন। ১৯৪২ সালের ভারত ছাড়ো আন্দোলন যা আগস্ট আন্দোলন নামেও পরিচিত-এই উপন্যাসে ভিন্ন সুর ভিন্ন মাত্রা নিয়ে উপস্থিত হয়েছে।

পুর্ণিয়া জেলের রাজবন্দী বিলু। তার বাবা, মা পৃথক পৃথক সেলে আটক রয়েছে। খুব ভোরে বিলুর ফাঁসি কার্যকর হবে। আদেশ হয়েছে, জল্লাদ প্রস্তুত। বিলুর বাবা, মা-যারা অপেক্ষা করে আছে তাদের নিজ নিজ আবেগ অনুভূতি সমেত। জেলগেটে ভাইয়ের শবদেহ নেবার অপেক্ষায় আছে নীলু-বিলুর সহোদর ভাই। এদিকে বিলু তার একাকী সেলে ভাবছে তার জীবনের অতীত স্মৃতি। মানসপটে ভেসে আসছে মা, বাবা, নীলু, জ্যাঠাইমা, সহযোদ্ধা রাজনৈতিক কর্মীদের কথা। আন্দোলনের কথা, স্বরাজের কথা।

বিহারের ‘পুর্ণিয়া সেন্ট্রাল জেলের সেল থেকে একফালি আকাশ দেখা যায়।’ স্মৃতি আর ঐ রাতের আকাশ বিলুর একান্ত আপন। ভোর পর্যন্ত বেঁচে থাকার এগুলোই তার সম্বল। মা-বাবা ভাইয়ের স্মৃতির সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জাড়িয়ে পড়ে বিলু। ছোটভাই নিলুর কথা মনে আসতে অস্বস্তি-বিব্রত বোধ করে। ‘নিজের পার্টির প্রতি একনিষ্ঠতা দেখাইবার জন্য সহোদর ভাইয়ের ফাঁসির পথ সুগম করিয়া দেওয়া হৃদয়ের সততার প্রমাণ না মনের শুচিবায়ের পরিচয়? বোধ হয় নীলুর ব্যবহার আমার ভিতরের আসল আমি কিছুতেই সমর্থন করিতে পারিতেছি না; তাই উপরের আমি পুরাতন স্মৃতির মধু দিয়া সেই দহনের জ্বালা স্নিগ্ধ করিতেছি।’

সতীনাথ ভাদুড়ীর বাসস্থান পুর্ণিয়া জেলায়-‘জাগরী’র প্রধান চার চরিত্র পুর্ণিয়ার জেলে বসেই তাদের নিজ নিজ গল্প-অনুভূতি বয়ান করে চলেন। বিলু, নীলু, বাবা, মা-একই পরিবারের চার অন্তপ্রাণ হলেও কাহিনী বর্ণনার সময়-পরিধির তাদের মধ্যে দেখা-সাক্ষাত হয় না-নিজ নিজ একান্ত অতীতে তাদের দেখা হয়।

মানবিক চেতনার পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলাফল মনের গভীরে তন্ন তন্ন করে ঢুঁড়ে সামনে হাজির করা হয়। মানুষের মনের জটিল বিন্যাস গাঁথা হয়েছে প্রতিটা চরিত্রের অভ্যন্তরে পুঙ্ক্ষানুপুঙ্ক্ষ অনুসন্ধানের মাধ্যমে। বিলু, বাবা, মা ও নীলু প্রত্যেকের মনের একান্ত জগতে লেখক প্রবেশ করেছেন, তাদের মনের ব্যবচ্ছেদ পাঠকের সামনে হাজির করেছেন। বাংলা সাহিত্যে এমন নজির খুব বেশি দেখা যায় না।

১৯৪২ সালের ভারত ছাড়ো আন্দোলন যা আগস্ট আন্দোলন নামে পরিচিত-গান্ধি, প্যাটেল, মৌলানা আজাদ, নেহেরুদের সাথে অসংখ্য নাম জানা-অজানা তরুণদের স্বতস্ফূর্ত আন্দোলনকে অনেকে নৈরাজ্য হিসেবে দেখেছে। তাদেরই একজন বিলুর ছোট ভাই নীলু। আদালতে সে বিলুর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়। সকলেরই ধারণা নীলুর কারণেই তার বড় দাদার ফাঁসির আদেশ হয়েছে। কিন্তু বিলু তার ছোট সহোদরকে নীলুকে বোঝে। এটা তার পার্টির প্রতি একনিষ্ঠতা। অন্যদিকে, নীলু ভাবছে তার দাদা নিশ্চয়ই তাকে ভুল বুঝবে না।

উপন্যাসখানা মূলত সাধু ভাষায় লেখা হয়েছে। কিন্তু ভারত বর্ষের বর্ণ বৈচিত্র্য তুলে ধরার জন্য লেখক মাঝে মাঝে হিন্দি ভাষা ব্যবহার করেছেন বেশ সাবলীলভাবে।

বিলুর বাবা মহাত্মা গান্ধীর অনুরাগী ও অনুসারী এবং তাঁর দেখানো রাজনৈতিক পথেই তিনি সারা জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন। মহাত্মার অনুকরণে তিনি বাড়ীতে একটা আশ্রম খুলেছেন। সেই আশ্রমের প্রতিদিনকার রান্না-বান্নার কাজ করে বিলুর মা। বিলু-নীলুও প্রথম দিকে গান্ধীরই অনুরক্ত ছিল। এই পরিবারকে জানার মধ্য দিয়ে তৎকালীন অবিভক্ত ভারত বর্ষের রাজনীতি, সংস্কৃতি সম্পর্কে বেশ ধারালো ধারণা পাওয়া যায়। বলা বাহুল্য, গান্ধীর আদর্শের ঢেউ ভারত বর্ষের প্রায় সকল পরিবারে গিয়ে পড়েছিল।

উপন্যাসের চারটি পর্বের প্রথম পর্বের শেষে দেখা যায় বিলু তার নিজের ফাঁসির জন্য অপেক্ষা করছে, ‘... প্রতিলোমকূপে প্রত্যাশিত আতঙ্কের সাড়া-প্রতি স্নায়ুতে-টাইফুনের বিক্ষোভ-এই আলোড়ন অক্ষিগোলকের মধ্য দিয়া ফুটিয়া বাহির হইতে চায়।...’ একই কারণে বিলুর বাবা অপেক্ষা করছে, ‘... ভগবান। মহাত্মাজী। বিলুর মাকে আঘাত সহ্য করিবার শক্তি দাও, নীলুর মনে বল দাও, বিলুর আত্মাকে শান্তি দাও।’ সকলেরই অপেক্ষা মোটরগাড়ির শব্দ জন্য, কারণ ঐ গাড়িতে করেই বোধহয় বিলুর শবদেহটা বয়ে নিয়ে যাবে।

কাহিনীর শেষ পর্বের শুরুতেই নীলুর কথাবার্তা শুরু হয়। নীলুর সাক্ষ্যেই আজ বিলুর ফাঁসি। তাই নীলুর অনুতাপের অন্তর্দহন চলছে, ভেতরে ভেতরে কি যেন তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে চলেছে অনবরত। আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে, দাদার রাজনীতির মতাদর্শ সম্পর্কে নীলুর ধারণা ব্যক্ত হয়, ‘... দাদার পক্ষপুটে থাকিয়া যে ভঙ্গিতে রাজনীতি দেখিতাম তাহা রুগ্‌ণ, jaundiced, ভ্রান্ত; উহা সুবিধাবাদী নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ভাবপ্রবণতার উচ্ছ্বাস মাত্র। যথার্থ সর্বহারার সাবলীল উদ্দামতার স্থান সেখানে নাই,-জাতীয়তার বাহিরে দেখিবার ক্ষমতা তাহাদের নাই।’ ১৯৩৪ সালে দাদার সাথে জেল বাসের সময় নীলু দল ছেড়ে অন্য দলে যোগ দেয়। আবার দাদার প্রভাব-যুক্তি তর্কের বেড়াজাল হতেও মুক্তি চায়।

‘ফাঁসি’ নিয়ে এমন রোমহর্ষক উত্তেজনা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে আর কোনো উপন্যাসে আছে বলে মনে হয় না।

উপন্যাসের একেবারে শেষে দেখা যায়, নীলু তার দাদার লাশ নিয়ে যাবার জন্য সরকারের অনুমতিপত্র একটা কাগজ নিয়ে অপেক্ষা করছে। কিন্তু ফাঁসির কিছু সময় আগেই সরকারের আদেশ এসেছে অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত ফাঁসির আদেশ মুলতবি। ফাঁসি হবে না। নীলুর কথা বলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছ। সে আবার পাখির কলকাকলি শুনতে পায়। লাস্যময়ী পৃথিবী তার কাছে আবার হাজির হয়েছে।

সতীনাথ ভাদুড়ীর জাগরী উপন্যাস অবলম্বনে। বই আকারে বের হয়েছে কোলকাতার প্রকাশ ভবন থেকে।


৩টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

যে ভ্রমণটি ইতিহাস হয়ে আছে

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১:০৮

ঘটনাটি বেশ পুরনো। কোরিয়া থেকে পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরেছি খুব বেশী দিন হয়নি! আমি অবিবাহিত থেকে উজ্জীবিত (বিবাহিত) হয়েছি সবে, দেশে থিতু হবার চেষ্টা করছি। হঠাৎ মুঠোফোনটা বেশ কিছুক্ষণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:২৬

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।
প্রথমত বলে দেই, না আমি তার ভক্ত, না ফলোয়ার, না মুরিদ, না হেটার। দেশি ফুড রিভিউয়ারদের ঘোড়ার আন্ডা রিভিউ দেখতে ভাল লাগেনা। তারপরে যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×