somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গার্মিশে ঘ্যাও ম্যাও -২

১০ ই জুলাই, ২০১৯ দুপুর ২:২৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


পর্ব ১

বিরিয়ানির স্বাদ খোলে বাসি হলে। গতকালের রয়ে যাওয়া সয়াসস থৈ থৈ ভিয়েতনামিজ কারিও দেখি তার স্বাদের ঝাঁপি মেলে ধরেছে। হালকা গরম করে বুভুক্ষের মত খাচ্ছি। ভোর ছয়টা। সবাই এখনো ঘুমের অতলে। নাক ডাকার শব্দ ভেসে আসছে। খেতে খেতে খেয়াল করলাম, নাক ডাকার একটা শ্রেনীবিভাগ আছে। বড়রা ডাকছে ফরফর্ ফরফর্। ছোটরা ফুরুৎ ফুরুৎ। হঠাৎ ছন্দপতন হল ম্যা ম্যা ভেড়ার ডাকে। এই ভেড়াকে আমি হাড়ে হাড়ে চিনি। ছেলে উঠে গেছে। কারো স্বপ্নভংগ না করে তাকে আনতে রওনা দিলাম।

ছোট্ট ডুপ্লেক্সের খাটগুলোও দোতলা। একটা বোর্ডিং স্কুল বোর্ডিং স্কুল ভাব আছে। কেজি পনেরোর আধো ঘুমন্ত দুই ফুটি ভদ্রলোককে নামাতে ঘাম ছুটে গেল। এর মাঝে অস্ফুট বিড়বিড়, ‘মামা, খিদা’। গজগজ করে উঠলাম, ‘আ মর জ্বালা, মায়েরে কয় মামু!’ পাঁচ মিনিটের মাথায় নাস্তার যোগাড় দিয়ে থালা বাড়িয়ে দিতেই বিজাতীয় ভাষায় অভিযোগ শুরু হল, ‘পিসি কায়ান, পিসি কায়ান। তাফসু মিয়ার ব্যক্তিগত একটা ভাষা আছে। প্রথম প্রথম বুঝতে না পারলেও এখন বেশ পারি। ‘পিসি কায়ান, পিসি কায়ান’ মানে হল, ‘পাউরুটি খাবো না, পাউরুটি খাবো না’। উত্তরে ঠান্ডা গলায় হুমকি ছুড়লাম , ‘বাসি কায়া, মাসি কায়া’ (বাপের মাথা খাও, মায়ের মাথাটাও’)। ছেলে ভয় পেয়ে শক্ত মায়ের ভক্ত বনে সায় দিল, ‘কায়া কায়া’ (খাচ্ছি, খাচ্ছি)।

ছানাপোনা খাইয়ে দাইয়ে সকাল সকাল আজকে বেরিয়ে পড়বো সবাই। যাবো Zugspitze-তে। জার্মানির সর্বোচ্চ শৃঙ্গ এটা। শব্দটাকে ‘সুগষ্পিৎজ্যে’ উচ্চারন করলে তেড়ে আসা যাবে না। ছাপোষা মুখ্য-সুখ্য লোক। মুজতবা আলি তো আর নই। তাই ভাঙ্গা কলমের কোপে গোটা সাতেক জার্মান শব্দকে খুন করলেও মাফ করে দিতে হবে। যাহোক, আজকে জার্মানমুলুকের নাকের ডগাটায় না চড়লে আর চলছেই না। কিন্তু বেয়ারা বাচ্চাকাচ্চার যন্ত্রনায় নাকের ডগা আমাদেরকে সর্দির ফ্যোৎ করে ঝেড়ে না ফেললেই হল।

যাচ্ছি মজারু একটা রেলগাড়িতে চেপে। এই রেলের চাকার দাঁত আছে। কগহুইল ট্রেন। পাহাড় কামড়ে কামড়ে ওপরে উঠছে। যাত্রাটা তাই আনুভূমিক না হয়ে কিছুটা উলম্ব হবে। মাটি ফুঁড়ে আকাশ বরাবর। এদিকে বাদাম খাওয়াকে কেন্দ্র করে তাফসু আর নূর ছোটখাট মারমারির প্রস্তুতি নিচ্ছে। নইলে কেমন একঘেয়ে হয়ে যায় না বেকার বসে থাকাটা? তাদেরকে ইচ্ছেমত মত দাঙ্গা করতে দিয়ে তাদের ঠোঙ্গা থেকেই নিরবে বাদাম সরিয়ে গালে পুড়ছি আমরা বড়রা।

কিন্তু বাদামের সাথে আইস্ক্রিমও খেতে ইচ্ছে করছে। সামনের আসনের বুড়োটার হাতের বাক্সে চার চারটে আইস্ক্রিম। কলার খোসা ছাড়ানোর মত করে একটার পর একটা খেয়ে উজাড় করে দিচ্ছে সে। সবাই মিলে হাইপোথিসিস দাঁড় করালাম, বুড়োর বউ মরেছে। সেই খুশিতে এই বেহিসাবী মিষ্টিমুখ। সাথে খুব খেয়াল করলাম, ছেলের বাবাদের চোখে সকাতর প্রতীক্ষা। কবে যে তাদেরও এমন সুদিন আসবে! তবে আশার কথা, শকুনের দোয়ায় গরু মরে না। গরুদের আবার কই মাছের প্রান।

দাঁতাল রেলগাড়ি ছেড়ে দড়ি টানা কেবল কারে দুলছি। সাগরপিঠ থেকে প্রায় সাড়ে উনত্রিশশো মিটার উঁচুতে উঠে যাচ্ছি। এই গরমেও সেখানে তুষারের ছড়াছড়ি। তাই হালকা সোয়েটার, জ্যাকেট সাথে আছে। সাদা হাওয়াই মিঠাইয়ের মত মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। মেঘের দেশে চলে এসেছি। কাঠির মাথায় মেঘ জড়িয়ে টুপ্ করে খেয়ে দেখতে ইচ্ছে করছে স্বাদটা কেমন। সৌন্দর্য দেখলে লোকে তারিফ করে বা আবেগে পড়ে টান দিয়ে কবিতা টবিতাও লিখে ফেলে। আর হাড় হাভাতে কিছু লোক আছে যারা সৌন্দর্য খেতে চায়। আবেগী কবিতা ভুল করে উড়ে এসে হাতে পড়লেও এরা সেটাকে চার ভাঁজ করে চিবিয়ে গিলে বসে থাকবে। নিজেকে নিয়ে আর পারা গেল না। হতাশ মাথা নেড়ে পাশে তাকাতেই দেখি আমার দল কিছুটা ভারী হয়েছে। নূর আর তাফসু মিয়া এক গাল লালা নিয়ে লোলুপ চোখে মেঘের মাঝে আইসক্রিম খুঁজছে। ট্রেনের দুষ্টু বুড়োটা আমাদের চোখে ঘোর লাগিয়ে দিয়েছে আজকে।

আকাশ থেকে পাতালে নেমে এলাম। একটা চমৎকার নীল হ্রদ আছে। নাম Eibsee। নদ-নদী, হ্রদকে এরা আদর করে সাগর ডাকে। হ্রদের জলে কেউ প্যাডেল মেরে নৌকা চালাচ্ছে। কেউ ওয়াটার বাসের যাত্রী হয়ে পুরো এলাকাটা চক্কর দিতে ব্যস্ত। আমরাও টিকেট কেটে তাতে চড়বো বলে পাড়ে দাড়িয়ে আছি। এদিকে আকাশ ঘোলা হয়ে আসছে। পাহাড়ে আবহাওয়া বদলায় খুব দ্রুত। তার চেয়েও দ্রুত মত বদলে ছোট্ট জাহাজটার ক্যাপ্টেন জানিয়ে দিয়ে গেলো, ‘ঝড় আসছে। আজকের মত পাততাড়ি গুটিয়ে ফেলতে হচ্ছে’। কি আর করা, এদিক সেদিক এলোমেলো ঘুরে দাঁতাল রেলে চেপে রাস্তা মাপলাম।

কখনো পাহাড়ভেদী সুরঙ্গ, কখনো বনের গহীন। ট্রেন ছুটে যাচ্ছে মাঝারি ঝাঁকুনি তুলে। এক আধটা হরিনও দেখলাম নাকি? লোকালয়ের কাছে আসতেই জীবন্ত হয়ে উঠল ছবির মত লাল টালির সারি সারি বাড়ি। ফুলের থোকায় উপচে পড়ছে বারান্দা আর আঙ্গিনা। ঠিক যেন বাভারিয়ান রূপকথায় সেজেছে গ্রামগুলো। বিশাল ঘন্টা গলায় ঝুলিয়ে পাহাড়ি গরু বিশাল তেপান্তরের মাঠে অলস জাবর কাটছে। ভেড়ার পাল উলের বল সেজে গ্যাঁট হয়ে বসেছে এখানে সেখানে। কাছেই ঘুরছে জাঁদরেল জার্মান শেফার্ড। মালিকের হয়ে সতর্ক চোখে রাখছে দলটার উপর। কি নিস্তরঙ্গ জীবনের ছবি। এই প্রথম বুঝতে পারলাম, শহুরে হট্টগোল ফেলে কত দূরে চলে এসেছি। (চলবে)

০৯.০৭.২০১৯
মিউনিখ, জার্মানি

সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জুলাই, ২০১৯ রাত ১২:৪২
১০টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেহেদী নামের এই ছেলেটিকে কি আমরা সহযোগীতা করতে পারি?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১০:০৪


আজ সন্ধ্যায় ইফতার শেষ করে অফিসের কাজ নিয়ে বসেছি। হঠাৎ করেই গিন্নি আমার রুমে এসে একটি ভিডিও দেখালো। খুলনার একটি পরিবার, ভ্যান চালক বাবা তার সন্তানের চিকিৎসা করাতে গিয়ে হিমশিম... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্য অরিজিনস অফ পলিটিক্যাল জোকস

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১১:১৯


রাজনৈতিক আলোচনা - এমন কিছু যা অনেকেই আন্তরিকভাবে ঘৃণা করেন বা এবং কিছু মানুষ এই ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। ধর্ম, যৌন, পড়াশুনা, যুদ্ধ, রোগ বালাই, বাজার দর থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভালোবাসা নয় খাবার চাই ------

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৯ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:০৬


ভালোবাসা নয় স্নেহ নয় আদর নয় একটু খাবার চাই । এত ক্ষুধা পেটে যে কাঁদতেও কষ্ট হচ্ছে , ইফতারিতে যে খাবার ফেলে দেবে তাই ই দাও , ওতেই হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতীয় ইউনিভার্সিটি শেষ করার পর, ৮০ ভাগই চাকুরী পায় না।

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৯ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৭



জাতীয় ইউনিভার্সিটি থেকে পড়ালেখা শেষ করে, ২/৩ বছর গড়াগড়ি দিয়ে শতকরা ২০/৩০ ভাগ চাকুরী পেয়ে থাকেন; এরা পরিচিত লোকদের মাধ্যমে কিংবা ঘুষ দিয়ে চাকুরী পেয়ে থাকেন। এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×