somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

।। আমার হাইস্কুল।। পর্ব-৩।।

২১ শে জুলাই, ২০১৩ বিকাল ৪:০৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমাদের দীঘিরজান হাইস্কুলের জমিতেই দীঘিরজান বাজার। বাজার থেকে স্কুলের একটা বাৎসরিক আয় হয়। আমাদের হেডস্যার বাবু মনীন্দ্রনাথ মজুমদার ও অনন্ত কুমার মজুমদার স্যারের পূর্ব পুরুষরা এই স্কুলের জন্য জমি দান করেছিলেন। সেই হিসেবে আমাদের স্কুলের প্রায় সকল কিছুতেই হেডস্যার আর অনন্ত স্যারের একটু বেশি মায়া। স্কুলকে স্যাররা নিজের সন্তান মনে করতেন। শনিবার আর মঙ্গলবার বসতো দীঘিরজানের হাট। এখনো বসে সপ্তাহে দুই দিন। সেই হাটের দিনে বাজার থেকে যে খাজনা ওঠে, তার একটা অংশ বছর শেষে স্কুল ফান্ডে জমা হয়। যা দিয়ে স্কুলের উন্নয়নমূলক কাজ হয়। আমরা যখন পড়তাম তখন সায়েন্স বিল্ডিংয়ের কাজ শুরু হল। আমরা যখন ক্লাশ নাইনে উঠলাম, তখন আমরা সেই সায়েন্স বিল্ডিংয়ে সায়েন্সের সকল ক্লাশ করতাম। প্রাকটিক্যাল করতাম। এখানে একটা বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন, আমাদের এই স্কুল কিন্তু বেশ পুরাতন। ১৯২১ সালের জুলাই মাসে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা, আমাদের স্কুল তারও চার মাসে সূচনা করেছিল। গোটা পিরোজপুর মহাকুমায় আমাদের স্কুল পুরাতন স্কুলের একটি। নাজিরপুর থানায় তো আমাদের স্কুল সবচেয়ে পুরাতন।
২০২১ সালে আমার স্কুল শতবর্ষে পদার্পন করবে। তখন একটা জাঁকজমক অনুষ্ঠান করার ইচ্ছে আমার আছে। অনন্ত স্যারের বয়স এখন ৯৬ বছর। হেডস্যারে প্রায় ৮৫ বছর। আমার স্যারদের সবাই রিটায়ার্ড করেছেন। কিন্তু এই স্কুলের জন্য তাঁদের মায়া এখনো ঠিক আগের মতো অটুট। আমরা যে বছর এসএসসি পরীক্ষা দেই সে বছর রেজাল্টে আমাদের স্কুল নতুন রেকর্ড করেছিল। পরে সেই ভেঙেছে কিনা আমার জানা নেই। তখন ২ টা স্টার, ১২ টা ফার্স্ট ডিভিশান, ৬৬ টা সেকেন্ড ডিভিশান আর ৮ টা থার্ড ডিভিশান পেয়েছিল। পাসের হার শতকরা ১০০ ভাগ। আমরা তখন ৮৮ জন পরীক্ষা দিয়েছিলাম। আমাদের স্কুলে দশম শ্রেণী'র টেস্ট পরীক্ষায় কেউ ফেল করলে সে বোর্ডের পরীক্ষা দেবার জন্য আনফিট ছিল। হেডস্যার এটা খুব শক্তভাবে মনিটর করতেন। কখনো কখনো সন্দেহ হলে দুইবার খাতা দেখাতেন হেডস্যার। আর আমাদের বাংলা খাতা প্রথমে নির্মল স্যার দেখলেও পরে হেডস্যার আবার দেখতেন। তখন হিসেব টা ছিল এমন। যদি কেউ হেডস্যারের দেখা বাংলায় ৪০ মার্ক পায়, সে বোর্ডের ফাইনালে একই রকম ভালো পরীক্ষা দিলে নিশ্চিত ৬০ পাবে। হেডস্যার যাদের ২৫ দিতেন তারা মিনিমাম ৪০ পাবার যোগ্য। নির্মল স্যারের কাছে টেস্টে আমি বাংলায় পেয়েছিলাম প্রথম পত্রে ৭৭ আর দ্বিতীয় পত্রে ৮৪। হেডস্যার যখন দেখলেন তখন প্রথম পত্রে পেলাম সাড়ে ৫৮ আর দ্বিতীয় পত্রে ৬৩। আর এসএসসি'র ফাইনালে প্রথম পত্রে পেলাম ৭৬ আর দ্বিতীয় পত্রে পেলাম ৮৩। ১ নম্বরের জন্য আমি দুটো লেটার পাইনি। বাংলায় হেডস্যার যাদের ২৫ এর উপরে দিতেন তারা হেডস্যারের বিশেষ বিবেচনায় ফাইনাল পরীক্ষা দিতে পারতো। অবশ্য সেই খাতাগুলো স্যার বার বার দেখতেন। তখন সিদ্ধান্ত নিতেন কে কে পরীক্ষা দিতে পারবে।
এরপরেই শুরু হতো আমাদের নিবিঢ় ক্লাশ। সেই ক্লাশ শুধু পরীক্ষার্থদের জন্য। কে কি ভুল করেছি, সেই ভুল কিভাবে ঠিক হবে, তা আমাদের টেস্ট খাতা দেখিয়ে ক্লাশে আলোচনা করা হতো। আমার ধারণা, দশম শ্রেণীর সেই টেস্ট পরবর্তী তিন মাসের বিশেষ ক্লাশগুলো'র কারণেই আমাদের স্কুল সব সময় ভালো রেজাল্ট করতো। আমাদের স্কুলের আরেকটা নিয়ম ছিল খুব সুন্দর। ছাত্রছাত্রীরা কি করছে তা প্রতি শনিবার আর মঙ্গলবার গার্ডিয়ানদের অবহিত করতেন হেডস্যার। যারা হাটের দিন সময় করতে পারতেন না তারা শুক্রবার ছুটির দিনে স্যারের বাড়িতে যেতেন। হেডস্যার যা পরামর্শ দিতেন গার্ডিয়ানরা তাই মেনে নিতেন। অর্থ্যাৎ আমাদের স্কুলের সাথে আমাদের সবার গার্ডিয়ানদের একটা সুসম্পর্ক সব সময়ই ছিল। কেউ দেখা করতে না আসলে নারায়ন দা'কে হেডস্যার চিঠি লিখে তার বাড়িতে পাঠাতেন। তখন অনেককে হাতের কাজ ফেলে হেডস্যারের সঙ্গে দেখা করা লাগতো। অর্থ্যাৎ স্কুলের এ টু জেড সবাই হেডস্যারের কড়া নজরের মধ্যে ছিল।
সেই সুযোগে হেডস্যারের জঙ্গলে যখন যে ফল হতো, আম-জাম-লিচু-পেঁপে-আনারস-কাঁঠাল-জামরুল (আমরা বলতাম লকোট) সব আমাদের দুষ্টু ছেলেদের পেতে যেতো। এ নিয়ে হেডস্যার অবশ্য তেমন মাথা ঘামাতেন না। সময়ও পেতেন না। হেডস্যারের বাবাকে আমরা ডাকতাম দাদু। দাদু'র বয়স তখন ১১৭ বছর। কিন্তু দিব্যি হালচাষ করতেন। হেডস্যার আর হেডস্যারের দুই ছেলে বাপী আর জয় ছিল দাদু'র হেলপার। স্কুলের দক্ষিণ পাশেই হেডস্যারদের জমি। সেখানে মরিচ, আলু, ধনিয়া, কফি, মূলা, লালশাক ইত্যাদি আবাদ করতেন দাদু। কখনো কখনো হেডস্যার ক্লাশের ফাঁকে দেখতাম দাদুকে সহযোগিতা করছেন। দাদু'র একজন পার্মানেন্ট হেলপার অবশ্য ছিল। জগদিশ। আমরা ডাকতাম জগাই। দাদু'র কাজকর্ম দেখে অনেকে হেডস্যারকে ভুল বুঝতো। আর হেডস্যার বলতেন, বাবা কাজ না করলে বাঁচবে না।
তো সে বছর স্বৈর শাসক এরশাদ একটা হ্যা না ভোটের আয়োজন করলো। প্রাইমারি স্কুলগুলো হল ভোটকেন্দ্র। দাদু তো দুপুর পর্যন্ত নিজের মাঠে আবাদ নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। তারপর বাড়িতে গিয়ে গা গোছল দিয়ে একটু খেয়ে উত্তর বানিয়ারী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভোট দিতে আসলেন দাদু। সেদিন আমাদের স্কুল ছিল বন্ধ। আমরা ওই স্কুলের পাশেই একটা দোকানের সামনে বসে দাবা খেলছিলুম। তো প্রাইমারি স্কুলের হেডমাস্টার সেকেন্দার মিঞা আমাদের কাছে আসলেন। আমার দূর সম্পর্কের মামা হন তিনি। বললেন, তোমাদের দাবা'র এই দান শেষ হলে স্কুলে এসে কিছু ভোট দিয়ে যাও। সেই প্রথম ভোটার না হয়েও ভোট দেবার অভিজ্ঞতা হয়েছিল। সেকেন্দার মাস্টার আমাদের বুঝিয়ে দিলেন, দশটা মারবা হ্যা সিল আর একটা মারবা না'তে। আমরা চার-পাঁচ জন দাবারু ও দাবা খেলা দেখতে থাকা লিলিপুট কেউ কেউ সেকেন্দার মাস্টারের অনুরোধ ফলো করলাম। আর খুব মজা পেলাম যে ভোট দিতে পারছি। আমি সিল মারি আর এক লিলিপুট ভাঁজ করে। আমরা ঘণ্টা খানেক এই কাজে বেগার দিলাম। ওই সময় আমাদের হেডস্যারের বাবা, মানে আমাদের সবার খুব প্রিয় দাদু ভোটকেন্দ্র । ভোট দিতে আসলেন। সেকেন্ড মাস্টার হল হাসান। তার বাড়ি ভাইজোড়া। মরা বলেশ্বরের ওপারে। তিনি হেডস্যারের বাবাকে ভালো করে খেয়াল করেন নি। দাদু ভাই ভোট দিতে চাইলেন। হাসান মাস্টার হাতের লিস্ট দেখে বললেন, আপনার ভোট তো দেওয়া হয়ে গেছে। আপনি বাড়ি চলে যান। ভোটকেন্দ্র তখন একদম ফাঁকা। আসলে সারা দিনই ফাঁকা ছিল। দাদু'র মতো অতি উৎসাহী দু'একজন বুড়ো রেডিও'র খবর শুনে ভোট দিতে এসেছিলেন। তারা সকালেই ভোট দিয়েছেন। দাদু কাজ শেষে পরন্ত বেলায় আসলেন। শুনলেন তার ভোট দেওয়া হয়ে গেছে!
পরন্ত বেলায় ভোটকেন্দ্রে তখন কয়েকজন বেকার পুলিশ, কয়েকজন আনসার, আমরা কয়েক ছোকরা, কয়েকজন প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক আর একমাত্র আগন্তুক ভোটার হেডস্যারের বাবা আমাদের দাদুভাই। হাসান মাস্টার যখনই বললেন, আপনার ভোট তে দেওয়া হয়ে গেছে। অমনি দাদুভাই চিৎকার করে উঠলেন। মুই মনীন্দ্র'র বাপ। মুই আইলাম না। সারা দিন কাম করছি। মোর ভোট ক্যাডা দেবে? মোরে চেনো না? দাদুভাই'র চিৎকারে পাশের রুম থেকে সেকেন্দার মাস্টার দৌড়ে আসলেন। কি হয়েছে দাদু? সেকেন্দার, মোর ভোট নাকি কোন হালার পো দিয়া গ্যাছে? তুমি থাকতে মোর ভোট কেমনে দিলো? মোরে তুমি চেনো না? মোর ভোট জাল হয় কি করে? সেকেন্দার মাস্টার দাদুকে আরেকটা ব্যালট পেপার দিয়ে ভোট দেবার চেষ্টা করেছিলেন। দাদুভাই তা প্রত্যখ্যান করে ভোটের লিস্ট দেখতে চাইলেন। ভোটার লিস্টে দাদুভাই'র নামের পাশে কালো কালী'র দাগ। মানে ভোট কেউ দিয়েছে। তারপর দাদুভাই গালাগালি করতে করতে বাড়ির দিকে হাঁটা ধরলেন। সেকন্দার মাস্টার দাদু'র পেছন পেছন গেল।
আর অন্য মাস্টাররা আমাদের নিয়ে ভোট বাক্স ঢেলে ভোট গণণা শুরু করলো। মোট কাস্টিং ভোট ১৭৬৪। এর মধ্যে হ্যা ভোট পেয়েছিল ১৫৯১ টা। ১৬২ টা না ভোট। আর ১১ টা পচা ভোট। মানে নষ্ট হয়েছে। সিল ঠিক মতো পড়েনি। আমার ধারণা, সারা দেশে সে বছর ওভাবেই হ্যা-না ভোট হয়েছিল। কিন্তু দাদু যে ভোট দিতে পারেন নি, সেই দুঃখে সেদিন প্রথম আমরা দাদুকে গালাগাল করতে দেখেছিলুম।
....................চলবে..........................
পর্ব ১ ও ২ এই লিংকে
Click This Link
Click This Link

সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জুলাই, ২০১৩ রাত ৮:৩৮
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ঝিনুক ফোটা সাগর বেলায় কারো হাত না ধরে (ছবি ব্লগ)

লিখেছেন জুন, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:০৯

ঐ নীল নীলান্তে দূর দুরান্তে কিছু জানতে না জানতে শান্ত শান্ত মন অশান্ত হয়ে যায়। ১৯২৯ সালে রবার্ট মোস নামে এক ব্যাক্তি লং আইল্যান্ড এর বিস্তীর্ণ সমুদ্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

মামুনুলের মুক্তির খবরে কাল বৃষ্টি নেমেছিল

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৪৯


হেফাজত নেতা মামুনুল হক কারামুক্ত হওয়ায় তার অনুসারীদের মধ্যে খুশির জোয়ার বয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ তো বলল, তার মুক্তির খবরে কাল রাতে বৃষ্টি নেমেছিল। কিন্তু পিছিয়ে যাওয়ায় আজ গাজীপুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ অপেক্ষা

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২৩



গরমের সময় ক্লাশ গুলো বেশ লম্বা মনে হয়, তার উপর সানোয়ার স্যারের ক্লাশ এমনিতেই লম্বা হয় । তার একটা মুদ্রা দোষ আছে প্যারা প্রতি একটা শব্দ তিনি করেন, ব্যাস... ...বাকিটুকু পড়ুন

×