প্রতিদিনের মতই এক অতি সাধারন বিকেল। রাস্তার পাশে হিরা মামার চায়ের দোকাটানে বসে গুটিকয়েক লাফাঙ্গা ছেলে আড্ডা দিতে দিতে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে আরও কিছু ধোঁয়ার যোগান দিয়ে বৈশ্বিক উষ্ণতাকে সামনে এগিয়ে নিতে সাহায্য করছে। ক্লান্ত সূর্যটা লাল হয়ে অপেক্ষা করছে দিগন্ত রেখার নিচে ডুব দেয়ার।
সারাদিনের এই সময়টার জন্যই ছেলেগুলা মুখিয়ে থাকে। সারাদিন নানা অকাজ কুকাজে ব্যস্ত থাকা বালকদের এই সময়ে যেন একটু বসার ঠাই মেলে। চায়ের কাপ আর ধুম্রশলাকার ধোয়ার মাঝে ডুব দিয়ে যেন মনে হয় পৃথিবীটা বড়ই সুন্দর, জীবনে এর থেকে শান্তি আর কোথায়।
ছেলেগুলাও এক একটা মাস্টারপিস। প্রতিদিন কেউ না কেউ কোথাও না কোথাও কিছু একটা ঝামেলা পাকাবেই। সেটা হোক পাশের বাড়ির টাকলু আঙ্কেল এর মাথায় গুলতি ছোড়া কিংবা বন্ধুর প্রেমিকাকে বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে পালিয়ে নিয়ে আসা। অকাজে কারো উৎসাহের কোন কমতি নেই। যেটা যত বড় অকর্ম সেটাতে উৎসাহ তত বেশি। তবে এত সব সুকর্মের ফল যে কাউকে ভোগ করতে হয় না সেটাও না। মাঝে মাঝেই গা ঢাকা দেয়াও সবার কাছে খুবই মামুলি ব্যাপার।
এইত কয়েকদিন আগে বাবার একাউন্ট থেকে একগাদা টাকা মেরে দেয়ার অপরাধে আঙ্কেল যখন শাকিল কে পিটিয়ে হাসপাতালে পাঠাল আমারা সবাই ভেবেছিলাম এইবার বুঝি আমাদের দল থেকে একটা মাইনাস হল। কিন্তু কিসের কি। সুস্থ হওয়ার ১০ দিনের মাথায় সে বলে বসল দোস্ত অনেকদিন ঘুরাঘুরি করা হয় না। আর হাসপাতালে থেকে মন মেজাজ ও খারাপ। চল সবাই মিলে দূরে কোথাও ঘুরতে যাই। সবাই এক বাক্যে রাজি কিন্তু টাকা? শয়তানটা নিরলজ্জের মত দাত বের করে পকেট থেকে ব্যাঙ্কের চেক দেখিয়ে বলল "কিছুদিন আগে যে প্যাদানি দিছে তাতে বাবা ঘুনাক্ষরেও চিন্তা করবে না যে এই কাজ আমি আবার করছি। সব ভাইয়ার উপর দিয়ে যাবে।"
আজিজটাও একটা পাক্কা হারামি। প্রতিদিন বাসা থেকে বের হয় কলেজে যাওয়ার কথা বলে। সময়মত বাসা থেকে বের হয় আবার সময় মত বাসায় ফেরে। কিন্তু মাঝের পুরো সময়টাই তাকে পাওয়া যায় দীঘির পাড়ের বড় গাছটার উপরে। এই ছেলে কি যে মজা পায় ঐ গাছের উপরে উঠে বসে বসে সিগারেট ফুকে সে ই জানে। আর এই ব্যক্তি একবার কথা বলার সুযোগ পেলে হইছে আর কারো কথা বলার কোন স্কোপ নাই। কেউ শুনুক বা না শুনুক। তার বেশীরভাগই ভুত প্রেত সম্পর্কিত শতভাগ নির্ভেজাল চাপা। আজকেও শুরু করছে।
-দোস্ত জানিস না তো আমি কালকে রাতে একবার ছাদে গেছি। দেখি বিশাল সাদা কাপড় পড়া কিছু একটা। যে ভয় টা পাইছিলাম। আমি আর তাকাই নাই। দৌড়ে নিচে চলে আসছি।
-দোস্ত ওইটা হয়ত তোর এক্সজিএফ এর আত্মা। অনেকদিন তোদের দেখা হয় না তো তাই তোকে দেখতে আসছিল।- পাশে থেকে জামান খোচা দেয়ার চেষ্টা করে।
-আরে ব্যাটা থাম না। বলতেই তো দিস না। নিচে এসে আমি যেই..............................
কথা শেষ হয় না। এর মধ্যে দৌড়াতে দৌড়াতে শরিফ এসে হাজির।
-দোস্ত দোস্ত শোন , সবাই শোন
-কি হইছে?
নতুন কোন ঝামেলা বাধছে ভেবে সবাই খুব উৎফুল্ল।
- আমাদের জাফর কে সুমি আপুর বাবা পিটাইয়া একবারে ভচকাইয়া ফেলছে।
আমরা নির্বাক। আমাদের মধ্যে জাফরই একটু শান্তশিষ্ট ভদ্র ছেলে। তাকে পিটাইছে তাও আবার সুমি আপার বাবার মত আগাগোড়া ভদ্রলোক একজন!!!!
-আরে রফিক ভাই জাফরকে চিঠি দিয়ে আপুকে দিতে বলছিল। সে দিতে গেছিল। কিন্তু ঐ সময় আপু বাসায় ছিল না। আর সে ও আঙ্কেল এর সামনে আমতা আমতা শুরু করছে। আঙ্কেল জোরেসোরে ঝারি মারায় সে সত্য কথা বলে দিছে আর আঙ্কেল কে চিঠিও দিছে। আঙ্কেল তার সাম্নেই চিঠি পড়া শুরু করে। চিঠিতে মনে হয় উল্টাপাল্টা কিছু ছিল। তাই আঙ্কেল পুরা রাগ জাফর এর উপরে ঝারছে।
-জাফর কই এখন? চল দেইখা আসি
- আ*দা নাকি তুই? ওরে আমাদের বাসায় শুয়াইয়া রাখছি। আন্টিরে ফোন দিয়া বলছি ও আজকে আমাদের বাসায়ই থাকব। আর বাসায় বলছি ও একটু অসুস্থ কিন্তু আঙ্কেল আনটি গ্রামের বাড়ি গেছে। তাই ওরে আমাদের বাসায় রাখতেছি। এখন সবগুলা মিলা বাসায় গেলে মা বুইঝা ফেলতে পারে।
-যাক কাজের কাজ করছস।
জাফরের ব্যাপারে আরও কিছু কথাবার্তার হল। এত দুশ্চিন্তার কিছু নেই। কয়েকদিন রেস্ট নিলেই ঠিক হয়ে যাবে। আমাদের কাছে খুবই সাধারন ব্যাপার এগুলো। কাল হয়ত দেখা যাবে আবার কেউ বাইক এক্সিডেন্ট করে হাসপাতালে, কিংবা বান্ধবিকে নিয়ে ঘুরতে বেরিয়ে বাসায় ধরা খেয়ে উত্তম মধ্যম খেয়েছে কিংবা গা ঢাকা দিয়েছে।
সবাই আবার আগের মত চা-সিগারেট নিয়ে আড্ডায় জমে গেল। আজীজ আবার শুরু করল তার প্রেতাত্মার কাহিনী। আবার চলতে লাগল লাফাঙ্গা ছেলেদের কার্যকলাপ। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নামল। বাড়তে লাগল রাত। এক পর্যায়ে বাড়ি ফিরে গেল যে যার মত। কাল আবার সবাইকেই দেখা যাবে এখানে। কোন হেরফের নেই এই রুটিনের। এভাবে হয়ত পেরিয়ে যাবে হাজারটা বিকেল। চেনা মুখগুলোকেও একসময় আর কখনও দেখা যাবে না এখানে। কিন্তু একপাল লাফাঙ্গা ছেলে চিরদিন মাতিয়ে রাখবে হিরা মামার চায়ের দোকান।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ রাত ৯:২০