somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মাকে খুব মনে পড়ে!

২৭ শে জানুয়ারি, ২০২৩ ভোর ৫:০৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মাকে খুব মনে পড়ে!

আজ আমার মায়ের ১৪তম মৃত্যুবার্ষিকী। ২০০৯ সালের ২৭ জানুয়ারি আমার মা আমাদের ছেড়ে অনন্তলোকে পাড়ি দেন। কিন্তু এখনও আমার কাছে মনে হয়- এই সেদিনের কথা! মায়ের সকল কথা, কথা বলার ঢঙ, হাসি, সবকিছু এখনও আমার দিব্যি মনে আছে। শেষজীবনে আমার মায়ের কোনো দাঁত ছিল না। কিন্তু হাসলে খুব সুন্দর লাগতো।

আমরা অনেকগুলো ভাইবোন। পাঁচ ভাই আর চার বোন। পঞ্চপাণ্ডবের মধ্যে আমি তৃতীয়, আমি অর্জুন। মায়ের সাথে আমার ছিল একটি স্পেশাল বন্ডিং। পরিবারে আমি ছিলাম সবচেয়ে দুরন্ত। তাই আমার নামে বাবার কাছে সবচেয়ে বেশি নালিশ আসতো। কোন নালিশের কেমন শাস্তি, তা নিশ্চয়ই সবাই বুঝতে পারো।

কিন্তু মা ছিল পরিবারে আমার প্রধান গোয়েন্দা। বাবা কর্তৃক শাস্তি নাজিল হবার আগেই আমি মায়ের থেকে সবকিছু ডিটেলস জেনে নিয়ে পগার পার। মানে পালিয়ে যেতাম। আমার একটি পালানোর জায়গা ছিল তুহিনের বিছানা। হয়তো বাবা-মা আমার খোঁজেই তুহিনদের বাড়িতে গেছে, কিন্তু একবারও বুঝতে পারতো না যে, কয়েক গজ দূরেই আমি দিব্যি লুকিয়ে আছি!

তুহিনের মা যাকে আমি ডাকতাম কাকিমা, আমাকে ভীষণ পছন্দ করতেন, আদর করতেন, ভালোবাসতেন। আমার লুকিয়ে থাকার ব্যাপারটা আন্দাজ করতে পেরে কাকিমা সবসময়ই আমার যথাযথ খাবারের ব্যবস্থা করতেন। আমার মা-বাবা তুহিনের মাকে ডাকতো দাদীজান। তাদের দাদীজান যে আমার অবস্থান জানতেন, এটা তারা কিছুতেই বুঝতে পারতেন না। তারা তাদের দাদীজানের কাছ থেকে পান খেয়ে কিছুক্ষণ গালগপ্পো করে একসময় বাড়িতে ফিরে যেতেন। যাবার সময় মাকে কানেকানে কাকীমা হয়তো বলে দিতেন- আর খুঁজতে হবে না, তোমরা এখন বাড়ি গিয়ে ঘুমাও। সকালে নিশ্চয়ই বান্দরটা বাড়ি ফিরে যাবে।

আমি আর আমার ছোট ভাই জাকিরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মারামারি হতো। মারামারিটা লাগতো দাবা খেলা নিয়ে। আর প্রায় মাসেই আমাদের দাবার কোর্ট বাবা কয়েকবার ছিড়ে ফেলতেন। কিন্তু পরের দিনই হয়তো আমরা বিকল্প উপায়ে দাবার কোর্ট বানিয়ে কিংবা নতুন কোর্ট কিনে আবার খেলা শুরু করতাম। আবার মারামারিও নতুন করে শুরু হতো। ছোটবেলায় এটা ছিল আমাদের একটা দৈনন্দিন ব্যাপার!

আমার বাবা-মা বা তুহিনের মা-বাবা কেউ আর এখন পৃথিবীতে নাই। সেই ছোটবেলার মধুর দিনগুলো কতই না সুন্দর ছিল। তুহিনের সাথেও অনেকদিন দেখা হয় না। তুহিন এখন অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী। আমার মাকে তুহিন ওরা ডাকতো ফুফু আর বাবাকে ডাকতো জামাই। তুহিনের নিজেদের ফুফু'র চেয়ে আমার মা ছিল ওদের বাড়ির কাছের প্রিয় ফুফু।

আমার বাল্যবন্ধু প্রকাশ। প্রকাশের মাকে আমরা ডাকতাম দিদি। আর আমার মাকে ওরা ডাকতো দিদি আর বাবাকে দাদা। দিদির সাথে আমার মায়ের ছিল দারুণ একটা সম্পর্ক। আজ দিদিও নাই, মাও নাই। আমি ভারতে থাকার সময়ে দিদি অনন্তলোকে চলে গেলেন। তবে দিদিকে আমার 'হরিবোল' চলচ্চিত্রে ৮ সেকেন্ড জীবন্ত ধরে রেখেছি। প্রকাশকে আমি সেকথা প্রায়ই বলি যে- দিদিকে আমি ক্যামেরায় ধরে রেখে আমার কাছে জীবন্ত করে রেখেছি।

প্রতিবেশীদের সাথে আমার মায়ের খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। আমাদের মামাবাড়ি আমাদের বাড়ি থেকে দুই আড়াই কিলোমিটার দূরে। ছোটবেলায় নানীর হাতে ডাল খাওয়া ছিল আমার একটা প্রিয় শখ। আমার নানী দুর্দান্ত ডাল রান্না করতেন। নানীর হাতের ডাল যে একবার খেয়েছে, সে এখনও মনে রাখার কথা। আমি ডাল খেতে চাইলেই মা বলতো, যা তোর নানীকে নিয়ে আয়।

আমি আর ছোট ভাই জাকির এক দৌড়ে মামাবাড়ি গিয়ে নানীকে যে অবস্থায় পেতাম, সেই অবস্থায় বুড়িকে পাকড়াও করে নিয়ে আসতাম। পরে আবার আমাদের আরেকবার মামাবাড়িতে যাওয়া লাগতো বুড়ির কাপড়চোপড় আনতে। কিন্তু বুড়ির ডাল রান্না করার কৌশলটাও ছিল ভারী চমৎকার। সকালবেলায় জ্বালায় (বড় মাটির পাত্র) বুড়ি ডাল চড়াতেন।

তারপর সারাদিন ধরে বুড়ি ডাল রান্না করতেন। দুপুরে খাওয়ার সময় পর্যন্ত বুড়ি সেই ডাল রান্না করতেন। পুরোটা সময় বুড়ি নারকেলের চামচ দিয়ে সেই ডাল ঘুটতেন। বুড়ির হাতের ডাল ঘুটোনি যে কী টেস্টি হতো, তা অল্পকথায় লিখে বোঝানো যাবে না। বুড়ি খুব সুন্দরী ছিল আর আমাকে অনেক ডাল রান্না করে খাওয়াতো! বুড়ির গায়েও এক অদ্ভুত সুন্দর ঘ্রাণ ছিল। বুড়ি আমাদের বাড়িতে আসলে বুড়িকে নিয়েই আমরা ঘুমানোর সময়ও মারামারি করতাম।

আমার মায়ের বাবা অর্থ্যাৎ আমার নানা ছিলেন এক মায়ের এক পুত। আর তার দুই বোন। মা'র বড় ফুফুকে আমরা ডাকতাম বড়বু। আর মা'র ছোট ফুফুকে আমরা ডাকতাম ছোটবু। আমার নানা-নানীরও ছিল এক পুত। মানে আমাদের এক মামা। আমার মামারও এক পুত। আবার আমার মামাতো ভাইয়েরও এক পুত! সে বড় অতি আশ্চার্য এক পুতের ধারা!

কিন্তু নানা-নানীর ছিল ছয় কন্যা। সবার বড় মামা। তারপর বড় খালা। তারপর আমার মা। মাতুল বংশের ভাইবোনদের হিসাবটা একসময় আমার মনে ছিল। এখন ঠিকঠাক আছে কিনা একবার যাচাই করা যাক। আমার একমাত্র মামার এক ছেলে চার মেয়ে। বড় খালার পাঁচ ছেলে দুই মেয়ে। আমার মা মেজো, আর আমরা পাঁচ ভাই চার বোন। সেজো খালার পাঁচ ছেলে চার মেয়ে। নোয়া খালার দুই ছেলে। পাঁচ নম্বর খালার দুই ছেলে চার মেয়ে। আর কুটি খালার দুই মেয়ে ও এক ছেলে। মানে আমরা মাতুলবংশে একুশ ভাই আর এক কুঁড়ি বোন।

আমাদের একই গ্রামে মামাবাড়ি। তাই মামাবাড়ির আত্মীয়স্বজনদের সাথে আমাদের বিশাল একটা নেটওয়ার্ক। মা'র চাচা (নানার চাচাতো ভাই) রাজ্জাক নানা ছিলেন মুসলিম সম্প্রদায়ের নেতা। রাজনীতিতে ছিলেন অসাধারণ দক্ষ। কিন্তু তিনি ছিলেন আমার বাবার প্রধান প্রতিপক্ষ।

আমরা তখন ছোট। তখন মুসলিম সম্প্রদায় থেকে আমার বাবাকে নানা একঘরে করে দিলেন। আর সেই ঘটনার প্রধান ছিলেন রাজ্জাক নানা। যে কারণে ছোটবেলায় আমরা হিন্দুপাড়ায় বড় হয়েছি। মুসলিম পাড়ায় খেলতে গেলেও বাবা তখন আমাদের মারধর করতেন। বাবা ছিলেন প্রচণ্ড জেদী। বাবা ছিলেন হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতা। যে কারণে আমাদের পড়াশোনা-খেলাধুলা সবকিছুই ছিল হিন্দুদের সাথে।

বড় ভাই'র বিয়েকে ঘিরেই বাবার উপর থেকে একঘরে হয়ে থাকার সেই নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলেন নানা। কারণ আমাদের বাড়ির নতুন বউকে দেখাতে রাজ্জাক নানাকে নিয়ে আশার জন্য মা হুকুম দিলেন আমাকে। আমি আর তুহিন কৌশল করে নানার থেকে গল্প শোনার ভান করতে করতে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসি। পরে তো নতুন বউ দেখে নানা ভারী খুশি। রাজ্জাক নানার দুই প্রিয় নাতি ছিলাম আমি আর তুহিন।

তারপর গ্রামের লোকজন যখন নানাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি তো মেয়ের বাড়িতে গিয়ে ঠিকই নতুন বউ দেখে খেয়েও আসলেন। আমরা কী দোষ করলাম। তখন নানা বাবার উপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়ে, বাবাকে বড় আকারে হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়কে নিমন্ত্রণ করে খাওয়ানোর জন্য বললেন। তারপর সেই একঘরে হয়ে থাকার ঘটনা একপ্রকার মিটমাট হয়ে গেল। কিন্তু ওই যে হিন্দুপাড়ায় আমাদের ছোটবেলায় খেলাধুলা ও বড় হওয়ার অভ্যাস, তা এখনো আমার মধ্যে রয়ে গেছে!

আমাদের গ্রামের মুসলিম পাড়ায় বলতে গেলে প্রায় ঘরেই মায়ের কুলের আত্মীয়। কেউ মামা, কেউ ফুফা, কেউ খালু। ফলে গ্রামে গেলে মামার কুলের মানুষেরা সম্পর্ক অনুযায়ী আমাকে ডাকাডাকি করেন। আমাকে সবচেয়ে বেশি ডাকতে হয় মামা। আমার নিজের মামা একজন হলেও গ্রামে মামার সংখ্যাই বেশি। কারণ মায়ের বাপের বাড়িও একই গ্রামে। মামা খালা দিয়ে আমার গ্রাম বলতে গেলে ভরপুর!

বাবার সাথে নানাদের সম্পর্কের টানাপোড়েনের সময়ও মায়ের সাথে কিন্তু সূক্ষ্ম একটি সম্পর্ক নানাবাড়িতে ছিল। মা অনেক সময় বাবার অজান্তে মামাবাড়ির লোকজনের সাথে সেই সম্পর্ক টিকিয়ে রেখেছিলেন। মা আদতে একটি যোগসূত্রের নাম। মামাবাড়ির সাথে সেই যোগসূত্র কার্যত টিকিয়ে রেখেছিলেন স্বয়ং মা নিজেই। বাস্তবে মায়ের ওই সম্পর্কটুকু না থাকলে মুসলিম পাড়ার সাথে ভবিষ্যতে আমাদের আর কখনো সম্পর্ক গড়ে ওঠার সুযোগই ছিল না।

২৭ জানুয়ারি ২০২৩
ঢাকা






সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে জানুয়ারি, ২০২৩ ভোর ৫:০৯
৭টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

×