somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একটি গ্রাম, একটি ওয়ালমেট

০৩ রা অক্টোবর, ২০১৩ রাত ১২:০৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


নিকষ অন্ধকারের বুক চিরে ধীরে ধীরে পরিস্কার পূব আকাশে রক্তিম ভাবটা ফুটে উঠছে। কিছুক্ষন পরই ভোড়ের নির্মল আলোয় চারিদিক আলোকিত হবে। সে আলোয় সমগ্র প্রকৃতি নতুন ভোরের সন্ধান পাবে। বয়ে চললো আরো কিছুটা সময়, কিরণ ছড়াতে শুরু করলো সূর্যি মামা। সোনালী আলোর বিচ্ছুরণে প্রস্ফুটিত হচ্ছে সবকিছু। অন্ধকারকে দূরে ঠেলে দিয়ে কিরণ ছড়াতে লাগলো হাজার বছর কৃপণতা ছাড়া আলো বিলিয়ে যাওয়া সূর্যি মামা।
বিচ্ছুরিত আলোতে ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে লাগলো একটি শান্ত নদীর অবয়ব। পুরোপুরি নদী না বলে ছোট নদী বললেই যথার্থ হবে। ওদিকের বড় নদীর দিক থেকে শুরু হয়ে এঁকে বেঁকে গ্রামের মাঝে দিয়ে চলে আবার বড় নদীতে পড়েছে। এই ছোট নদীর মাঝ দিয়েই সূর্যি মামা আলো ছড়াতে শুরু করেছে। সূর্যের সোনালী আলোর বিচ্ছুরণে ছোট নদী কলকলিয়ে উঠলো চারিদিকে। অভাবনীয় এক খেলায় মেতে উঠলো সোনালী আলো আর স্বচ্ছ জলরাশি।
প্রস্ফুটিত আলোর বিচ্ছুরণে এবার চোখে ধরা পড়লো ওপাড়ের দোচালা মাঝারি ঘরটি। হ্যাঁ, এখন ভালোই চেনা যাচ্ছে, সামনের দিকে একটি দরজা আর দুটি জানালার অবয়বে দেখা দিলো শহীদ মাঝির দোচালা ঘরটি। ছোট্ট হলেও শহীদ মাঝি তার ঘরের সামনে ছোট্ট উঠোন রাখতে ভুল করেনি। এ উঠোনে শহীদ মাঝির প্রিয়তমা স্ত্রী সালেহা ধান শুকায়, এক কোনে সে নিজে মাছ ধরার জাল বিছায় আর তার কিশোরী কন্যা সাথী কলসী কাঁধে উঠান পাড় হয়ে যায় পানি আনতে আর নদীর পাড়ে বসে ওপাড়ের রহিম মাঝির ছেলে মনিরের ভাসিয়ে দেয়া কলা পাতার নৌকার প্রতীক্ষায় থাকে।
শহীদ মাঝির ঘরের পিছনে খড়ের স্তুপটাও দেখা যাচ্ছে বেশ স্পষ্ট। নাও নিয়ে নদীতে যাওয়ার আগেই সে গোয়াল থেকে গরু দুটোকে ঘরের স্তুপের কাছে এনে বেঁধে রাখে। বেলা বাড়লে বাবার হাত ধরে করতে শেখা শহীদ মাঝির ১০ বছরের ছেলে ফারুক গরু দুটোকে পিছনের ক্ষেতে খুটায় বেধে রেখে আসে। তারপর সে নাস্তা করে পাশের গ্রামের স্কুলে যায়, ফিরে এসে আবার ছুটে যায় বিলের ধারে। আজও এর ব্যতিক্রম হয়নি, সকাল হতেই গরু দুটোকে সে নিয়ে গেছে বিলের ধারে বাঁধতে।
শহীদ মাঝি ভোড়ের আলো ফোটার অনেক আগেই থেকে ছুটে গিয়ে নৌকা নিয়ে চলে যায় উত্তরের বড় নদীতে মাঝ ধরতে। ছোট্ট দোচালা ঘরের মাঝখানে বেড়া দিয়ে বানানো দু্ই রুমের উত্তরের ঘরে সাথী আর ফারুক দুই ভাইবোন ঘুমায় আর দক্ষিনের ঘরে শহীদ মাঝি আর সালেহা বেগম থাকে। মাঝ রাত পার হলেই শহীদ মাঝির বাহুবন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে বিছানা ছাড়ে সালেহা, স্বামীর জন্য তৈরী করে গরম ভাত, আলু ভর্তা আর মাছের তরকারী। নদী থেকে ফিরতে বেলা হয়ে যায় বলে সকাল বেলা নৌকায় বসেই সে নাস্তা সেড়ে নিবে। একদিকে রান্না শেষ করতে থাকে সালেহা আর আরেক দিকে বিছানা ছেড়ে নদীর পানিতে গোসল করে জাল, নৌকা, বাতিসহ সব কিছু প্রস্তুত করে শহীদ মাঝি। নৌকা নিয়ে শহীদ মাঝি নদীতে রওয়ানা হলে তাকে বিদায় দিয়ে সালেহা সবকিছু গুছিয়ে জায়নামাজ পেতে বসে যায় নামাজে।
গত দেড় দশক তাদের সুখের সংসারের রুটিন এটাই চলে আসছে। ১৫/১৬ বছর আগে সালেহাকে বিয়ে করে নতুন ঘরে বাঁধে এ নদীর পাড়েই। বাবার সাথে নদীতে মাছ ধরতে গিয়ে নদীর প্রতি যে টান তৈরী হয় সে টান আর ভুলতে পারে নাই, তাই প্রিয়তমা স্ত্রীকে নিয়ে সংসার পাতে নদীর তীরেই। সংসারে আসে সাথী আর ফারুক, তাদের নিয়ে এখানেই তার সুখীজীবন অতিবাহিত হচ্ছে। নতুন ঘর বানানোর আরো পাঁচ বছর পরে নদীর পাঁড় দিয়ে রাস্তা তৈরী হয়েছে।সময় ঘরের পিছনে সে লাগায় সুপাড়ি গাছ, তাল গাছের চারা, কলার চারা, কিছু ফলজ গাছ। ঘরের চারপাশ সবুজ সমারোহে সুন্দর হয়ে উঠেছিলো এতো বছরে কিন্তু গতবারের বন্যায় তা শেষ হয়ে গেছে শুধু উচু রাস্তার পাশে লাগলো ২টা তালগাছ, একটা ডাবগাছ আর একটা কলাগাছই টিকে আছে সেগুলোর সাক্ষী হিসেবে। নতুন চারা লাগালেও তা বাড়তে এখনো সময় লাগবে। এ প্রত্যুষে দোচালা ঘরের চালের ফাঁকে বাসা বাঁধা এ্কজোড়া পাখি কলা গাছের উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে দূরে কোথায় খাবার সংগ্রহের জন্য, দিন আলো ফুরালে হয়তো তারা আবার ফিরতে নীড়ে। প্রভাতের সূর্য শহীদ মাঝির দোচালা ঘর, আর ঘরে আশেপাশটাকে রূপরাজ্যের বসতঘরের আদলে যেন আলোকিত করে তুলেছে।

***
সোনালী সূর্য শুধু নদীর পূর্বপাড়কেই আলোকিত করেনি, নির্মল আলোচ্ছটা ছড়িয়ে পড়েছে পশ্চিমপাড়েও। মাথা উঁচু করা বহু কালের সাক্ষী হিসেবে বটগাছটি একপায়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কবে কে লাগিয়েছিলো তা বলা মুশকিল তবে গ্রামে কথিত আছে রহিম মাঝির বাবাই প্রথম এপাড়ে বসত গড়ে তাই তিনিই লাগিযেছেন এ গাছটি। অনেক ঝড়, বন্যার মাঝেও এই বটবৃক্ষটি অনেক কিছুর সাক্ষী হিসেবে এখনো টিকে আছে। প্রতি রাতে রহিম মাঝির ছেলে বাঁশি নিয়ে চলে আসে এখানে। সুর দিয়ে বাজিয়ে চলে একটানা, মাঝে মাঝে দম নিযে আবার শুরু করে।

মনিরের দাদা ছিলেন অসাধারণ সুরের একজন বংশীবাদক। দিনের বেলা নদীতে মাছ ধরে প্রতি রাতে নিজের তৈরী করা বাঁশি নিয়ে চলে আসতেন এখানে। বটগাছের শিকড়ে বসে সুর দিয়ে যেতেন একের এক সুরের। বহুমানুষ তার বাঁশির সুর শুনতে ছুটে আসতো নৌকা নিয়ে। কেউ আবার প্রিয়তমা স্ত্রীকেও নিয়ে আসতো, তাকে নৌকায় রেখে সে গিয়ে বসতো গাছের গোড়ায়। প্রায় প্রতিরাতেই আসর বসতো এখানে। মনির তার কাছ থেকেই বাঁশির সুর রপ্ত করেছে। ওর বাবা তার বাবার মতো মাঝি হলেও বাঁশির প্রতি আকর্ষন তৈরী করতে পারেনি কিন্তু মনির ওর দাদার সাথে থাকতে থাকতে শিখে ফেলেছে বাঁশির যত সুরলাহিড়ী। মনিরের দাদা কুদ্দুস মাঝি বছর তিনেক আগে মারা যান বার্ধক্য জনিত রোগে। এর পর বেশ কিছু দিন এ বাঁশির সুর শুনতে পায়নি এ এলাকার মানুষ কিন্তু মনির দাদা বৈশিষ্ট্যে তৈরী তাই সেও প্রতি রাতে চলে আসে এখানে। যদিও তার সুর শুনতে এখনো গ্রামের লোকেরা জড়ো হয়না তবুও সে সুর দিয়ে চলে আর সে সুরে একটি কিশোরী হৃদয় হয় আন্দোলিত। ওপাড়ের সাথীর ভাই ফারুক যখন হ্যারিকেন জ্বালিয়ে বই পড়ে অথবা ঘুমিয়ে যায় তখন গভীর মনযোগ দিয়ে মনিরের বাঁশির সুরে ডুবে যায় সাথী। তার হৃদয়েও বাজতে থাকে বাঁশির সুর। যে বাঁশির সুরে সে হারিয়ে যায় দূর থেকে বহুদূরে, যতক্ষন বাঁশির সুর ভেসে আসে ততক্ষন তার হৃদয়, মন, সত্ত্বা দিয়ে শুনতে থাকে সে সুর। একটা সময় করুণ বাঁশির সুর আস্তে আস্তে থেমে যায় তখন সাথী গভীর ঘুমে হারিয়ে যায় স্বপ্নরাজ্যে। আর মনিরে বাঁশির সুরে সাথীকে ঘুম পড়িয়ে নিজেও চলে যায়ে আপন বিছানায় ঘুমাতে।

সকালের শুভ্রতায় নতুনত্ব পায় বটগাছের আশেপাশের ঘাসফুলগুলো। নতুন দিনে নতুন করে শুভ্রতা ছড়ায় চারিদিকে। ঘাসের মাঝে ফুলগুলো হেসে যায় আপন মনে, কোন কৃপণতা নেই সে হাসিতে। বটগাছের আশেপাশের মাঝারি প্রান্তরটা তৈরী হয়েছে ঘাসের সবুজ কার্পেটে। প্রায় প্রতিটি বিকেলে গাঁয়ের ছেলেরা চলে আসে এখানে। একটু দূরে চলে গ্রাম্য খেলাধূলা আর এ সবুজ ঘাসের কার্পেটে চলে আড্ডা, কখনো কলব্রীজ খেলা ইত্যাদি, আর এগুলো চলে সন্ধ্যা অবধি। সন্ধ্যা নামতেই যে যার বাড়ীতে যায় সাক্ষী হিসেবে রেখে যায় শুধু কালের সাক্ষী বটবৃক্ষটি আর তার আশেপাশে বেড়ে উঠা সবুজ ঘাসের চত্ত্বরটিকে। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত গভীর হলে আবার এ বটগাছকে সঙ্গ দিতে বাঁশি হাতে হাজির হয় মনির। তখন বয়বৃদ্ধ বটবৃক্ষকে সঙ্গ দেয় মনির আর ঠিক যেন মনিরের দাদা যেভাবে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন ঠিক সেভাবে বটবৃক্ষ ডালপালা ছড়িয়ে রাখে মনিরের মাথার উপরে এবং একাকি সঙ্গ দিয়ে চলে ঠিক মনিরের দাদা কুদ্দুস মিয়ার মতো।

মনিরদের ঘর বটগাছ থেকে একটু দূরে। দোচালা ছনের ঘর। ছনের চালের তৈরী করা ঘরটি মাঝে মাঝেই মেরামত করতে হয় ভারী বর্ষণে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পানি পড়ে। গতবারের ঝড়ে রহিম মিয়ার ঘরটি প্রায় ভেঙ্গে পড়েছিলো, অনেক কষ্টে বাপ ছেলে মিলে আবার নতুন করে নিয়েছে ঘরটিকে। বড় ঘরের সাথে বাড়তি ছাউনি দিয়ে তৈরী বারান্দায় থাকে মনির। আর ভেতরের ঘরে রহিম মাঝি আর স্ত্রী ফাতেমার সাথে থাকে তাদের ৭ বছরের আদুরে কন্যা, মনিরের ছোট বোন বিথি।

রহিম মাঝির ঘরের সামনে তারই লাগানো বটগাছটির কারণে এখনো সকালের সোনালী সূর্য এখনো পুরো আলোকিত করতে পারেনি ঘরটাকে। ঘরের পূর্বপাশটা এখনো বটগাছ আর ঘরের ছায়ায় আবছা অন্ধকারে ঢেকে আছে। হয়তো আরো কিছুটা বেলা বয়ে গেলে এ আবছাটা থাকবেনা। গরমের দিনের দুপুর বেলা রহিম মাঝির নিজ হাতে লাগানো বটগাছের ছায়ায় বসে সে হাওয়া খায়। এখানে বসেই সে তার জাল বুনে, ছেড়া জাল মেরামত করে, আদুরে কন্যা বিথিকে কোলে নিয়ে গল্প শুনায়; নদীর গল্প, রাজা রানীর গল্প।
বাবা নদীতে গেলে বিথি পুতুল খেলায় মত্ত হয় এই বটগাছের নিচেই। পুতুলের সাথে পুতুলের বিয়ে দেয়, রান্না-বান্না করে, অন্য পুতুলদের দাওয়াত দেয় বিয়ের আসরে, বর যাত্রী পাঠায়, আরো কত কি! মাঝে মাঝে মনির যদি জিজ্ঞাসা করে, কিরে বিথি কি করিস? চট করে সে উত্তর দিয়ে দেয়, তোমার আর সাথী আপুর যেভাবে বিয়ে হবে সেভাবে পুতুলের সাথে সাথে পুতুলের বিয়ে দেই। মনির পুরো থ! কি বললি…..? আমার সাথে সাথীর বিয়ে হবে তোকে কে বললো? কে আবার বলবে: পাশের বাড়ীর কুলসুম বলছে….
মনির ছোট বোনের মুখ থামিয়ে দেয়… আস্তে বল বিথিমনি; মা যাতে না শুনে। মনিরের সাথে এভাবেই চলে ছোট বোনের খুনসুটি।

আবার কখনো কখনো বটগাছের নিচে বাড়ীর সাথে ছোট্ট উঠোনে বিথি আর পাশের বাড়ীর কুলসুম কুতকুত খেলে। রহিম মাঝির আদুরে মেয়ে মাতিয়ে রাখে ঘর, উঠোন, আশেপাশটা। তাকে নিয়ে রহিম মাঝির আননন্দের শেষ নেই যেন; কল্পনা করে মেয়েকে সে পড়ালেখা শিখাবে, একদিন বড়ঘরে পাত্রস্থ করবে। ভাবতে ভাবতে সে হারিয়ে যায় বহুদূরে, তার আদুরকন্যাকে তাকে ঘর থেকে বিদায় দিতে হবে? দুগন্ড বেয়ে নেমে কয়েকফোটা অশ্রু…. প্রথমে বুঝতে না পারলেও সম্ভিত ফিরে পেয়ে সাথে সাথেই কাঁধে রাখা গামছা দিয়ে মুছে ফেলে অশ্রু, বাস্তবে ফিরে আসে আবার। আর ওদিকে ফাতেমা সংসারের কাজ গুছাতে গুছাতে কাটিয়ে দেয় সারাটি দিন। ভোর রাতে স্বামীর সাথে বিছনা ছাড়ে, খাবার তৈরী করে দিতেই রহিম মাঝি গোসল সেড়ে নৌকা নিয়ে নদীতে যাত্রা করে। নদীতে যাওয়ার সময় কখনো রহিম মাঝি শহীদ মাঝিকে ডাক দেয় আবার কখনো শহীদ মাঝি বহুকালের বন্ধু রহিম মাঝিকে ডাক দেয়।
রহিম মাঝির ঘরের কাছে বাঁধা রয়েছে একটি ছোট্ট নৌকা। সে এক নৌকা নিয়ে নদীতে গেছে আরেক নৌকায় চড়ে মনির। ছোট্ট এ নৌকায় সে যায় পাশের হাটে, কখনো আবার দূরের চরে পাখি শিকারে, ছোট্ট নৌকা নিয়ে ছুটে যায় দূর দুরান্তে। নৌকা নিয়ে ঘরে ফিরলে লগি বৈ সে যত্ম করে রাখে। খালি নৌকাটা অপেক্ষা করতে কখন তার মালিক তাকে নিয়ে যাত্রা করবে দূর সীমানায়।

***
আঁকাবাঁকা সুন্দর নদীটি ছবির চেয়েও সুন্দর করে তুলেছে গ্রামটিকে। নদীর পশ্চিম পাড়ে ফুটে উঠেছে শাপলা। মাঝে মাঝে জমা হয়ে ভাসতে ভাসতে এখানে আসা কচুরীপানা। কোন কোন কচুরীপানায় আবার ফুটেছে কচুরীপানার সুন্দর ফুল। মনিরদের এপাড়ে শাপলার সাড়ি তার ফুল ফুটিয়ে সৌন্দর্য্যের ডালি সাজিয়েছে। ফুলের নিচে বড় বড় কচুরী পাতাগুলো ছড়িয়ে দিয়েছে বিশাল পত্রপল্লব, বিশাল পাতাগুলো নদীতে ভেসে রয়েছে শান্তভাবে। ভোরের সোনালী সূর্যের প্রতিবিম্ভ শান্ত নদীতে শাপলা ফুলরা নদীর সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুন।
আর বিক্ষিপ্ত কুচুরীপানারা ভেসে এসেছে বহু দূর থেকে, কেউ এসে এখানে আরেক সঙ্গীর সাথে জড়ো হচ্ছে কেইবা জড়ো হয়ে আবার দলছুট হয়ে ভেসে যাচ্ছে অজানা গন্তব্যে আর কেউবা না দাড়িয়ে স্রোতের সাথে ভেসে চলছে দূর বহুদূরে। কতক কচুরীপানার বেগুনী ফুলগুলো কচুরীপানার মাঝে মাথা উচু করে তার অপরূপ সৌন্দর্য্যের জানান দিচ্ছে। বিশাল পত্রের মাঝে অপরূপের ডালি সাজিয়ে স্থির দাড়িয়ে থাকা জাতীয় ফুল শাপলাকে যখন কচুরী পানার অতিক্রম করে তখন মনে হয় রাজা রানীকে সম্মান জানাতে যেভাবে সৈন্যরা পতাকা হাতে স্যালুট দিয়ে অতিক্রম করে সামনে চলে ঠিক তেমনি কচুরী পানারা মাথায় ফুল দিয়ে গড়া সৌন্দর্য্যের প্রতীক নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সামনে। উভয়ের সৌন্দর্য্যে প্রকৃতি হয়েছে আরো অপরূপ।
মনির সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে মাঝে মাঝে এই অপরূপ প্রকৃতির প্রেমে পড়ে যায়। নদীর তীরে বসে বসে প্রকৃতির ময়াময়তা গভীরে প্রবেশ করার চেষ্টা করে। সদ্যঘুম থেকে জেগে বাহিরে বের হওয়া সাথীর অপেক্ষা করে, কখনো বেখেয়ালে অবিনস্ত চুলে বেড়িয়ে এসে সাথী হয়ে পড়ে লজ্জবতী ফুলের মতো। সকালের নির্মলতায় দুপাড়ে দুজনে বসে করে ভাবে বিনিময়। কখনো কখনো প্রকৃতির কাছ থেকে মনির ধার নেয় শাপলা অথবা কচুরীফুল। ছোট্ট নৌকা নিয়ে ওপাড়ে গিয়ে পৌছে দিয়ে আসে সাথীকে। ঘাটে নৌকা বেধে ঘরে ফেরার সময় আরেকটি ফুল প্রকৃতির কাছে থেকে চেয়ে নিয়ে গেঁথে দেয় আদরের ছোট বোন বিথির চুলে।
বয়ে চলা এ ছোট নদীতে পাল তুলে দাঁড় ফেলে চলে যায় দক্ষ মাঝিরা। ভোড়ের আলো ফোটার আগেই গাঁয়ের জেলেরা নৌকা নিয়ে চলে বড় নদীতে মাঝ ধরতে। কয়েকবছর আগে নদীর পূর্ব পাড় দিয়ে রাস্তা তৈরী হলেও এখনো গ্রামের লোকেরা বাহন হিসেবে নৌকা ব্যবহার করে। দাঁড় বেয়ে চলে বাজারে, জরুরী কাজে, স্বজনদের বাড়ীতে। স্রোতের অনুকূলে বাতাস থাকলে নানা রঙ্গের পাল তুলে দেয় দূরের যাত্রীরা।
সকালের নির্মলতাকে আরো বাড়িয়ে দিলো দূরের পথে রওয়ানা দেয়া নৌকা। দক্ষিনের নদী দিয়ে স্রোতের বিপরীতে সাউনী ফেলে ভেসে আসলো মাঝারি নৌকা। শান্ত নদীর হালকা ঢেউয়ে ছ্যালাৎ ছ্যালাৎ শব্দ তুলে চলছে কোন এক গন্তব্য, উঁচু দুই গলুইর মাঝে সাদা সাউনীতে বেগুনী রঙ্গে রঙ্গিন করেছে নৌকার মালিক। নদীতে নতুন ভাসানো নৌকাটি তার গাঁয়ের রং এই বলে দিচ্ছে তার নতুনত্ব। পিছনে পিছনে বৈঠা বেয়ে আসলো আরো একটি ছাউনী ফেলা ছোট নৌকা। জোড়ে হাক দিয়ে জানতে চাইলে হয়তো জানা যাবে বৈঠা বেয়ে নৌকার মাঝি কোথায় চলেছে এই সাতসকালে। মাঝি বৈঠা দিয়ে আপন মনে বেয়ে চলেছে আর মাঝে মাঝে গানের সুর ধরছে। রাতের বেলা নদীর পাড়ে বটের নীচে সুর তুলে মনির আর সে সুরে নদীতে দাঁড় বেয়ে চলা মাঝি ধরে হৃদয় নিসৃত গান। তৈরী হয় মোহময় অনুভূতি।
প্রকৃতির এ নীলম্বরীতে নতুন করে যুক্ত হলো দূর আকাশে তিন প্রস্থ মেঘের ভেলা। নীল আকাশের নীলাম্বরীকে নতুন মাত্রা দিয়েছে ধূসর মেঘেরা। সূর্যের কিরণ বাস্পীত এ নদীর পানিরা আশ্রয় নিয়েছে সূর্যের কাছে আকাশে। ওই মেঘেরাই আবার জড়ো হয়েই নেমে আসবে এই প্রকৃতির মাঝে ভূমির টানে।

***
সোনালী সকালটাতে এভাবেই ছবির মতো সুন্দর গ্রামটিকে নানা কারুকাঁজে তৈরী করেছেন এর দক্ষহাতের কারগর। এক প্রস্থ কালো কাপড়ে বহুদিন পূর্বে দক্ষ কারিগর শুরু করেছিলেন সাদা চকে আকিঁবুকি করা। কাঁরুকাজ শুরু করে মাঝেমাঝে অনেকদিন সুন্দর সুঁই সুতা একসাথে ভাজ রেখে দেন আবার শুরু করেন। দক্ষ হাতে আকিঁবুকির কাপড়টাকে সুঁই সুতোর কাঁরুকাজে ক্ষতবিক্ষত করলেন, শুরু করলেন শান্ত নদীর উপর দিয়ে সোনালী সূর্য দিয়ে, ঘর বেঁধে দিলেন নদীর তীরে, তৈরী করলেন ঘরে আশেপাশের প্রকৃতিকে। তালগাছ, কলাগাছ, নদী তীরের রাস্তা, খড়ের স্তুপ, পাখির মাঝে ফুটিয়ে তুললেন সকালের অপরূপ প্রকৃতিকে।
নদীর এপাড়ে এসে আবার বেঁধে দিলেন নতুন জনপদ, নতুন ঘর, নতুন জনপদে গড়ে উঠা বহুবছরের সাক্ষী একাধিক বটগাছ। বটের ছায়ায় ঘেরা ঘরের সাথে ছোট্ট উঠানটা দিতে ভুললেন না। নদীর তীর আর বটগাছের চত্ত্বরটাকে করে তুললেন সবুজ কাপের্টে তৈরী প্রান্তরে। নিতান্তেই প্রাকৃতিক করে করে সাজালেন তীর ও তীরবর্তী পরিবেশটাকে।সবুজ আবরণে ঘাসফুলের চত্ত্বরে সকালকে করে তুললেন অপরূপ প্রকৃতি। তীরে বেঁধে দিলেন ভেসে থাকা ছোট নৌকা।
নেমে পড়লেন এবার নদীর সৌন্দর্য বর্ধণে, বিশাল পত্রপল্লাবে বিস্তৃত শাপলা ফুলের সাথে মাথা উচু করে ফুল ফুটিয়ে ভেসে চলা কচুরীপানার লীলাখেলায় মাতলেন। হালকা ঢেউয়ের মাঝে দূর থেকে ভাসিয়ে নিয়ে আসলেন সাউনী ফেলা নৌকাকে, তারই পিছনে পিছেনে ভাসিয়ে নিয়ে আসলেন আরো একটি ছাউনী ফেলা ছোট নৌকা। ভাসিয়ে নিয়ে চললেন দূর অজানায়।
একে একে গ্রামটিকে সাজিয়ে সুঁই সুতার শেষ ফোঁড় গুলো দিচ্ছিলেন নীল আকাশে ধূসর মেঘের ভেলায়। একে এসে শেষ ভোঁড়গুলো দিয়ে লম্বা এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। হ্যাঁ…….. অবশেষ শেষ করতে পারলেন, ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন ছোটবেলায় নানার বাড়ী ঘুরতে গিয়ে দেখা ছবির মতো সুন্দর গ্রামটিকে। মনে কোণে গেথে নেয়া নির্মল পরিবেশটাকে, স্মৃতির পাতায় আশ্রয় নেয়া মোহময় স্মৃতি সৃষ্টির জনপদটাকে, উপায়হীন বারবার ফিরতে চাওয়া সে পরিবেশটাকে।
দীর্ঘশ্বাসে একপলকে তাকিয়ে রইলেন তার সৃ্ষ্টির দিকে। হায়… আসলে কি কিছু করতে পেরেছেন? কতটুকু করতে পেরেছে তিনি জানেন না কিন্তু তিনি শুধু জানেন ………. মনের গভীরে গেথে থাকা সুন্দরের নীলাভূমিকে তিনি কল্পনার রাজ্য থেকে বাস্তবে নিয়ে আসার চেষ্টা করেছেন সুঁই সুতার মাধ্যমে। এই সুঁইসুতার কাঁরুকাজে ফুটে উঠুক সমগ্র প্রকৃতি।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা অক্টোবর, ২০১৩ রাত ১২:৪৭
৬টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

লালনের বাংলাদেশ থেকে শফি হুজুরের বাংলাদেশ : কোথায় যাচ্ছি আমরা?

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৪



মেটাল গান আমার নিত্যসঙ্গী। সস্তা, ভ্যাপিড পপ মিউজিক কখনোই আমার কাপ অফ টি না। ক্রিয়েটর, ক্যানিবল কর্পস, ব্লাডবাথ, ডাইং ফিটাস, ভাইটাল রিমেইনস, ইনফ্যান্ট এনাইহিলেটর এর গানে তারা মৃত্যু, রাজনীতি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি! চুরি! সুপারি চুরি। স্মৃতি থেকে(১০)

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৪


সে অনেকদিন আগের কথা, আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। স্কুলে যাওয়ার সময় আব্বা ৩ টাকা দিতো। আসলে দিতো ৫ টাকা, আমরা ভাই বোন দুইজনে মিলে স্কুলে যেতাম। আপা আব্বার... ...বাকিটুকু পড়ুন

যেকোন বাংগালীর ইন্টারভিউর সময়, 'লাই-ডিটেক্টটর' যোগ করে ইন্টারভিউ নেয়ার দরকার।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৫ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০৭



আপনার এনলাকার এমপি, প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী কামাল সাহেব, যেকোন সেক্রেটারী, যেকোন মেয়র, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান, বিএনপি'র রিজভী, আওয়ামী লীগের ওয়ায়দুল কাদের, আপনার থানার ওসি, সীমান্তের একজন বিজিবি সদস্য, ঢাকার... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×