somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মায়ানমারের সাথে সমঝোতা চুক্তি একটি দুর্বল কূটনৈতিক তৎপরতা!!!

২৪ শে নভেম্বর, ২০১৭ বিকাল ৪:৩৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মায়ানমারের রাখাইন প্রদেশ থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন আগামী দু'মাসের মধ্যে শুরু হতে পারে। গতকাল বৃহস্পতিবার মায়ানমারের রাজধানী নেপিডোতে মায়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে একটি কূটনৈতিক সমঝোতা চুক্তি হয়েছে। ''অ্যারেঞ্জমেন্ট অন রিটার্ন অফ ডিসপ্লেসড পারসনস ফ্রম রাখাইন স্টেট'' (রাখাইন রাজ্যের বাস্তুচ্যুত মানুষদের ফিরিয়ে আনার সমঝোতা) নামে বৃহস্পতিবার দুপুরে মায়ানমারের স্টেট কাউন্সিলের অফিসে ওই সমঝোতার দলিল চূড়ান্ত হয়।

বাংলাদেশের পক্ষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী এবং মায়ানমারের পক্ষে ইউনিয়ন মিনিস্টার ইউ চ্য টিন্ট সোয়ে ওই সমঝোতা দলিলে স্বাক্ষর করেন। তবে মায়ানমার সরকার ওই দলিল স্বাক্ষরের পর এক বিবৃতিতে ঘোষণা দিয়েছে যে, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন এবং ১৯৯২ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পাদিত দ্বিপাক্ষিক চুক্তি অনুযায়ী হচ্ছে কিনা তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে।


উল্লেখ্য, ১৯৮২ সালে মায়ানমার সামরিক জান্তা কর্তৃক প্রণীত চুক্তির ফলেই রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়া হয়, যদিও তারা সেখানে কয়েক শতাব্দী ধরে বসবাস করছেন। মূলত মায়ানমার সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞের হাত থেকে বাঁচতেই গত ৩ মাসে প্রায় সোয়া ৬ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। এর আগে থেকে নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত মিলিয়ে আরো কয়েক লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে বসবাস করছেন। রোহিঙ্গাবিরোধী অভিযানের পরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়নের নেতৃত্ব দিয়েছে সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনী উগ্র বৌদ্ধদেরও রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে উসকে দিয়েছে।

ওদিকে চীন সফররত মায়ানমার সেনাপ্রধান হ্লাইং বুধবারও বলেছেন, রাখাইন পরিস্থিতি স্থানীয় রাখাইন নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী (মগ) ও বাঙালি (রোহিঙ্গা) উভয়ের কাছে অবশ্যই গ্রহণযোগ্য হতে হবে। বরং স্থানীয় রাখাইন নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীই মায়ানমারের সত্যিকারের নাগরিক এবং সে কারণে তাদের ইচ্ছাকেই প্রাধান্য দিতে হবে। তিনি রোহিঙ্গাদের ফের বাঙালি তথা অবৈধ অভিবাসী বলে মন্তব্য করেছেন। মগরা রোহিঙ্গা নিধনে সেনাদের সহযোগী এবং তারা চায় না রোহিঙ্গারা ফের ফেরত যাক।


রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কতোটা বাস্তবায়ন হবে?
১. সমঝোতা চুক্তিতে ঠিক কত সময়ের মধ্যে রোহিঙ্গাদের মায়ানমারে ফিরিয়ে নেওয়া হবে, তার কোনো সুনির্দিষ্ট সময় সীমা বলা হয়নি। যে কারণে মায়ানমার সরকার যে কোনো অযুহাতে এটা যখন খুশি বন্ধ করে দিতে পারে।
২. মায়ানমার সেনাবাহিনী বলছে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন এবং ১৯৯২ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পাদিত দ্বিপাক্ষিক চুক্তি অনুযায়ী হচ্ছে কিনা তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে। এই পরীক্ষা-নিরীক্ষার নামে অনেক রোহিঙ্গা তারা গ্রহণ করবে না।
৩. জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গোষ্ঠীকে পাশকাটিয়ে মায়ানমারের সাথে বাংলাদেশের এই তড়িঘড়ি সমঝোতা চুক্তি আসলে গত সপ্তাহে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরের ফসল। ফলে চীন যেভাবে চাইবে মায়ানমার সেনাবাহিনী সেভাবে তা বাস্তবায়ন করবে। এখানে বাংলাদেশের কোনো বক্তব্যকে গ্রহণযোগ্য ধরবে না মায়ানমার।
৪. বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় দশ লাখের উপরে রোহিঙ্গা বসবাস করছেন। মায়ানমার এদের সবাইকে ফিরিয়ে নেবে বলে কোনো গ্র্যান্টি এই সমঝোতা চুক্তিতে নেই।
৫. অং সান সু চির সরকার আন্তর্জাতিক চাপের ফলে রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে বাংলাদেশের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি করলেও তাদের প্রত্যাবাসন ঠেকিয়ে দিতে পারে মায়ানমার সেনাবাহিনী। কারণ সেনাদের ঠেকানোর কোনো ক্ষমতাই নেই সু চির। সামরিক জান্তা প্রণীত সংবিধানেই মায়ানমারের সেনাবাহিনী সরকারের ভেতরেই আরেক ক্ষমতাধর সরকার।
৬. সম্প্রতি মায়ানমার সফরকালে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন মায়ানমার সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইংয়ের সঙ্গে একান্তে বৈঠক করেন। সেই বৈঠক যে ফলপ্রসূ হয়নি তা বোঝা যায় বুধবার টিলারসনের দেয়া বিবৃতিতে। এতে তিনি রাখাইনে মায়ানমার সেনাবাহিনী জাতিগত নিধন চালাচ্ছে বলে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেন।
৭. মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যে অব্যাহত ‘জাতিগত নির্মূল অভিযানের’ প্রতিবাদে মায়ানমারের সুনির্দিষ্ট ব্যক্তিবিশেষের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথা বিবেচনা করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র যদি কূটনৈতিক কারণে মায়ানমার সামরিক বাহিনী বা মায়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে ঢালাওভাবে অর্থনৈতিক বা সামরিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, তাহলে চীন মায়ানমারকে নতুন কৌশল নিতে পরামর্শ দেবে। সেক্ষেত্রে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন মুখ থুবড়ে পড়বে।
৮. বুধবার বেইজিংয়ে চীনের সেন্ট্রাল মিলিটারি কমিশনের জয়েন্ট স্টাফ ডিপার্টমেন্টের প্রধান জেনারেল লি জুচেংয়ের সঙ্গে বৈঠক করেন চীন সফররত মায়ানমার সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইয়াং। চীনের সাথে মায়ানমারের সামরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির পাশাপাশি উভয় দেশ আঞ্চলিক শান্তি, স্থিতি ও নিরাপত্তার স্বার্থে চীন মায়ানমারের সেনাবাহিনীর সঙ্গে আরও সম্পর্কোন্নয়ন চায়। ফলে রোহিঙ্গা ইস্যুর প্রধান কলকাঠি আসলে চীনের হাতে। সেখানে বাংলাদেশ এক ঠুটো জগন্নাথ।
৯. রোহিঙ্গা সঙ্কটের আন্তর্জাতিকীকরণের বিরোধিতা করে মায়ানমার সরকারের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে সমস্যা শান্তিপূর্ণ দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মধ্য দিয়ে সমাধান করতে হবে। মায়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দুই দেশের মধ্যে সর্বশেষ সমঝোতাকে 'উইন-উইন সিচুয়েশন' বা দু'পক্ষের জন্য বিজয় বলে বর্ণনা করেছে। যা বাংলাদেশের কূটনৈতিক পরাজয়ের জ্বলন্ত উদাহরণ।

রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ এককভাবে মায়ানমার সরকারের সাথে কূটনৈতিক খেলায় কোনোদিন বিজয়ী হতে পারবে না। বরং জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক মাধ্যমগুলোর অনুপস্থিতে এই সমঝোতা চুক্তি এখন মায়ানমার সরকারের পক্ষেই গেল। মায়ানমার এখন ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন এবং ১৯৯২ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পাদিত দ্বিপাক্ষিক চুক্তি অনুযায়ী পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে কিছু রোহিঙ্গা হয়তো ফেরত নেবে, কিন্তু তা মোটেও দশ লাখ রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবার মত বিষয় হবে না। ফলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মায়ানমার সফর এবং রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সমঝোতা চুক্তি একটি দুর্বল কূটনৈতিক তৎপরতা। যা কখনো পুরোপুরি আলোর মুখ দেখবে না।

-----------------------------
২৪ নভেম্বর ২০১৭

সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে নভেম্বর, ২০১৭ বিকাল ৪:৩৮
৭টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×