পর্ব ২
পর্ব ৩
পর্ব ৪
৫.
স্কালিজার প্রাসাদ যেমন দেখা হল না, তেমনি অদেখা রয়ে গেল ডি আনুজ্জিও’র জাদুঘর ভিত্তোরিয়ালে। ইটালির ইতিহাসের বিচিত্র চরিত্র গ্যাব্রিয়েল ডি আনুজ্জিও। বিখ্যাত এই কবি একসময়ে ঋনের ভারে ফ্রান্সে পাড়ি দেয়। প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের দামামা বেজে উঠলে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে আসে বটে। কিন্তু এসেই কবিতার খাতা হেলায় ফেলে বিমান উড়িয়ে যুদ্ধে নেমে পড়ে। মাত্র তিনশ যোদ্ধা নিয়ে ফিউমে অঞ্চল (বর্তমানের ক্রোয়েশিয়ায় পড়েছে) এক বছর অবরোধ করে রীতিমত স্বাধীনতার ঘোষনা দিয়ে বসে আনুজ্জিও। সেখানেও ক্ষ্যাপামির পরিচয় মেলে। সৈনিক কবির একনায়ক রাষ্ট্রে সংবিধানের মূল নীতি ছিল সংগীত! কিন্তু দখল নেয়ার এই মানসিকতা দেখে ফ্যাসিজমের বীজ ঢুকে যায় মুসোলিনি আর হিটলারের মাথায়। তারপর দুনিয়াজুড়ে শুরু হয় ফ্যাসিবাদের ফ্যাসাদ। যাহোক, যুদ্ধে এক চোখ খুইয়ে ফিরে এসে জীবনের শেষ সতেরো বছর গার্দা লেকের পাড়েই কেটেছে আনুজ্জিওর। আলোয়-কালোয় মেশানো খামখেয়ালী লোকটার বিচিত্র সংগ্রহে ঠাসা বাড়িটাই এখন জাদুঘর। আবার সুযোগ হলে যাওয়াটা অবশ্যকর্তব্যের ভেতর পড়ে।
সব শুরুরই শেষ থাকে। সেই নিয়ম মেনে আজকে বাড়ি ফিরে যাব। দুপুরের ট্রেনে চেপে। কিন্তু সকালটাকেই বা বিকিয়ে দেই কি বলে? তাই গুটি গুটি পায়ে সবাই এসে দাঁড়িয়েছি গার্দার তীরে। সোনারঙ্গা রোদের ঝিলিকে খোলামকুচির মত পড়ে থাকা নুড়িপাথরগুলো মনি মুক্তা বলে বিভ্রম হয়। আর কূল ভাসানো গহীন নীল জল দেখে মন ভাবতে চায় এ যেন সাগর পাড়। কিন্তু ঢেউ হয়ে আছড়ে পড়ার তাড়া নেই। অলস রাজহাঁস জলকেলির খুনসুটিতে ব্যস্ত। দূরে পটে আঁকা ছবির মত একটা দুটো নৌকার আনাগোনা। জলে ভাসা এক নন্দনকানন। কে বলবে আমরা সমুদ্রের পিঠ থেকে পঁয়ষট্টি মিটার উঁচুতে বসে আছি?
বড় বড় পাথুরে চাঁইয়ে বসে ভাবছি, আরে আমরা নিজেরাই তো একেকজন হ্রদের মতন। কোথাকার বঙ্গোপসাগরের জল গড়িয়ে গড়িয়ে ভাগ্যের খুঁড়ে দেয়া পথ বেয়ে ভিনদেশের বদ্ধ জলাশয়ে আটকে গেছি। সাগরের মত মহাসাগরের সাথে আর যোগ নেই। তাই জোয়ার ভাটায় বয়ে চলার স্বাধীনতাও নেই।
গাঢ় ভাবনাটাকে জোর করে সরিয়ে দিলাম। তিন দিকে পাহাড়ের প্রহরী সবুজের হাতছানিতে ডাকছে। পাহাড়ের গায়ে সান্তা বারবারা নামের ছোট একটা চ্যাপেল আছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে গড়া। জলবিদ্যুতের স্থাপনা বানাতে গিয়ে ধর্ম ভীরু খনি শ্রমিকরা নিজেরাই হাত লাগিয়ে চ্যাপেলটা বানিয়েছিল। সেটা দেখার আর সময় হল না এবার। তাকে এমনি এমনি দেখা যায় না। জয় করে দেখতে হয়। হেঁটে কি দৌড়ে পেশীতে টান ধরিয়ে তবেই তাকে জয় করা যায়। অসাধারন হাইকিং ট্রেইল আছে ওপরে ওঠার। হাদী ভাই এক দৌড়ে দেখে এসেছিল। আমি সে চেষ্টা করতে গেলে দেখা যেত ফুসফুসটা পাজর ফুঁড়ে বেরিয়ে চার হাতে পায়ে দুড়দাড় করে পালাচ্ছে। অগত্যা নিচ থেকে সান্তা বারবারাকে শ্বেতপায়রার মত চুপ করে আল্পসের কোলে আদুরে ভঙ্গিতে বসে থাকতে দেখে দুধের সাধ ঘোলে মিটাতে হল।
মোটের ওপর এই ভ্রমনে আমরা ছেলে বুড়ো বারো আনার ওপরে ষোল আনা খুশি। আনা-আধুলির কথা বলতে গিয়ে আরেক আনার কথা মনে পড়ছে। জার্মান বান্ধবী আনা। সে প্রায়ই খোঁচা মেরে জিজ্ঞেস করে, ‘শনি-রবি কি করলে?’ কি করে বলি যে চাক্ চাক্ করে আলু কেটে চাইনিজ দোকানের কই মাছ ঝোল করে রেঁধেছি কিংবা তুর্কি দোকানের হালাল মুরগি টমেটো দিয়ে ভুনা করেছি? যেখানে আনার সপ্তাহান্ত কাটে অস্ট্রিয়ার বরফে স্কি করে কিংবা আল্পসের কোথাও হাইকিংয়ে, সেখানে ছুটির দিনগুলোতে আমি মাছ-মুরগির সাথে ধস্তাধস্তি করে কাটিয়ে দেই। দুর্দশা দেখে ছুরির নিচে আলু-টমেটোরাও মুখ টিপে হাসে। কি বিচিত্র জটিল বাঙালি জীবন! তবে এই ক’টা দিনের ঘুরে বেড়ানো সেই দুঃখ খানিকটা ভুলিয়ে দিয়েছে। যাক, এবার ফিরে গিয়ে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে এমন গপ্পো করবো যে জার্মান বান্ধবীর চোখ ট্যাঁ হয়ে যাবে।
ঘড়ির কাটা বেরসিকের মত সময়ের চাবুক মারলো পিঠে। ফিরে যেতে হবে ফেলে আসা কুয়াশায় ঢাকা শীতের শহরে। আমাদের ইবনে বতুতাগিরির এখানেই সমাপ্তি। তবে আনন্দের রেশ রয়ে যাবে অনেকদিন। দিন শেষে স্মৃতিটুকুই অমূল্য। আর বাকি সব জাগতিক বস্তুর মামুলি হিসেব কষা দর আছে। তাই শেষবারের মত শান্ত হ্রদের স্নিগ্ধ শহরের স্মৃতি যতটুকু পারি হাতের আজলায় তুলে নিলাম। যাযাবর মনের মুকুরে যোগ হল আরেকটা পোস্টকার্ড। (সমাপ্ত)
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই এপ্রিল, ২০১৯ বিকাল ৩:৪০