somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কয়েকটা কাল্পনিক চরিত্র ও একটা গল্প

০৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:৩০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বাবার চাকরীর সুবাদে বিভিন্ন জেলা দেখার সৌভাগ্য হয়েছে আমার; কেটেছে স্মৃতি বিজরিত শৈশবের অমূল্য সময়। নতুন নতুন যায়গায় যেতাম আর নতুন নতুন অভিজ্ঞতা তৈরি হত। প্রথম প্রথম নতুন কোন যায়গাতে গেলেই খুব বিষন্ন লাগতো। এমনিতেই ছেলে হয়ে জন্মেছি বলে ঘরে মন বসতো না, তার উপর কাউকে চিনিনা। এক্সট্রোভাট টাইপের ছিলাম বলে খুব সহজেই মানুষের সাথে মিশে যেতে পারতাম। আস্তে আস্তে চেনা পরিচিতি বাড়তে থাকে, যখনই যায়গাটার প্রতি মায়া জন্মে যায় ঠিক তখনই বাবার ট্রান্সফারের খবর এসে যায়। একরাশ বিষন্নতা আর স্মৃতির থলি নিয়ে ব্যাগ গুছাতে হয়, চলে যেতে হয় নতুন যায়গায়। মাঝে মাঝেই শৈশবের স্মৃতিগুলো চোঁখের সামনে ভাসতে থাকে- একবার হয়েছে কি, তখন আমরা চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলাতে থাকি। আমার বাবা কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তরে চাকরী করেন, সরকারী চাকুরীজিবী হওয়াতে আমরা অফিসিয়াল কোয়ার্টারে থাকতাম। তখন আমার বয়স কেবল সাত বছর, গ্রাম এলাকা ভালো স্কুল না থাকায় বাবা ট্রান্সফারের খুব জোর চেষ্টা চালাচ্ছিলেন; এদিকে আমাকে স্কুলে ভর্তি করার উপযুক্ত সময় পার হয়ে যাচ্ছে। পড়াশুনার চর্চা যেন থাকে সে জন্য বাবা আমাকে গ্রামের এক স্কুলে দিয়ে দিলেন। আমাদের কোয়ার্টার থেকে বেরিয়ে প্রসস্থ-লম্বা কাঁচা রাস্তা ধরে হেঁটে যেতে বিশ মিনিটের মত সময় লাগতো। কোন প্রাতিষ্ঠানিক স্কুল না, গ্রামের ছেলেমেয়ে যেন নূন্যতম শিক্ষাটা পায় সে কারনে নিজ উদ্যোগে এক ভদ্রলোক ওই স্কুল খুলেছেন, তিনিই সেখানে পড়াতেন কোন টাকা-পয়সা নিতেন না। একরুমের একটা স্কুল, বাঁশের চাটাই দিয়ে ঘেরা চারপাশ, উপরে ছনের চালা, একটা ব্ল্যাকবোর্ড, একটা ডাস্টার, এক বক্স চক। নিচে পাটি পাতানো, সবাই একত্রে চক স্লেট নিয়ে বসে পড়তাম ক, খ, অ, আ লেখার জন্য। প্রতিদিন বাবা মারতে মারতে আমাকে স্কুলে নিয়ে যেতেন কারন আমি স্কুলে যেতে চাইতাম না;

আমার স্কুলে যেতে না চাওয়ার প্রধান কারন হল – আমি চাটাই দিয়ে বানানো স্কুলে যাব না। কিছুতেই ওই স্কুলে যাবোনা, যাবোনা করে প্রতিদিনই যেতে হত। একদিন ক্লাসে স্যার ব্ল্যাকবোর্ডে কবিতা লিখছিলেন আর ক্লাসের সবাই দেখে দেখে চক দিয়ে স্লেটে লিখছিলেন। লেখা শেষ করার পর-
স্যার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন- এই রাফাত এদিকে আয়?
আমি ভয়ে ভয়ে কাছে গেলাম, ভয় পাওয়ার কারণটা হল আমার বাবা স্কুলে দিয়ে যাওয়ার সময় স্যারকে বলে গেছেন খুব দুষ্ট ছেলে পড়তে না চাইলে মাংস আপনার হাড্ডি আমার; মেরে তক্তা বানায় ফেলবেন, আমি ওই তক্তার উপর পেরেক মারবো। এসব কথা শুনে স্বাভাবিকভাবেই মনে হতে পারে আমার বাবা খুব নিষ্ঠুর প্রকৃতির লোক। আসলে নিষ্ঠুর সে শুধুমাত্র পড়াশুনার ব্যাপারেই, উনি ছোটবেলায় অনেক কষ্ট করে মানুষের বাসায় লজিন থেকে পড়াশুনা করেছেন, মাষ্টার্স পাশ করেছেন, ভাল একটা পদে চাকরী করছেন, তাই পড়াশুনাকে খুব গূরুত্ব দেন।
যাইহোক, স্যারের কাছে যেতেই স্যার ডাস্টার এগিয়ে দিয়ে বললেন ব্ল্যাকবোর্ডের লেখা গুলো মুছে ফেল... একথা শুনেই খুশিতে আমার মন ভরে গেল কেননা আমার কাছে মনে হত ডাস্টার, ব্ল্যাকবোর্ড শুধুমাত্র বড় মানুষদের জন্য (তখনকার বয়সের চিন্তাধারায় বড় মানে সম্মানিত লোক বোঝায়)। আমি লাফাতে লাফাতে বাসায় এসে মাকে বললাম –

মা জানো, আজকে স্কুলে কি হয়েছে।

মা বললেন কি হয়েছে??

আমি বললাম – আজকে ক্লাসে স্যার আমাকে লাস্টার দিয়ে মুছতে দিয়েছে।

একথা শুনেই মা জোরে জোরে হাসতে শুরু করলো, মায়ের হাসি আর থামেনা। আমি অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম –

মা তুমি হাসো কেন??

মা আমাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলল – বাবা ওইটা লাস্টার না, ওইটা ডাস্টার। ওই লাস্টারের কাহিনী নিয়ে বাসার মধ্যে সেই কান্ড, যে শুনে সেই হাসে আর আমি লজ্জায় জড়োসড়ো হয়ে যাই। আস্তে আস্তে স্কুল ভাল লাগতে শুরু করলো, স্কুলে দুইজন বন্ধুও হল- আরফান আর শরিফ। আরফান খুব সহজ সরল টাইপ ছেলে তবে খুব সাহসী প্রকৃতির ছিল। কথা কম বলতো, তবে যেটা বলতো সেটা ভাল কথাই বলতো। আমি যে রাস্তা দিয়ে স্কুলে যাই, সে রাস্তার চারপাশে অসখ্য বাঁশঝাড় আর জঙ্গল। মোটা চওড়া রাস্তা গ্রামের পথ লোকজন তেমন হাটাচলা করেনা। আরফানের বাড়ি আমাদের স্কুল থেকে পশ্চিমে আরও এক কিলোমিটার ভেতরে। খেতের আঁইল ধরে, ছোট একটা জঙ্গল পেরিয়ে ওর বাড়ি যেতে হয়। বিকেলের একটু আগে আগে ঐ পথ দিয়ে হাঁটতে সবারই গা ছমছম করে, আর আরফান প্রায়ই নাকি রাতের বেলা ঐ পথ দিয়ে একলা হেটে বাড়ি যায়। আরফানের বাবা কৃষক ছিলেন, প্রায় সময়ই ওর বাবার সাথে গঞ্জে যেতে হত শাক-সবজি বিক্রি করতে। হাটের দিন বাজারে যায়গা পাওয়া যেতনা বলে আরফানের বাবা বিক্রির যায়গা ধরে রাখার জন্য রাতে গঞ্জেই থেকে যেত। আর ও একা একা বাসায় ফিরতো। ধীরে ধীরে দু’জনের সাথেই সখ্যতা বাড়তে থাকে। আমি ওকে কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছি-

আচ্ছা আরফান তোর ভয় করেনা???

আরফান বলে- ভয় পেলেই ভয় লাগে, ভয় না পেলে ভয় লাগে না (ওইটুকু বয়সে ওর কি বিচারবুদ্ধি ছিল ভেবে অবাক হয়ে যাই)।

আমি আবার বললাম জ্বীন পরী কিছু দেখেছিস কখনও???

______ দেখেছি তবে তোদের এখন বলা যাবেনা।

এখন বলা যাবেনা কেন???? পাশের থেকে চিল্লিয়ে উঠে শরিফ –

নাহ কেন??? এখনি বলতে হবে তোকে। (শরিফ খুব ঘাউড়া টাইপ, কথা একটু বেশি বলে, ঘোর-প্যাচ নেই যা বলার সরাসরি মুখের উপর বলে দেয়। শরিফের বাবা নেই, ওর যখন এক বছর বয়স তখন ওর বাবা মারা যায়; মা অনেক কষ্ট করে সংসার চালায়)।

উত্তরে আরফান বলে সময় হলে তোদের বলবো এবং দেখাব।

শরিফ মানতে নারাজ ও এখনি শুনবে। উপায় না পেয়ে আরফান বলল- আচ্ছা বলতে পারি তবে কাউকে বলতে পারবিনা।

আমরা দু’জনেই প্রতিজ্ঞা করলাম কাউকে বলবোনা। আরফান বলা শুরু করলো____ আমাদের গ্রামের উত্তরে গ্রামের শেষ মাথায় একটা পোড়াবাড়ি আছে, অনেক আগের পুরাতন জমিদার বাড়ি। আশেপাশে তেমন কোন বসতি নেই। লোকে মুখে শুনেছি প্রতি আমাবস্যা রাতে ওখানে জ্বীনেরা আসে। আমার খুব ইচ্ছে কোন এক আমাবস্যা রাতে ওখানে যাওয়ার। (আরফানের এসবের প্রতি প্রচন্ড রকমের আগ্রহ ছিল, প্রায়ই বলত- আমার এখানে থাকতে ভাল লাগেনা, জ্বীন পরীদের দেশে গিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে)
ওই সব ঢক আমাকে বলিস না। আমি এইসব জ্বীন-পরী বিশ্বাস করিনা। খুব নির্বিকার ভাবে বলে যায় শরিফ।

আরফান বললো তাহলে সাহস থাকলে চল একদিন আমার সাথে??? কি, যাবি???

তুই যদি যেতে পারিস তাহলে আমিও পারবো, শরিফ দৃঢ় কন্ঠে বলতে থাকে। (শরিফ নিজে যা তার থেকে একটু বাড়িয়ে বলার অভ্যাস আছে)।
আচ্ছা দেখা যাবে তুই কতটুকু সাহস রাখিস।

এবার শরিফ আমার দিকে তাকিয়ে বললো, তুই যাবি তো আমাদের সাথে??
হ্যাঁ তোরা দু’জন গেলে আমি অবশ্যই যাবো।

সিউর তো??

হ্যাঁ সিউর!!! আমি একটু দ্বিধা নিয়ে উত্তর দিলাম আমি; কারন বাস্তবিক পক্ষে আমি সব ব্যাপারেই এভারেজ টাইপ ছেলে ছিলাম। খুব ভীতুও না আবার খুব সাহসীও না। তবে জ্বীন-পরি তে আমার বিশ্বাস এবং ভয় দুটোই আছে। দাদীর মুখে শুনেছিলাম আমার বড় ফুপুকে একবার জ্বীনে ধরেছিল-

সে অনেক আগের কথা ফুপু তখন কলেজ এ পড়তো, নতুন বিয়ে হয়েছে। ফুফা হাইস্কুলে মাষ্টারি করেন। একদিন ফুপুর কলেজ থেকে বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল। তাড়াহুড়ো করে বাড়িতে ঢুকতেই দেখলেন ফুফা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন। আস্তে আস্তে ফুপা, ফুপুর সামনে এসে দাঁড়ালেন। নতুন বিয়ে হয়েছে ফুপু ফুপাকে দেখেই লজ্জ্বা পেয়ে মাথা নিচু করে ফেললো। হঠাত ফুপু খেয়াল করলেন- ফুপার হাঁটু থেকে নিচ পর্যন্ত দু’টো পায়ের একটা পাও নেই। তারপর আর কিছু তার মনে নেই। পরে ফুপুকে বাথরুমের পাশে অজ্ঞান অবস্থায় পাওয়া যায়। শুনেছি তিনি অজ্ঞান হয়ে যাওয়াতে জ্বীন তাকে নিয়ে যেতে পারেনি। ঘুমিয়ে পরলে নাকি জ্বীনদের শক্তি কাজ করেনা।
সারাদিন ওদের সাথে ঘুরে বেড়াতাম, এর ওর গাছের ফল চুরি করে খেতাম। আমাদের স্কুলের পাশেই একটা শশা ক্ষেত ছিল এক বুড়ি’মার ক্ষেত। তার কাছে পঞ্চাশ পয়সা দিলে তিনি ক্ষেত থেকে একটা শশা ছিড়ে দিতেন, আর আমরা কচ কচ করে খেতাম। সন্ধ্যার ঠিক আগে আগে ওই পঞ্চাশ পয়সার শশাই ফ্রি খেতাম শরিফের উছিলায়। শরিফ সবসময় বলত টাকা দিয়ে শশা খাওয়ার দরকার কি একটু দেরি কর সন্ধ্যা হলেই তো ফ্রি খাওয়া যাবে। আর আরফান বলত না বলে খাওয়া তো চুরি, চুরি করে খাওয়া ঠিক না। আরফান ভাল মন্দের বিচার টা সবসময় ধরিয়ে দিত, তবে শরিফের কনভিন্স করার ক্ষমতা ভাল থাকায় শেষমেষ আরফানকেও ঐ শশা খেতে হত।
এভাবেই ওদের সাথে খুব ভাল সময় কাটছিল আমার। এরমধ্যে হঠাৎ করে বাবার ট্রান্সফার অর্ডার চলে আসাতে তাড়াহুড়ো করে আমাদের ব্যাগ-প্যাক করে ঢাকায় চলে আসতে হল। যাওয়ার আগে ওদের বলাও হলোনা, আর পোঁড়াবাড়িতেও যাওয়া হল না।

কিছুদিন হল অ্যাপ্লাইড ফিজিক্সে এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশুনা শেষ করেছি। মা-বাবা আর ছোট বোনকে নিয়ে ঢাকাতেই থাকি আঠেরো বছর হয়ে গেছে। এখন আমার বয়স পচিশ। মাঝেই মাঝেই আমাকে শৈশব স্মৃতিগুলো নাড়া দেয়, মনে পড়ে আরফান আর শরিফের কথা। চাকরী জীবনে ঢোকার আগে তাই চিন্তা করলাম স্মৃতি হাতরাতে আরফান আর শরিফের সাথে দেখা করতে দামুড়হুদায় যাবো। যেই ভাবা সেই কাজ, সকাল এগারোটার সময় বাবার কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে ব্যাগ পত্র গুছিয়ে দুই, তিন দিনের জন্য বেরিয়ে পরলাম দামুড়হুদার উদ্দেশ্যে। কমলাপুর রেল স্টেশানে এসে দর্শনা এক্সপ্রেস ফার্স্ট ক্লাসের একটা টিকিট কাটলাম। দুপুর দুইটার ট্রেন বিকাল চার টায় ছাড়লো। আমার সিটটা জানালার পাশে হওয়াতে বাইরের পরিবেশ উপভোগ করতে করতে যেতে লাগলাম। বাইরের পরিবেশকে পেছনের দিকে ঠেলে দিয়ে আঁকাবাঁকা পথ ধরে ট্রেন এগিয়ে যাচ্ছে। আরফান আর শরিফ এতদিনে আমার মতই অনেক বড় হয়ে গেছে নিশ্চয়। এখন কি ওদের দেখে চিনতে পারব?? তবে ওদের ছোট বেলার চেহারা আমার স্পষ্ট মনে আছে। এসব ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পরলাম। রাত ১২ টার সময় ট্রেন গিয়ে পৌছল। আমি ট্রেন থেকে নামলাম। জংশন বলে ট্রেন পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করে চলে গেল। স্টেশান থেকে শরিফের বাড়ি কাছেই চল্লিশ মিনিটের পথ ভ্যানে করে যেতে হবে তাই আগে থেকেই ডিসিশান নিয়েছিলাম আগে শরিফের বাড়িতে উঠবো, তারপরে আরফান এর বাড়িতে। আশেপাশে তাকিয়ে দেখি কোন ভ্যান কিংবা রিক্সা কিছুই নেই। এত রাতে এখান থেকে কিভাবে যাওয়া যায় খবর নেয়ার জন্য স্টেশান মাস্টারের রুমে গেলাম, গিয়ে দেখি স্টেশান মাস্টার নেই একজন পাহারাদার আছে; সেও ঘুমিয়ে গেছে। কয়েকবার ডাক দেয়াতেও লাভ হলনা। ফাঁকা স্টেশান, শীতের রাত শুনশান চারিপাশ গা কেমন জানি ছমছম করছিল। খুবই টেনশানে পরে গেলাম, একটু ভয় ভয়ও লাগছিল। টেনশান দূর করার জন্য পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটা সিগারেট ধরালাম, আর ভাবতে লাগলাম এভাবে আসা কি ঠিক হল। ওরা যদি আমাকে না চিনে তাহলে এত রাতে কোথায় যাব?? টেনশানের মাত্রা ধীরে ধীরে বাড়তে লাগলো।

হঠাৎ দেখি ট্রেন লাইন ধরে স্টেশানের দিকে কেউ একজন আসছে। দূর থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছেনা তবে লোকটা চাদর মুড়ি দেয়া। একই সাথে কিছুটা স্বস্তি এবং ভয় লাগছিল। লোকটা আমার দিকে আসতে আসতে নির্দিষ্ট একটা দূরত্ব বজায় রেখে হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল। এখন আর আমার মোটেও স্বস্তি লাগছেনা বরং ভয় ভয় লাগছে। লোকটা যদি ডাকাত ঠাকাত কিছু হয়??? আমি খুব রিলাক্স ভান করে সিগারেট টানছি কিন্তু মনের মধ্যে জমের ভয় আমাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। খেয়াল করে দেখলাম লোকটা একটু পরপর আমার দিকে ঘুরে ঘুরে তাকাচ্ছে। এবার আমার ভয় আগের তুলনায় দ্বিগুন পরিমান বাড়তে শুরু করেছে… কিছুক্ষন পর দেখি লোকটা আমার দিকেই আসছে। প্রচন্ড শীতেও আমার শরীর বেয়ে দরদর করে ঘাম ঝরছে। আসতে আসতে লোকটা প্রায় কাছেই চলে এসেছে, স্টেশানের আবছা আলোয় চেহারা কারোরই ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না। আমি একটু নড়েচড়ে দাঁড়ালাম, লক্ষ্য করলাম লোকটার দুই পায়ে দুই রকমের স্যান্ডেল, সাদা প্যান্ট পড়া, মাফলার দিয়ে পুরো মুখ ঢাকা শুধু চোখটা বের করা। আমি কিছু জিজ্ঞেস করতেই লোকটা বলল- তুমি রাফাত না?? তোমার বাবা কৃষি অফিসে চাকরী করতো। তোমরা কোয়ার্টারে থাকতে।
আমি অবাক হয়ে গেলাম। এই লোক আমাকে চিনে কিভাবে??? আমি জিজ্ঞেস করলাম আপনি কে??

আমি আরফান এই বলেই মাফলার খুলে আমার দিকে তাকালো।

এবার আমার চিনতে একদমই কষ্ট হলোনা। সেই চোখ, সেই মুখ, চেহারার মধ্যে সেই আগের মতই সাহসী একটা ছাপ ফুটে আছে। আমার ভয় নিমিষেই দূর হয়ে গেল, খুশিতে আমি আরফান কে জড়িয়ে ধরলাম। আরফানও আমাকে এতদিন পর দেখে খুব খুশিতে আলিঙ্গন করলো।
আমি জিজ্ঞেস করলাম অন্ধকারে তুমি আমাকে চিনলে কি করে???

উত্তরে আরফান বলল- গ্রামের ছেলে অন্ধকার-আলো একইরকম চিনতে কষ্ট হয়না। কিন্তু এতদিন পর চিনতে কষ্ট হওয়ারই কথা। আরফান বলল- তোমার চেহারা আমার স্পষ্ট মনে আছে। আর তাছাড়া তুমি একটুও বদলাওনি। আমি বললাম- এতরাতে তুমি এখানে থাকবে আমি ভাবতেই পারিনি, অনেকক্ষন যাবত এখানে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম কি করবো, কাউকে পাচ্ছিলামও না জিজ্ঞেস করার জন্য। আগে থেকেই চিন্তা করে এসেছি শরিফের বাড়িতে উঠবো, তারপর সকালে তোমার সাথে দেখা করবো। তোমাদেরকে অবাক করে দেব ভেবেছি, কিন্তু তুমি ই আমাকে অবাক করে দিলে। তো এতরাতে তুমি এখানে কি মনে করে??

আরফান বলল আমার এক মামা আসার কথা, উনাকে নিতেই এখানে এসেছি। মনে হয় উনি ট্রেন মিস করেছেন। শেষ রাতের আগে আর আসবেন না। এত রাতে এখন ভ্যান পাওয়া যাবেনা, চলো তোমাকে শরিফের বাড়ি পৌছে দিয়ে আসি, ততক্ষনে হয়তো মামা চলে আসবে...।

ব্যাগ টা তুলে নিয়ে আমি শরিফের বাসার উদ্দেশ্যে আরফানের সাথে রওনা করলাম। সরু কাঁচা রাস্তা ধরে আরফানের সাথে হেঁটে চলেছি। রাস্তার পাশে অসংখ্য গাছ সারি সারি সাজানো।
আচ্ছা শরিফের কি অবস্থা??? ও কেমন আছে???

ও খুবই ভাল আছে, বিয়ে করেছে, গঞ্জে একটা দোকানও দিয়েছে।

কি!!!! শরিফ বিয়েও করে ফেলেছে।

হ্যাঁ......। একটা মেয়েও আছে, চার বছর বয়স।

ওর মায়ের কি অবস্থা??

ওর মা মারা গেছে তিন বছর হল।

ইন্নালিল্লাহি ওইন্না ইলাইহির রাজিউন। কিভাবে মারা গেল??

সন্ধ্যার সময় পুকুরে গেছে পানি আনতে, পরে খোঁজাখুঁজি করে রাত তিনটার সময় পুকুরের পাশের জঙ্গলে ঘাঁড় মটকানো অবস্থায় পাওয়া গেছে। সবই বদ জ্বীনদের কারসাজি।

আচ্ছা আরফান তুমি কি এখনও সেই জ্বীন-পরীদের দেখা পেয়েছো???

আরফান ছোটবেলার মতই খুব গম্ভীর হয়ে বলল- হুম...। পেয়েছি।

কোথায় সেই পোঁড়া বাড়িতে???

আরফান কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বলল- বাদ দাও ওসব ছোটবেলার কথা মনে করে আর কি লাভ?? চলো আমরা শর্টকার্টে এই পথ দিয়ে যাই, আমিও আরফানের সাথে চলতে শুরু করলাম। এই পথটা একটু জংলাটে আশেপাশে বাড়ি ঘরের কোন ছিটেফোটাও নেই। আরফান বলল- আচ্ছা রাফাত এই যায়গাটার কথা তোমার মনে আছে??? নাহ তো, ঠিক মনে করতে পারছিনা। কেন মনে নেই, আমাদের স্কুলের রাস্তা দিয়ে গরুর গাড়িতে বোঝাই করে আঁখ নিয়ে যেত আমরা তিনজন পেছন থেকে আঁখ টেনে নিয়ে দৌড়ে পালাতাম আর এই জঙ্গলে বসে খেতাম। রাফাত বলল- একবার তোমার আঁখ টানতে গিয়ে অনেকখানি হাত কেটে গিয়েছিল। আচ্ছা তোমার হাতের কাটা দাগ টা কি এখনও আছে??

আরফান হাত বাড়িয়ে বলল- হ্যাঁ আছে। আমি দেখলাম সেই তিনটা সেলাইয়ের দাগ এখনও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। আচ্ছা আরফান এই জঙ্গলটা তো দিনের বেলাতেই খুব অন্ধকার থাকতো, আর প্রচন্ড ভয়ও লাগতো। কিন্তু এতরাতে এত পরিষ্কার লাগছে কেন, আজকে পূর্ণিমা তো তাই এত ফকফকা লাগছে।

হাঁটতে হাঁটতে আমরা জঙ্গলের শেষ মাথায় অনেকটা পথ চলে এসেছি। কিছুটা দূরে সামনে একটা বাড়ি দেখা যাচ্ছে। আরফান আমাকে ঐদিকে দেখিয়ে বলল ওটাই শরিফের বাড়ি। যাও তুমি। কেন তুমি যাবে না???- আমি জিজ্ঞেস করলাম। আরফান বলল-নাহ এখন আর যাবোনা। মামা আসার টাইম হয়ে যাবে তোমার সাথে কাল দেখা হবে। আরেকবারের মত বুকে জড়িয়ে আরফান কে বিদায় দিলাম। আরফান বলল ভাল থেকো বন্ধু, উত্তরে আমিও বললাম ভাল থেকো কাল সকালে অবশ্যই দেখা হচ্ছে...।। আর আমরা কাল আমাদের সেই পুরানো স্কুলে যাবো কিন্তু। চিল্লিয়ে বলতে থাকি আমি...।।

বাড়ির উঠোনে পা রাখতেই দেখি আশেপাশে প্রচন্ড অন্ধকার, কিন্তু একটু আগেই তো অনেক পরিষ্কার লাগছিল। শরিফদের আগের সেই মাটির ঘর নেই, ঘর পাঁকা করেছে, সবকিছু পরিবর্তন হয়ে গেছে, কারেন্টের লাইন এসেছে ঘড়ের কোনায় চল্লিশ পাওয়ারের একটা লাইট জ্বলজ্বল করছে। আমি ভেবেছিলাম সবাই ঘুমিয়ে পানি, কিন্তু ভেতর থেকে টুকটাক কথার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল। আমি শরিফ বলে ডাক দিতেই, ভেতর থেকে বলে উঠল।

কে...?? কে ওখানে??

আমার চিনতে কষ্ট হলনা এটা শরিফের কন্ঠ। আমি বললাম দরজা খুলো আমি রাফাত। দরজা খোলার আওয়াজ পেলাম, বেরূতেই শরিফ জিজ্ঞেস করলো কোন রাফাত?

আমি তোমার ছোটবেলার বন্ধু রাফাত মনে নেই আমরা একইসাথে হানিফ মাষ্টারের স্কুলে পড়তাম, স্কুলের পাশে বুড়িমার ক্ষেত থেকে শশা চুরি করে খেতাম। শরিফের সবকিছু মনে পরে গেল, তোমার সাথে আবার কখনও দেখা হবে চিন্তাই করিনি, তোমাকে তো একেবারে চেনাই যাচ্ছেনা বলে বুকে জড়িয়ে নিল আমাকে। তাড়াহুড়ো করে আমাকে ভেতরে নিয়ে গেল, বউকে ডেকে বলল- রাবেয়া দেখ কে এসেছে, তোমাকে ছোটবেলার গল্প করতাম না, আমাদের তিনজনের মধ্যে এই হল সেই রাফাত। ভেতর থেকে শরিফের বউ আসলো এসে আমাকে সালাম দিল, আমি সালামের উত্তর নিলাম। দেখলাম খুব ছোট একটা মেয়ে ইন্টারমিডিয়েট পড়ে এরকম বয়সী। রাবেয়া বলল উনি অনেক দূর থেকে এসেছেন নিশ্চয়ই খুব ক্ষুদা লেগেছে, তোমরা হাতমুখ ধুয়ে গল্প করো আমি ঝটপট খাওয়ার কিছু ব্যবস্থা করি। হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হলাম, রাবেয়া খুব চালু মেয়ে এরই মধ্যে খাবার টেবিলে সাজিয়ে ফেলেছে। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে দুই বন্ধু মিলে গল্প করতে বসলাম। পাশের রুম থেকে শরিফের মেয়ের কান্নার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে, রাবেয়া দৌড়ে চলে গেল। আমি শরিফ কে জিজ্ঞেস করলাম সন্তান সংসার নিয়ে তো একেবারে অনেক গোছালো হয়ে গেছো। আগের সেই শরিফ আর নেই, তোমার মধ্যে অনেক ভার-ভাত্ত্বিক ভাব চলে এসেছে। শরিফ বলল এতদিনে কত ঘটনা ঘটে গেছে... সে সব কথা ছাড়ো, তোমার কথা বল?? কি করছো এখন??

এইতো কেবল পড়াশুনা শেষ করলাম। লাইফ শুরু করার আগে ভাবলাম শৈশবের বন্ধুদের সাথে দেখা করা দরকার। তাই চলে এলাম।

ও আচ্ছা খুবই ভাল করেছো, তুমি আমার বাড়ি চিনলে কি করে????

সে এক মজার কাহিনী, স্টেশানে নেমে দেখি কিছুই নেই। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর, আরফানের সাথে দেখা, চাদর মুড়ি দিয়ে এসেছে, ওই তো আমাকে তোমার বাড়ি পর্যন্ত পৌছে দিল।

আরফান পৌছে দিল মানে??? এটা কি করে সম্ভব??? (খুব অবাক হয়ে শরিফ জিজ্ঞেস করলো)।

কেন কি হয়েছে??? (আমি জিজ্ঞেস করলাম)

আরফান তো মারা গেছে তোমরা দামুড়হুদা থেকে চলে যাওয়ার কয়েকমাস পরেই। তোমার মনে আছে আমরা যে পোঁড়াবাড়িতে যাওয়ার জন্য প্রতিজ্ঞা করেছিলাম। তুমি তো চলে গেলে, তার কয়েকমাস পরেই হঠাৎ একদিন বিকেলবেলা ও আমাকে বলল চল শরিফ আজকে আমাবস্যার রাত আজকে পোঁড়াবাড়িতে যাবো। আমিও রাজি হলাম, নদী পার হয়ে যেতে যেতে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল। ওকে বললাম দোস্ত আমার ভয় করছে চল চলে যাই, কিন্তু ও নাছোড়বান্দা ও যাবেই। আমাকে বলল তুই না গেলে না যা আমি আজকে যাবোই। আমার সাহসে কুলায়নি, আমি ওকে রেখেই চলে এসেছি। আমি ওকে অনেকবার বারণ করা সত্ত্বেও ও শুনেনি। তারপর......
শরিফের কথা শুনে আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল। ভয়ে আমার শরীর শিউরে উঠলো। আমি কাঁপা কাঁপা কন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম- তারপর???

তারপর আরফান আর ফিরে আসেনি......

শরিফের কাছ থেকে জানতে পারলাম আজকে পূর্ণিমা না, আজকে আমাবস্যার রাত........

উৎসর্গঃ আমার প্রয়াত দাদা জনাব হাসেম মিয়া। খুবই সাহসী এবং ভাল প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। তাকে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি, আমার জন্মের একুশ দিন আগে তিনি মারা গেছেন। না দেখলেও এই লোকটাকে আমি আমার আদর্শ মানি।
১০টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসলামের বিধান হতে হলে কোন কথা হাদিসে থাকতেই হবে এটা জরুরী না

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ১০:৫৫



সূরাঃ ৫ মায়িদাহ, ৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
৩। তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে মৃত, রক্ত, শূকরমাংস, আল্লাহ ব্যতীত অপরের নামে যবেহকৃত পশু, আর শ্বাসরোধে মৃত জন্তু, প্রহারে মৃত... ...বাকিটুকু পড়ুন

লবণ্যময়ী হাসি দিয়ে ভাইরাল হওয়া পিয়া জান্নাতুল কে নিয়ে কিছু কথা

লিখেছেন সম্রাট সাদ্দাম, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১:৫৪

ব্যারিস্টার সুমনের পেছনে দাঁড়িয়ে কয়েকদিন আগে মুচকি হাসি দিয়ে রাতারাতি ভাইরাল হয়েছিল শোবিজ অঙ্গনে আলোচিত মুখ পিয়া জান্নাতুল। যিনি একাধারে একজন আইনজীবি, অভিনেত্রী, মডেল ও একজন মা।



মুচকি হাসি ভাইরাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×