আমি একজন আঁকিয়ে। রং নিয়ে খেলা করার হাতেখড়ি সেই চার বছর বয়সে। বাসার দেয়ালগুলো আজও সে স্মৃতি বহন করে চলেছে।
আমার ধারণা, আমাদের প্রত্যেকের জীবন এক-একটা ক্যানভাস, আর বিধাতা সে ক্যানভ্যাসে তার পছন্দসই রঙের তুলি চালিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। আমার নিজের জীবনে একটি রঙের অভাব খুব বোধ করতাম—লাল রং। আমার ভালোবাসার রং। সাদা, কালো, সবুজ, হলুদের ভিড়ে হঠাৎ একদিন আবিষ্কার করলাম, লাল রংটাও উঁকি মারছে। আর আমার জীবন নামের ক্যানভাসে এই লাল রং নিয়ে এসেছিল কাব্য।
আমি যখন হাঁটতাম, খেয়াল করতাম আরও এক জোড়া পা আমার চলার পথের সঙ্গী হয়েছে। যখন হাসতাম, আরও একজনের হাসির শব্দ আমার মাথায় টোকা মারত। রাতে আমার ঘুম না আসা রোগের বড়ির নাম ছিল কাব্য। আমার আঁকার খাতাটা তার স্কেচে ভরে গেল। ধীরে ধীরে লাল আমার প্রিয়তম হয়ে উঠল।
সেদিন ১৪ ফেব্রুয়ারি। কাব্যকে বললাম, ‘আজ তুমি ১৪টা লাল গোলাপ নিয়ে আসবে আমার জন্য। একদম টকটকে লাল। আমি অপেক্ষা করব।’
সময়ের আগেই পৌঁছে গেলাম আমি। আজ কাব্যকে পৃথিবীর সেই শক্তিশালী শব্দটা বলব। লাল রং কতটা তীব্র হতে পারে, বলব সে কথাও।
ওই তো, কাব্যকে দেখা যাচ্ছে, কিন্তু ওর হাতে তো লাল গোলাপ থাকার কথা, তার বদলে সাদা গোলাপ কেন?
‘তোমাকে পইপই করে বলে দিলাম, লাল গোলাপ নিয়ে আসবে। তুমি সাদা গোলাপ আনলে কেন?’ কাছে আসামাত্র ওকে বললাম।
‘লাল গোলাপই তো এনেছি, এই দেখো। তাও ১৪টা।’
‘কাব্য! কেন মজা করছ?’
‘মিথ্যা বলতে যাব কেন? এই দেখো, তোমার ফরমায়েশমতো গুনে গুনে ১৪টা লাল গোলাপ।’
আমি কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম অপলক। হঠাৎ একটা আশঙ্কা আমাকে পেয়ে বসে। কাঁপা-কাঁপা গলায় ওকে শুধু জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি যে শার্টটা পরে আছ, তার রং বলতে পারবে?’
‘কেন! নীল, আসমানি নীল...’
কয়েক মুহূর্তের জন্য সেখানে স্থির দাঁড়িয়ে রইলাম। কাব্যের হালকা সবুজ রঙের শার্টের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললাম, ‘কাব্য, তুমি বর্ণান্ধ! এ কথা তুমি আমাকে আগে বলোনি কেন?’
পেছন ফিরে ভীষণ জোরে দৌড়ালাম আমি, যেন পালাচ্ছি সত্য থেকে। অথচ সত্য বিন্দুমাত্র পাল্টাল না, যেমন ছিল তেমনই রইল—অচল ও রূঢ়।
ঘরের লাগোয়া বারান্দায় বসে ছিলাম। অসময়ের বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টি পড়ার বৈজ্ঞানিক কারণ জানা থাকা সত্ত্বেও কেন যেন মনে হচ্ছিল, আমার দুঃখ ভাগ করে নিতে আকাশও বুঝি কাঁদছে, নয়তো এ অসময়ের বৃষ্টির অর্থ কী?
মুঠোফোনে একটা মেসেজ আসে: ‘আমার শার্টের রং যা-ই হোক না কেন, এই শার্টের বুকপকেটে যে স্বপ্ন আমি ধারণ করি, তাতে যে মুখটি প্রতিনিয়ত দেখি, সেটা তোমার। তোমার প্রতিটি তুলির আঁচড়ের সাক্ষী হতে চাই আমি...।’
চোখ মুছে বাইরে তাকাই। এই বৃষ্টি হঠাৎ করে এসেছে, হঠাৎ করেই চলে যাবে। একে হাতছাড়া করা যাবে না। আজ আমি ভিজব। আজ আমি রংহীন বৃষ্টিতে ভিজব।
নাদিরা মুসতারী
ঢাকা।
উৎস: ছুটির দিনে
গল্পটি ভাল লাগল তাই শেয়ার করলাম ।