somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নববর্ষ, মেলা ও সন্দেশ

০৩ রা এপ্রিল, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:৫৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১. ছোট বেলায় নববর্ষ মানেই ছিল মেলা। ভাই-বোন বা বন্ধুদের সাথে পায়ে হেঁটে প্রায় ৭ কি মিঃ পথ অতিক্রম করে মেলায় যেতাম। এত দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে মেলায় যেতে কখনও ক্লান্তিবোধ করিনি। বহু প্রতিক্ষিত এই বৈশাখী মেলায় যেতে যেতে মনের কোনে উঁকি দিত লাটিম, সার্কাস, টমটম কিংবা গুড়ের জিলাপি, সন্দেশ বা মেলার জন্যই বিশেষভাবে বানানো রংবেরঙের বড় রসগোল্লা। সাথে যেতে পথে চোখে পড়া সবুজ ধানক্ষেত, ছায়াঘেরা শালবন, হলুদ সবুজে ভরা মিষ্টি কুমড়া ক্ষেত, লাল সবুজের মরিচ ক্ষেত বা আঁকা বাঁকা ছোট নদী মন জুড়িয়ে দিতে ছিল যথেষ্ট।
মেলায় পৌঁছলে আনন্দের সাথে সাথে এক ধরনের ভয়ও কাজ করত। হারিয়ে যাবার ভয়। বাসায় মেলায় গিয়ে হারিয়ে যাবার গল্প এত শুনেছিলাম যে, মেলার হাজারো মানুষ ও সার্কাসের মাইকগুলোর চিৎকারে মনে ভয় ঢুকে যেত- এই বুঝি হারিয়ে গেলাম। অনেক গল্পের মাঝে এই গল্পটা খুব ভালভাবেই মনে পড়েঃ একজন তার ভ্রাতুষ্পুত্রকে নিয়ে মেলায় গেছেন। একসময় বালকটি হারিয়ে গেল মেলার ভিড়ে। আর চাচা গেলেন ভাস্তের নাম ভুলে। এখন তিনি কি করবেন? একটা উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করতে লাগলেন, আমি কার চাচা? আমি কার চাচা?
মেলায় গিয়ে নিজে কখনও হারাইনি। কিন্তু একবার হারিয়ে গেছি, এই ভয়ে কুঁকড়ে গিয়েছিলাম। তখন আমি ক্লাস থ্রীতে পড়ি কি পড়িই না। আমাকে নিয়ে, আমার এক দুলাভাই চলেছেন মেলা দেখাবেন বলে। মেলা ঘুরার পর দুলাভাই আমাকে একটা দোকানে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে রাখলেন। বললেন, তুমি বসো, আমি আসছি। তারপর তিনি কেনাকাটা করতে লাগলেন। অনেকক্ষণ পার হয়ে গেল, তিনি আসছেন না। ... আসছেন না। কি ভয়ানক ব্যাপার! কান্না চলে এলো। তবে আমি কাঁদিনি। গলা বুজে এসেছিল। আজকে হাঁসি পাচ্ছে, কারন আমিও তো দুলাভাইয়ের নাম জানতাম না!! আমি কীভাবে দুলাভাইকে খুঁজতাম? – কে আমার দুলাভাই? কে আমার দুলাভাই?
আজ পহেলা বৈশাখ। আমাদের নববর্ষ। নববর্ষের সাথে মেলার একটা সম্পর্ক রয়েছে। সে কারনেই ছোটবেলায় দেখা মেলা আর ছোটবেলায় শোনা মেলার গল্প করছি।
তখন আমি অনেক ছোট। এমনি এক বৈশাখী মেলায় গিয়েছিলাম মোস্তফা ভাইয়ের সাথে। মোস্তফা ভাই আমাদের বাসায় থাকতেন। আমরা সবাই তাকে মোস্ত ভাই বলে ডাকতাম। আম্মু মেলায় কেনাকাটার জন্য মোস্ত ভাইকে লম্বা ফর্দ ধরায় দিলেন। মোষের গাড়িতে চড়ে মেলায় গিয়ে সার্কাস দেখে, পেট ভরে জিলেপি আর রসগোল্লা খেয়ে ঠোঙ্গা ভরে নেয়া হল বাড়ীর জন্য। এরপর শুরু হল কেনাকাটা। খরিদকৃত জিনিসের মধ্যে ছিল রসুন, শুকনো মরিচ, কুলা, ধামা, কাস্তে, দাঁড়িপাল্লা, নিড়ানি, কোদাল, গরু- মোষের মুকাড়ি, মোষ কে মারার জন্য ব্যবহৃত চাবুক আরও কত কি? বাদ গেল না কিছুই। এই জিনিসগুলো যে বছরের অন্য কোন সময় পাওয়া যায় না তা না। কিন্তু কেন যেন, সবাই সারাটা বছর অপেক্ষা করত মেলার দিনটার জন্য। কেনাকাটা শেষে ফেরার পথে ছোট্ট মনে একটা প্রশ্নের উদয় হল। সংকোচ না করে মোস্ত ভাইকে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম- এতকিছু কিনলাম, বৈশাখ কিনলাম না কেন? মোস্ত ভাই কি উত্তর দিয়েছিল মনে নেই। আমি হয়তো ভেবেছিলাম, বই মেলায় বই, কম্পিউটার মেলায় কম্পিউটার পাওয়া গেলে বৈশাখী মেলায় বৈশাখ পাওয়া যাবে না কেন?

২. আজ আমাদের নববর্ষ। আজ তো আমরা নিজেদের গল্প করবই। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই মনে প্রশ্ন দোলা দিত- ভিন্ন দেশের, ভিন্ন সংস্কৃতির লোকজন কীভাবে তাঁদের উৎসবগুলো পালন করে? আর কিভাবেই বা শুরু করে নতুন বছর? নতুন বছরের আগমন নিয়ে কোন ভ্রান্ত সংস্কার আছে কি না? আমরা যেমন বছরের প্রথম দিনটি জাঁকজমক করে পালন করতে চাই, ভাবি এই দিন যেভাবে কাটবে বছরের বাকী দিনগুলো সেভাবে যাবে। স্কুলে পড়াকালীন সময়ে পহেলা বৈশাখের আগের দিন আমার এক বন্ধু আমাকে পরামর্শ দিয়েছিল- “আগামীকাল ভুলেও ভোরে ঘুম থেকে উঠবিনা, তাহলে সারা বছরই ভোরে উঠতে হবে!”
বলতে ইংরেজি সাল হলেও, ইংলিশরা ছাড়াও পৃথিবীর অনেক জাতি ১লা জানুয়ারিতেই নববর্ষ পালন করে থাকে। লিখিতভাবে না হলেও এই গ্রেগরিয়ান পঞ্জিকাই আধুনিক পঞ্জিকা হিসেবে সর্বজনীন ভাবে গৃহীত। আবার চাঁদের গতিবিধির উপর নির্ভর করে বলে চীনাদের নতুন বছর শুরু হয় জানুয়ারি ২১ থেকে ফেব্রুয়ারির ২১ তারিখের মধ্যে যে কোন সময়ে। ইরানে নতুন বছর শুরু হয় মার্চ মাসের কোন এক দিন এবং তা নির্ভর করে মঙ্গল গ্রহের গতিবিধির উপর। বিভিন্ন ধর্মের, সংস্কৃতির মানুষ ভিন্ন আঙ্গিকে বা ভিন্ন সময়ে নববর্ষ পালন করলেও সবাই নববর্ষকে খুব ভাল ভাবে উদযাপন করতে চায়। সৌভাগ্য নিয়ে শুরু করতে চায় নতুন বছর। এমনি কয়েকটি উদযাপনের ধরন নিচে তুলে ধরলাম।
ডেনিশরা যেমন সারা বছর তাঁদের ভাঙ্গা তৈজসপত্র জমা করে রাখে। নববর্ষের আগেরদিন রাতে তারা আত্মীয় বা বন্ধুদের বাসার দরজার সামনে সেগুলো ফেলে রেখে আসে। দরজা খুলে ভাঙ্গা তৈজসপত্রের স্তর দেখতে পাওয়াকে তারা সৌভাগ্য মনে করে। তারা ভাবে যত বড় স্তর হবে, তার প্রকৃত বন্ধুর সংখ্যা তত বেশি। কিন্তু আধুনিক যুগে কাগজের প্লেটে বা কাগজে মোড়ানো খাবার(ফাস্ট ফুড) খেলে এতগুলো ভাঙ্গা প্লেট কোথায় পাওয়া যাবে এটাই চিন্তার বিষয়!
এ তো গেল সৌভাগ্যের কথা। ইস্তেনিয়াতে নববর্ষের দিন রাতে ৭, ৯ বা ১২ বার খাবার খাওয়া হয়ে থাকে। ধারনা করা হয়, একটা লোক যতবার খাবার খেতে পারবে ঠিক ততটা পুরুষের শক্তি সে অর্জন করবে। আগামী বছরে সে সেরকম উদ্দীপনা নিয়ে কাজ করবে। যদিও সব খাবার শেষ করতে হয় না। একটা অংশ রেখে দেয়া হয়, অতিথি যারা বেড়াতে আসে তাঁদের জন্য। কিন্তু প্রশ্ন হল, বালিকারাও পুরুষসম শক্তি নিয়ে কি করবে?
আর জার্মানদের কথা কিবা বলার আছে? চিন্তা করা যায় একটা টিভি অনুষ্ঠান একটা দেশের নববর্ষ পালনের ঐতিহ্য হতে পারে? হ্যাঁ, জার্মানরা ৪২ বছর ধরে প্রতি বছর একই টিভি অনুষ্ঠান বা নাটক উপভোগ করে আসছে। “ডিনার ফর ওয়ান” নামক এই ব্রিটিশ শো একই সংলাপে, একই পাণ্ডুলিপিতে নববর্ষের আগের দিন মধ্যরাতে প্রচার করা হয়ে থাকে। এমনকি এই শো এতটাই জনপ্রিয়তা পেয়েছে যে, এর সংলাপ গুলো সবার মুখে মুখে থাকে।
এই সংস্কার গুলোর হয়ত কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। তবুও বছরের পর বছর ধরে তারা এগুলো পালন করে আসছে। শিকড়কে আঁকড়ে ধরে আছে। উৎসকে কখনও ভুলে যায়নি।

৩.
আমাদের নববর্ষের এই উৎসব চর্চায় বাংলার গ্রামীণ জীবন-জীবিকা আর সংস্কৃতির একটা গভীর বন্ধন আছে। আজকাল এ বদলের দুনিয়ায় গ্রামের চেয়ে শহুরে নববর্ষের রঙ্গ অনেক বেশি, রুপ অনেক জাঁকজমকপূর্ণ। তবে যে বর্ণে আর ঢঙ্গেই বর্ষবরণ সাজুক না কেন, সব আয়োজনের মূল সুর গ্রামের লোকজ সংস্কৃতির মাঝেই আটকে আছে। বাংলাদেশের গ্রামের মানুষের কাছে বাংলা পঞ্জিকা এখনও নিত্যদিনের বাস্তবতা। বীজ বুনা, ধান কাটা, নবান্ন উৎসব, পিঠাপুলি উৎসব, বিয়ে-শাদি সবই হয় বাঙলা পঞ্জিকা ধরে। আমরা হয়তো পঞ্জিকার ব্যবহার করি না কিন্তু বছরে একদিন পান্তা পাতে নেই। তারও একটা ইতিবাচকতা আছে। এর মধ্যে দিয়ে আমরা আমাদের জীবন যাপনের আদি চিহ্নগুলো, বৈশিষ্ট্যগুলো ধারণ করছি, উদযাপন করছি। আমরা আমাদের শিকড় ভুলে যাচ্ছি না। হোক না সেটা এক দিনের জন্য।
প্রতিটা বছর শুরু হয় একটা সপ্ন নিয়ে। সেই সপ্ন নিয়েই বছরটির এক-দুই করে দিন চলতে থাকে। আমাদের সব স্বপ্নের শতভাগ বাস্তবায়িত হোক ১৪২২ এ। সব অশুভ শক্তিকে হটিয়ে আমরা বাঙ্গালী চেতনার জয়গান গাইতে চাই। প্রানের মাঝে ধারন করতে চাই শতবর্ষের এই বাঙ্গালী সংস্কৃতিকে। পয়লা বৈশাখের শুভেচ্ছা সবাইকে।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ১২:১৭
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্মৃতিপুড়া ঘরে

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৩০



বাড়ির সামনে লম্বা বাঁধ
তবু চোখের কান্না থামেনি
বালিশ ভেজা নীরব রাত;
ওরা বুঝতেই পারেনি-
মা গো তোমার কথা, মনে পরেছে
এই কাঠফাটা বৈশাখে।

দাবদাহে পুড়ে যাচ্ছে
মা গো এই সময়ের ঘরে
তালপাতার পাখাটাও আজ ভিন্নসুর
খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×